পরিবর্তন চেয়ে
হংকংয়ে পড়ুয়াদের কলরব
এই
অক্টোবরের প্রথম দিনে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উৎসবের বৈভবে
রাঙিয়ে উঠেছিল তিয়েনআনমেন চত্বর। গোটা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য যাবতীয় কিছু
মজুত থাকলেও সেদিনও বিশ্ব সংবাদমাধ্যম দখল করে রেখেছিল হংকং। দুনিয়া জেনেছে, ১
অক্টোবর ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ চীনের ৭০তম প্রতিষ্ঠা দিবসে হংকংকে প্রতিবাদ করতে হয়েছে সেই
গণতন্ত্রের জন্যই! প্রতিবাদের রূপ ধরা পড়েছে ‘জি-নাৎসি’ পতাকায়। চীনের
লাল পতাকায় সমাজতন্ত্রী তারার জায়গায় আঁকা হয়েছিল নাৎসি জার্মানির স্বস্তিকা। সেই
পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ চলেছে হংকংয়ের রাস্তায়। আর সেই ‘পরিবর্তনের লড়াই’-এ ক্রমে
বিশাল ছায়া বিস্তার করছেন এডওয়ার্ড লিয়ুং নামে এক তরুণ। জেলে বন্দি থেকেই যিনি
ক্রমে চীনের ঘুম কেড়ে নিচ্ছেন। প্রতিদিন।
চলতি
বছরের জুনে প্রশাসক ক্যারি ল্যামের প্রস্তাবিত প্রত্যপর্ণ বিল নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে
হংকং। বন্দি প্রত্যার্পণ বিলের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে
প্রতিবাদ শুরু করেন। দাবি, গণতন্ত্রী হংকংয়ের মুক্ত ভাবনাকে ল্যাম যে অগণতান্ত্রিক
ব্যবস্থা হত্যা করতে চান,
তাকে রুখতে হবে। কী আছে সেই বিলে? বিচারের প্রয়োজনে হংকংয়ের
অপরাধীদের চীনে প্রত্যর্পণ করার কথা বলা হয়েছিল ওই বিলে। মানবে কেন হংকং? ১৯৯৭
সালে ব্রিটেনের হাত থেকে চীনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর এত বড় প্রতিবাদ দেখেনি
হংকং। বিক্ষোভের জেরে শয়ে শয়ে উড়ান বাতিল হয়। যার প্রভাব সরাসরি পড়তে শুরু করে
পর্যটন শিল্পে। কড়া হাতে সেই বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে হংকংয়ের
দাঙ্গা দমনকারী পুলিস। অতঃপর দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে হংকং-এর আন্দোলন। নিউ ইয়র্ক,
লন্ডন, প্যারিস, সিডনি-সহ
১২টি দেশের ২৯টি শহরে হংকং-এর স্বাধীনতার দাবি ওঠে। বিক্ষোভকারীরা ল্যামের
পদত্যাগের দাবিতেও সরব হন। তিন মাস ধরে যে দাবি নিয়ে পথে নেমেছিল হংকং, তার অন্যতম দাবিটি শেষ প্রযন্ত মেনে নিতে বাধ্য হন প্রশাসক ক্যারি ল্যাম। ৫
সেপ্টেম্বর বিকেলে টিভিতে এক বার্তায় তিনি জানান, বিতর্কিত
প্রত্যর্পণ বিল পুরোপুরি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর প্রশাসন। মানুষের
ক্ষোভ আর উদ্বেগ প্রশমনে এটাই যোগ্য সিদ্ধান্ত বলে তাঁর প্রশাসন মনে করছে বলেও জানান
ল্যাম। তবে প্রত্যর্পণ বিল প্রত্যাহারের পরও আন্দোলন বন্ধ হয়নি। কারণ, এই
আন্দোলনের দাবিদাওয়া ও গভীরতা বুঝতে পর্যবেক্ষকদের গাফিলতি রয়েছে। এটা শুধুমাত্র
একটা আইনবিরোধী হঠাৎ তৈরি হওয়া আন্দোলন নয়। এই আন্দোলনের পিছনে আমেরিকার ইন্ধন
খোঁজারও চেষ্টা চলছে। কিন্তু যড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে হংকংয়ের এই প্রতিবাদ অধ্যায়কে
বুঝতে যাওয়া বড় ধরনের সংকীর্ণতা। এই আন্দোলন কার্যত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির
কর্তৃত্ববাদী শাসনই চ্যালেঞ্জ করছে। এটাও আবার আন্দোলনের একটা দিক মাত্র।
চীনের
কাছে হস্তান্তরের আগে বহু যুগ হংকং ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ। হংকংয়ের স্থানীয় লোকজন
জাতিগতভাবে মূল চীনেরই কাছের। ভূখণ্ডটি হাতে পেয়ে চীন এখন ‘এক দেশ-দুই
ব্যবস্থা’ নীতিতে প্রশাসন চালাচ্ছে। অথচ, হংকংয়ের নিজস্ব
একটা আইনসভাও আছে। আছে কিছু স্বায়ত্তশাসনও। তবে এখানকার নেতারা কার্যত চীনের পুতুল
মাত্র। তাঁদের দায়বদ্ধতা যতটা হংকংবাসীর কাছে, তার চেয়ে
বহুগুণ চীনের নেতৃত্বের কাছে। কারণ, এই পদাধিকারী সর্বজনীন
ভোটে নির্বাচিত নন। বর্তমান প্রধান প্রশাসক ক্যারি ল্যামও তার ব্যতিক্রম নন।
স্থানীয় প্রশাসন সম্প্রতি আবাসন খাতে বড় বড় সব প্রকল্প নিচ্ছে, সেগুলোয় চীনের কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া কারবার হংকংবাসীর পুরোনো ক্ষোভে
জ্বালানি জুগিয়েছে। ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে মূল চীনের সঙ্গে হংকংয়ের যে সেতু হচ্ছে,
তা নিয়েও আপত্তি আছে। তারা মনে করছে, তাদের
অর্থে এভাবে মূল চীনের পুঁজিরই সমৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে। চীনের জন্য এটা উদ্বেগজনক
বার্তা। হংকংয়ের এলিটরা এত দিন চীনা ধাঁচের পুঁজিতন্ত্রের বিশেষ মিত্র হিসেবেই
ছিল। সেই ‘আস্থা’য় ঘা দিয়েছে খোদ চীনই।
হংকংয়ের
চলতি আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছাত্ররা। কিন্তু শুরু থেকে এই আন্দোলনে অন্য
পেশাজীবীদের নীতিগত সমর্থন আছে। স্বাধিকার চেতনার সমর্থনে দু–একবার প্রায় ১০
লাখ মানুষের মিছিলও হয়েছে। ৭০ লাখ জনসংখ্যার ভূখণ্ডে এত মানুষ যখন কোনও আন্দোলনে
শরিক হয়ে যায়, তখন সেটাকে মনোযোগ দিয়ে না দেখে উপায় থাকে না।
প্রত্যর্পণ বিল সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের পর, এখনও লড়াইয়ে রয়েছে
শত শত তরুণ-তরুণী। এরা অধিকাংশই স্থানীয় জাতীয়তাবাদী নেতা এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের
সমর্থক। লিয়ুংয়ের ছয় বছরের জেলজীবনের প্রথম বছর চলছে এই মুহূর্তে। দাঙ্গার অভিযোগে
এই সাজা। তাঁর আরও কয়েক সহযোগী একই মামলায় কারাগারে। ‘হংকং
ইন্ডিজেনাস’ নামে জাতীয়তাবাদী সংগঠনের স্বঘোষিত মুখপাত্র তাঁরা।
২০১৫ সালে এই সংগঠনের জন্ম। আর এখন তাঁরা ‘জাতি’র প্রেরণায় পরিণত হয়েছেন। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র থাকাকালে
২০১৬ সালে এক স্থানীয় নির্বাচনে লিয়ুংয়ের ৬০ হাজার ভোটপ্রাপ্তি থেকে বোঝা যাচ্ছিল,
চীনবিরোধী স্থানীয় জনমত কত ব্যাপক। সেই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকতে
দেওয়া হয়নি তাঁকে। হকারবিরোধী পুলিসের অভিযানের বিরুদ্ধে এক দাঙ্গায় যুক্ত থাকার
অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। এমনকি তাঁর ‘স্বাধীনতাপন্থী’
বক্তব্যের জন্য পরবর্তী যেকোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়
এই তরুণকে। এরপর তাঁকে পুরোপুরি থামিয়ে দিতেই ২০১৮ সালে ছয় বছরের দণ্ড দিয়ে
কারাগারে পাঠানো হয়। আদালতে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেননি যে রাস্তায় পুলিসের
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই সততা ও সাহসই বিদ্যুৎ চমকের মতো আলো ছড়িয়েছে
হংকংয়ের তরুণদের মধ্যে। তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছে, পরিবর্তনের এই লড়াই চলছে, চলবে।
লক্ষণীয়, শুধু সংহতি
আন্দোলন হয়েও এর দাবি কতখানি ব্যাপ্ত— ন্যায়বিচার নয়,
স্বায়ত্তশাসন নয়, একেবারে স্বাধীনতা! আসলে,
সামান্য দাবিই বদলাতে বদলাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। শাসকের
অত্যাচারের মাত্রাও সীমা অতিক্রম করেছে। হংকংয়ের রাজনীতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল মাত্রই বোঝেন,
প্রশাসক ক্যারি ল্যাম নিমিত্তমাত্র, পর্দার
আড়ালে খেলা পরিচালনা করছে বেজিং। প্রশাসন ও নাগরিকের সমঝোতা একেবারে দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার
কারণও তারাই। চীনে একদলীয় শাসন কায়েম, অতএব শাসকের বিরুদ্ধে
স্বর তোলার রেওয়াজ নেই। হংকংয়ের সেই প্রথা ভেঙেছে। আন্দোলনকারীদের মূল সুরও চীনের
বিরুদ্ধেই। হংকংয়ে ছাত্র আন্দোলনের নেতা এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের উত্থান ইঙ্গিত দিচ্ছে,
পরিবর্তনের রাজনীতি দুনিয়াব্যাপী থেমে নেই। পাল্টাচ্ছে কেবল তার
ধরন। পাল্টাচ্ছে ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রতিবিপ্লব’-এর মানে। কর্তৃত্ববাদীরা যত হুমকি দিয়ে
যাচ্ছে, তরুণরা ততই রাজনীতিতেই আগ্রহ দেখাচ্ছে। শহরের রাজপথও এখন পড়ুয়াদের কলরবে
উত্তাল।
গত ১০
অক্টোবর লিয়ুং কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতির জন্য হংকং হাইকোর্টে এলে হাজার
হাজার তরুণ-তরুণী সেখানে জমা হয়। অনেকে সকাল ছ’টা থেকে অপেক্ষা করছিল এডওয়ার্ড
লিয়ুংকে নিয়ে আসা প্রিজন ভ্যানটির জন্য। অপেক্ষাকারীরা কিছুক্ষণ পরপরই গাইছিল ‘এইটিন’ নামে একটি গান। যাকে এখন বলা হচ্ছে হংকংয়ের আন্দোলনকারীদের ‘জাতীয় সংগীত’। অনলাইনেই এই গানের প্রকাশ ও প্রসার। যার
মধ্যে সুর পেয়েছে ছাত্র রাজনীতির মূল্যবোধের সারাংশটুকু। তরুণ-তরুণীদের ভাষায় এই
গানের মধ্যে তারা খুঁজে পায় ‘হংকংয়ের গৌরব’। ইতিহাসের পরিহাস, এই ধরনের গৌরব নিয়েই মাও সে–তুংয়ের চীন একসময় জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিল। এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের
সমবয়সী ভক্তরা তাঁর মামলার খরচ জোগানোর জন্য অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সাড়ে তিন লাখ
হংকং ডলার জোগাড়ের ডাক দিলে ফেসবুকে ১৫ মিনিটে সেই অর্থ জোগাড় হয়ে যায়।
তাৎক্ষণিকভাবে ১ হাজার ২৬৮ জন ৪ লাখ ৫৩ হাজার হংকং ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করে
অভূতপূর্ব এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। অদ্ভুত বিষয়, যারা এই
অর্থ সংগ্রহ করছে এবং যারা দিচ্ছে, সবাই এডওয়ার্ড লিয়ুংকে
মনে করছে তাদের সাম্প্রতিক যাবতীয় তৎপরতার আধ্যাত্মিক উৎস হিসেবে। হংকংয়ের ইতিহাসে
এই প্রথম আদালত চত্বরে সম্মিলিত স্লোগান ওঠে, ‘হংকংকে মুক্ত
করো, এটাই আমাদের বিপ্লব’। কথাটি
লিয়ুংয়েরই। ২০১৬ সালে তিনি এই স্লোগান তুলেছিলেন। গত জুলাইয়ে কারাগার থেকে আন্দোলনকারীদের
উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে লিয়ুং বলেছেন, ‘তোমরা হংকংয়ের নতুন
ইতিহাস রচনা করছ।’ রাজপথে আগুন জ্বলতে এই একটি বাক্যের
ভূমিকা বিশাল। তবে হংকংয়ের পরিস্থিতি এখনও রাবার বুলেট আর কাঁদানে গ্যাসেই
সীমাবদ্ধ আছে। যদিও পুলিস এ খবরও জানাচ্ছে, ১৩ অক্টোবর
বিক্ষোভের সময় বোমার ব্যবহারও নাকি ঘটেছে। ফলে সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে ফরমান
জারি হয়েছে হংকংয়ে। মুখোশ পরা চলবে না। রং মেখে বা কাপড় বেঁধে আড়াল করা যাবে না
মুখ। সভা-সমাবেশ বা পথে কোনও ভাবেই গোপন করা যাবে না পরিচয়। প্রশাসনের সাফ কথা,
নিজেকে আড়ালে রেখে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আর বরদাস্ত করা হবে না। পাল্টা
জবাবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার মুখপাত্র মার্তা হুর্তাডোর মন্তব্য, ‘যে কোনও নিষেধাজ্ঞারই একটা আইনি ভিত্তি প্রয়োজন।’ আমেরিকার
তরফ থেকেও এই আন্দোলনের সমর্থনে সহানুভূতির কমতি নেই। এই দেখে, তৃতীয় বিশ্বের অনেকে এই আন্দোলনে আমেরিকার গোপন ইন্ধনও খুঁজছেন। যদিও এই আন্দোলনের
পিছনে রয়েছে স্থানীয় প্রচুর শ্রমিক সংগঠন। আছে ধনীরাও। আসলে এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের হাত
ধরেই নেতৃত্বহীন প্রত্যর্পণ বিলবিরোধী আন্দোলনের ভিতরে একটা পরিচয়বাদী রাজনৈতিক
সত্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে।
হংকংয়ের
বিদ্রোহ স্পষ্টত নতুন এক উপনিবেশবিরোধী চেতনা। যা প্রমাণ করছে বিখ্যাত সব
স্বাধীনতা ও বিপ্লবী আন্দোলনের পরও সমাজে উপনিবেশবাদী মনস্তত্ত্ব রয়ে যায় এবং তার
বিরোধিতারও জন্ম হয়। লিয়ুং সে রকম এক বিদ্রোহেরই প্রতীক। যিনি হংকং বিদ্রোহের মূল
নায়ক নন, কিন্তু সেখানকার তরুণ-তরুণীদের রাস্তায় পড়ে থাকতে তিনি প্রধান এক
উদ্দীপনা। তাঁর প্রভাবেই প্রত্যর্পণ বিলবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে হংকংয়ে ক্রমে দানা
বাঁধছে স্থানীয় ‘পরিচয়ের রাজনীতি’।
ইতিহাসে ‘উন্নয়নের রাজনীতি’র পাশাপাশি
এই পরিচয়ের রাজনীতির আবেদনও বড় কম নয়— প্রমাণিত হচ্ছে
বারবার।
No comments:
Post a Comment