Friday, January 17, 2020

তাহলে কি মহাকাশে যুদ্ধ আসন্ন?


তাহলে কি মহাকাশে যুদ্ধ আসন্ন?
মৃণালকান্তি দাস

হলিউডের সেই বিখ্যাত সিনেমা আর্মাগেডন দেখেছেন? সে এক অন্তিম যুদ্ধ-এর কাহিনী। যার পরিণতিতে নাকি পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে! বিলুপ্ত হতে পারে মানব জাতি। বাঁচাতেই হবে বসুন্ধরাকে। গত ২৭ মার্চের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে সেই আর্মাগেডন (১৯৯৮) সিনেমার একটি অনবদ্য দৃশ্যের কথা। যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে একটি মহাকাশ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করছেন। যে ঘোষণায় গোটা দুনিয়া জানল, পৃথিবীর দিকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা এক গ্রহাণুর হানায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে মানব সভ্যতা! মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একদল সাহসী বিজ্ঞানী তাঁদের জীবন তুচ্ছ করে সেই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করতে চলেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন এই ভাষণ দিচ্ছেন, তখন ব্রিটেন থেকে চীন, ফ্রান্স থেকে সৌদি আরব, গোটা দুনিয়ার সব মানুষ উদ্বেগের সঙ্গে অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণতে শুরু করে দিয়েছে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করেছে। অজানা আতঙ্কে কেউ টিভির সামনে সেঁটে বসে। কেউ রেডিওতে কান পেতে।
২৭ মার্চ, দিনটি শুরু হয়েছিল একইভাবে। আচমকা টিভিতে ব্রেকিং নিউজ। একটি ট্যুইটবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, সকাল ১১.৪৫ মিনিট থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে তিনি দেশবাসীকে একটি বিশেষ বার্তা দেবেন। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ট্যুইটটির খবর। পরের ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ছিল ভারতের কাছে ‘আর্মাগেডন’-এর মতো মুহূর্ত। যাবতীয় সম্প্রচারমূলক অনুষ্ঠান ও রিপোর্টিং বন্ধ করে দিয়ে টিভিতে দেখান হল উদ্বিগ্ন দর্শকদের মুখ। অফিস, কলেজের ক্যান্টিন, হাসপাতাল, রেল স্টেশন— সর্বত্র তখন একই ছবি। এই অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকল যতক্ষণ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টিভির পর্দায় আবির্ভূত হলেন।
ইতিমধ্যে একটি টিভি চ্যানেলের সুবাদে ছড়িয়ে গিয়েছে, ‘বিগ ক্যাচ’! মাসুদ আজহার না দাউদ ইব্রাহিম? টেলিভিশনের পর্দাতেও শুধুই আলোচনা, কী হবে? শুধু কনফার্ম করা গিয়েছে, মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক বৈঠক হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা সওয়া ১২টাও পেরিয়ে গেল। অতঃপর! প্রধানমন্ত্রী এলেন। ১০ মিনিটের লম্বা ভিডিও বার্তায় নরেন্দ্র মোদিকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিল। তাঁর হাত কাঁপছিল। গোটা ভারতবাসীর প্রবল উদ্বেগে জল ঢেলে তিনি জাতির উদ্দেশে বললেন, ভারত আজ অন্তরীক্ষ মহাশক্তি হিসেবে নিজের নাম নথিবদ্ধ করেছে। এত দিন আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনের এই সক্ষমতা ছিল। এবার ভারত হয়ে উঠল চতুর্থ দেশ, যারা এই সক্ষমতায় পৌঁছল। প্রত্যেক ভারতবাসীর জন্য এর চেয়ে গর্বের মুহূর্ত আর কিছু হতে পারে না। উপগ্রহ-বিধ্বংসী (এস্যাট) এই প্রকল্পের নাম মিশন শক্তি। দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ (ডিআরডিও) এই ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি করেছে। ক্ষেপণাস্ত্রটি আঘাত হেনেছে যে উপগ্রহে, সেটিও ভারতীয় উপগ্রহ। লোয়ার অর্বিটে ভ্রাম্যমান উপগ্রহটির কার্যকাল আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এই প্রকল্পটি কোনও দেশের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের সর্বাধুনিক মহাকাশ যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রের প্রদর্শন মাত্র। সমালোচকরা বললেন, গোটা পর্বটাই একেবারে নির্বাচনী স্ক্রিপ্ট!
সেই সমালোচনাকে উসকে দিয়ে দেশের এই সাফল্যে মুহূর্তে রাজনীতির রং লাগালেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। বিজেপির মঞ্চ থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে পাশে নিয়ে অরুণ জেটলি অভিযোগ তুললেন, ২০১২-তেই দেশের বিজ্ঞানীরা এই কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের সেই ক্ষমতাও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইউপিএ-সরকার সেই অনুমতি দেয়নি। অরুণ জেটলির অভিযোগ, তখন সরকারের সেই সাহস ছিল না। চিন্তাভাবনার স্বচ্ছতা ছিল না। ইউপিএ-সরকার যে সাহস দেখাতে পারেনি, সেটাই নরেন্দ্র মোদি করে দেখালেন। ডিআরডিও-র প্রাক্তন প্রধান ভি কে সারস্বত, বর্তমানে মোদি সরকারের নীতি আয়োগের উপদেষ্টা তাঁকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, আমরা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সামনে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। একই যুক্তি দিয়েছেন ইসরো-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান জি মাধবন নায়ার। গত বছর বিজেপি-তে যোগ দেওয়া নায়ারের বক্তব্য, ভারতের হাতে দশ বছর আগেই এই ক্ষমতা এসে গিয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মোদি উদ্যোগী হয়েছেন। যদিও তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের পাল্টা দাবি, ডিআরডিও তখন এমন কোনও আর্জিই জানায়নি। সারস্বতের বক্তব্য প্রসঙ্গে একটি ওয়েবসাইটকে মেনন বলেন, ‘এই প্রথম এমন কথা শুনলাম। এই বিষয়ে ডিআরডিও ঘরোয়া প্রেজেন্টেশন দিয়েছিল। কিন্তু সারস্বত কোনও দিন এমন পরীক্ষার জন্য আমার কাছে অনুমতি বা সম্মতি চাননি।’
বিরোধীরা প্রশ্ন তোলে, কেন ঠিক ভোটের সময়ই মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হল? অভিযোগ, দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতেই ঢাকঢোল পিটিয়ে মহাকাশ সাফল্যের ঘোষণা করেছেন মোদি। ট্যুইটারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন, ‘ভারতের মহাকাশ গবেষণা বরাবরই বিশ্বমানের। তার জন্য আমাদের বিজ্ঞানীদের নিয়ে গর্ব বোধ করি। বহুবছর ধরে লাগাতার মহাকাশ সম্পর্কিত গবেষণা চালিয়ে আসছেন তাঁরা। কিন্তু নিজে সবকিছুর কৃতিত্ব নিতে অভ্যস্ত নরেন্দ্র মোদি। ভোটের আগে তাই ফায়দা তুলতে নেমে পড়েছেন।
ভোটকে কেন্দ্র করে ভারতের মাটিতে রাজনীতি যাই হোক না কেন, আসলে মহাকাশ এখন এক নতুন রণাঙ্গন। রাজনৈতিক স্বার্থে ভোটের মুখে কেউ কেউ বলছেন, ‘মিশন শক্তি’-র সাফল্য মানে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর পাকিস্তানকে আরও একবার সমঝে দেওয়া গেল। অত্যুৎসাহী এক নেতা এমনও বলছেন, এটা যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে আরও প্রত্যক্ষ আঘাত হানা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট, খাতায় কলমে মহাকাশে যু্দ্ধ এখনও হয়নি। কিন্তু সেই যুদ্ধের প্রস্তুতির যুদ্ধটাও কম বিপজ্জনক নয়।
কে না জানে, আকাশ, মাটি, জলের পর এখন মহাকাশ দখলই শক্তিশালী দেশগুলির লক্ষ্য। আটের দশকের গোড়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান বলেছিলেন স্টার ওয়ার্স’, বা মহাকাশ যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা। যদিও সেই প্রস্তাব ছিল শুধুই একটি পরিকল্পনা, যা এখনও তেমনভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। রেগান থেকে ট্রাম্পএই সময়ে আমেরিকা মহাকাশে স্থাপন করেছে সামরিক উপগ্রহ। একই পথে হেঁটেছে রাশিয়া, চীন। এই মুহূর্তে মহাকাশে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৮৫৯টি উপগ্রহ। এর মধ্যে ১৫৯টি সামরিকউপগ্রহ, যেগুলি সরাসরি অপারেট করে মার্কিন সামরিক বাহিনী। চীন, রাশিয়ার রয়েছে যথাক্রমে ৭৫ ও ৩৬টি সামরিক উপগ্রহ।
অবিভক্ত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় রাশিয়া এবং আমেরিকা পাল্লা দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা বাড়াচ্ছিল মহাকাশে। সেই সময় দুই দেশই অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইল নিয়ে গবেষণা শুরু করে। ১৯৫৯ সালে আমেরিকা প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে উপগ্রহ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। তবে সেই ক্ষেপণাস্ত্র আকাশ থেকে ছুঁড়তে হত। অন্য দিকে ১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফল ভাবে মাটি থেকে ছোড়া যায় এমন উপগ্রহ ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা করে। অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইলের প্রাথমিক উদ্দেশ্য, মহাকাশে নিজের দেশের যে সমস্ত কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে এবং গবেষণামূলক কাজকর্ম চলছে সেগুলিকে নিরাপত্তা দেওয়া। সেই সঙ্গে মহাকাশ থেকে কোনও শত্রু দেশের আক্রমণ হলে তা যেন মহাকাশেই প্রতিহত করা যায়, তা নিশ্চিত করা। অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইলের সঙ্গে প্রয়োজনে পরমাণবিক অস্ত্রও যুক্ত করা যায়। আমেরিকা রাশিয়ার পর চীন তৃতীয় শক্তি হিসাবে ২০০৭ সালে সফল ভাবে ওই প্রযুক্তির ব্যবহার করে। চীনের সাফল্য মহাকাশে ভারতের নিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর থেকে ভারতও সেই একই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। ২০১২ সালের মধ্যেই অ্যান্টি স্যাটেলাইট মিসাইল তৈরির প্রযুক্তি তৈরিতে সক্ষম হন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। এই সাফল্যের ঔজ্জ্বল্য যতই চোখ ধাঁধিয়ে দিক, প্রশ্ন উঠছে তার ভবিষ্যৎ নিয়েও। মহাকাশে এই সাফল্য ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য হয়ে উঠবে না তো?
জোসেফ ডব্লিউ এশি, কমান্ডার-ইন-চিফ অব ইউএস স্পেস কমান্ড। মহাকাশ বিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রোগ্রেসিভ ম্যাগাজিন, জানুয়ারি ২০০০-এ লিখেছিলেন, ‘রাজনৈতিক ভাবে বিষয়টি স্পর্শকাতর। কিন্তু তা ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। কিছু মানুষ তো বিষয়টি নিয়ে শুনতেই চায় না। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আমরা মহাকাশ থেকে যুদ্ধ ও মহাকাশে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছি। আর তাই উচ্চ-শক্তি সম্পন্ন ও মারণাস্ত্র তৈরি করছি। আমরা জাহাজে, বিমানে ও মূলত ভূমি হতে মহাকাশে নিক্ষেপণ-যোগ্য অস্ত্র তৈরির দিকে মনোযোগী হচ্ছি।’ আর সেই পথ ধরেই পেন্টাগন ও মার্কিন প্রতিরক্ষাদপ্তরকে স্পেস ফোর্সগঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই সেনাবাহিনী হবে মার্কিন নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, মেরিন, সেনাবাহিনী এবং উপকূলরক্ষীর সমকক্ষ, কিন্তু আলাদা। এটি হবে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর ষষ্ঠ শাখা। ২০২০-র মধ্যেই খোলা হবে এই শাখা। মহাকাশে মার্কিন গর্বের উত্তরাধিকারকে পুনর্প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর কথায়, মহাকাশ, একটি রণাঙ্গন, ঠিক যেমন আকাশ, মাটি, জল। নিজস্ব উগ্র জাতীয়তাবাদী মেজাজে ট্রাম্প বলেছেন: মহাকাশে আমেরিকার নিছক উপস্থিতিই যথেষ্ট নয়, মহাকাশে থাকা উচিত মার্কিন আধিপত্য। একই সুরে বলেছেন নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জিম ব্রাইডেনস্টাইন। সম্প্রতি ওয়াশিংটন এক্সামিনারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এনার্জি গ্রিড থেকে ওয়াল স্ট্রিটআজ মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল জিপিএস উপগ্রহগুলির উপর। প্রতিটি ব্যাঙ্কিং লেনদেনের জন্য জরুরি হল জিপিএস থেকে নিমেষে আসা সঙ্কেত। অন্যভাবে বললে, যদি কোনও জিপিএস না থাকে, অচল হয়ে যাবে মার্কিন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা। সমস্ত কিছুর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাবে মুহূর্তে। এর জন্যই মহাকাশে আধিপত্য জরুরি।
তাহলে কি মহাকাশে যুদ্ধ আসন্ন? মহাকাশের অস্ত্র মানবজাতির জন্য যুদ্ধের নতুন অভিশাপ নিয়েই আসবে বলে অনেকে মনে করছেন। তা হলে কি আমরা পৃথিবীর শেষ দিনের অপেক্ষায়? বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ‘আর্মাগেডন’ হল শেষ বিচারের আগের দিন। সৎ ও অসতের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ! এই যুদ্ধ থামাবে কে?


No comments:

Post a Comment