কালো
টাকা
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন অন্যতম প্রধান
চর্চিত বিষয় হলো কালো টাকা। সাম্প্রতিককালে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে কালো
টাকা সংক্রান্ত নানান তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ায় ইউ পি এ সরকার যেমন বেকায়দায় পড়ে গেছে
তেমনি বিরোধীরাও সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে উঠে পড়ে লেগেছে। বিপুল পরিমাণ কালো
টাকা এবং ক্রমাগত তা বেড়ে যাওয়ার প্রশ্নে, মোট কালো টাকার সিংহভাগ বিদেশে
পাচার হয়ে যাবার প্রশ্নে বিরোধীরা আঙুল তুলছেন সরকারের প্রশ্রয় ও অপদার্থতার দিকে।
সম্প্রতি অর্থনীতি ও রাজনীতির আঙিনা থেকে বিষয়টি আদালতের আঙিনায় প্রবেশ করেছে।
কালো টাকার প্রশ্নে উদ্বিগ্ন সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকার তীব্র
সমালোচনা করেছে। জনগণের শ্রমে সৃষ্ট সম্পদ সরকারের প্রশ্রয়ে বেআইনীভাবে পরিণত
হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ব্যক্তিগত সম্পদে। আর সেই বেআইনীভাবে অর্জিত সম্পদের
বেশিরভাগ গোপনে জমা হচ্ছে বিদেশী ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে। এইসব জেনে বুঝেও
নিষ্ক্রিয় ও শিথিল মনোভাব নিয়ে চলেছে কেন্দ্র। এই টাকা উদ্ধারের ন্যূনতম সদিচ্ছা
তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অথচ অর্থের অভাবে নাকি রেশন ব্যবস্থা চালু রাখা
যাচ্ছে না, গরিব
মানুষের স্বার্থে সমাজ কল্যাণমূলক ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়ণ করা যাচ্ছে না। ইউ
পি এ সরকার কালো টাকা উদ্ধারে শিথিল ও নিষ্ক্রিয় মনোভাবের পরিচয় দিয়েই ক্ষান্ত
থাকছে না। কালো টাকার মালিকদের নাম জানা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করছে না এবং তাদের
বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সবচেয়ে গুরুতর বিষয় যে পথে প্রতিবছর
হু হু করে কালো টাকা বাড়ছে সে পথ বন্ধ করারও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। কংগ্রেস
নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা
কালো টাকার কারবারীদের আড়াল করতেই বেশি ব্যস্ত।
গত লোকসভা
নির্বাচনের আগে কালো টাকা নিয়ে বিরোধীরা ইউ পি এ সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ
তোলে। কালো টাকা উদ্ধার এবং কালো টাকার উৎসমুখ বন্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারের
নিষ্ক্রিয়তাকে সামনে আনে বামপন্থীরা। তখন নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী
মনমোহন সিং প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন তাঁরা ফের ক্ষমতায় এলে ১০০দিনের মধ্যে কালো
টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবেন। ইতোমধ্যে ইউ পি এ-টু সরকার ৫০০
দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই সময়কালে একবারের জন্যও
কালো টাকা উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর কোনো সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়নি। কালো টাকার
প্রশ্নে কংগ্রেস যে ভোটের আগে মানুষকে ভাঁওতা দিয়েছিলো এখন তা দিনের আলোর মতো
পরিষ্কার।
কালো
টাকা বলতে কি বোঝায়
বিভিন্ন
ফৌজদারি ও দেওয়ানিবিধি,
কর আইন, কাস্টমস-এর
নিয়ম, ভ্যাট
এবং ব্যাঙ্কবিধি লঙ্ঘন করে যে অর্থ অসৎ ব্যক্তি ও সংস্থা গোপনে নিজেদের আয়ত্তে
রাখে এবং বিদেশের ব্যাঙ্কে জমায় তাকেই সাধারণভাবে কালো টাকা বলা হয়। অর্থাৎ যে
টাকা বেআইনী পথে অসৎ উপায়ে,
সরকারী কর্তৃপক্ষের অগোচরে, কর ফাঁকি দিয়ে আয় করা হয় বা হস্তান্তরিত করা হয় অথবা ব্যয়
করা হয় সেটাই কালো টাকা। তেমনি ইতোমধ্যে অর্জিত কালো টাকা বেআইনীভাবে বিনিয়োগ করে
বা বেআইনী ব্যবসায় খাটিয়ে যে মুনাফা অর্জিত হয় সেটাও কালো টাকা।
ভারতে কালো
টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি নতুন ঘটনা নয়। স্বাধীনতার সময় থেকেই কালো টাকার
বাড়বাড়ন্ত দৃশ্যমান। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস পুঁজিপতিদের মুনাফা সৃষ্টিকারী
বড়লোক ঘেঁষা যে নীতি গ্রহণ করে তার অন্যতম পরিণতি কালো টাকার বৃদ্ধি। সরকারের
দুর্বলতা, কালো
টাকা রোধে শিথিল মনোভাবই ভারতে কালো টাকার পাহাড় তৈরিতে সাহায্য করেছে। প্রয়াত
জননেতা জ্যোতি বসু প্রায়শই বলতেন দেশে কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি রমরমিয়ে
চলছে। এই কালো টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হলে দেশের দারিদ্র্য হ্রাস ও সামগ্রিক
উন্নয়নের কাজ অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, গত ছয়
দশকেরও বেশি সময়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কোনো সরকারই কালো টাকা উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ
নেয়নি। ফলে প্রতিবছরই দুরন্ত গতিতে বেড়ে উঠেছে কালো টাকার পরিমাণ। আজ কালো টাকা নিয়ে
বি জে পি হইচই করলেও এন ডি এ আমলে এই প্রশ্নে তাদের ন্যূনতম সদিচ্ছাও দেখা যায়নি।
আসলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই লুকিয়ে আছে কালো টাকার উৎসমুখ। তাই
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে অথচ কালো টাকা বাড়বে না সেটা অবাস্তব কষ্ট কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। পুঁজিবাদ
বিকাশের বর্তমান স্তরে নব্য উদারনীতিতে সরকারী নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি শিথিল। পুঁজির
মুনাফা সৃষ্টির পথে বাধা সৃষ্টিকারী সরকারী বিধিগুলি এখানে যেমন অনেকটাই
প্রত্যাহৃত হয়েছে তেমনি সরকারীবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সরকারী নজরদারি ও
লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধিও শিথিল হয়ে গেছে। ফলে উদারনীতিতে কালো টাকার
সমান্তরাল অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটছে এবং শক্তিশালী হচ্ছে।
কালো
টাকার গন্তব্য
কালো টাকার
স্বর্গরাজ্য হিসেবে সারা বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত নাম সুইজারল্যান্ড। সুইজারল্যান্ড
হলো আয়করমুক্ত দেশ। এখানে আয়ের জন্য কাউকে কর দিতে হয় না। তাই সুইজারল্যান্ডের
ব্যাঙ্কে নিরাপদে যত খুশি অর্থ জমা রাখা যায়। তাছাড়া সুইজারল্যান্ডের আইন অনুযায়ী
সুইজ ব্যাঙ্কে আমানতকারীদের নাম, জমা অর্থের পরিমাণসহ যাবতীয় তথ্য কঠোরভাবে গোপন রাখার
ব্যবস্থা আছে। এই সুযোগ থাকার ফলে সারা পৃথিবীর কালো টাকার কারবারীরা তাদের
বেআইনী টাকা নিরাপদে ও গোপনে রাখার জন্য বেছে নেয় সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কগুলিকে।
কালো টাকার
স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত হলেও আজ আর সুইজারল্যান্ড একা নয়।
বিশ্বের বহু জায়গায় বিশেষ করে দ্বীপাঞ্চলে এমন করমুক্ত কালো টাকার নতুন নতুন গন্তব্য
আত্মপ্রকাশ করছে। আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের স্বার্থে যত বেশি বেশি করে
উদারনীতির প্রয়োগ বাড়ছে ততই বেড়ে চলেছে কালো টাকা মজুতের নিরাপদ জায়গা। বর্তমানে
সারা বিশ্বে ৯১টি জায়গা আছে যেখানে সারা বিশ্বের কালো টাকার মালিকরা তাদের টাকা
লুকিয়ে রাখে। আগে কালো টাকার প্রধান গন্তব্য ছিলো ইউরোপ এবং ইউরোপের ঔপনিবেশিক
দেশগুলির অধীনস্ত কিছু দ্বীপ। পরবর্তীকালে আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে
এই গন্তব্য সম্প্রসারিত হয়। সাম্প্রতিককালে, বিশেষ করে বিগত দু’দশকে
এশিয়ায়ও বেশ কিছু কালো টাকার স্বর্গরাজ্য তৈরি হয়েছে। আফ্রিকাতেও
কালো টাকার স্বর্গরাজ্য তৈরি হতে শুরু করেছে। বিশ্বায়ন তথা উদারনীতির ফলে
বিধিনিষেধ যত শিথিল হচ্ছে ততই কালো টাকার নিরাপত্তা দেবার ব্যবস্থা প্রসারিত
হচ্ছে। এশিয়ায় থাইল্যান্ড,
সিঙ্গাপুর, হঙকঙ
এবং ম্যাকাও দ্রুত কালো টাকার জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠছে। ভারতীয়দের কালো টাকা
রাখার পছন্দের জায়গা হলো সুইজারল্যান্ড ও মরিশাস। এখন সিসিলি এবং ম্যাকাও নতুন
গন্তব্য হয়ে উঠছে। এছাড়া পরিচিত কালো টাকা রাখার জায়গা হলো লুক্সেমবার্গ, লিচটেনস্টাইন, চ্যানেল
আইল্যান্ড এবং বাহমা। আছে বারমুডা, ভার্জিন আইল্যান্ড, আইসলে অব
মান, জার্সি, কেম্যান
আইল্যান্ড ইত্যাদিও। বর্তমানে কালো টাকা নিয়ে দেশজুড়ে যে শোরগোল হচ্ছে এবং
সুপ্রিমকোর্টে কেন্দ্র তীব্র সমালোচিত হচ্ছে তার মূলে আছে লিচটেনস্টাইন-এর একটি
ব্যাঙ্কে কয়েকজন ভারতীয়র কালো টাকার তথ্য ফাঁস হওয়া। অন্য আরও কত ব্যাঙ্কে কত শত
ভারতীয়র কত লক্ষ কোটি কালো টাকা আছে তার হদিস এখনো গোপনই আছে।
কালো
টাকার পাহাড়
গত লোকসভা
নির্বাচনের আগে বি জে পি-র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিলো বিদেশের ব্যাঙ্কে
ভারতীয়দের ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১.৪ লক্ষ কোটি ডলার কালো টাকা মজুত আছে। টাকার
অঙ্কে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৬৩ লক্ষ কোটি টাকা। টাস্কফোর্স গঠন করে কালো টাকার এই
পরিমাণ নির্ধারণ করেছে বলে বি জে পি দাবি করলেও এই তথ্য আসলে ‘সুইজ
ব্যাঙ্কিং অ্যাসোসিয়েশনে’র
রিপোর্ট থেকে পাওয়া।
বিশ্বের
বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে যে পরিমাণ অর্থ আমানত করে তার
রিপোর্ট প্রকাশ করে সুইজ ব্যাঙ্কিং অ্যাসোসিয়েশন। ২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী
ভারতীয়দের আমানতের পরিমাণ ছিলো ১.৪৫৬ লক্ষ কোটি ডলার। দু’বছর পর
২০০৮ সালের রিপোর্টে ভারতীয়দের আমানতের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১.৮৯১ লক্ষ কোটি ডলার।
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৪৪ হাজার কোটি ডলার। সারা বিশ্ব
থেকে যত কালো টাকা সুইজ ব্যাঙ্কে জমা হয় তার অর্ধেকের বেশি ভারতের। বিশ্বে
কালো টাকার সবচেয়ে বড় উৎপাদক হলো ভারত।
২০০৫ সালের
মার্চ মাসে কালো টাকা সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে ট্যাক্স জাসটিস
নেটওয়ার্ক নামে ব্রিটেনের একটি সংস্থা। এই গবেষণায় সারা বিশ্বের মোট কালো টাকার
পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১১.৫ লক্ষ কোটি ডলার। সারা বিশ্বের ধনী লোকেরা তাদের এই বিপুল
পরিমাণ ব্যক্তিগত (গোপন) সম্পদ জমা করেছে বিশ্বের কম-বেশি ৭০টি করমুক্ত
স্বর্গরাজ্যে।
রেমন্ড
বাকের তাঁর উচ্চ প্রশংসিত বই ‘‘ক্যাপিটালিজিমস আকিলিজ হিল : ডার্টি মানি অ্যান্ড হাউ টু
রিনিউ দ্য ফ্রি মার্কেট সিস্টেম’’-এ অনুমান করেছেন ১৯৭০ সালের পর দরিদ্র দেশ থেকে এইভাবে
পশ্চিমী উন্নত দেশে ৫ লক্ষ কোটি ডলার স্থানান্তরিত হয়েছে।
কালো টাকা
নিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণাঙ্গ গবেষণার কাজ করেছে ‘গ্লোবাল
ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’
নামে একটি মার্কিন সংস্থা। গত নভেম্বর মাসে (২০১০) তাদের সেই গবেষণা ‘‘দ্য
ড্রাইভার্স অ্যান্ড ডাইনামিক্স অব ইলিসিট ফিনান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ইন্ডিয়া :
১৯৪৮-২০০৮’’ — এই
নামে প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু কালো টাকার বৃহত্তম উৎস ভারত তাই তারা তাদের গবেষণায়
ভারতকেই বেছে নিয়েছে। এই গবেষণায় তারা বিশ্বব্যাঙ্কের ‘রেসিডুয়াল
মডেল’ এবং
আই এম এফ-র ‘ট্রেড-মিসপ্রাইসিং
মডেল’ অনুসরণ
করে কালো টাকার হদিস পাবার চেষ্টা করেছে।
গ্লোবাল
ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জি এফ আই) রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের মোট কালো টাকার
পরিমাণ ৬৪০০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১৭৮০০ কোটি ডলার (২৭.৮ শতাংশ) রয়েছে দেশের
অভ্যন্তরে। বাকি ৪৬২০০ কোটি ডলার (৭২.২ শতাংশ) জমা হয়েছে বিদেশে। অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল
থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৬১ বছরে প্রায় ২২ লক্ষ কোটি টাকা দেশ থেকে গোপনে পাচার হয়ে
গেছে বিদেশে। ২০০৮ সালে ভারতের মোট জি ডি পি-র পরিমাণ ছিলো ১.২৮লক্ষ কোটি ডলার।
সেই দিক থেকে ভারতের জি ডি পি-র অর্ধেকের সমান তার কালো টাকা। আর যে পরিমাণ কালো
টাকা বিদেশে মজুত হয়েছে তার পরিমাণ জি ডি পি-র ৪০ শতাংশের সমান এবং টু-জি
স্পেকট্রাম দুর্নীতিতে লোপাট অর্থের ১২ গুণের সমান। অবিশ্বাস্য হলেও এই নির্মম
সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন প্রত্যেক ভারতবাসী।
লক্ষণীয়
বিষয় ১৯৪৮ সাল থেকে যে ৪৬২০০ কোটি ডলার বিদেশে জমা হয়েছে তার অর্ধেকই পাচার হয়েছে
১৯৯১ সালে উদারনীতি চালু হবার পর থেকে। আর এক-তৃতীয়াংশ পাচার হয়েছে ২০০০ থেকে ২০০৮
সালে যখন উদারনীতি তীব্র হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল, অর্থাৎ ইউ পি এ সরকারের আমলে
পাচার হয়েছে ৯৬০০ কোটি ডলার। ১৯৯৫ সালে কালো টাকা মজুতের স্বর্গরাজ্যে মজুত
বিশ্বের মোট কালো টাকার ৩৬.৪ শতাংশ ছিলো ভারতের। ২০০৯ সালে বিশ্বের মোট কালো টাকার
ভারতের অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.২ শতাংশ। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১১.৫ শতাংশ হারে
বিদেশে কালো টাকা জমা বাড়ছে।
এই
বিপুলায়তন কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করে ভারত যদি দেশে ফিরিয়ে আনতে পারে তাহলে তার
অর্ধেক দিয়ে সমস্ত বিদেশী ঋণ (২৩০০০ কোটি ডলার) শোধ করে দিতে পারে। আর বাকি অর্ধেক
দিয়ে অনায়াসে দারিদ্র্যদূরীকরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ সফলভাবে
রূপায়ণ করতে পারে।
সুইজ
ব্যাঙ্কিং অ্যাসোসিয়েশনের ২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে
ভারতীয়দের গোপন অ্যাকাউন্টে মোট জমা
অর্থের পরিমাণ ১৪৫৬০০ কোটি ডলার। ২০০৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৯১০০ কোটি
ডলার। যদি একে ১৫০০০০ কোটি ডলার ধরা হয় তাহলে তা ভারতের মোট বিদেশী ঋণের ১৩গুণ।
অর্থাৎ সব বিদেশী ঋণ শোধ করার পরও যা উদ্বৃত্ত থাকবে তা বিদেশী ঋণের ১২ গুণ। এই
উদ্বৃত্ত অর্থ আমানত করে বর্তমান হারে যে সুদ মিলবে সেটা কেন্দ্রীয় সরকারের
বাজেটের পরিমাণ থেকেও বেশি হবে। অর্থাৎ সরকারকে কোনোরকম কর বসিয়ে আয় করার প্রয়োজন
হবে না।
কিভাবে
কালো টাকা পাচার
কালো টাকা
আয়ের যেমন নানা পদ্ধতি আছে তেমনি কালো টাকা বিদেশে পাচার করারও নানা পদ্ধতি আছে।
তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো : (১) অনথিভুক্ত অয়ার ট্রান্সফার-ইলেকট্রনিক
প্রক্রিয়ায় দেশের কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে টাকা
স্থানান্তরিত হয়। অথচ সেটা নথিভুক্ত করা হয় না। (২) এক্সপোর্ট আন্ডার ইনভয়েস — রপ্তানির
সময় পণ্যের কর কমিয়ে দেখানো হয়। (৩) ইম্পোর্ট ওভার ইনভয়েস — আমদানির
সময় পণ্যের কর বাড়িয়ে দেখানো হয়। (৪) হাওলা বা হুণ্ডি পদ্ধতিতে (৫) বাহকের মাধ্যমে
সঙ্গে করে লুকিয়ে পাচার করা (৬) সীমান্তে মুদ্রার চোরাচালানের মাধ্যমে।
কালো টাকার
মালিক যেহেতু অসৎ শিল্পপতি,
রাজনীতিক ও আমলা এবং এই অসৎ ব্যক্তিরাই যেহেতু পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে
বিদেশে তাদের কালো টাকা পাচার করে তাই তাদের বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না। অনেক সময়
বিশেষ বিমান বা চাটার্ড বিমানে করে দিল্লি ও মুম্বাই থেকে কালো টাকা পাচার হয়ে
যায়। সম্ভবত এই কারণেই ব্যক্তিগত বিমানের চাহিদা ইদানীংকালে হু হু করে বাড়ছে।
প্রাইভেট বিমানে করে সহজে কালো টাকা বিদেশে পাচার করা যায়। তবে কালো টাকা পাচারের
৭৭.৬ শতাংশই হয়েছে বাণিজ্যে পণ্য ও পরিষেবার সঠিক মূল্য গোপন করার মধ্য দিয়ে
(ট্রেড মিসপ্রাইসিং)। আর এই প্রক্রিয়া বেড়ে যায় উদারনীতির ফলে। উদারনীতি চালু হবার
পর দেশের বাজার খুলে যায়। আমদানি-রপ্তানি বিধি সরল হয়। সেই সুযোগে মূল্য কারচুপির
মাধ্যমে বানের জলের মতো কালো টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
জি এফ আই-র
গবেষণা থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমত ১৯৯১ সালে অর্থনীতির
উদারীকরণ এবং সংস্কার কর্মসূচী শুরু হবার পর বিদেশগামী কালো টাকা পরিমাণ ভীষণভাবে বেড়ে
গেছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ সাল —
এই ৪৩ বছরে যত কালো টাকা বিদেশে পাড়ি দিয়েছে তার সমপরিমাণ পাড়ি দিয়েছে ১৯৯১
থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উদারনীতির ১৮ বছরে। তেমনি উদারনীতির সময়কালে যত কালো টাকা
বিদেশে পাচার হয়েছে তার ৬৭ শতাংশই গেছে ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে। তেমনি ২০০০
থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে যত কালো টাকা বিদেশে গেছে তার ৬২ শতাংশই গেছে ২০০৪ থেকে
২০০৮ সালের মধ্যে। এই সময় কংগ্রেসের নেতৃত্বে এবং মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে
ইউ পি এ সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন। দ্বিতীয়ত, কালো টাকা পাচারে প্রধানত সক্রিয় বেসরকারী ক্ষেত্রের
উচ্চ বিত্তশালী ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলি। তৃতীয়ত ভারতের কালো টাকার অর্থনীতিও
বিদেশে কালো টাকা পাচারের অন্যতম চালক।
জি এফ আই-র
ডাইরেক্টর এবং রিপোর্টের ভূমিকা লেখক রেমন্ড বাকের জানিয়েছেন, ১৯৯১ থেকে
২০০৮ সালে সংস্কারোত্তর যুগে বিনিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে ভারতের
অর্থনীতি থেকে কালো টাকার প্রবাহ ত্বরান্বিত হয়েছে। বাণিজ্যে মূল্য কারচুপির সুযোগ
বেড়েছে। আন্তর্জাতিক গোপন বা ছায়া অর্থ ব্যবস্থা (ফিনান্সিয়াল সিস্টেম), বিশেষ করে বিভিন্ন
করমুক্ত দ্বীপ, এইসব
হট মানিকে জায়গা করে দিচ্ছে। গোপন জায়গায় গড়ে ওঠা বেসরকারী সংস্থা ভারত থেকে বেআইনী
পথে বিপুল টাকা বের করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার সেই টাকা পুনরায় ভারতে স্বল্পমেয়াদী ও
দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে কাজে লাগাচ্ছে। এমনকি ফের বেআইনী পথে মুনাফাসহ বাইরে পাচার
করে দিচ্ছে। এইভাবে চক্রাকারে কালো টাকার অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠছে এবং বিত্তবানদের
অর্থ বাড়ছে।
আর্থিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদদের একটা
অংশ মনে করেন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে পশ্চিমী
দুনিয়ায় করমুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা হলো গরিব দেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমী দুনিয়ার এক
ধরনের ষড়যন্ত্র। বিংশ শতাব্দীজুড়ে এইভাবে এই ধরনের করমুক্ত অঞ্চলের সম্প্রসারণ
ঘটিয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিরল ও মূল্যবান পুঁজি ধনী দেশে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
তৃতীয় দুনিয়াকে দুর্বল করে রাখা, তাদের বিকাশের পথ অবরুদ্ধ করার জন্য তাদের কষ্টার্জিত
পুঁজি সরানো হয় উন্নত দুনিয়ায়। উন্নত ধনতন্ত্র তথা সাম্রাজ্যবাদের এটা অন্যতম
বৈশিষ্ট্য। এইভাবে পুঁজির বা সম্পদের প্রবাহ ধনী দেশমুখী হয়। ধনী দেশের পুঁজি বাড়ে
এবং সেই পুঁজি গরিব দেশকে শোষণের কাজে ব্যবহৃত হয়।
No comments:
Post a Comment