জিন্নার
দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যর্থতা যেন ভুলে না যাই
ব্রিটিশ
শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্বের (টু-নেশন থিওরি) প্রবক্তাদের মধ্যে
প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না। দ্বিজাতিতত্ত্বের কনসেপ্ট বা
ধারণা ছিল, ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমরা শুধু ধর্মীয়ভাবেই আলাদা জাতি নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি, এমনকি শিক্ষাগত ও
অর্থনৈতিক দিক দিয়েও তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। এই বাস্তবতা এবং
যৌক্তিকতার ভিত্তিতে ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের
বার্ষিক সম্মেলনে মুসলিম জাতির জন্য একটি আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি
ওঠে। এরপর ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের সাধারণ সম্মেলনে
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব ওঠে। প্রস্তাবে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত
উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং পূর্ব অঞ্চল নিয়ে দু’টি আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সম্মেলনে এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশ্য
পরবর্তীকালে এই প্রস্তাব অনুযায়ী দু’টি আলাদা অঞ্চল নিয়ে ‘পাকিস্তান’
নামে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিকশিত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয় এবং এই ভূখণ্ডে স্বাধীন
ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রদ্বয়ের সৃষ্টি হয়। যদিও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হওয়ার মধ্য
দিয়ে মুসলিম লিগের সেই দ্বিজাতিতত্ত্ব মোক্ষম ঘা খেয়েছিল।
জিন্নার
সেই ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ পাকিস্তানকে কী দিয়েছে?
পাকিস্তান
নামক রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই গণতন্ত্র সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজও সেনাবাহিনী
আর ভুস্বামীদের কথায় দেশ চলে। আজও পাকিস্তানে সামন্তবাদী মানসিকতার ক্ষমতাধর এক
শ্রেণির মানুষ আর সেনাবাহিনী মনে করে, জনগণ হল প্রজা, তাদের
শাসন করতে হবে। তাই দেশটিতে গণতান্ত্রিক কাঠামো কখনওই গড়ে তুলতে দেওয়া হয়নি। যার
খেসারত সবসময় দিতে হয়েছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে। সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে
দেওয়া হয়নি সংখ্যালঘু কোনও সম্প্রদায়কেই। এসব কারণেই আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়
সেখানে জঙ্গিবাদের চাষ হয়েছে। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগ, তারা জঙ্গিদের শুধু প্রশিক্ষণই নয়, কাড়ি কাড়ি অর্থও
দিয়ে থাকে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরোধিতায় তালিবানদের সরাসরি
পৃষ্ঠপোষকতাই শুধু নয়, প্রশিক্ষণও দিয়েছে পাকিস্তানের সামরিক
গোয়েন্দা সংস্থা, ‘আইএসআই’। পাকিস্তান
মানেই আজ সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত, নির্যাতিত, ধর্মীয় কট্টরপন্থী সংগঠনগুলির বাড়বাড়ন্ত।
স্বাধীনতার পর যে আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেছে, সেই আগুনেই জ্বলছে পাকিস্তান।
স্বাধীন
হওয়ার পরে ভারত জিন্নার পথে না হেঁটে অত্যন্ত দ্রুত গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু
করে। যেখানে ধর্মকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দেশ গড়া অর্থনীতিকে।
পাকিস্তান সে পথ নেয়নি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালেই সাধারণ নির্বাচন হয়
ভারতে। নতুন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীনতার ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালে
প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মুখ দেখে। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর পর ১৯৫১ সালের ১৬
অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। দীর্ঘ
দিন গণতন্ত্রের পথে না হাঁটায় স্বাধীনতার পর প্রায় দু’দশক ধরে
পাকিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল হয়েছে কোনও নির্দিষ্ট নীতি না মেনে।
রাষ্ট্রচালনায় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অযথা দেরি হওয়ায় সেনাবাহিনী শাসন
ক্ষমতায় নাক গলানোর সুযোগ পেয়েছে। ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইসকান্দর মির্জা এবং
সেনাপ্রধান আয়ুব খান হাত মিলিয়ে পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থান ঘটান। দেশে মার্শাল ল
জারি হয়। সংবিধান বাতিল ঘোষিত হয়। খুব দ্রুত জেনারেল আয়ুব খানই হয়ে ওঠেন
পাকিস্তানের প্রধান নিয়ন্ত্রক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির অকুণ্ঠ
সহযোগিতায় আয়ুব খানের জমানায় পাকিস্তানের দ্রুত অগ্রগতি শুরু হয়। কিন্তু ১৯৬৫ সালে
আয়ুব ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ান। সেই যুদ্ধে পাক সেনা অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন
হয়। পাক অর্থনীতিও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৭১-এর
যুদ্ধের পরও পাকিস্তান গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সংবিধান বদল হয়।
জুলফিকার আলি ভুট্টোর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে আবার
সেনা অভ্যুত্থান ঘটান জেনারেল জিয়া উল হক। ক্ষমতা দখল করেই থামেননি জিয়া। তাঁর
নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রশাসন-সেনা-রাজনীতির ঢেউ থেকে
বাঁচেনি পাক বিচারব্যবস্থাও। জিয়ার আমলেই সন্ত্রাস বাসা বাঁধতে শুরু করে
পাকিস্তানে। পাকিস্তান তখন প্রতিবেশী আফগানিস্তানের তদানীন্তন সোভিয়েত ঘনিষ্ঠ
সরকারকে অস্থির করে তুলতে জঙ্গি তৈরি করা শুরু করে বলে অভিযোগ। পাকিস্তানেই তৈরি
হয় জঙ্গি শিবির। শুরু হয় সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অস্ত্র জোগানো।
আজ সন্ত্রাসে আক্রান্ত হচ্ছে পাকিস্তান নিজেও। সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর পাকিস্তান—
এমন অভিযোগ ওঠায় অনেক পুরনো মিত্র দেশের থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে
তারা।
জেনারেল
জিয়াউল হক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৭৮ থেকে ’৮৮ পর্যন্ত। ’৮৫-তে প্রধানমন্ত্রী হন খান মহম্মদ জুনেজো। ১৯৮৮-র মে মাসে জেনারেল জিয়া
প্রধানমন্ত্রী জুনেজোকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু এর ফলে পাকিস্তানের রাজনীতির
স্থায়িত্ব নষ্ট হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর বেনজির ভুট্টো বসেন প্রধানমন্ত্রীর তখতে।
পাকিস্তানের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির
অভিযোগ তুলে তাঁকে সরান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গুলাম ইশাক আলি খান। তিনি সংসদ ভেঙে
দিয়ে ভুট্টোকে বরখাস্ত করে দেন। ১৯৯০ সালে নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় আসেন। তিন বছর পর
গুলাম ইশাক খান আবার সংসদ ভেঙে দেন। তিনি ভোট ঘোষণা করেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট
বলে, এই নির্দেশ অবৈধ। ১৯৯৭-এ নওয়াজ প্রবল পরাক্রান্ত
প্রধানমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্ট তখন পাঁচ জন বিচারপতিকে নিয়োগ করে সেই নওয়াজেরই
বিরুদ্ধে তদন্ত করায়। পারভেজ যখন নওয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তখনও বিচারব্যবস্থা
পারভেজের পক্ষেই ছিল। ২০০৭ সালে রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকত বাগে গুলি করে হত্যা করা হয়
বেনজিরকে। বেনজির ভুট্টো হত্যা মামলায় কোর্টে হাজিরা না দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বিশেষ আদালত। তারপর আবার ক্ষমতায় নওয়াজ। আর
সেনাবাহিনীর মদতে কীভাবে সেই নওয়াজকে পরাজিত করে মসনদে বসেছেন ইমরান— তা সকলেরই
জানা। এই তো পাকিস্তানের প্রতিহিংসার রাজনীতির ইতিহাস।
অন্যদিকে
জিন্নার পথে না হেঁটে ভারতের শাসনযন্ত্রে কোনওদিন সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। স্বাধীনতার
সাত দশকেও ভারতের মাটিতে কখনও সামরিক অভ্যুত্থানও হয়নি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার
পালাবদলে যথানিয়মে জনগণের ভোটের মাধ্যমেই রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছে।
বিশ্ব ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, পাকিস্তানের মতো ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা
কোনও দেশ কোনও দিনও স্থিতিশীল থাকেনি। জিন্নার সেই ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ পাকিস্তানকে আজ
ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। স্বাধীনতার কয়েক মাস পর জিন্না যখন ঢাকায় আয়োজিত এক
জনসভায় উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা করেন, তখনই বাঙালিদের
প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হয়েছিল। বাঙালিরা গভীর
দুঃখের সঙ্গে উপলব্ধি করে, ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে
মুক্ত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্বের খড়্গ তাদের উপর নেমে আসছে।
উপস্থিত জনতা এই ঘোষণায় মৃদু প্রতিবাদ করা থেকে ক্রমান্বয়ে প্রতিবাদমুখর হয়। এর
ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন। এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
স্বাধীন
রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পাকিস্তানের নেতারা নিজেদের দেশকে বলতেন ‘এশীয় বাঘ’। কিন্তু স্বাধীনতার পর সাতটা দশক কাটিয়ে এসে গোটা বিশ্বের কাছে
পাকিস্তানের পরিচিতিটা কিন্তু অন্য রকম। ধর্ম পাকিস্তানকে কী দিয়েছে জানেন? বিশ্ব
অর্থনীতির বিশ্লেষক যাঁরা, তাঁদের অনেকেই বলেন, পাকিস্তান ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’।
কেউ কেউ বলেন, পাকিস্তান একটি ‘দুর্বৃত্ত
পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র’। আর পাকিস্তান যে সন্ত্রাসবাদের
কারখানা হয়ে উঠেছে, তা তাদের বহু পুরনো মিত্র আমেরিকাও এখন
বার বার বলছে। একইসঙ্গে স্বাধীন হয়েছিল ভারত। অর্থনৈতিক এবং সামরিক সক্ষমতায় ভারত
আজ গোটা বিশ্বের সমীহ আদায় করছে। কিন্তু প্রবল আর্থিক সঙ্কট, সন্ত্রাসবাদের রমরমা আর ভঙ্গুর গণতন্ত্র নিয়ে পাকিস্তান হাঁসফাঁস করছে। ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’-এর
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের হাতে পাকিস্তানই রক্তাক্ত।
এই
জাতপাত, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির ভয়ঙ্কর দিকের আগাম আঁচ পেয়ে ২০১৫ সালে নেপালও বদলে
নিয়েছে তাদের সংবিধান। ৬৫ বছর পর সংবিধানে লেখা হয়েছে, নেপাল এক
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দীর্ঘদিন থেকে নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করার দাবিকে
নস্যাৎ করে ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েছে নেপাল। ধর্মীয় ও
সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, একইসঙ্গে প্রাচীনকাল থেকে যে ধর্মচারণ
ও সাংস্কৃতিক ধারা অব্যাহত রয়েছে তার সুরক্ষাদান। সংবিধানে জাতপাতগত ছুৎমার্গ ও
ভেদপন্থাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। নেপালও জানে, দেশ গড়ার রাজনীতি-অর্থনীতিকে
গুরুত্ব না দিয়ে, ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করলে কী হয়— পাকিস্তানই বড় প্রমাণ।
আশঙ্কা
একটাই— সেই পাকিস্তানকে সবক শেখাতে গিয়ে আমরাই যেন পাকিস্তানের মতো না হয়ে যাই!
No comments:
Post a Comment