Friday, June 7, 2013

ইরানে ক্ষমতাবান কারা
পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের নিত্যনতুন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ১৪ জুন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে মোট আটজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে দেশটিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কতটুকু তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জটিল রাজনৈতিক পদ্ধতি, অগণিত কাউন্সিল, ধর্মীয়, বিচারিক বিষয়ক প্রাজ্ঞজনদের (কেউ নির্বাচিত, কেউ বাছাইকৃত) মধ্যে কে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, সেটি খুঁজে বের করা বেশ কঠিনই বলা চলে। ইরানে সরকার বিচারিক, সাংবিধানিক ও নির্বাহী শাখার সমন্বয়ে গঠিত। এর সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় সর্বোচ্চ কাউন্সিলের পরামর্শ ও অনুশাসন নীতিমালা। সর্বোচ্চ নেতার নীতিমালা মেনে চলেই সমন্বিত সরকার পরিচালিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে ইরানে ধর্মীয় নেতাদের দাপট চলে আসছে। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতা থাকলেও দেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা সীমিত। এ কারণে জনমত বা জনগণের চাওয়া সবসময় উপেক্ষিত থেকে যায়।
শীর্ষ নেতা : ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। ১৯৮৯ সাল থেকে আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এ পদে রয়েছেন। ইরানের রাজনৈতিক ও সরকার পরিচালনা পদ্ধতিতে এ পদটিই হচ্ছে সর্বোচ্চ পদ। ২০১২ সালের ফোর্বসের বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালীর তালিকায় ২১তম অবস্থানে ছিলেন। ইরানে তার কথাই শেষ কথা হিসেবে বিবেচিত ও গ্রহণযোগ্য।
শীর্ষ নেতার অধীনে সরকারের সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ, নির্বাহী কমিটি, আইন প্রণয়ণকারী কমিটি ও বিচারিক কমিটির অবস্থান। এ ছাড়া সামরিক বাহিনী ও গণমাধ্যমও শীর্ষ নেতার নির্দেশেই নির্বাচিত হন। ধর্মীয় নেতাদের সম্মেলনে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই শীর্ষ নেতাদের নির্বাচিত করা হয়।
গার্ডিয়ান কাউন্সিল ও পার্লামেন্ট : শীর্ষ নেতার অধীনে রয়েছে গার্ডিয়ান কাউন্সিল ও পার্লামেন্ট। এর মধ্যে গার্ডিয়ান কাউন্সিল হচ্ছে অনির্বাচিত একটি পরিষদ, যেটি পার্লামেন্ট মেম্বারদের গৃহীত যেকোনো সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে। মোট ১২ সদস্যের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের ছয় সদস্য শীর্ষ নেতার সরাসরি পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করা হয়। ২৯০ আসনের ইসলামিক সংবিধানের পার্লামেন্ট সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও অনির্বাচিত গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা শীর্ষ নেতার তুলনায় তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই বললেই চলে।
প্রেসিডেন্ট :দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে বিবেচিত হলেও সাংবিধানিকভাবে ইরানের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। শীর্ষ নেতার অধীনেই তাকে কাজ করতে হয়। তিনিও সরাসরি জনভোটে নির্বাচিত। তার প্রধান দায়িত্ব মন্ত্রিসভা পরিচালনা করা। ২২ সদস্যের নির্বাচিত মন্ত্রিসভা নিয়েই প্রেসিডেন্টের কার্যক্রম।
উপদেষ্টা পরিষদ : পার্লামেন্ট ও গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য রয়েছে শীর্ষ নেতার বাছাই করা অনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে বিশেষ কাউন্সিল। এক্সপেডিয়েন্সি কাউন্সিল নামক এ শাখার ৩৪ সদস্য শীর্ষ নেতার উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়োজিত। শীর্ষ নেতার অধীনে এরকম আরও একটি পরিষদ রয়েছে, যেটি সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত।
যদিও শীর্ষ নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা রয়েছে কিংবা প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা এদের রয়েছে, তবে কখনো শীর্ষ নেতাকে এ পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়নি।
এ ছাড়া দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আরও দুটি ভাগ রয়েছে, বিচারিক বিভাগ ও সামরিক বাহিনী। সামরিক বাহিনীর অধীনে রেভলিউশনারি গার্ড বা বিশেষ সেনাবাহিনী এবং সাধারণ সামরিক আধাসামরিক ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রেভলিউশনারি গার্ডের অধীনে বিভিন্ন খাতে দেড় লাখ সেনা রয়েছে। অন্যদিকে সাড়ে তিন লাখ সাধারণ সেনা আলাদা করে রয়েছে। ২০১৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে শীর্ষ নেতা বা নির্বাহী কমিটির সদস্যদের দাপট আবার পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের কণ্ঠেও নেতাদেরই সুর।
সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী :ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুউল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর শীর্ষ নেতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এর পরই রয়েছেন গার্ডিয়ান কাউন্সিলের প্রধান আয়াতুল্লাহ আহমাদ জান্নাতি। তার সঙ্গে রয়েছেন সংবিধানিক পরিষদের প্রধান মুহাম্মদ রেজা মাহদাভি কানি। নির্বাচন বিষয়ে পরামর্শের পাশাপাশি সংবিধান সংশোধনীতে কাজ করে থাকেন তিনি।
সাংবিধানিক পরিষদের ইসলামিক চিন্তাবিদদের অংশের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ তাকি মেজবাহ ইয়াজদি। নির্বাচন থেকে শুরু করে সরকারের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার দায়িত্বে ইয়াজদির কমিটির।
ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আলি জাফারি। আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজে পছন্দ করে তাকে এই বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান নির্বাচন করেছেন। তিনিও ইরানের অন্যতম প্রভাবশালীদের তালিকায় রয়েছেন।
ইরানের বৈপ্লবিক সেনা দলের অধীনে যে গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে সেটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন হোসেইন তায়েব। তিনি সাবেক সামরিক কর্মকর্তা। তার সঙ্গে রয়েছেন মুজতবা খামেনি, যিনি আয়াতুলল্লাহ খামেনির পুত্র। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে যে ২২ ইরানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, হোসেন তায়েব তাদের একজন। খোরাসানের সুলতান নামে পরিচিত আয়াতুল্লাহ আব্বাস ভায়েস তাবাসি অনির্বাচিত উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। দেশের শীর্ষ ধনীদের তালিকায়ও তিনি শীর্ষে। প্রায় ১০০ কোটি ডলারের সম্পত্তি রয়েছে তার। শীর্ষ নেতার অনেক সিদ্ধান্তেই তার প্রভাব প্রকট।
পার্লামেন্টের স্পিকার আলি লারজানি আরেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যার ক্ষমতা অসীম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রভাবও সীমাহীন। তিনি পরমাণু কাউন্সিলের সমঝোতাকারী হিসেবেও পরিচিত।

বৈপ্লবিক সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান মোহসেন রেজায়ী শীর্ষ নেতা খামেনির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এদিকে পার্লামেন্ট স্পিকারের ভাই আলি লারজানির ভাই সাদিক লারজানি বিচারিক বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সরাসরি আয়াতুল্লাহ খামেনির পছন্দে নিয়োগ পেয়েছেন। আকবর হাশেমি রাফসানজানি আরেকজন শীর্ষ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারলেও খামেনির খুব কাছের লোক হিসেবেই পরিচিত তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ মুহূর্তে অনির্বাচিত উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

No comments:

Post a Comment