হৃদয়জুড়ে মানবসেবা
সমকাল
তাঁকে যথেষ্ট লজ্জা দিয়েছিল!
নিজের দেশ
ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে কপর্দকহীন এক সন্ন্যাসীকে নিগৃহীত করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন
ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধি প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। স্বামীজির বিজয়কীর্তিকে ধূলিসাৎ করতে নিজের
‘ইউনিটি অ্যান্ড দি মিনিস্টার’ পত্রিকায় স্বামীজিকে ‘নবহিন্দু বাবু নরেন্দ্রনাথ
দত্ত’ সম্বোধন করে বলা হয় যে, তিনি নাকি যুবাবয়সে ব্রাহ্মসমাজে আসেন শুধুমাত্র ‘নববৃন্দাবন’ থিয়েটারে অভিনয়ের জন্য। এভাবেই কেউ তাঁর সন্ন্যাসজীবন নিয়ে লজ্জাজনক কটাক্ষ
করেছেন, ইঙ্গিত দিয়েছেন নারী সংসর্গ সম্পর্কে। এই শহরের সংবাদপত্রেও অভিযোগ উঠেছে,
শিকাগো বক্তৃতার ঠিক পরেই তিনি কি বিদেশের রেস্তরাঁয় নিষিদ্ধ মাংসের
অর্ডার দিয়েছিলেন? মৃত্যুর কাছাকাছি এসেও সেই সব যন্ত্রণার
অবসান হয়নি। বেলুড় মঠকে নরেন দত্তর ‘প্লেজার হাউস’ বলে চিহ্নিত করে বালি মিউনিসিপ্যালিটি ট্যাক্স নির্ধারণ করেছে। বাধ্য
করেছে বিপন্ন সন্ন্যাসীকে আদালতে যেতে। নগর কলকাতার নিষ্ঠাবান, নামীদামি নাগরিক তাঁর স্মরণসভায় যেতে চাননি। এমন কথাও বলেছেন, হিন্দু আমল হলে তাঁকে নাকি তুষানলে দগ্ধ হতে হতো। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, সেবার জন্য, সত্যের
জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়ে তাঁর কীর্তি কতখানি সুদূরপ্রসারী হবে তা সন্ন্যাসী
বিবেকানন্দ তাঁর জীবনকালে আন্দাজ করে যেতে পারেননি। এ বিষয়ে তাঁর মাথাব্যথাও ছিল
না। নিজে ক্ষত হয়েছেন, কিন্তু ক্ষতির বিস্তার চাননি। কারণ, স্বামীজির হৃদয়জুড়ে
ভারত ও ভারতবাসী।
তাঁর জীবনের
প্রথম বড় ঘটনা শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচয়। যিনি সবচেয়ে আধুনিক এবং সবচেয়ে পূর্ণ
বিকশিত চরিত্র জ্ঞান,
প্রেম, বৈরাগ্য, উদারতার
পূর্ণ প্রকাশ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল তিনটি মূল অস্ত্র। অকপট সত্যানুরাগ,
নিপীড়িত মানুষের প্রতি অকৃপণ প্রেম এবং যুক্তিবাদে আস্থা। সমাজ ও
ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় অসঙ্গতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন তিনি,
জ্বেলেছিলেন যে প্রাণের প্রদীপ, তা আজও নিবাত
নিষ্কম্প। আচারের চোরাবালিতে যে ধর্মের সমাধি ঘটতে চলেছিল, সত্য
ও প্রেমের প্রাণোচ্ছল স্রোতোধারায় তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনিই। তাঁর কাছে ধর্ম
কখনওই আচারসর্বস্ব ছিল না। প্রচলিত গড়পড়তা ধর্মাচার্যদের সঙ্গে এখানেই তাঁর
প্রভেদ। পরম ঔদার্যে তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন ধর্মে ধর্মে বিভেদের খড়ির গণ্ডি। সকল
সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তাই তিনিই বলতে পেরেছিলেন: যত মত তত পথ। রামকৃষ্ণ নিজের
জীবনে বহু সাধনার পথ পেরিয়ে ওই উপলব্ধিতে পৌঁছন। এই অমোঘ বাণীর প্রেরণায় শ্রেষ্ঠ
শিষ্য বিবেকানন্দ মনে করেছিলেন, সব ধর্মের মধ্যে মূলগত একটি
ঐক্য আছে। সেটিকে স্বীকার করতে হবে।
বিবেকানন্দ
সেই উপলব্ধিকে দেখেন বেদান্তের আলোয়। উপনিষদই তো বলে, ‘একম্ সদ্,
বিপ্রো বহুধা বদন্তি।’ মানে, সত্য একটিই, ঋষিরা তাকে নানা ভাবে বলেন।
ধর্মচেতনাতেও ধাপে ধাপে অভিব্যক্তির কথা বলেন তিনি। শুরুতে দ্বৈতবাদ। জীব আর ঈশ্বর
আলাদা। আরও অগ্রসর হলে, অদ্বৈতবাদ। তখন জীব আর ঈশ্বরে ফারাক
নেই। এরপরই গুরু রামকৃষ্ণের সেই চেতনা ছড়িয়ে দিতে পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর
ভারতসন্ধান। দুঃখী ভারতকে আবিষ্কার। একইসঙ্গে দুর্জয় মনোবৃত্তি, “আমি যতক্ষণ খাঁটি আছি, ততক্ষণ কেউ আমাকে প্রতিরোধ
করতে সমর্থ হবে না।... যুবকদলকে সঙ্ঘবদ্ধ করতেই জন্মগ্রহণ করেছি। এরা দুর্দমনীয়
তরঙ্গাকারে ভারতভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। যারা সর্বাপেক্ষা দীন হীন পদদলিত
তাদের দ্বারে দ্বারে এরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, নীতি, ধর্ম ও শিক্ষা বহন করে নিয়ে যাবে। এটাই আমার আকাঙ্ক্ষা ও ব্রত। এটি আমি
সাধন করব কিংবা মৃত্যুকে বরণ করব।’’
রামকৃষ্ণের
প্রকৃত যে সংজ্ঞা তিনি দিয়েছেন তা আসমুদ্র ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে অতি অল্প সময়ের
মধ্যে। “যে রামকৃষ্ণের ছেলে, সে আপন ভাল চায় না, প্রাণ দিয়েও তারা পরের কল্যাণকাঙ্ক্ষী। যারা আপনার আয়েস চায়, কুঁড়েমি চায়, যারা আপনার জেদের সামনে সকলের মাথা
বলি দিতে রাজি, তারা আমাদের কেউ না, তারা
তফাত হয়ে যাক, এই বেলা ভালয় ভালয়।” শত
শত বুদ্ধের কারুণ্য-নিষিক্ত হৃদয়বান মানুষই ছিল তাঁর কাঙ্ক্ষিত। অজ্ঞ, কাতর, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজে, তাদের স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই
তাঁর ধর্ম-দর্শন-অধ্যাত্মচিন্তার সবটাই জুড়ে আছে মানুষের কথা। তিনি যথার্থ মানুষ,
ভালো মানুষ, সচেতন-শুভ্র-সুন্দর-বুদ্ধ-শুদ্ধসত্ত্ব-প্রমুক্ত
মানুষ চান। বলতেন, জন্মালেই আমরা সবাই মানুষ হয়ে উঠি না। মানুষ হয়ে উঠতে হয়।
চৈতন্যের সম্প্রসারণে মানুষের পশুত্ব থেকে দেবত্বে উত্তরণ হয়।
বিবেকানন্দ
লিখেছিলেন: ‘অতীতে যত ধর্মসম্প্রদায় ছিল, আমি সবগুলিই সত্য বলিয়া
মানি এবং তাহাদের সকলের সহিতই উপাসনায় যোগদান করি। প্রত্যেক সম্প্রদায় যেভাবে
ঈশ্বরের আরাধনা করে, আমি তাহাদের প্রত্যেকের সহিত ঠিক সেই
ভাবে তাঁহার আরাধনা করি। আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব, খ্রিস্টানদিগের
গির্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদিগের
বিহারে প্রবেশ করিয়া বুদ্ধের ও তাঁহার ধর্মের শরণ লইব, এবং
অরণ্যে গমন করিয়া সেই–সব হিন্দুর পার্শ্বে ধ্যানে মগ্ন হইব,
যাঁহারা সকলের হৃদয়–কন্দর–উদ্ভাষণকারী জ্যোতির দর্শনে সচেষ্ট।’’ পৃথিবীতে যত
বড় বড় কাজ হয়েছে, তার মূলে আছে আত্মবোধ ও আত্মবিশ্বাসের জাগরণ।
আর আত্মবিশ্বাস থেকেই আসে আস্তিকতা। স্বামীজির ভাষায়, ‘যে
নিজেকে (মানুষ) বিশ্বাস করে না, সে নাস্তিক— আর যারা হাজারটা দেবদেবীতে বিশ্বাস না করেই শুধু নিজের উপর বিশ্বাস রাখে,
আত্মবোধে ভর দিয়ে সচেতন হয় সে-ই আস্তিক।’ বিবেকানন্দ
মন ও মুখের সত্যতায় স্পষ্টত জানান ‘ধর্ম মানুষের বন্ধু।’
তা কোনও শর্তাধীন নয়। বিনিময়যোগ্য স্বার্থের আদানপ্রদানে সঙ্কুচিতও
নয়। ধর্ম বিবর্তনের পথেই এগোয়। ধর্ম সমাজের দায় বহন করে। নিরন্ন মানুষের জন্য অন্ন,
অসুস্থ প্রপীড়িতের জন্য ত্রাণ-সেবা, অনাথ-বিধবার
অশ্রুমোচনের দায়িত্ব ধর্মকেই নিতে হয়।
আসলে
অ-সুখের, অ-সত্যের, অ-ধর্মের, অ-বিচারের গভীরে পৌঁছে তিনি
আবিষ্কার করেন জীবন অন্বেষায় উত্তরণের উজ্জ্বল পথ— আজকের
সমাজে যা অপরিহার্য। শুধু স্বাধীনতা অর্জনই নয়, দেশগঠন,
শান্তিশৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয়
সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে বিবেকানন্দ প্রখর সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে বলেন,
“বলো ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ।”
এই আহ্বান আধুনিক ভারতে উত্তরণের মহাঋক্। ‘যৌবনের
উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী’ তাঁর প্রিয়
ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের জাগরণে উত্থান ও উন্নতি, পুনর্গঠন
ছিল তাঁর বিশেষ কাম্য— “নূতন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার কুটির থেকে, জেলে, মালো, মুচি, মেথরের ঝুপড়ির
মধ্য থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে...”।
বিবেকানন্দ
হিন্দুধর্মের বিশেষ এক কাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সেই কাঠামোর নানা
সীমাবদ্ধতা, তবে ভারতের নানাত্বকে তা অনেকটাই স্বীকার করে। তা বর্জনপন্থী নয়, গ্রহণপন্থী। আর সবচেয়ে বড় কথা, বিবেকানন্দ স্বীকার
করেছেন সব মানুষ এক রকম নন, নানা মানুষের নানা কাজ নানা রুচি,
সুতরাং সবাইকে এক ভাবে চালনা করতে চাওয়া মূর্খতা। ঢাকা নগরীতে
দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বছর আমাদের
গরীয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা হোন। অন্যান্য অকেজো দেবতাদের এই কয়েক বছর
ভুললে কোন ক্ষতি নেই। তাঁরা এখন ঘুমোচ্ছেন।’
বিবেকানন্দ
বুঝেছিলেন যে, দেবতা আকাশ থেকে নামেন না বা মাটি ফুঁড়েও ওঠেন না। বিবেকানন্দ চান জীবন্ত
মানুষের পুজো। শিষ্যবর্গ এবং সতীর্থদের প্রতি তাঁর নির্দেশ, ‘মানুষের জন্য কাজ (যা পুজোরই শামিল) করে করে তোরা শেষ হয়ে যা, এটাই আমার আশীর্বাদ।’ গুরুভাই তূরীয়ানন্দকে বলেছিলেন,
‘জীবে জীবে, বিশেষত মানুষের মধ্যে তাঁর
অবস্থান’। ‘তাঁর’ অর্থাৎ মানুষ যাঁকে বলে দেবতা। যোগীর ধারণায় পরমপুরুষ—ভগবান—ঈশ্বর! বৈদান্তিক অনুভবে তিনিই পরমব্রহ্ম। সেই
নতুন চিন্তা থেকেই লেখেন, ‘তোমার পূর্বপুরুষ না-হয় দুটো বেদ,
উপনিষদ লিখেছে, দুটো মন্দির তৈরি করেছে,
কিন্তু তাতে কী আসে যায়? জাতপাতে দীর্ণ,
অসহায়, দরিদ্র মানুষরাই সভ্যতার স্রষ্টা।’ সেই গরিব মানুষদের খেতে দিতে হবে। অপুষ্টি, রোগ
থেকে তাদের শরীরটা বাঁচাতে হবে। কুসংস্কার থেকে বের করে এনে তাদের মনে শিক্ষার আলো
ছড়িয়ে দিতে হবে। জাগাতে হবে তাদের আত্মবিশ্বাস। তারপর তোমাকে আর কিছু করতে হবে না।
তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নেবে। এটিই তাঁর সামগ্রিক চিন্তাধারার
সারাৎসার।
বিবেকানন্দ
শক্তিমান ভারত চেয়েছিলেন অবশ্যই, কিন্তু সেই শক্তি হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়, ‘ঐসলামিক পেশি এবং হিন্দু মস্তিষ্ক’। ১৮৯৩ সালে
শিকাগো ধর্ম-মহাসম্মেলনে বলেছিলেন, ‘যদি কেহ এরূপ স্বপ্ন
দেখেন যে, অন্যান্য ধর্ম লোপ পাইবে এবং তাঁহার ধর্মই টিকিয়া
থাকিবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র; তাঁহার জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত, তাঁহাকে আমি
স্পষ্টভাবে বলিয়া দিতেছি, তাঁহার ন্যায় লোকেদের বাধাপ্রদান
সত্ত্বেও শীঘ্রই প্রত্যেক ধর্মের পতাকার উপর লিখিত হইবে— ‘বিবাদ
নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।’
স্বামী
আত্মবোধানন্দ লিখেছিলেন, ‘মানবসেবাই তাঁর কাছে মানবিকতা। আজকে বহুবাদের মধ্যে
মানবতাবাদের বিশেষ প্রয়োজন। তাঁর এই মানবতাবাদ যদি জগতে প্রতিষ্ঠিত হত, তা হলে অনেক বাদ
আরও পরিশুদ্ধ হতে পারত। সব বাদের মধ্যমণি হওয়া উচিত মানবতাবাদের। এবং সমস্ত বাদীর
পরিচিত হওয়া উচিত মানবতাবাদী বিবেকানন্দের দর্শনের সঙ্গে।’
দেশের
রাজনীতিবিদরা সেই দর্শনের পাঠ নিতে পারলেন কি?
No comments:
Post a Comment