বালুচিস্তানের
যন্ত্রণা নিয়ে কিছু বলুন!
২০১৬
সালের ৯ সেপ্টেম্বর। বালুচিস্তানের দেরা বুগতি জেলার গৈন্ধরি গ্রামে তখন সূর্য
উঠেছে মাত্র। হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে ধেয়ে এসেছিল ১০টি পাকিস্তানি বেল এইচ হেলিকপ্টার।
মুহূর্তেই আকাশ থেকে গুলি ও বোমা ছুটে এসেছিল গৈন্ধরি গ্রামের উপর। একদিকে আকাশপথে
হামলা, অন্যদিকে পাকসেনারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ গ্রামবাসীর উপর। নির্বিচারে
চলেছিল ঘণ্টা তিনেকের গণহত্যা। গ্রামের প্রতিটি ঘরেই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল আগুন।
মানুষ নিধনের মহোৎসবে বৃদ্ধ-মহিলা-শিশু কেউই বাদ যায়নি। সেদিন মেয়েদের তুলে নিয়ে
যাওয়া হয়েছিল পাকিস্তানি সেনা ছাউনিতে। ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা চার দিনের ওই
সেনা অভিযানে নিহত হয়েছিল ৩৪ জন গ্রামবাসী আর নিখোঁজ পঞ্চাশের বেশি মানুষ। সেনা
অভিযানের ৩০ দিন পর ২২ অক্টোবর হেলিকপ্টার থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল শাম্মি
বুগতি নামে এক মহিলার ছিন্নভিন্ন দেহ। তাঁর স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে— কেউই তখন
বেঁচে নেই। গৈন্ধরিতে শাম্মির মৃতদেহ কবর দেওয়ার জন্য কেউ বেঁচে ছিল না।
বালুচিস্তানের
রুক্ষ্ম পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আজ মানুষের মৃতদেহ, পাথরের গায়ে মনুষ্যশোণিতের কালচে
লাল ছিটে আর তার আঁশটে গন্ধ... প্রতিদিনই ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়ের এমনই এক
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁপে উঠেছিলেন বালোচ মানবাধিকার সংস্থা (বিএইচআরও)-র
সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লা আব্বাস বালোচ। সাত-আট বছর আগে তিনিও পাক সেনাবাহিনীর
হুলিয়ায় পালিয়ে জার্মানিতে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর ফিরে আসতে পারেননি
নিজের জন্মভূমিতে।
আব্বাসের
বয়সের তরুণ প্রজন্মের বালোচরাই আজ পাক সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
কারণ, অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত বালোচ নবপ্রজন্ম ৮০ বছর ধরে চলা বালুচিস্তানের স্বাধীনতা
সংগ্রামকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। স্বাধিকারের আন্দোলনকে বর্তমানে পাকিস্তান থেকে
আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের আন্দোলনে পরিণত করেছে এই তরুণ
প্রজন্মই। বালুচিস্তানের মুক্তিসংগ্রামে শামিল হয়েছে কমপক্ষে ১২টি রাজনৈতিক দল। বালোচ
লিবারেশন আর্মি (বিএলএ),
বালোচ রিপাবলিকান আর্মি (বিআরএ), বালোচ
লিবারেশন ফ্রন্ট, ইউনাইটেড বালোচ আর্মি (ইউবিএ), লস্কর-ই-বালুচিস্তান (এলইবি), বালুচিস্তান লিবারেশন
ইউনাইটেড ফ্রন্ট যাদের অন্যতম। এই তো দিন কয়েক আগের কথা। জেনেভায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের
মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠক চলাকালীন বাইরে হাতে ব্যানার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন ‘দ্য বালোচ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অ্যান্ড পাশতুনস’-এর কর্মীরা। উদ্দেশ্য পাক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এই
আন্দোলনের নেতা রাজ্জাক বালোচ বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান কোনও
সভ্য দেশ নয়। বিশেষ করে বালুচিস্তান, সিন্ধ ও পাক-অধিকৃত
কাশ্মীরে যে ধরনের নৃশংসতা ওরা দেখিয়েছে, তারপর কাশ্মীরিদের নিয়ে কথা বলার সময়
ওদের লজ্জিত হওয়া উচিত।’ জেনেভায় সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে বালুচিস্তানের মানবাধিকার
কাউন্সিলের মহাসচিব সামাদ বালোচ বলেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের ‘প্রজনন ক্ষেত্র’। পাকিস্তান এমন একটি দুর্বৃত্ত
রাষ্ট্র যা বিশ্ববাসীর কাছেও মূর্তিমান ত্রাস বা বিপদ। কারণ, এখানে কোনও আইন নেই, ন্যায়বিচার নেই। ‘পাকিস্তানে
নিয়মিত গণহত্যার শিকার হচ্ছেন সংখ্যালঘুরা। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। আমাদের
সামাজ-সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অধিকারগুলি থেকে আমরা বঞ্চিত
হচ্ছি। ওরা (পাকিস্তান) আমাদের সম্পদ লুঠ করে চলেছে। বালুচিস্তান খনিজ ও প্রাকৃতিক
সম্পদে সমৃদ্ধ। তা সত্ত্বেও আমরাই ভুগে চলেছি। বালুচের মানুষরাই শুধু নয়, সিন্ধি ভাইরাও পাকিস্তানে গণহত্যার শিকার হচ্ছে।’ বালোচ মানবাধিকার
কর্মীরাই আজ বলছেন, ‘চীন পাকিস্তানের অপরাধের সঙ্গী। ওরা আমাদের সোনা আর সম্পত্তি
লুঠ করছে। বালুচিস্তানের সব সোনার খনি দখল করেছে চীনের সংস্থাগুলি। ওরা বালুচের
স্বর্ণখনি থেকে ধনী হয়েছে। পাক সেনার নেতারা এখানকার সম্পত্তি থেকে লাভবান হয়েছে।
বালুচিস্তান থেকে পাওয়া টাকা ওরা সুইস ব্যাঙ্ক ভরাচ্ছে।’
পৃথিবীর
কোনও সংবাদমাধ্যমকেই আজ বালুচিস্তানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এই কারণে এই ব্যাপক
গণহত্যার খবর বাইরের বিশ্বে পৌঁছায় না। যেটুকু যায় তাও আবার ঘটনা ঘটে যাওয়ার অনেক
দিন পর। এই কারণে এসব সংবাদ বিশ্ব মিডিয়ায় তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। আসলে বালুচিস্তানের
গণহত্যা হল ‘সিসটেমেটিক জেনোসাইড’। আয়তনের দিক দিয়ে বালুচিস্তান
পাকিস্তানের প্রায় ৪৬ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত হলেও এখানে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে আটটি।
এর মধ্যে মাত্র একটি মধ্যম মানের, অন্যগুলো নামমাত্র।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বালোচ ভাষার পরিবর্তে শেখানো হয় উর্দু। পাকিস্তানের মোট
উৎপাদনের ৪৫ শতাংশ গ্যাস বালুচিস্তান থেকে উত্তোলন করা হলেও তা পাইপলাইনে চলে যায়
পাঞ্জাব প্রদেশে। অথচ, বালুচিস্তানের মানুষ গ্যাস পায় না। বেশির ভাগ পরিবারে
রান্নাবান্না হয় কাঠখড় পুড়িয়ে। এখানকার সোনা, তামা, মার্বেল পাথরসহ মূল্যবান সব প্রাকৃতিক সম্পদের পুরোটাই ভোগ করে পাক সরকার।
তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করতে বালোচদের মধ্যে মাদক বিক্রি ও সেবন— এই দুটো সুকৌশলে
ঢুকিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)। এতে দিন দিন শেষ
হয়ে যাচ্ছে বেলুচিস্তানের যুবসমাজ। সরকারি চাকরির উঁচু পর্যায়ের জায়গাগুলোতে
যোগ্যতা থাকলেও জায়গা পায় না বালোচরা। না, এসব অভিযোগ নিয়ে নীরবই থাকেন পাক
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কারণ, তাঁর সরকার সেনাবাহিনীকে ফ্রি হ্যান্ড দিয়েছে। এখন
সেই ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ চলছে এবং চলবে কিছুদিন। এবং আমরা সেই ফ্রি হ্যান্ডের
মানে তত্ত্বগতভাবে বুঝি। বালোচ জনতা জীবন দিয়ে বোঝেন। এক ভিশাস সার্কেল! অন্তহীন!
একসময়
পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মুশারফ বালোচ বিদ্রোহ সম্পূর্ণ শেষ করে
দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। বালোচদের নেতা নবাব আকবর বুগতিকে ২০০৬ সালে একটি
পাহাড়ের গুহার মধ্যে ঢুকে খুন করে পাক সেনা। মুশারফ ভেবেছিলেন বালোচ নবাবকে খুন
করতে পারলেই শেষ হয়ে যাবে বিদ্রোহ। কিন্তু বিদ্রোহের আগুন তারপর থেকে দাবানলের মতো
ছড়িয়েছে বালুচিস্তান জুড়ে। ২০১২ সালে করাচিতে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা
করা হয় বুগতির আপন বড় বোন ও তার ১২ বছরের মেয়েকে। আইএসআইয়ের এজেন্টরাই এই
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হলেও এর কোনও বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। তার মতো
হাজার হাজার মুক্তিকামী বালোচ রয়েছে যাদের প্রত্যেকের পরিবারের কেউ না কেউ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে খুন বা নিখোঁজ হয়েছে। বুগতির হত্যার পর থেকে
আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি বদলে গিয়েছে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামে। বালোচরা আজ মনে করেন, ইসালামাবাদ
বিশ্বাসঘাতক। গত প্রায় সাত দশক ধরে পাকিস্তানের সরকার যে নৃশংসতার সাহায্য নিয়ে
দমন করতে চেয়েছে বালোচদের, তাতে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র
ঘৃণা বালোচদের মনে।
পাকিস্তানের
মানুষের কাছে দিনটির বিশেষ কোনও তাৎপর্যই না থাকলেও, বালুচিস্তানের মানুষের কাছে
২৭ মার্চ দিনটা যন্ত্রণার। ‘পরাধীনতা দিবস’! সাত দশক আগে এই
দিনেই পাকিস্তানি সেনা দখল করেছিল বালুচিস্তান। স্রেফ বেয়নেটের খোঁচা আর বন্দুকের
জোরে সেখানকার তৎকালীন শাসককে বাধ্য করেছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে।
বালুচিস্তানের পরবর্তী ইতিহাস বলতে বিদ্রোহ, রাষ্ট্রীয়
সন্ত্রাস আর কয়েক হাজার মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে
মুক্তির জন্য এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বালোচ অঞ্চলকে
পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকেই রক্তপাত শুরু। নির্মম দমননীতি চালিয়ে
পাকিস্তান বহু বার স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বালোচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
কিন্তু বার বার মাথাচাড়া দিয়েছে বালোচ বিদ্রোহীরা। এই লড়াইয়ের শিকড় কিন্তু সুদূর
অতীতে।
ইতিহাস
বলে, বালুচিস্তানের চার স্বাধীন রাজ্য ব্রিটিশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও, আত্ননিয়ন্ত্রণের
অধিকার কখনোই ছেড়ে দেয়নি। সমস্যার সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালের পর। বালুচিস্তানের যে
অংশ সরাসরি ব্রিটিশদের হাতে ছিল, ১৯৪৭ সালে বালুচিস্তানের
চারটি করদ রাজ্যের মধ্যে তিনটি (মাকরান, লাস বেলা, খারান) পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর কালাটের শাসক বা খানের সঙ্গে ১৯৪৮
সালে পাক সরকারে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে স্বাধীন বালোচ
অঞ্চলটিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বা স্বশাসন দেওয়ার কথা হয়েছিল। মহম্মদ আলি
জিন্না নিজে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অর্থনীতি, বিদেশনীতি
এবং প্রতিরক্ষা— শুধু এই তিনটি বিষয় ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণে
থাকবে বলে চুক্তি হয়েছিল। বাকি সব কিছুই বালোচদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে
স্থির হয়েছিল। কিন্তু জিন্না কথা রাখেননি। পাকিস্তান পরবর্তী কালে সে চুক্তির শর্ত
আর মানেনি। উল্টে বালোচ এলাকার সঙ্গে আরও নানা অঞ্চলকে যুক্ত করে, বালুচিস্তান নামে একটি অখণ্ড প্রদেশ গঠন করে তাকে পাকিস্তানের অন্য
প্রদেশগুলির সঙ্গে একই আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। বালোচদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার
দেওয়া হবে বলে যে চুক্তি হয়েছিল, তা ইসলামাবাদ মানতে
অস্বীকার করে। চতুর্থ প্রদেশ কালাটের খান নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে বসে। মহম্মদ
আলি জিন্না অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করেন যাতে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে চলে আসে,
কিন্তু কালাটের খান আহমেদ ইয়ার খান সময় চেয়ে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখেন।
ধৈর্য হারিয়ে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান কালাটকে তার অধীনস্থ হিসাবে ঘোষণা
করে। এপ্রিলে সামরিক অভিযান হয়। যুদ্ধে হেরে গিয়ে আহমেদ ইয়ার খান সন্ধিচুক্তি সই
করেন ঠিকই কিন্তু তার দু’ভাই আঘা আবুদিল করিম বালোচ এবং
মহম্মদ রাহিম বন্দুক নামাতে রাজি হন না। পাকিস্তান সেনার উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন।
পাক সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতাই বিদ্রোহী করে তোলে বালোচদের।
পাকিস্তানের
নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৯৪৮ সালেই প্রথম বার চরমে পৌঁছেছিল ক্ষোভ। শুরু
হয়েছিল বিদ্রোহ। তার পর ১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯, ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭
পর্যন্ত বার বার পাক সেনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছেন বালোচ
বিদ্রোহীরা। বার বারই নির্মম দমননীতি চালিয়ে, বলপ্রয়োগ করে,
বহু প্রাণ কেড়ে নিয়ে বিদ্রোহ দমিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। পরিস্থিতি
এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে পাকিস্তান সরকারকে বালুচিস্তানের স্থানে স্থানে নতুন সামরিক
ঘাঁটি তৈরি করতে হয়েছে। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ফের
সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন বালুচিস্তানে। সেখানকার প্রাদেশিক সরকারকে ফেলে দিয়ে
সামরিক শাসন জারি করা হয়। দমন যত বাড়ে ততই বাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গেরিলা
আক্রমণের ধার। বালোচ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের স্রোত ক্রমশ বেড়েছে বই কমেনি।
যেখানে শুধুই রক্তপাত, সংগ্রাম এবং বারুদের গন্ধ।
২০০৬
সালের আগস্টে আকবর খান বুগতি খুন হন পাক সেনার হাতে। সেই সঙ্গে প্রাণ হারান ৬০ জন
পাক সেনা এবং ৭ জন অফিসার। মূলত এই সময় থেকেই ইসলামাবাদ অভিযোগ করতে শুরু করে, বালোচ জঙ্গিদের
এই সামরিক সক্রিয়তায় ভারতের মদত রয়েছে। ভারতীয় নৌসেনার প্রাক্তন কমান্ডার কূলভূষণ
যাদবকে পাকস্তান সে দেশ থেকে গ্রেপ্তার করে প্রচার করে যে তিনি আসলে বালোচ
বিদ্রোহে মদত দিতে ভারতের হয়ে চরবৃত্তি করছিলেন।
প্রুসিয়ান
আর্মি জেনারেল কার্ল ভন ক্লসউইত্জ বলেছিলেন, যুদ্ধটাও এক ধরনের রাজনীতি। অধিকারের
রাজনীতি। এর ডায়নামিক্স ঘটে দুটি শ্রেণির মধ্যে— উপরতলার
শাসক এবং যারা তাঁদের দ্বারা শাসিত। বিক্ষোভ এই নিয়ে, শাসকরা
যে সুবিধাগুলি ভোগ করছেন, তা শাসিতদের সঙ্গে ভাগ করতে নারাজ।
কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া বেলুচ ছাত্র সংগঠন (বিএসও আজাদ)-র চেয়ারম্যান বানুক
করিমা বেলুচের কথাই শুনুন। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) বালুচিস্তানের
অভিশাপ আখ্যা দিয়ে বানুক করিমা বলেন, ৪৫ বিলিয়ন ডলারের এই
চুক্তি বালুচিস্তানের জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে করা হয়েছে। চুক্তিতে যা আছে তা
কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। পাকিস্তানের সিভিল সরকারও বোধ হয় জানে না ওই চুক্তিতে কী
আছে। কারণ, চুক্তি বাস্তবায়নের পুরোটাই সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত। এই চুক্তি
বালুচিস্তানের নিজ ভূমিতে বালোচদের সংখ্যালঘু বানানোর ষড়যন্ত্র। চীন বালুচিস্তানে
একটি সেনা পোতাশ্রয় নির্মাণ করবে এবং গদর বন্দর থেকে সড়কপথে পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং
প্রদেশের কাশহার পর্যন্ত সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখানকার যত প্রাকৃতিক সম্পদ
আছে তা গদর বন্দরের মাধ্যমে চালান হয়ে যাবে অন্যত্র। এখানে পাঞ্জাব ও সিন্ধের
জনগণকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার পুরোটাই
বালুচিস্তানের জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে। গদর বন্দরের জন্য ইতিমধ্যে হাজার হাজার
বালোচকে তাদের ভিটে থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা এখনও রয়েছে তাদেরও নিজের বাড়িতে
ফিরতে অনুমতি নিতে হয়। কত দিন এসব সহ্য করবে বালুচিস্তানের জনগণ! সিপিইসিকে
বাস্তবায়ন করতেই বালুচিস্তানে সবচেয়ে বেশি সেনা অভিযান পরিচালিত হয়েছে। আর এসব
অভিযানের লক্ষ্য একটাই— এই অঞ্চলকে বালোচ-শূন্য করা। এই অনিঃশেষ পঙ্কিল বিষাক্ত
আবর্তই বালোচদের ভবিতব্য... অতএব!
বালোচরা
চান, ১৯৭১-এ ভারত যে ভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সে
ভাবেই পাশে দাঁড়াক বালুচিস্তানের। ‘বালুচিস্তানের গান্ধী’
বলে পরিচিত আব্দুল কাদির বালোচ গত বছর দিল্লি এসে বলেছিলেন,
‘আমাদের অস্ত্র দিন! যাতে আমরা লড়াই করতে পারি।’ নিজে অহিংসার পথে স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই করতে করতে কখন তিনিও সশস্ত্র
আন্দোলনকারী হয়ে গিয়েছে। নিজেই হয়তো জানেন না বালুচিস্তানের গান্ধী!
No comments:
Post a Comment