‘হাজি
কাশেম’ খতমে স্বস্তি আইএস জঙ্গিদের
২০১৯-র
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়। বাগদাদজুড়ে তখন অস্থিরতার উত্তাল হাওয়া। কয়েক সপ্তাহ ধরেই
ইরাকের রাজধানী বাগদাদ ছিল অবরুদ্ধ। আন্দোলনকারীরা রাস্তা দখল করে মিছিল করছিল
দুর্নীতির অবসান আর প্রধানমন্ত্রী আদিল আব্দুল মাহদির পদত্যাগের দাবিতে। অভিযোগ
উঠেছিল, ইরাকি রাজনীতিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরানের অযাচিত হস্তক্ষেপের।
সেই সময়ই গোপনে
বাগদাদে ঢুকেছিলেন তিনি। তাঁর আঙুলের বিরাট আর জ্বলজ্বলে লাল আংটিটা গোটা আরব
দুনিয়ার তাবড় তাবড় সন্ত্রাসবাদীদের কাছে আতঙ্কের। ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের
কাছে তো বটেই! প্রধানমন্ত্রী আব্দুল মাহদিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তাঁর আচমকা
উপস্থিতি ইরাকি আন্দোলনকারীদের বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিল। হবেই বা না কেন? সিআইএ ও মোসাদের
হিটলিস্টে এক নম্বরে তাঁর নাম। ইরাক-সিরিয়ায় নৃশংস আইএস জঙ্গিদের ঝাঁপ বন্ধ করে
দেওয়ার অন্যতম কারিগর। ইরানিদের কাছে যাঁর পরিচিতি হাজি কাশেম নামে। ছোটখাটো, বলিষ্ঠ চেহারার ক্যারিশম্যাটিক
জেনারেল। ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য এহেন হাজির বাগদাদে যাওয়ার ঘটনা অবশ্য এটাই
প্রথম ছিল না। আব্দুল মাহদিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার তেহরানের এই প্রচেষ্টা ছিল
ইরাককে নিজেদের ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ হিসেবে ধরে রাখার সুদীর্ঘ তৎপরতারই একটা অংশ। যে
তৎপরতার প্রমাণ উঠে এসেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ৭০০ পৃষ্ঠার ইরানের সরকারি গোপন
ডকুমেন্টে।
ফাঁস হওয়া
ডকুমেন্টগুলোতে মূলত ইরাকের উপর ইরানের প্রভাবের চিত্রই ফুটে উঠেছে। কীভাবে ইরানি
গোয়েন্দারা বছরের পর বছর ধরে ইরাকি নেতাদেরকে হাত করার জন্য কাজ করে এসেছে। কীভাবে
তারা আমেরিকানদের হয়ে কাজ করা ইরাকি গোয়েন্দাদেরকে অর্থ দিয়ে নিজেদের দলে টেনে
নিয়েছে। কীভাবে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রসহ ইরাকের জনজীবনের
প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করেছে। সংবাদসংস্থা ইন্টারসেপ্টের
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গোপন ডকুমেন্টগুলোতে বেশকিছু গোয়েন্দাগিরির
কথা এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে, মনে হতে পারে সেগুলো যেন কোনও
স্পাই থ্রিলারের পাতা থেকে হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব ডকুমেন্টের কেন্দ্রে
কিন্তু সেই একজনই। হাজি কাশেম সোলেমানি। খাতায়-কলমে রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের কাডস
ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন জেনারেল সোলেমানি। তবে অলিখিতভাবে তাঁর পদমর্যাদা ইরানের
যেকোনও সামরিক কর্তার উপরে। আদতে ছিলেন ইরানের সেনাপ্রধানই। রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস ফোর্স’ তাঁর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো। ২২ বছর ধরে
বাহিনীটি গড়ে তুলেছিলেন নিজের হাতেই। ছায়াযুদ্ধের জন্য তৈরি করা একটা বৃহৎ ‘স্পেশাল অপারেশান ইউনিট’ বলা হয় সেই বাহিনীকে। যার
প্রধান কর্মক্ষেত্র এখন ইরানের বাইরে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফ্রন্টে তৎপর ‘পবিত্র’ এই যোদ্ধারা। ইরানের আন্তর্জাতিক স্তরে
উত্থানে বর্শার ফলকে পরিণত হয়েছে কুদস ফোর্সের সদস্যরা। যাঁদের ব্যবহার করে আরব
দুনিয়ায় ইতিমধ্যে সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছিলেন সাদা চুলের হাজি কাশেম।
যার তাপ লেগেছে দুনিয়ার অন্যত্রও। বিশেষ করে অর্থনীতিতে।
ইরানের
সরকারি গোপন ডকুমেন্ট ফাঁস হওয়ার পর আর সময় নষ্ট করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট
ডোনাল্ড ট্রাম্প। আরব দুনিয়ায় আমেরিকার প্রভাব আলগা হওয়ার আগেই অত্যাধুনিক মার্কিন
ড্রোন ‘এমকিউ-৯ র্যাপার’ হানায় খতম করা হয়েছে কমান্ডার জেনারেল কাশেম সোলেমানিকে।
প্রাণ হারিয়েছেন ইরাকি ‘পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্স’-এর উপ-প্রধান আবু মহদি আল-মুহান্দিস
ওরফে জামাল জাফর ইব্রাহিমি। প্রশ্ন হল, কে এই কাশেম সোলেমানি?
প্রাক্তন
সিআইএ কর্তা জন ম্যাগুইয়ার দ্য নিউ ইয়র্কারকে বলেছিলেন, সোলেমানি ছিলেন ‘আরব দুনিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর একক অপারেটিভ’। ১৯৫৭
সালে জন্ম ইরানের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের কেরমান প্রদেশের এক দরিদ্র পরিবারে। ১৩ বছর
বয়সেই তাঁকে জীবিকার সন্ধানে পথে নামতে হয়। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। ফরেন পলিসি
ম্যাগাজিন বলছে, সেনাবাহিনীতে মাত্র ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ
নিয়েছিলেন সোলেমানি। তাতেই প্রমাণ করেছিলেন নিজের দক্ষতা। আরব দুনিয়া তাঁকে চিনত
জেমস বন্ডের ইরানি সংস্করণ হিসেবেই। চষে বেড়াতেন ইরাক-ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন-আরব—
প্রায় পুরো পশ্চিম এশিয়া। ইরানের ভূমিকা কোথায়-কেমন হবে, এত দিন নাকি সব ঠিক করে দিতেন তিনিই। সোলেমানি শুধু ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
আয়াতোল্লা আলি খামেনিকেই রিপোর্ট করতেন। তাই ইরানিরাও ‘কুদস ফোর্স’-এর সংখ্যা ও সামর্থ্য নিয়ে সামান্যই ওয়াকিবহাল। এই ‘ফোর্স’-এর সঙ্গে কাজ করে লেবাননের হিজবুল্লা, প্যালেস্তাইনের
হামাস ও ইসলামিক জেহাদ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ‘ফাতেমিয়ুন’ আর ‘জাইনাবিয়ুন’
নামে মিলিশিয়া গ্রুপ এবং ইয়েমেনের হুতিরা। এর বাইরে সিরিয়া-ইরাকে
শিয়াদের অনেক প্রশিক্ষিত বাহিনী রয়েছে ‘কুদস ফোর্স’-এর অধীনে। রীতিমতো আন্তমহাদেশীয় চরিত্রের বাহিনী। যার সঠিক আকার ও
সদস্যসংখ্যা আঁচ করা কঠিন। ইরান এদের বলে ‘প্রতিরোধের
অক্ষশক্তি’। অন্তত ১৫-২০টি দেশে সরাসরি কিংবা সীমিত পরিসরের
ইজরায়েল, আমেরিকা, সৌদি আরব, আরব আমিরশাহি সহ বিভিন্ন দেশের স্বার্থের বিপরীতে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত।
সমরবিদ্যায় এই রকম যুদ্ধকে বলে ‘বড়যুদ্ধের মধ্যবর্তী ছোট ছোট
অভিযান’। সৌদি আরব তার তেলক্ষেত্রে অজ্ঞাত উৎস থেকে পরিচালিত
এই রকম এক অভিযান দেখেছে গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর। যা বিশ্ব অর্থনীতিকেও খানিকটা
ঝাঁকুনি দিয়েছিল। হয়তো তাই আমেরিকার চোখে সোলেমানি ‘জেহাদের
কারবারি’। পশ্চিম এশিয়ার একটা বড় অংশ জুড়ে সন্ত্রাসের
মদতদাতা।
কেন সোলেমানিকে
হত্যা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল?
তাঁর
বিরুদ্ধে ছিল মার্কিন সরকারের একাধিক নিষেধাজ্ঞা। এও মনে করা হয়, ইরানের বিরুদ্ধে
আমেরিকার সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা মূলত সোলেমানির উপর ক্ষোভ থেকে। ইজরায়েলের
গোয়েন্দাদের অভিযোগ, অন্তত দু’বার আমেরিকা সোলেমানিকে সুযোগ
পেয়েও মারেনি। কারণ, জঙ্গি সংগঠন আইএস নিয়ন্ত্রণে সোলেমানি তখনও
অপরিহার্য। তাঁকে হত্যা করা মানেই ইরানের সঙ্গে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতার পথ
বহুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। আজ যে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরাক, কাতার ইরানের
সঙ্গে অক্ষশক্তি হিসেবে কাছাকাছি হয়েছে, তা সোলেমানির সামরিক
নেতৃত্বের অবদান। তাঁর কৌশলে শুধু আইএস ইরাক ও সিরিয়াতে ধ্বংসই হয়নি, ওই দেশ দু’টি ইরানের পরম মিত্র হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সোলেমানিকে নিয়ে আমেরিকার
চেয়ে ইজরায়েলের মাথাব্যথা ছিল বেশি। ইজরায়েল মনে করে, লেবানন, সিরিয়া, গাজা থেকে সোলেমানির অদৃশ্য সেনারা ক্রমে
তাদের ঘিরে ফেলছে। এভাবে ইরান সীমান্তকে সোলেমানি টেনে নিয়ে এসেছেন ইজরায়েলের
বাড়ির পাশে। অথচ তেহরান-জেরুজালেমের মাঝে দূরত্ব ১৫০০ কিলোমিটারের বেশি।
প্রতিবেশী
সিরিয়ায় ইরানের কুদস ফোর্সের সামরিক দপ্তর থাকা ইজরায়েলের কাছে তেহরানের পারমাণবিক
অস্ত্রের মতোই অসহনীয় কিছু। ইজরায়েলের জেনারেলরা এটা কখনোই গোপন করেন না যে মোসাদের
হিটলিস্টে সোলেমানি ছিল এক নম্বরে। ইরানেরও তা অজানা ছিল না। হয়তো এই কারণেই আয়াতুল্লা
খামেনি সোলেমানিকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন: ‘বিপ্লবের জীবন্ত
শহিদ’। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ২০১৮ সালের নভেম্বরে এমন রিপোর্টও করেছে যে, সাংবাদিক
খাসোগিকে হত্যার অন্তত এক বছর আগে একই খুনে দল ইজরায়েলের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিলে
সোলেমানিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। এই কাজের বাজেট ছিল দুই বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য
হাসিলে ভাড়াটে কোনও শক্তিকে ব্যবহারের কথা ছিল। অজ্ঞাত কারণে তা আর সফল হয়নি।
সৌদি
আরবের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে ইরানের যে ছায়াযুদ্ধ চলছে, তার প্রধান কারিগরও জেনারেল সোলেমানি।
আবার ইরাকে আইএস যে সাময়িকভাবে হলেও পরাস্ত, এককভাবে তার বড়
কৃতিত্ব সোলেমানিকেই দিতে হবে। সোলেমানির জন্যই ইরানে এবং এশিয়ায় দাঁত ফোটাতে
পারেনি বাগদাদির জঙ্গি বাহিনী। গত কয়েক বছরে সোলেমানির ‘অক্ষশক্তি’
যে ক্রমে সামরিক পরিসর ছেড়ে রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে, তারও বহু নজির রয়েছে। হিজবুল্লা এক সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকলেও এখন তাদের
নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া লেবাননে সরকার গঠন আটকে যায়। ইরাকে ‘পপুলার মবিলাইজেশন ফোর্স’ নামে পরিচিত সোলেমানি
প্রভাবিত মিলিশিয়াদের অনেক সংগঠক পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন এবং তাঁরা
সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এক ‘ব্লক’।
ইয়েমেনে হুতিদের সশস্ত্র সংগঠন ‘আনসারুল্লা’ সরাসরি একটা রাজনৈতিক শক্তিও বটে।
ইরানকে
অর্থনৈতিকভাবে কাবু করতে ইজরায়েলের উৎসাহেই অবরোধ চলছে দশকের পর দশক ধরে। ২০১৬
থেকে পরবর্তী দুই বছর বাদ দিলে ১৯৭৯ সাল থেকে গত প্রায় ৪০ বছর ইরানের অর্থনীতিকে
অবরোধে ফেলে কাবু করার চেষ্টা চলেছে। সামরিক সক্ষমতা কমাতে ইরানের বহু বিজ্ঞানীকে
চোরাগোপ্তা কায়দায় হত্যা করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। এর পাশাপাশি ‘মুজাহেদিন-ই খালক’,
‘জয়েস উল-আদিল’ নামে বিভিন্ন সংগঠন ইরানের
অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত চালাতে মরিয়া। জেনারেল সোলেমানি মনে করতেন, এই রকম জটিল পরিস্থিতিতে ইরানকে তার অস্তিত্বের জন্যই সীমান্তের বাইরে
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্তরে উপস্থিতি বাড়াতে হবে। তিনি শত্রুর সঙ্গে চোখে চোখ
রেখে পাল্টা প্রতিরোধের পক্ষে। সামনাসামনি দেখলে এই ধরনের বিপজ্জনক চিন্তার
মানুষটির যে বড় বৈশিষ্ট্যটি চমকে দিত তা হল, অতি সাধাসিধে
জীবনযাপন। তারকা জেনারেলদের শরীরী ভাষায় যে ঔদ্ধত্য থাকে, কাশেম
সোলেমানি একদম তার বিপরীত। শুধু এই কারণেই, শিয়া মিথে ভরপুর
ইরানের সমাজে অনেকে তাঁর মাঝে দেখতেন ঈশ্বরের ছায়া। সারাক্ষণ রণাঙ্গনে ঘুরতে পছন্দ
করতেন। সামরিক পোশাকে নয়, সাধারণ একটা জ্যাকেট পরা অবস্থায়
দেখা যেত অধিকাংশ সময়। খামেনি ছাড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও তাঁর
মেলামেশা ছিল কম। ২০১৭ সালে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে
চাননি। মূলত ‘জাতীয় স্বার্থে’ ভূকৌশলগত
সামরিক চিন্তার দক্ষতাই তাঁকে জাতীয় বীরে পরিণত করেছিল। তবে ইরানিদের প্রিয় ‘হাজি কাশেম’ তাঁদের দেশকে আরব দুনিয়ায় এমন এক
যুদ্ধের ভিতরও টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন, হয়তো সেই যুদ্ধের রেশ
বয়ে চলতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
সোলেমানির
মৃত্যুর খবর আধা-বিধ্বস্ত আইএসের কাছে বিরাট স্বস্তি তো বটেই!
No comments:
Post a Comment