Friday, January 17, 2020

ব্যাঙ্কের রাহুমুক্তি কবে? তাকিয়ে দেশের মানুষ


ব্যাঙ্কের রাহুমুক্তি কবে? তাকিয়ে দেশের মানুষ
নীরব মোদির প্রতারণা কাণ্ড ফিকে হয়নি। পিএনবিতে নীরবের জালিয়াতির অঙ্ক ছিল প্রায় ১৩ হাজার কোটিরও বেশি। ভুয়ো লেটার অব আন্ডারটেকিং ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিল ওই হিরে ব্যবসায়ীর সংস্থা। প্রতারণা কাণ্ডে নীরবের মামা মেহুল চোকসিও সঙ্গী হয়েছিলেন। এই মুহূর্তে নীরব লন্ডনের জেলে বন্দি। আর মেহুল নাগরিকত্ব নিয়েছেন অ্যান্টিগায়। এখনও উদ্ধার করা যায়নি সেই বিপুল টাকা। তার দেড় বছরের মাথায় জানা গেল আরও এক ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। জানা গেল, নতুন ঋণ জালিয়াতির শিকার হয়েছে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পিএনবি)। গত জুলাইয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কটি স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছিল, ,৮০০ কোটি টাকারও বেশি অঙ্কের জালিয়াতি হয়েছে। ভূষণ পাওয়ার অ্যান্ড স্টিলকে (বিপিএসএল) যা দেওয়া হয়েছিল। ব্যাঙ্কের অভিযোগ, সংস্থাটি সেই তহবিলই নয়ছয় করেছে। হিসেবের খাতায় গরমিল করেছে ঋণদাতাদের গোষ্ঠীর কাছ থেকে ধার নেওয়ার জন্য। গোটা বিষয়টি রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জানিয়েছিল পিএনবি। এখানেই শেষ নয়!
পিএনবি-র পর জালিয়াতির শিকার হয় পিএমসি! টানা ছ’-সাত বছর ধরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চোখে ধুলো দিয়ে হিসেবে গরমিল দেখিয়ে গিয়েছে পাঞ্জাব-মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক। আরবিআই-এর পাশাপাশি ব্যাঙ্কের পরিচালন বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট কাউকে কিছু না জানিয়েই হাউজিং ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড (এইচডিআইএল)-এর কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণকে নন প্রফিটেবল অ্যাসেট (এনপিএ) হিসেবে দেখাননি ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয় টমাস। আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে রিয়েল এস্টেট সংস্থা এইচডিআইএল। পিএমসি ব্যাঙ্কের কাছে এই সংস্থার দেনা গত কয়েক বছরে বাড়তে বাড়তে প্রায় ৪,৩৫৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যোগসাজশে ৪৪টি ঋণ অ্যাকাউন্টকে ২১,০০০টি ভুয়ো অ্যাকাউন্টে বদলানো হয়। চাপা দেওয়া হয় ঋণ খেলাপের ঘটনাও। কিন্তু আগে থেকে তার বিন্দু-বিসর্গও আঁচ করতে পারেনি আরবিআই। কারণ, বছরের পর বছর ধরে ব্যাঙ্কের এমডি এই সংস্থার অ্যাকাউন্টকে সন্দেহের তালিকায় রাখেননি। বরং আরবিআই-কে ভালো অ্যাকাউন্ট হিসেবেই দেখিয়ে এসেছে। ফলে এইডিআইএল চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। ওই ঋণও ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শেষ। ফলে সঙ্কট ঘনিয়ে আসে পিএমসি ব্যাঙ্কেও।
পিএমসি ব্যাঙ্কে ৪,৫০০ কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির জেরে কী হয়েছে জানেন? আর্থিক কেলেঙ্কারিতে চোট খাওয়া পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কোঅপারেটিভ (পিএমসি) ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলায় বিধিনিষেধ বসিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। গ্রাহকদের অভিযোগ, তার পর থেকে তাঁদের দুর্দশা শুধুই বেড়েছে। টালমাটাল পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের মধ্যে এক রকম আতঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। কেউ জমা টাকা তুলতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন, তো কেউ অস্ত্রোপচারের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে না পেরে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন। সেই মৃত্যু মিছিল চলছেই। কেউ ছেলেমেয়ের স্কুলের ফি দিতে পারছেন না। কারও আটকে গিয়েছে চিকিৎসা। টাকা তুলতে না পেরে কারও আবার সংসারের খরচ চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। ওই ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্ট বা ফিক্সড ডিপোজিট আছে যাঁদের, তাঁদের অনেকেরই আশঙ্কা সারা জীবন ধরে জমানো টাকা হয়তো হারাতে হবে। ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের প্রশ্ন, অডিটে এত বড় আর্থিক নয়ছয় ধরতে পারল না কেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক? তাতে দেশের মানুষের ব্যাঙ্কের প্রতি ভরসা কমছে। বাড়ছে অবিশ্বাসের আবহও।
সাম্প্রতিক কালে দেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে একের পর এক প্রতারণার অভিযোগ সামনে আসার পরে অস্বস্তি বেড়েছে মোদি সরকারের। সেই অস্বস্তি আরও কয়েক দফা বাড়িয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্ট জানিয়েছে, গত অর্থবর্ষে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে প্রতারণা-জালিয়াতির ঘটনা বেড়েছে আরও অনেকখানি। প্রায় ১৫ শতাংশ। শুধু তাই নয়, প্রতারণা সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতেই। জানা গিয়েছে, চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ছমাসে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে ৯৫,৭০০ কোটি টাকার বেশি প্রতারণা হয়েছে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতারণার ঘটনা ছুঁয়েছে ৫,৭৪৩টি। সম্প্রতি এই কথা জানিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। যেখানে তার আগের বছর ২,৮৮৫টি ঘটনায় নয়ছয়ের অঙ্ক ছিল ৩৮,২৬০ কোটি। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন্দ্র বার বার নজরদারিতে জোর দেওয়ার কথা বললেও, প্রতারণা এতখানি বাড়ছে কী করে? কে বা কারা করছে এই প্রতারণা? শীর্ষ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে যে সব প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, তার সিংহভাগ জুড়েই আছে ঋণ। এ পোড়া দেশে এ বড় লক্ষ্মীছাড়া সময়!
এখন প্রশ্ন হল, ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হলে আপনার সঞ্চয়ের টাকার কী হবে?
কে না জানে, বিভিন্ন ব্যাঙ্কে প্রতারণা-জালিয়াতির ঘটনার দায় এসে পড়ছে গ্রাহকদের উপর। পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র সমবায় (পিএমসি) ব্যাঙ্ক ফেল পড়ার পর দেশে ব্যাঙ্কে জমা টাকার উপর কম পরিমাণ বিমা নিয়ে বিতর্ক ফের শুরু হয়েছে। বর্তমান সময়ে যদি ভারতে কোনও ব্যাঙ্ক ফেল পড়ে, তাহলে কোনও গ্রাহক তাঁর জমা একলক্ষ টাকার বিমা দাবি করতে পারেন। তাঁর জমা যদি এক লক্ষ টাকার বেশি হয়, তাহলেও ঊর্ধ্বসীমা ওই এক লক্ষ টাকাই থাকবে। ব্যাঙ্ক ফেল পড়লে এক লক্ষ টাকার বেশি উদ্ধার করার কোনও আইনি উপায় গ্রাহকের কাছে নেই। এই পরিমাণ অর্থ ডিপোজিট ইনশিওরেন্স বলা হয়ে থাকে। এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমা টাকা ফেরত দেবে ডিপোজিট ইনশিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন (ডিআইসিজিসি)। এই সংস্থা সম্পূর্ণ ভাবে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মালিকানাধীন ভর্তুকিপ্রাপ্ত সংস্থা।
প্রশ্ন উঠেছে, আরবিআই কেন ইনস্যুরেন্স মানির উর্ধ্বসীমা বাড়াচ্ছে না?
১৯৬৮ সাল থেকে প্রথম এই ইনস্যুরেন্স চালু হয়। তখন ঊর্ধ্বসীমা ছিল পাঁচ হাজার টাকা। ১৯৭০ সালে আইনের সংস্কার হয়। ঊর্ধ্বসীমা পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে হয় ১০ হাজার টাকা। এর ছবছর পর ১৯৭৬ সালে ফের আইনের সংস্কার হয়। ১০ হাজার টাকা থেকে ইনস্যুরেন্সের ঊর্ধ্বসীমা বেড়ে হয় ২০ হাজার টাকা। অর্থাত্ ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হলে গ্রাহক সর্বাধিক ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা ফেরত পেতেন। তারপর ১৯৮০ সালে ঊর্ধ্বসীমা ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। আর শেষবার আইন সংস্কার হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। যখন এই ঊর্ধ্বসীমা ৩০ হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করে আরবিআই। কিন্তু তার পর ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও নতুন করে আর এই ঊর্ধ্বসীমার সংস্কার করা হয়নি। ফলে গ্রাহকদের ইনস্যুরেন্সের ঊর্ধ্বসীমা একই রয়ে গিয়েছে। আইনে অবশ্য এই ঊর্ধ্বসীমা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। সর্বাধিক পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত করা যেতেই পারে এই ঊর্ধ্বসীমা। যদিও এখনও আরবিআই সেই প্রস্তাব মেনে নেয়নি এখনও। ভয়ঙ্কর এই আতঙ্ক নিয়ে কোথায় যাবেন এদেশের মধ্যবিত্ত, গরিব মানুষ? অন্যদিকে, প্রবীণদের মূল আয় হল ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসের সুদ। দুর্ভাগ্যের হল, সুদের হার ক্রমশ কমছে। অন্য দিকে বাড়ছে খরচখরচা। বিপাকে পড়েছেন সুদ-নির্ভর মানুষরা। তাহলে কি বাজারশাসিত এই সমাজে অন্য কেউ আমার-আপনার কথা ভাববে না?
তার উপর সম্প্রতি জল্পনা ছড়িয়েছে, কেন্দ্র নাকি ফের এফআরডিআই বিল আনার কথা ভাবছে। অরুণ জেটলি অর্থমন্ত্রী থাকার সময় যে আমানত বিল আনার চেষ্টা করেছিল কেন্দ্র। তাতে প্রস্তাব ছিল, কোনও ব্যাঙ্ক দেউলিয়া ঘোষণার মুখে দাঁড়ালে গ্রাহকের অনুমতি ছাড়াই তাঁর জমা টাকা ব্যাঙ্ক চাঙ্গা করতে ব্যবহার করা যাবে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় শেষে বিলটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় কেন্দ্র।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, অনাদায়ী বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা আদায়ের দায়িত্ব কার? ব্যাঙ্কের বোর্ডগুলিরযারা এই ঋণ মঞ্জুর করেছে, সরকারের রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরযাদের তত্ত্বাবধানে ব্যাঙ্কগুলি চলে, সবার উপরে দায়িত্ব সরকারের। এরা কেউই তাদের দায়িত্ব পালন কেন করে না? শিল্পপতিরা বিপুল ঋণ নিয়ে তা মেটাচ্ছেন না কেন? তাদের অজুহাত, শিল্প রুগ্ন, তাই ঋণ অনাদায়ী। বাস্তবে কোনও শিল্পপতিকেই রুগ্ন দেখা যাচ্ছে না। তাদের  মুনাফার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তা ছাড়া কোনও শিল্প রুগ্ন হলে তার দায় কি সাধারণ মানুষের? মালিকরা যখন শতসহস্র কোটি টাকা মুনাফা করে তার ভাগ তো তারা জনগণকে দেয় না! তাহলে তাদের দায় সাধারণ মানুষ নেবে কেন?
এফআরডিআই বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিল, আর্থিক সঙ্কটে ব্যাঙ্ক দেউলিয়ার মুখে থাকলে, আমানতের টাকা গ্রাহকের অনুমতি না নিয়েই বাড়তি সময় আটকে রাখতে পারবে ব্যাঙ্ক। গ্রাহকের সঙ্গে সবরকম চুক্তি অস্বীকার করে জমা টাকার উপর সুদের হার কমাতেও পারবে। এমনকী প্রয়োজনে তা বদলে দিতে পারবে শেয়ার, ডিবেঞ্চার বা বন্ডে। বিরোধীদের তোপ, আসলে এফআরডিআই বিল তথা ফিনান্সিয়াল রেজলিউশন অ্যান্ড ডিপোজিট ইনসিওরেন্স বিল মানে, ঋণ নেবে ধনকুবেররা, শোধ করবে জনগণ।
দেশে ব্যাঙ্কের এই রাহুমুক্তি কবে? তাকিয়ে দেশের মানুষ।

No comments:

Post a Comment