Monday, June 24, 2013

us vs soviet

কমিউনিস্ট বিরোধী ষড়যন্ত্রের
শিকার হয়েছিলো সোভিয়েতও

মহান নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন হওয়ার সময়কাল থেকেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মেও ১৩,০০০মার্কিন সেনা ঘঅঁটি গেড়ে বসেছিলো সোভিয়েত ভূখণ্ডে টানা ২বছর ধরে লাগাতার হিংসা ছড়িয়েও আঁতুড়ঘরে সোভিয়েত রাষ্ট্রকে বিনাশ করার প্রচেষ্টা সার্থক হয়নি ব্রিটেনের তৎকালীন যুদ্ধমন্ত্রী উইন্সস্টন চার্চিল প্রতিবিপ্লবীশ্বেত সৈন্য-র জোটকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, গ্রেট ব্রিটেনসহ বহু রাষ্ট্রের এই সৈন্যবাহিনীর যথেচ্ছভাবে সোভিয়েতের নাগরিকদের হত্যা করেছে সোভিয়েত সরকারের শত্রুদেরকে অস্ত্র জোগানো, বন্দরে অবরোধ সৃষ্টি করা, যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেওয়াসহ সমস্ত রকমের আগ্রাসনমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল এই জোটবাহিনী প্রশ্ন উঠতেই পারে বলশেভিক বিপ্লবের মধ্যে কী এমন বিষয় ছিল যা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল? কী স্বার্থে তারা এমন একটি দেশ অভিযান করে যেখানকার সামরিক বাহিনী দীর্ঘ তিন বৎসর সময়কাল ধরে টানা লড়াই চালিয়েছে, চূড়ান্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে যা বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন পক্ষের কোন দেশকে এত জীবনহানি ঘটেনি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়াকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বলশেভিকরা জার্মানির সঙ্গে পৃথক শান্তিচুক্তি পর্যন্ত করেছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসানের লক্ষ্যে রাশিয়ার বুকে পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎখাত করে বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন বলশেভিকরাই বিশ্ব ইতিহাসের এই স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় ছিল জোট শক্তির পক্ষে ভীতিপ্রদ তাই, অন্ধ কমিউনিস্ট বিরোধিতার আবহাওয়া তৈরির সার্বিক প্রয়াস শুরু হয়েছিল সেই সময়কাল থেকেই শুরু হয়েছিলো ঠাণ্ডা যুদ্ধ
সোভিয়েত রাষ্ট্রের উপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হানাদারির প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও ঠাণ্ডা যুদ্ধ বিশারদ ডি এফ ফ্লেমিং লিখেছেন‘আমেরিকার জনগণের উপর রাশিয়া হস্তক্ষেপের কোন প্রভাব অবশিষ্ট নেই বহুদিন মানুষ তা বিস্মৃত হয়েছেন কিন্তু সোভিয়েত জনগণ সে দেশের নেতৃত্বের কাছে সময়টি ছিল অগুনতি হত্যা, লুঠপাটে ঘটনাবহুল প্লেগ মহামারীর কবলে লক্ষ লক্ষ দেশবাসী যা কয়েক প্রজন্মের পক্ষে বিস্মৃত হওয়া অসম্ভব সোভিয়েত রাষ্ট্রকে সতর্ক থাকতে হয়েছে পুঁজিবাদী আক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে ১৯৫৯ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ক্রুশ্চেভ নিউ ইয়র্কে তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন যে সেই সময়ে আপনারা সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন বিপ্লব দমনের উদ্দেশ্যে ইতিহাস আমাদের একথা বলে না যে স্বাভাবিক পরিবেশে বিকাশ সম্ভব ‍‌লে সোভিয়েত ইউনিয়ন কী হতে পারতো এই রাষ্ট্র শৈশবে আক্রান্ত হয়েছে চূড়ান্তভাবে, তা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এর পরেই পশ্চিমী শক্তির প্রচ্ছন্ন মদতে চেপে বসেছে নাৎসি বাহিনীর আক্রমণ
লক্ষ্য করুন, কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার শুরু হয়েছিল সামরিক হস্তক্ষেপের পূর্বেই ১৯১৮সাল শেষ হওয়ার আগেই নিউইয়র্ক টাইমসের পাতায়লাল বিপদ’, ‘সভ্যতার উপর বলশেভিক আক্রমণএবংবিশ্বে লালদের বিপদ লক্ষ্য করা যাচ্ছেশীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৯১৯সালের ফেব্রুয়া‍‌রি মার্চ মাসে মার্কিন সেনেটের বিচার সংক্রান্ত উপসমিতির সভায়বলশেভিকদের ভয়াবহ গল্পউপস্থিত করা হয় ‘মহিলাদের প্রকাশ্য রাস্তায় বিবস্ত্র করছে উন্মত্ত জনতা’— এইসব কল্পকাহিনীর উদ্দেশ্যই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে হিংস্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন করা ঐতিহাসিক ফ্রেডেরিক লুইস শ্যুম্যান লিখেছেন, সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে এধরনের প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল, একটা নৃশংস সংগঠনের হাতে ক্রীতদাসত্বের জীবন কাটাচ্ছে মানুষ-এমনই বার্তা গোটা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া। যার প্রধান লক্ষ্য হলো সভ্যতার সকল চিহ্ন মুছে ফেলে দেশটাকে আবার অতীতের বর্বরতার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া শ্যুম্যান আরও লিখেছেন, ‘মহিলাদের জাতীয়করণ করা থেকে শুরু করে শিশুদের খাওয়া নিয়ে সমস্তরকমের বিকৃত প্রচার চলেছিল মহিলারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ, বাধ্যতামূলক বিবাহ, ‘মুক্ত প্রেমপ্রভৃতি নানা মিথ্যাচার তখন আমেরিকা, বিদেশে হাজারো চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়েছে এর পরিণতিতে বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিকের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল যে রাশিয়ার কমিউনিস্টরা হলো দুশ্চরিত্র-অপরাধী
১৯১৯সালেরশেষার্ধ্বে পরাজয় আসন্ন হলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার জোট সঙ্গীদের সমর্থনে প্রচার মাধ্যম আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে নিউইয়র্ক টাইমস ৩০শে ডিসেম্বর ১৯১৯ সংবাদ শিরোনাম করে, লালেরা আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধাতে চাইছে’, ১৬ই জানুয়ারি, ১৯২০ ওই পত্রিকার প্রথম পাতায় আট কলাম শিরোনাম ছিলো, ব্রিটেন লালদের সঙ্গে যুদ্ধের সম্মুখীন, প্যারিসে কাউন্সিল সভার আহ্বান,পরের দিনেই সংবাদ প্রকাশিত হয়,রাশিয়ার সঙ্গে কোন যুদ্ধ নয়, জোট শক্তি তাঁর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী’ আবার ৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯২০-তে লালরা ভারত আক্রমণে উদ্যতশীর্ষক মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করা হয় ১১ই ফেব্রুয়ারি আতঙ্ক ছড়ানো হয়,আশঙ্কা হচ্ছে, বলশেভিক এবার জাপান আক্রমণ করবে পরিহাসের বিষয় হলো, নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাঠকদের এটা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছিলো যে এই সকল আগ্রাসনের কেন্দ্রবিন্দু যে দেশ, তারা তখন চূড়ান্ত বিধ্বস্ত এক বর্বর গৃহযুদ্ধে শামিল বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলির মদত প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে, বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে যারা তখনো মুক্ত হতে পারেনি শিল্পে উন্নতি থেকে বহু দূরে, দু‍‌র্ভিক্ষের মুখোমুখি একটি রাষ্ট্র ধরনের পরিকল্পনা করছে যা বাস্তববোধ রহিত নিউ রিপাবলিক পত্রিকা ১৯২০সালে রাশিয়া বিপ্লব আগ্রাসন সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন সংক্রান্ত একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ প্রকাশ করে তাতে বলা হয়— দেখা যাচ্ছে, ১৯১৭সালের নভেম্বর মাস পরবর্তী ২বছরে পত্রিকাটি অন্তত ৯১বার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে যেসোভিয়েত সৈন্য তাদের দিকে এগিয়ে আসছে বা এসে পড়েছেএই যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির সংবাদপত্রের চেহারা হয় তাহলে কল্পনা করা যেতে পারে সে দেশের বাকি সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে পাঠকদের কাছে কী সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছিল বিশ্বে এক নতুন গড়ে ওঠা সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মার্কিন জনগণের অভিজ্ঞতা প্রাথমিক শিক্ষা ধরনের হয়েছিল কমিউনিজম সম্পর্কে এই চিন্তাস্রোত কখনো থেমে থাকেনি সামরিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হয়েছিল, কিন্তু অপপ্রচার স্তব্ধ হয়নি শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলিতে কিছুটা স্তিমিত হয়েছিল মাত্র
১৯৪৩সালে ‘লাইফ’ সাময়িকীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কমরেড লেনিন সম্পর্কে বলা হয়েছিলসম্ভবত আধুনিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ কিন্তু মাত্র ২বছর পরেই হোয়াইট হাউসে হ্যারি ট্রুম্যান আসবার পরে এই ভ্রাতৃত্ববোধ উবে যায় নাৎসিবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার পরের দিনেই হ্যারি ট্রুম্যান বলেছিলেন —‘আমরা যদি দেখি যে জার্মানি জিততে চলেছে, তাহলে আমাদের উচিত রাশিয়াকে সাহায্য করা আর যদি রাশিয়া জেতে তাহলে আমাদের উচিত হবে জার্মানিকে সাহায্য করা আমরা চাই এভাবে কমিউনিস্টরা যতো ইচ্ছে মরুক যদিও হিটলার কোনভাবে বিজয়ী হোক তা আমি বাসনা করি না‘১৯২০সালের লাল সন্ত্রাস থেকে শুরু করে ১৯৫০- দশকে ম্যাকার্থিহিজম, ১৯৮০- দশকে শয়তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রেগনের ধর্মযুদ্ধ’, এইসব প্রচারে মার্কিন জনগণকে বাধ্য হতে হয়েছে বিরামহীন কমিউনিস্ট বিদ্বেষী মতবাদ গলাধঃকরণ করতে কমিকস, স্কুল পাঠ্য বই, দৈনিক সংবাদপত্রে সব কিছুর মাধ্যমেই এই জঘন্য বিদ্বেষ ছড়ানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে, ৪০‍‌ঊর্ধ্ব মার্কিন নাগরিকরা প্রায় ২৫বছর একটানা কমিউনিস্ট বিদ্বেষী প্রচারের বৃত্তে থাকবার ফলে দেখা গেছে, কমিউনিস্ট বিদ্বেষী মনোভাব একটা নিজস্বতা তৈরি করে নিয়েছে যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মার্কিন বিদেশনীতি গড়েই ‍‌ঠেকমিউনিস্টমিউনিস্ট বিদ্বেষীএই ধারণাকে কেন্দ্র করে তখন বিশ্বের দেশে দেশে মার্কিন সংস্থা সি আই - গুপ্ত অভিযানের সাফাই গাওয়া হয়েছে সোভিয়েত গোয়েন্দা বাহিনী কে জি বি- পালটা পদক্ষেপ হিসেবে সি আই - প্রাক্তন আধিকারিক জন স্টকওয়েল লিখেছেন, তাঁর ১২বছরের কর্মজীবনে তিনি কখনো শোনেননি বা দেখেননি যে কে জি বি কোনভাবে সি আই - ওপর আক্রমণ করেছে বা তার অভিযানে বাধা দিয়েছে অথচ, এই কে জি বি-কে নিয়েই কতো গল্প ফাঁদা হয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কমিউনিস্ট বিদ্বেষী মনোভাবের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গভীর উপলব্ধি হলো ‍‌ যে, সো‍‌ভিয়েত ইউনিয়নসহ কিউবা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশসমূহের ‘কমিউনিস্ট গুপ্ত সংগঠন’ যে কোনো সময় বিপ্লবের ফণা তুলতে পারে বা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এখানে, ওখানে বা সর্বত্র

No comments:

Post a Comment