দক্ষিণআফ্রিকা
একদিন ম্যান্ডেলাকে যাঁরা চাননি…
সুজান
মুর
হাসপাতালের সামনে মানুষের
ভিড় বাড়ছে, আমরা এখনো জানি না চূড়ান্ত মুক্তির
কত কাছে চলে গেছেন ম্যান্ডেলা। তাঁর বিদায়ের এই কালে তাঁর অসুস্থতা নয়, বরং কথা বলতে চাই তাঁর শক্তি নিয়ে। খুদে রাজনীতিবিদেরা এই অতিকায়
মানুষটিকে অন্তিম শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়ানোর আগে, আমি মনে করতে চাই, কীভাবে তিনি তীব্রভাবে বেঁচে
ছিলেন অন্যদের জীবনে। আমার স্মৃতির একটা অংশ বলছে, বিশ্বের
অনেক রাজনীতিবিদই তাঁকে সাধু মনে করতেন না, অথচ আজ তাঁদের
কর্মচারীরাই লিখবে ম্যান্ডেলা সম্পর্কে তাঁদের হূদয়স্পর্শী শোকগাথা।
আসলেই, ম্যান্ডেলার বিদায় ক্ষণে আমি সেসব নেতা ও দলের শোক প্রকাশ দেখতে চাই না, যাঁরা একদিন তাঁকে সন্ত্রাসী এবং তাঁর সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী বলে বর্ণনা করতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাকে অর্থনৈতিক অবরোধ করা ঠিক হয়নি। ওই সব দলের তরুণ সদস্যরা ম্যান্ডেলার ফাঁসি চাই লেখা টি-শার্ট পরতেন। অবশ্য সত্য যে ব্রিটেনের রক্ষণশীল টোরি দলের সবাই-ই বর্ণবাদের সমর্থক ছিলেন না।
আমাদের আজ স্মরণ করা উচিত, ব্যাপারটা আসলে কেমন ছিল তখন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই বামপন্থীদের এককাতারে এনেছিল। আমি নিজেও ঘটনাক্রমে এর সঙ্গে জড়িত হই। হয় না এ রকম যে ঘটনাক্রমে আপনি রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলেন? অসাধারণ মানুষজনের সংস্পর্শে এসে, ব্যতিক্রমী জমায়েতের অংশ হয়ে এবং হঠাৎ কোনো ঘটনার অভিঘাতে? আমার বেলায়ও তেমনই ঘটেছিল।
১৯৮১ সালে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরে আমি উত্তর লন্ডনের একটি সেবাকেন্দ্রে চাকরি নিই। সেখানকার স্থানীয় শিশুদের নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। মেয়েরা চোদ্দতেই বখে যাচ্ছিল। ছেলেরা অন্যের বাড়ির জানালা ভাঙত, গাড়ি চুরি করত। সেখানে এক আফ্রিকান নারীকে আমি পাশে পাই। তিনি সব সময়ই ওই সব দুষ্টু শিশু-কিশোরদের স্কুল না পালিয়ে উকিল হতে বলতেন। তিনি শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন আর আমি বিশ্বাস করতাম সৌজন্যে। তাই রাতের পর রাত একটানা কথা বলে যেতে আমাদের অসুবিধা হতো না। তিনি ছিলেন আমার দেখা শালীন নারীদের একজন। মাঝেমধ্যে তাঁর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফোন পাওয়ার পর তাঁকে কাঁদতে দেখতাম। শুনতাম যে সেখানে নিয়মিত খুন-জখম ও গুপ্তহত্যা চলে। তাঁর নাম ছিল আদেলাইদে ট্যাম্বো, তাঁর স্বামীর নাম ছিল অলিভার ট্যাম্বো। তাঁরা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) নির্বাসিত নেতা।
তাঁর কাছ থেকেই আমি এএনসি সম্পর্কে জানা শুরু করি। জানতে পারি, কীভাবে ১৯৫২ সালে প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ম্যান্ডেলাকে নির্যাতন করা হয়। কীভাবে তাঁর ওপর নির্যাতন চলে এবং কীভাবে অবশেষে তাঁকে রুবেন দ্বীপে বন্দী করা হয়। একটা ছোট কুঠরিতে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। শাস্তির অংশ হিসেবে পাথর ভাঙতে ভাঙতে তাঁর চোখের স্থায়ী ক্ষতি হয়। সে সময়ই ট্যাম্বো দম্পতিকেও দেশ ছাড়তে হয়। তার আগে এক পাহাড়ি কারাগারে তাঁরা আটক থাকেন। আমি বলি, আপনারা কি একটা জানলাও ভাঙতে পারতেন না?
‘না, সুজান।’ তিনি বলেন, ‘পারতাম না, জানালাগুলো ছিল বুলেটপ্রুফ কাচের তৈরি।’ এভাবেই তাঁদের সেখানে থাকতে হতো।
এভাবেই এএনসির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। সে সময় আমি যাঁদের চিনতাম, সবাই বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ছিল। কে এমন বর্বরতা সমর্থন করতে পারে? এটা কেবল বর্ণবাদের চেয়েও বেশি কিছু ছিল—বর্ণবাদী বোথা সরকার কালো মানুষদের মানুষ মনে করত না, মনে করত পশু।
১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ শিল্পী জেরি ড্যামারস ‘নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দাও’ শীর্ষক গান লিখলেন। কিন্তু তার পরও বর্ণবাদ টিকে রইল এবং তাকে সমর্থন জুগিয়ে যেতে থাকল ব্রিটেনের টোরি সরকার। এই দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা এখনো মনে করেন যে থ্যাচারের শাসন ছিল সার্থক। অথচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বোথা সরকারের পৃষ্ঠপোষক। এই সেদিন, ২০০৬ সালে সেই দলেরই নেতা ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন স্বীকার করেছেন যে এএনসিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা এবং অবরোধের বিরোধিতা করে মার্গারেট থ্যাচার ভুল করেছিলেন। যেসব প্রবীণ রাজনীতিবিদ জানতেন যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণহত্যা করা হয়েছে, তাঁরাও যখন বিলম্বে সত্য স্বীকার করেন, তখন তাঁদের মানবিকতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। যদিও তাঁরা জানতেন, এটা দক্ষিণ আফ্রিকান কালো মানুষদের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা।
আমি যখন দেখি, ইংরেজ বাগিচাশিল্পী অ্যালান টিচমার্শ ম্যান্ডেলার জন্য আশ্চর্য বাগান বানাচ্ছেন বা ব্যান্ডদল স্পাইস গার্লস ম্যান্ডেলার কোলে উঠে বসছে, তখন ভাবি, ওরা কি জিল স্কট-হেরনের জোহানেসবার্গ গান (১৯৭৫) শুনেছেন কিংবা কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে ম্যান্ডেলার মুক্তি দাবি করেছিলেন?
এমনকি ডেভিড ক্যামেরনও ২৩ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিলেন এমন এক কোম্পানির খরচে, যারা বর্ণবাদের
পক্ষে ছিল। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে ক্যামেরনও নিজে বর্ণবাদকে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পক্ষেও না জেনে থাকা সম্ভব ছিল না যে দক্ষিণ আফ্রিকায় কী ঘটছে। অনেকেই তা জানত এবং অনেকেই তখন দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য বর্জন করে চলত।
ক্যামেরনের ভক্ত ডিলান জোনস একটা বই লিখেছেন, তাতে তিনি দাবি করেছেন, আশির দশক ছিল কোমলতার যুগ। একেবারেই ঠিক নয়। ওই দশকেই আমরা ‘নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দাও’ স্লোগানে কনসার্ট করেছিলাম। সেটা ছিল জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ। কনসার্টের মঞ্চের শোভা ছিল ম্যান্ডেলার বিরাট প্রতিকৃতি। তাঁর হাসির ঝলক আমাদের উৎফুল্ল করত আবার কাঁদাত। যখন তিনি রুবেন দ্বীপের কারাগারে পাথর ভেঙে চলছেন, তখন সূর্যের আলোর ঝলক তাঁর চোখের স্থায়ী ক্ষতি করেছিল। কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাস ও আশাবাদ অটুট ছিল। যখন তিনি মুক্তির দিকে হেঁটে যাচ্ছেন, (লং ওয়াক টু ফ্রিডম, বা মুক্তির দিকে দীর্ঘযাত্রা ছিল ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীর নাম) তখন তিনি লিখেছেন, ‘যদি আমি মন থেকে ঘৃণা মুছে না ফেলতাম, তাহলে হয়তো আজও আমি বন্দী থাকতাম।’
তাঁর জীবন এক সুন্দরের উদাহরণ। কিন্তু ইতিহাস ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যাঁরা একদিন তাঁর সংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ যেন তাঁরা তাঁর শুভানুধ্যায়ী সাজতে না পারেন।
ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘কোনো অনুভূতিই সামান্য নয়।’ তিনি তাঁর জনগণকে অতীত মনে রাখতে বলেছিলেন। আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই, যাঁরা আজ ম্যান্ডেলার পরবর্তী জীবনের ঔজ্জ্বল্যের মধ্যে নিজেদেরও আলোকিত দেখাতে চান, তাঁদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগে, আমাদেরও নিজেদের অতীত মনে রাখা উচিত।
খুবই দুঃখের হলেও, তাঁকে আমাদের বিদায় জানাতে হবে। তার আগে আমি শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, কেমন ছিল তাঁর বিদায়ের আগের সময়; আর কীভাবে তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই ইতিহাস নতুন করে লেখা শুরু করবে। যাঁরা ভুল করেছিলেন, তাঁদের ক্ষমা করা অবশ্যই সম্ভব, কিন্তু ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
আসলেই, ম্যান্ডেলার বিদায় ক্ষণে আমি সেসব নেতা ও দলের শোক প্রকাশ দেখতে চাই না, যাঁরা একদিন তাঁকে সন্ত্রাসী এবং তাঁর সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী বলে বর্ণনা করতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাকে অর্থনৈতিক অবরোধ করা ঠিক হয়নি। ওই সব দলের তরুণ সদস্যরা ম্যান্ডেলার ফাঁসি চাই লেখা টি-শার্ট পরতেন। অবশ্য সত্য যে ব্রিটেনের রক্ষণশীল টোরি দলের সবাই-ই বর্ণবাদের সমর্থক ছিলেন না।
আমাদের আজ স্মরণ করা উচিত, ব্যাপারটা আসলে কেমন ছিল তখন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই বামপন্থীদের এককাতারে এনেছিল। আমি নিজেও ঘটনাক্রমে এর সঙ্গে জড়িত হই। হয় না এ রকম যে ঘটনাক্রমে আপনি রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলেন? অসাধারণ মানুষজনের সংস্পর্শে এসে, ব্যতিক্রমী জমায়েতের অংশ হয়ে এবং হঠাৎ কোনো ঘটনার অভিঘাতে? আমার বেলায়ও তেমনই ঘটেছিল।
১৯৮১ সালে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরে আমি উত্তর লন্ডনের একটি সেবাকেন্দ্রে চাকরি নিই। সেখানকার স্থানীয় শিশুদের নিয়ে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। মেয়েরা চোদ্দতেই বখে যাচ্ছিল। ছেলেরা অন্যের বাড়ির জানালা ভাঙত, গাড়ি চুরি করত। সেখানে এক আফ্রিকান নারীকে আমি পাশে পাই। তিনি সব সময়ই ওই সব দুষ্টু শিশু-কিশোরদের স্কুল না পালিয়ে উকিল হতে বলতেন। তিনি শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন আর আমি বিশ্বাস করতাম সৌজন্যে। তাই রাতের পর রাত একটানা কথা বলে যেতে আমাদের অসুবিধা হতো না। তিনি ছিলেন আমার দেখা শালীন নারীদের একজন। মাঝেমধ্যে তাঁর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফোন পাওয়ার পর তাঁকে কাঁদতে দেখতাম। শুনতাম যে সেখানে নিয়মিত খুন-জখম ও গুপ্তহত্যা চলে। তাঁর নাম ছিল আদেলাইদে ট্যাম্বো, তাঁর স্বামীর নাম ছিল অলিভার ট্যাম্বো। তাঁরা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) নির্বাসিত নেতা।
তাঁর কাছ থেকেই আমি এএনসি সম্পর্কে জানা শুরু করি। জানতে পারি, কীভাবে ১৯৫২ সালে প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ম্যান্ডেলাকে নির্যাতন করা হয়। কীভাবে তাঁর ওপর নির্যাতন চলে এবং কীভাবে অবশেষে তাঁকে রুবেন দ্বীপে বন্দী করা হয়। একটা ছোট কুঠরিতে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। শাস্তির অংশ হিসেবে পাথর ভাঙতে ভাঙতে তাঁর চোখের স্থায়ী ক্ষতি হয়। সে সময়ই ট্যাম্বো দম্পতিকেও দেশ ছাড়তে হয়। তার আগে এক পাহাড়ি কারাগারে তাঁরা আটক থাকেন। আমি বলি, আপনারা কি একটা জানলাও ভাঙতে পারতেন না?
‘না, সুজান।’ তিনি বলেন, ‘পারতাম না, জানালাগুলো ছিল বুলেটপ্রুফ কাচের তৈরি।’ এভাবেই তাঁদের সেখানে থাকতে হতো।
এভাবেই এএনসির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। সে সময় আমি যাঁদের চিনতাম, সবাই বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ছিল। কে এমন বর্বরতা সমর্থন করতে পারে? এটা কেবল বর্ণবাদের চেয়েও বেশি কিছু ছিল—বর্ণবাদী বোথা সরকার কালো মানুষদের মানুষ মনে করত না, মনে করত পশু।
১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ শিল্পী জেরি ড্যামারস ‘নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দাও’ শীর্ষক গান লিখলেন। কিন্তু তার পরও বর্ণবাদ টিকে রইল এবং তাকে সমর্থন জুগিয়ে যেতে থাকল ব্রিটেনের টোরি সরকার। এই দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা এখনো মনে করেন যে থ্যাচারের শাসন ছিল সার্থক। অথচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বোথা সরকারের পৃষ্ঠপোষক। এই সেদিন, ২০০৬ সালে সেই দলেরই নেতা ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন স্বীকার করেছেন যে এএনসিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা এবং অবরোধের বিরোধিতা করে মার্গারেট থ্যাচার ভুল করেছিলেন। যেসব প্রবীণ রাজনীতিবিদ জানতেন যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণহত্যা করা হয়েছে, তাঁরাও যখন বিলম্বে সত্য স্বীকার করেন, তখন তাঁদের মানবিকতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। যদিও তাঁরা জানতেন, এটা দক্ষিণ আফ্রিকান কালো মানুষদের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা।
আমি যখন দেখি, ইংরেজ বাগিচাশিল্পী অ্যালান টিচমার্শ ম্যান্ডেলার জন্য আশ্চর্য বাগান বানাচ্ছেন বা ব্যান্ডদল স্পাইস গার্লস ম্যান্ডেলার কোলে উঠে বসছে, তখন ভাবি, ওরা কি জিল স্কট-হেরনের জোহানেসবার্গ গান (১৯৭৫) শুনেছেন কিংবা কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে ম্যান্ডেলার মুক্তি দাবি করেছিলেন?
এমনকি ডেভিড ক্যামেরনও ২৩ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিলেন এমন এক কোম্পানির খরচে, যারা বর্ণবাদের
পক্ষে ছিল। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে ক্যামেরনও নিজে বর্ণবাদকে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পক্ষেও না জেনে থাকা সম্ভব ছিল না যে দক্ষিণ আফ্রিকায় কী ঘটছে। অনেকেই তা জানত এবং অনেকেই তখন দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য বর্জন করে চলত।
ক্যামেরনের ভক্ত ডিলান জোনস একটা বই লিখেছেন, তাতে তিনি দাবি করেছেন, আশির দশক ছিল কোমলতার যুগ। একেবারেই ঠিক নয়। ওই দশকেই আমরা ‘নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দাও’ স্লোগানে কনসার্ট করেছিলাম। সেটা ছিল জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ। কনসার্টের মঞ্চের শোভা ছিল ম্যান্ডেলার বিরাট প্রতিকৃতি। তাঁর হাসির ঝলক আমাদের উৎফুল্ল করত আবার কাঁদাত। যখন তিনি রুবেন দ্বীপের কারাগারে পাথর ভেঙে চলছেন, তখন সূর্যের আলোর ঝলক তাঁর চোখের স্থায়ী ক্ষতি করেছিল। কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাস ও আশাবাদ অটুট ছিল। যখন তিনি মুক্তির দিকে হেঁটে যাচ্ছেন, (লং ওয়াক টু ফ্রিডম, বা মুক্তির দিকে দীর্ঘযাত্রা ছিল ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীর নাম) তখন তিনি লিখেছেন, ‘যদি আমি মন থেকে ঘৃণা মুছে না ফেলতাম, তাহলে হয়তো আজও আমি বন্দী থাকতাম।’
তাঁর জীবন এক সুন্দরের উদাহরণ। কিন্তু ইতিহাস ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যাঁরা একদিন তাঁর সংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ যেন তাঁরা তাঁর শুভানুধ্যায়ী সাজতে না পারেন।
ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘কোনো অনুভূতিই সামান্য নয়।’ তিনি তাঁর জনগণকে অতীত মনে রাখতে বলেছিলেন। আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই, যাঁরা আজ ম্যান্ডেলার পরবর্তী জীবনের ঔজ্জ্বল্যের মধ্যে নিজেদেরও আলোকিত দেখাতে চান, তাঁদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগে, আমাদেরও নিজেদের অতীত মনে রাখা উচিত।
খুবই দুঃখের হলেও, তাঁকে আমাদের বিদায় জানাতে হবে। তার আগে আমি শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই, কেমন ছিল তাঁর বিদায়ের আগের সময়; আর কীভাবে তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই ইতিহাস নতুন করে লেখা শুরু করবে। যাঁরা ভুল করেছিলেন, তাঁদের ক্ষমা করা অবশ্যই সম্ভব, কিন্তু ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান
থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সুজান মুর: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
সুজান মুর: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment