মৃত্যুর হিমশীতল
বাহু...
বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত 'আফ্রিকা' কবিতায় কালো আফ্রিকায় সূর্যোদয়ের স্বপ্ন
দেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা কবিতা লেখার অনেক পরে একজন মহামানব আফ্রিকা
কবিতার সার্থক রূপ দিয়েছেন। সাদাদের বিরুদ্ধে জিতে ঘোষণা দিয়েছিলেন 'আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি আফ্রিকান।'
আবার নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয়ের
দ্বারপ্রান্তে এসে বলেন_ 'সাদারাও আফ্রিকান। দক্ষিণ আফ্রিকায়
যারা বসবাস করেন তারা সবাই দক্ষিণ আফ্রিকান। সবাই এ দেশের নাগরিক।'
নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম করে জয়ী
হয়ে বিজিতদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ নয়, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে সর্বজনীন চেতনা_
আমাদের কালের নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা সে অধিকার
প্রতিষ্ঠারই উজ্জ্বল উদাহরণ।
কবি নির্মলেন্দু
গুণ লিখেছেন_
'যে বয়সে পুরুষ ভালোবাসে নারীকে, সে বয়সে তুমি
ভালোবেসেছিলে
তোমার মাতৃভূমি, দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
যে বয়সে পুরুষ
প্রার্থনা করে প্রেয়সীর বরমাল্য,
সে বয়সে তোমার
কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছে ফাঁসির রজ্জুতে
যে বয়সে পুরুষের
গ্রীবা আকাঙ্ক্ষা করে
রমণীয় কোমল
বাহুর ব্যগ্র-মুগ্ধ আলিঙ্গন;
সে বয়সে তোমাকে
আলিঙ্গন করেছে
মৃত্যুর হিমশীতল
বাহু।'
... 'আফ্রিকার প্রেমের কবিতা'
সারাজীবন যিনি
উৎসর্গ করেছেন তার দেশের জন্য, দেশের মানুষের
জন্য, সেই মহান নেতা ক্ষমতার মসনদে আটকে
যাননি, আটকে যাননি কেবল তার সম্প্রদায়ের
মানুষের বৃত্তে। শান্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে কালো ও সাদা সমস্ত দক্ষিণ
আফ্রিকাবাসীর নেতায় পরিণত হয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা জীবনভর সংগ্রাম করেছেন মানুষের
মুক্তির জন্য। প্রায় ২৮ বছর জেল আর নির্বাসন। এই মুক্তিসংগ্রামী আজ আফ্রিকার
ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী জনতার প্রেরণার উৎস। মানবমুক্তি
ও স্বাধীনতাকে জীবনের মূলমন্ত্র করে তিনি বাধার পর বাধার পাহাড় ডিঙিয়েছেন ধৈর্যে,
সহিষুষ্ণতায়, দৃঢ়চিত্তে। ফলে মানুষের আত্মিক জয় আর
ম্যান্ডেলার সাধনা একাত্ম হয়ে গেছে। ম্যান্ডেলাই কৃষ্ণ আফ্রিকাকে তুলে এনেছেন
সম্মানের আসনে।
১৯৯৩ সালে নোবেল
শান্তি পুরস্কারে ভূষিত নেলসন ম্যান্ডেলার নোবেল বক্তৃতার অনুবাদ...
মহামান্য রাজা,
রয়্যাল হাইনেস,
নরওয়েজিয়ান
নোবেল কমিটির সদস্যবৃন্দ,
সম্মানীয়
প্রধানমন্ত্রী, ম্যাডাম গ্রো হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড,
মন্ত্রীবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং রাষ্ট্রদূতবৃন্দ,
যৌথভাবে নোবেল
বিজয়ী সহযোগী মি. এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ক, সম্মানিত অতিথিবৃন্দ,
বন্ধু,
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়বৃন্দ
নোবেল শান্তি
পুরষ্কার বিজয়ীদের সারিতে আমাদের স্থান দেওয়ায় আমি আমার হৃদয়ের গভীর থেকে
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
পাশাপাশি আমি আমার স্বদেশী এবং নোবেল শান্তি পুরষ্কারে যৌথভাবে
সম্মানিত বিজয়ী, রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এফ. ডব্লিউ ডি
ক্লার্ককে অভিনন্দন জানানোর সুযোগটিও এখানে গ্রহণ করতে চাই।
আমরা যৌথভাবে যুক্ত হয়েছি দুই মহান সাউথ আফ্রিকান প্রয়াত চিফ আলবার্ট
লুতুলি এবং হিজ গ্রেস আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর সাথে, যারা ক্ষতিকর জাতিবিদ্বেষ প্রথার বিরুদ্ধে
শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম সূচনার প্রারম্ভিক অবদানের জন্য ইতোপূর্বে নোবেল শান্তি
পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
এখানে এটা অসঙ্গত হবে না যদি আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের মধ্য থেকে
বিশিষ্ট নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী প্রয়াত রেভারেন্ড মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের
নাম এখানে যুক্ত করি। সাউথ আফ্রিকান হিসেবে আজকে যে সমস্যাগুলো আমাদের মোকাবিলা
করতে হচ্ছে, তিনি সেগুলোর সমাধান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
ছিলেন এবং এ-সম্পর্কিত উদ্যোগের ফলেই তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
আমরা এখানে যুদ্ধ ও শান্তি, সহিংসতা ও অহিংসা, বর্ণবাদ ও
মানুষের মর্যাদা, অত্যাচার ও দমননীতি এবং সার্বভৌমত্ব ও
মানুষের অধিকার, দরিদ্রতা ও স্বাধীনতা- এই বিভাজনগুলোর
চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলছি। লাখ লাখ মানুষ যারা যুদ্ধ, সহিংসতা, বর্ণবাদ, অত্যাচার,
দমননীতি এবং দারিদ্র সৃষ্টিকারী সামাজিক
সিস্টেমগুলোর বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা নিয়েছে, আমরা আজকে এখানে এসেছি তাদের পক্ষ থেকে;
আমাদের ভূমিকা তাদের প্রতিনিধির চাইতে বেশি
কিছু নয়।
সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষ, বিভিন্ন দেশের সরকার ও সংস্থাসমূহ যারা একটি দেশ হিসেবে সাউথ আফ্রিকা
বা এর মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে কেবল বর্ণবাদের মতো অপরাধ,
মানবতাবিরোধী ও অমানবিক পন্থার বিরুদ্ধে
অবস্থান নিয়েছিলো এবং বর্ণবৈষম্য দ্রুত দূর করতে অবস্থান নিয়েছিলো এবং আমাদের
সপক্ষে যুক্ত হয়েছিলো, আমি এখানে তাদের প্রতিনিধি হিসেবেও
এখানে দাঁড়িয়েছি।
কোনো নিজস্ব স্বার্থ ছাড়াই আমাদের দেশের ভেতর ও বাইরের এসব অগণিত
মানুষ অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলো,
তার একটি মহত্ত্ব আছে। তারা উপলব্ধি করতে
পেরেছিলো যে, একজনের প্রতি একটি আঘাতের অর্থ হচ্ছে
সবার প্রতিই আঘাত; এবং সে কারণে ন্যায়বিচার এবং সাধারণ
মানবতাবোধ রক্ষায় তারা একসঙ্গে কাজ করেছে। বহু বছর ধরে তাদের সাহস ও ধৈর্য্যরে
কারণে আজকে আমরা এমন একটি ক্ষণ নির্ধারণ করতে পারি যখন সব মানবতা একত্র হয়ে আমাদের
শতকের অন্যতম একটি বিশেষ মানবিক বিজয় উদযাপন করতে পারবে। ওই বিশেষ মুহূর্তে আমরা
সবাই একত্রে বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ এবং শ্বেতাঙ্গদের
সংখ্যালঘু নীতির বিরুদ্ধে বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করতে পারবো। এই বিজয় একইসাথে পাঁচশ
বছরের আফ্রিকায় উপনিবেশবাদের ইতিহাসের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে যা শুরু হয়েছিলো
পর্তুগিজদের সাম্রাজ্য স্থাপনের মাধ্যমে। এ কারণে এটি ইতিহাসের একটি বড় অগ্রগতি
হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পাশাপাশি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানুষের সংগ্রামের
প্রামাণিক দলিল হিসেবে কাজ করবে।
এই দামী মর্যাদা এবং অমূল্য উপহারটি আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ দিকের
মানুষগুলোর জন্য প্রস্তুতি-সহায়ক হিসেবে কাজ করবে যারা মানবতার জন্য কষ্ট করার
পাশাপাশি স্বাধীনতা, শান্তি, মানবিক মর্যাদা এবং মানুষের পরিপূর্ণতা-
সবকিছুর জন্য ত্যাগ স্বীকার করছে।
অর্থের বিনিময়ে এই পুরষ্কারকে পরিমাপ করা যাবে না। আমাদের
পূর্বপুরুষরা যে আফ্রিকান মাটির ওপর পদক্ষেপ ফেলেছিলেন,
আমরা সেগুলোর ওপরই পদস্থাপন করেছি। দুর্মূল্য
কিছু ধাতু ও বহুমূল্য পাথরের সমষ্টিগত দাম দিয়ে সেই অবশিষ্টাংশ মাটির সমান
মূল্যবিচার করা যাবে না। তবে শিশুদের সুখ ও কল্যাণের নিরিখে এর মূল্যমান অবশ্যই
বিচার করা যাবে কারণ শিশুরা যে কোনো সমাজে তাৎক্ষণিক নির্মমতার শিকার এবং আমাদের
বহুমূল্য সম্পদ। আমরা নিশ্চিত করতে চাই, শিশুরা অন্তত একটি উন্মুক্ত পরিবেশে বিচরণ করতে পারবে। তাদের ক্ষুধার
কষ্ট সহ্য করতে হবে না, তারা রোগে ধ্বংস হবে না,
উপেক্ষা, উৎপীড়ন বা অপব্যবহারের কষ্টকর যন্ত্রণার শিকার হতে হবে না। আজকে এই
গুরুত্বপূর্ণ দর্শকদের সামনে আমরা একটি নতুন সাউথ আফ্রিকার প্রতিজ্ঞা করছি যেখানে
শিশুদের বেঁচে থাকা, সুরক্ষা এবং উন্নতির লক্ষ্যে বিশ্ব
ঘোষণার উদ্দেশ্যগুলোকে যে কোনোভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
শিশুদের পাশাপাশি তাদের পিতামাতাদের সুখ ও কল্যাণের মাধ্যমেও এই
পুরষ্কারের মূল্যবিচার করা যাবে যারা পৃথিবীকে চলমান রেখেছেন অপহৃত হওয়ার ভয়ভীতিকে
উপেক্ষা করে অথবা রাজনৈতিক বা বস্তুগত লাভের কারণে মৃত্যুবরণ করে বা দারিদ্র্যের
কশাঘাতে উপেক্ষিত হয়ে। পাশাপাশি বেকার, গৃহহীন, ক্ষুধার্ত মানুষ যারা হতাশার ভারী বোঝা
বয়ে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে
হবে।
যারা কষ্ট সহ্য করেছে তাদের সবার কাছে এই উপহারের মূল্য রয়েছে।
আমাদের দেশের সে সমস্ত মানুষের সুখ ও কল্যাণের দ্বারা এর মূল্যমান বিচার করা হবে
যারা এই অমানবিক বিভেদের দেওয়াল উপড়ে ফেলবে, যে দেওয়াল তাদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে।
মানুষের মর্যাদার জন্য অবমাননাকর যে বিষয়গুলো কাউকে প্রভু বানায়,
কাউকে বা দাস, সেগুলোকে নির্মূল করতে এই মহান মানুষগুলোই
এগিয়ে আসবে। এই মর্যাদাহানিকর বিষয়গুলো প্রত্যেককে লুণ্ঠনকারীতে রূপান্তরিত করতে চায়
যাদের টিকে থাকা নির্ভর করে কেবল অন্যদের ধ্বংস করার ওপর।
আনন্দঘন শান্তিপূর্ণ অবস্থা ও বিজয়োল্লাসের মাধ্যমেই যৌথভাবে পাওয়া
আমাদের এই সম্মান যথাযথ মর্যাদা পাবে। কারণ সাধারণ মানবতা সাদা-কালোকে এক করে একটি
অভিন্ন মানবিক গন্তব্যে নিয়ে যাবে। এই বিজয়োল্লাস আমাদের প্রত্যেককে জানাবে-
স্বর্গের শিশুরা যেভাবে বাঁচে, আমাদের জীবন হবে
তেমনই।
সুতরাং আমাদের বাঁচতে হবে। কারণ আমরা এমন এক সমাজ গড়বো যেখানে
প্রত্যেকে সমান অধিকার নিয়ে জন্মাবে এবং একইভাবে জীবনযাপন করার পাশাপাশি প্রতিটি
মানুষ স্বাধীনতা, উন্নতি, মানবাধিকার এবং সুশাসনের অধিকারী হবে। এই সমাজ
কখনোই চেতনার বন্দীত্ব স্বীকর করবে না কিংবা কারো মানবাধিকার নষ্ট হওয়া বরদাশত
করবে না। পাশাপাশি নিজেদের স্বার্থের জন্য অসৎ উদ্দেশ্যে যারা মানুষের কাছ থেকে
ক্ষমতা কেড়ে নিতে চায়, তারা আর কখনোই শান্তির এই পরিবর্তনকে
বাধা দিতে পারবে না।
একই সাথে আমরা আরেক নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু কিকে
মুক্তি দেওয়ার জন্য বার্মা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। বার্মার জনগণের কল্যাণের
জন্য তাঁকে এবং তাঁর প্রতিনিধিদের আলোচনায় যুক্ত করার আহ্বান জানাই। এই কাজটি করার
মতো ক্ষমতা যাদের আছে, আর কোনো বিলম্ব ছাড়া তাঁর মেধা ও
শক্তিকে দেশের মানুষের কল্যাণ এবং সার্বিকভাবে মানবতার কল্যাণের কাজে লাগানোর জন্য
তাদের অনুরোধ জানাই।
আমাদের দেশের কঠিন ও বিরক্তিকর রাজনীতিকে দূরে রেখে আমি যৌথভাবে
শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মি. এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ককে সম্মান জানানোর
সুযোগটি নিতে চাই। আমাদের দেশ যে ভয়াবহ ভুলের মধ্যে ছিলো এবং মানুষকে
জাতিবিদ্বেষের এক আরোপিত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিলো,
সেটি স্বীকার করার সাহস তাঁর রয়েছে। সাউথ
আফ্রিকার সব মানুষকে আলোচনার মাধ্যমে যেতে হবে এবং সেখানে সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে
নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেদেরই ঠিক করে নিতে হবে- এই বিষয়টি বুঝার মতো অন্তর্দৃষ্টি এবং
গ্রহণ করার মানসিকতা তাঁর মধ্যে রয়েছে। তারপরও আমাদের দেশে এমন কিছু মানুষের মধ্যে
ভুল ধারণা রয়েছে যে, পরিত্যাজ্য একটি ধারণাকে আঁকড়ে ধরে
তারা ন্যায়বিচার ও শান্তির পথে অবদান রাখতে পারবে। সেটি যে নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছু
সৃষ্টি করে না, তা তো এখন প্রমাণিত। আমরা আশা করি,
যথেষ্ট কারণসহকারেই তাদের উপলব্ধি করবে যে,
ইতিহাস কখনোই ভুলে যাওয়ার নয় এবং ভয়াবহ অতীতের
পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টি হবে না, নতুন সমাজ হবে পরিশুদ্ধ এবং নতুনভাবে।
ঠিক আজকে যে অবস্থা আছে, আমাদের দেশকে সেরকম গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাছাকাছি আনার আন্দোলনে
যেসব দেশপ্রেমিক মুখ এবং সংগঠন মূল ভূমিকা পালন করেছে,
তাদের প্রতিও সম্মান জানাতে চাই। আমরা আনন্দিত
যে, ’স্বদেশ’ গঠনে যারা কাজ করেছে এবং করছে তারা এবং এসব
সংগঠনের অনেক প্রতিনিধি আমাদের সাথে অসলোতে এসেছে। নোবেল শান্তি পুরষ্কার যা
আমাদের দিয়েছে, সেগুলো তাদেরও শেয়ার করতে হবে।
আমরা বেঁচে আছি এই আশা নিয়ে যে, সাউথ আফ্রিকা নিজেকে পুনর্গঠিত করতে সচেষ্ট হবে যেমন করে একটি
মাইক্রোসোম নতুন পৃথিবীতে আসার জন্য প্রাণপন সংগ্রাম করে। এটা হবে একটি গণতন্ত্রের
বিশ্ব, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল,
দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বঞ্চনা ও উপেক্ষার ভয়াবহতা থেকে মুক্ত,
গৃহযুদ্ধ ও বাইরের আগ্রাসনের যন্ত্রণা ও হুমকি
থেকে মুক্ত, লাখ লাখ উদ্বাস্তুর করুণ অবস্থা থেকে
মুক্ত এক বিশ্ব। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছে সাউথ আফ্রিকা এবং পুরো আফ্রিকার
দক্ষিণাঞ্চল। এটি আমাদের সবাইকে উদ্দীপ্ত করছে এমন একটি স্রোতে ভেসে যেতে যেখানে
মানুষ তার চেতনায় যেরকম পৃথিবী গড়তে চায়, এ অঞ্চলকে সেরকমভাবে একটি বাসযোগ্য আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তুলতে।
আমরা বিশ্বাস করি না, যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য এই নোবেল
শান্তি পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। আমাদের বলা দরকার, জাতিবিদ্বেষ পদ্ধতির মৃত্যু ঘটতে যারা দেখেছে,
এই নোবেল শান্তি পুরষ্কার তাদের সবার সম্মিলিত
হৃদয়ের সাড়া বা আবেদন। আমরা তাদের ডাক বুঝতে পেরেছি। তারা চায় যে,
আমাদের জীবনে যা ঘটেছে প্রকৃতপক্ষে মানুষের
বেঁচে থাকার স্বাভাবিক অবস্থার শর্ত হচ্ছে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, শান্তি, বর্ণবাদমুক্ত,
সবার জন্য উন্নতি,
স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ,
লিঙ্গবিভেদমুক্ত এবং মানুষের মাঝে ঐক্য।
এই আবেদনে সাড়া দিয়ে এবং তাদের মহত্ত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে পৃথিবীকে
নতুন করে সাজাতে আমাদের যা করণীয় আমরা তা করবো, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আমাদের ‘রেচড অব দ্য আর্থ’ (পৃথিবীর জঘন্য
ব্যক্তি) বলতে না পারে। আপনারা আমাদের ওপর এই বিশ্বাসটুকু রাখতে পারেন।
ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন কখনোই বলতে না পারে,
গতানুগতিকতা, নিন্দাবাদ বা স্বার্থপরতার কারণে মানবতাবাদের
আদর্শ, যা নোবেল শান্তি পুরষ্কারের মূল বিষয়,
তা অনুসরণে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
আমরা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের উক্তিটিকে প্রমাণ করার জন্য সংগ্রাম
করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, মানবতা খুব বেশিদিন বর্ণবাদ এবং
যুদ্ধের নক্ষত্রহীন অন্ধকার রাত্রে দুঃখজনকভাবে বাধা থাকতে পারে না। আমরা আমাদের
কাজের মাধ্যমে আরো প্রমাণ করতে চাই যে তিনি কেবল স্বপ্ন দেখছিলেন না যখন তিনি
বলেছিলেন- সত্যিকারের ভ্রাতৃত্বের সৌন্দর্য এবং শান্তি হীরে,
রুপা বা সোনার চেয়ে অধিকতর দামী। নতুন যুগ
আসছে।
ধন্যবাদ।
লং ওয়াক টু
ফ্রিডম
১৯৯৪ সালে
প্রকাশিত আত্মজীবনী এ লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এ নেলসন ম্যান্ডেলা লিখেছেন,
‘আমি স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি
দিয়েছি। আমি হোঁচট খাব না তা ভাবিনি। পথে আমি অনেক ভুল পদক্ষেপ নিয়েছি। কিন্তু
একটি বড় পাহাড়ে ওঠার পর আমি এই গোপন রহস্য আবিষ্ককার করেছি যে আশপাশে অনেক পাহাড়
আছে, যাতে আরোহণ করা সম্ভব। কিছু সময়ের জন্য
আমি এখানে বিশ্রাম নিয়েছি আমার চারদিকে উজ্জ্বল দৃশ্যপরম্পরা দেখতে,
ফিরে তাকাতে সেই পথের দিকে,
যে পথ অতিক্রম করে আমি এসেছি। কিন্তু সামান্য
সময়ের জন্যই আমি বিশ্রাম নিতে পারি। কারণ স্বাধীনতার সঙ্গে আসে দায়িত্ব এবং আমি
দেরি করতে পারি না। কারণ, আমার দীর্ঘ পথ এখনো শেষ হয়নি।’ সাম্রাজ্যবাদী সাদাদের শাসন-শোষণ,
নিপীড়ন-নির্যাতন কালোদের কেবল ক্রীতদাসই
বানায়নি, বিচ্যুত করেছে সভ্যতার পথ থেকে। দক্ষিণ
আফ্রিকার ভূমিপুত্র কালোদের জমি তারা দখল করে নিয়ে ভূমিহীন উদ্বাস্তু,
নিজদেশে পরবাসী করে দিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে
সাদাদের রচিত রূপকথায় কালোরা রাক্ষস-খোক্কসের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। দক্ষিণ
আফ্রিকার অবিসংবাদী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তার জীবনপণ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কালো
আফ্রিকার সেই ভাবমূর্তির অবসান ঘটিয়ে সত্যিকার আফ্রিকার পরিচয় তুলে ধরেছেন। জীবনের
সুদীর্ঘ ২৭টি বছর যিনি কারান্তরালে কাটিয়েছেন, কোনো আপস করেননি কিংবা থেমে যায়নি তার সংগ্রাম। কারাগারকে তারা পরিণত
করেছিলেন শিক্ষালয়ে_ কারাগারেও তারা বিকশিত করেছেন নিজেদের।
রবেন দ্বীপের বন্দিশালার সেলে আবদ্ধ করে যাদের বিচ্ছিন্ন-শক্তিহীন করতে চেয়েছে
শ্বেতাঙ্গ শাসক শ্রেণী, তারা নিজেদের ভেতর ঐক্য গড়ে তুলে
কারাভ্যন্তরেও এগিয়ে নিয়ে গেছেন কালো আফ্রিকার মুক্তির সংগ্রামকে। নেলসন
ম্যান্ডেলার 'লং ওয়াক টু ফ্রিডম'
এই সুদীর্ঘ জীবনীর পাতায় পাতায় বিধৃত হয়েছে সেই
আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। দেশমাতৃকার মুক্তিকামী একজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক
কর্মী কীভাবে ঘটনা পরম্পরায় জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রজ্ঞাবান এক নেতায় পরিণত
হন তার এক সুনিপুণ আলেখ্য রচিত হয়েছে এই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। একজন প্রজ্ঞাবান
নেতা তার দেশ ছাপিয়ে, মহাদেশ ছাপিয়ে কী করে পরিণত হন এক
বিশ্ববরেণ্য কালজয়ী ব্যক্তিত্বে_ সেই সুকঠিন
সংগ্রামের প্রামাণ্য দলিল লং ওয়াক টু ফ্রিডম।
যেভাবে প্রকাশিত
হলো ম্যান্ডেলার বই
দক্ষিণ আফ্রিকার
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার
আত্মজীবনীমূলক বই দ্য লং ওয়াক টু ফ্রিডম আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া
অন্যতম বই। বর্তমানে বইটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। তবে তিনজন ব্যক্তির
সাহসী ভূমিকা না থাকলে এ বইটি হয়তো কখনো আলোর মুখই দেখত না।
বর্ণবাদবিরোধী
আন্দোলনে যুক্ত থাকার দায়ে এ তিন ব্যক্তি রোবেন আইল্যান্ডে ম্যান্ডেলার সঙ্গে
দীর্ঘ মেয়াদে কারাভোগ করেন। তাঁরা হলেন: ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী
সত্যেন্দ্রনাথ রঘুনানান ওরফে ‘ম্যাক’
মহারাজ এবং আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের দুই
বিশিষ্ট বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকর্মী আহমেদ কাদরাদা ও ওয়াল্টার সিসুলু। আলোচিত ‘রিভোনিয়া বিচারের’
পর বর্ণবাদী সরকার তাঁদের কারাগারে নিক্ষেপ
করে।
‘ম্যাক’ মহারাজ ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান
কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তিনি ম্যান্ডেলার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গেও
যুক্ত ছিলেন।
বইটির
প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ‘ম্যাক’ মহারাজ সম্প্রতি বলেন,
‘আলাদা কারাকক্ষে রাখা হয়েছিল আমাদের।
প্রতিটি কক্ষে করিডরমুখী জানালা ছিল। রক্ষীরা দিনরাত আমাদের পাহারা দিত। ২৪ ঘণ্টাই
আলো জ্বলত।’ তিনি বলেন,
‘প্রতি রাতেই লিখতেন ম্যান্ডেলা। লেখার
জন্য যিকঞ্চিত্ যে সুযোগ, তা কাজে লাগিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫
পৃষ্ঠা করে লিখতেন তিনি। আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে ও স্মৃতি হাতড়ে লেখার কাজ
চালাতেন তিনি।’
৭৬ বছর বয়সী
ম্যাক মহারাজ আরও বলেন, ‘লেখা শেষ হলে পরদিন এসব কাগজ কাদরাদা ও
সিসুলুর কাছে যেত। তাঁরা লেখা পড়ে মতামত দিতেন। পরে আমি অনুলিপির কাজ করতাম। রাতে
আবার ১০-১৫ পৃষ্ঠা লিখে ফেলতেন ম্যান্ডেলা।’
ম্যান্ডেলার
সহযোগীরা মাঝেমধ্যে অসুস্থ হওয়ার ভান করে পড়ে থাকতেন। তখন তাঁদের শুয়ে থাকার সুযোগ
হতো। এতে তাঁরা রক্ষীদের নজর এড়িয়ে ম্যান্ডেলার লেখার কাজে সহযোগিতা করতে পারতেন।
লেখার জন্য
রুলটানা এ-ফোর আকারের কাগজ ব্যবহার করতেন ম্যান্ডেলা। কারাগারের চৌহদ্দির ভেতর
একটি মনিহারি দোকানে পাওয়া যেত এই কাগজ। অনেক কারাবন্দী পড়াশোনা করতেন। তাঁদের
জন্য প্রয়োজন হতো এসবের।
লেখার কাজ শেষ
হলে মূল পাণ্ডুলিপি একটি টিনের পাত্রে ভরে সবজিবাগানে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়।
এদিকে মহারাজ অনুলিপির ৬০ পৃষ্ঠা একটি হাতে তৈরি ফাইলে লুকিয়ে ফেলেন।
পরিসংখ্যানবিষয়ক নকশা বহন করা হতো ওই ফাইলে। কিছু পৃষ্ঠা ভরা হয় আপাত নির্দোষ বইয়ের
ভেতরে। অনেক বাঁধাবিঘ্ন পেরিয়ে ১৯৭৬ সালে এই সহযোগীরা গোপনে কারাগারের বাইরে
পাঠাতে সক্ষম হন ম্যান্ডেলার পাণ্ডুলিপি। একদিন এটি ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়ে
আলোড়ন সৃষ্টি করে।
স্ত্রী উইনিকে
লেখা চিঠি
নেলসন
ম্যান্ডেলা ১৯৭৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি উইনি ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠিতে বলেন,
...কারাগারের খুপরি হচ্ছে নিজেকে জানতে
শেখার উপযুক্ত এক স্থান; এখানেই মন-মানসিকতার মতিগতি ও
পরিবর্তনের পরম্পরাকে প্রত্যক্ষ ও বাস্তবানুগভাবে খোঁজ করা যায়। ব্যক্তি হিসেবে
আমরা যখন আমাদের অগ্রগতির বিচার করতে যাই তখন সামাজিক অবস্থান,
প্রভাব প্রতিপত্তি,
বিত্তবৈভব আর 'সার্টিফিকেটের শিক্ষা'র মতো অলঙ্কৃত বিষয়গুলো মানদণ্ড হিসেবে আমাদের
মনোযোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। .... সততা, সচেতনতা, সরলতা, মানবিকতা, অমায়িকতা, পরের তরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া_
এসব গুণ মনের নাগালের সীমার মধ্যেই থাকে;
নিভৃতে হয়ে থাকে আধ্যাত্মিক মনের
ভিত্তিস্তম্ভরূপে। এসব অন্তর্নিহিত গুণ করায়ত্ত করা তখনই অসম্ভব_
যখন তুমি অজানাই রয়ে যাও তোমার নিজের কাছে;
যখন তুমি জানো না তোমার দুর্বলতা কোথায়;
যখন তুমি অন্ধ তোমার ভুলগুলো নিয়ে।
ম্যান্ডেলার
আত্মজীবনী থেকে উক্তি
"" ‘একজন মানুষ অন্য একজনকে শুধু তার গায়ের রং,
অতীত-পরিচয় বা ধর্মের কারণে ঘৃণা করতে পারে না।
কীভাবে ঘৃণা করতে হয়, তা মানুষকে শিখতে হয়। আর যদি তারা
শিখতে পারে কীভাবে ঘৃণা করতে হয়, তাহলে কীভাবে
ভালোবাসতে হয় তা-ও তাদের শেখানো সম্ভব। ঘৃণার তুলনায় ভালোবাসা মানুষের হূদয়ে আরও
স্বতঃস্কুর্তভাবে আসে।’
"" ‘আমি জেনেছি, ভয়ের অনুপস্থিতিই সাহস নয়, সাহস হলো ভয়ের ওপর বিজয়। যিনি ভীত হন না তিনি সাহসী মানুষ নন,
বরং তিনিই সাহসী যিনি ভয়কে জয় করেছেন।’
"" ‘আমাদের দেশে আমরা প্রথমে কারাগারে যাই,
তারপর রাষ্ট্রপতি হই।’
"" ‘কোনো দেশের কারাগারে না থাকলে একজন মানুষ সে
দেশকে সত্যিকারভাবে জানতে পারে না। একটি জাতি সর্বোচ্চ সম্মানিত নাগরিকদের সঙ্গে
কেমন আচরণ করে তা দিয়ে নয় বরং সবচেয়ে নিচের লোকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে তা দিয়ে ওই
জাতি কেমন তা বিচার করা যেতে পারে।’
"" ‘আমি সব সময়ই জানতাম একদিন আমি আমার নগ্ন পায়ে
ঘাস স্পর্শ করতে পারব। রৌদ্রোজ্জ্বল পথে মুক্ত মানুষ হিসেবে হাঁটতে পারব।’
"" ‘মুক্তির সহজ পথ কোথাও নেই। আকাঙ্ক্ষার
পর্বতশিখরে পৌঁছাতে হলে আমাদের অনেককেই বারবার মৃত্যুময় ছায়া উপত্যকা পেরিয়ে যেতে
হবে।’
"" ‘আমি সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিকে ঘৃণা করি,
কারণ এটি খুব বর্বর একটি বিষয়। আসুক সেটি কোনো
কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির থেকে কিংবা শ্বেতাঙ্গ একজনের কাছ থেকে।’
"" ‘একজন মানুষ একটি পুরস্কার জেতার আশায়
মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে না। কিন্তু যখন আমি দেখলাম, ১৯৯৩ সালে এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে
যৌথভাবে আমি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছি, তখন তীব্রভাবে তাড়িত হলাম। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে নোবেল পুরস্কারের
সম্পর্কের কারণে আমার কাছে এর একটা বিশেষ মূল্য আছে। এ পুরস্কার সব দক্ষিণ
আফ্রিকানের জন্য সম্মানের, বিশেষ করে যাঁরা লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন।
আমি তাঁদের পক্ষ থেকে এটি গ্রহণ করেছি।’
"" ‘আমি সমবেত জনতার উদ্দেশে বললাম,
ঠান্ডায় আমার গলা ভেঙে গেছে। ডাক্তার আমাকে
সমাবেশে যোগ দিতে নিষেধ করেছেন। আমি বললাম, “আপনারা যেন এটা ফাঁস করে দেবেন না যে আমি তাঁর কথা অমান্য করেছি।”
আমি ডি ক্লার্ককে ধন্যবাদ দিলাম তাঁর শক্ত
ভুমিকার জন্য। আমি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সদস্যদের ধন্যবাদ দিলাম যাঁরা
গণতন্ত্র্রের জন্য এত কঠোর ও এত দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। মহান মুক্তিযোদ্ধা মার্টিন
লুথার কিং জুনিয়রের স্ত্রী করেটা স্কট কিং ওই দিন মঞ্চে ছিলেন। আমি তাঁর দিকে
তাকালাম। আমি তাঁর স্বামীর অমর বাণী থেকে উদ্ধৃতি দিলাম। “আমাদের দেশের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
মুহুর্তগুলোর একটি এই সময়টা। গভীর গৌরব ও আনন্দে উদ্বেলিত মানুষের সামনে আমি
দাঁড়িয়েছি। সাধারণ ও বিনম্র মানুষের গৌরবের সামনে। আপনারা প্রশান্তি ও সহিষ্ণুতার
সঙ্গে এই দেশকে নিজের বলে দাবি করেছেন। আজ আমরা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিতে পারি,
অবশেষে আমরা স্বাধীন হয়েছি। অবশেষে স্বাধীন।
আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে, আপনাদের সাহসের কাছে অবনত,
আপনাদের সবার জন্য ভালোবাসা ভরা এক হূদয় নিয়ে।’
"" ‘এই দীর্ঘ একাকিত্বের বছরগুলোতে আমার নিজের
মানুষের মুক্তির ক্ষুধা পরিণত হলো কালো-শাদা সব মানুষের মুক্তির ক্ষুধায়। আমি
জানতাম, নিপীড়িতের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে
নিপীড়কেরও মুক্তি দরকার। যে মানুষ অন্য একজন মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেন,
তিনি ঘৃণার জালে বন্দী। তিনি তাঁর পূর্বধারণা ও
সংকীর্ণ মানসিকতার দ্বারা আবদ্ধ। আমি যখন কারও স্বাধীনতা কেড়ে নিই তখন সত্যিকার
অর্থে আমি মুক্ত নই, যেমনভাবে আমার স্বাধীনতা কেউ কেড়ে নিলে
আমি আর মুক্ত থাকি না। নিপীড়ক ও নিপীড়িত উভয়েই তাদের মানবতা থেকে একইভাবে বঞ্চিত।
"" কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার
পর আমার লক্ষ্য হলো নিপীড়ক ও নিপীড়িত উভয়কেই মুক্ত করা। কেউ কেউ বলেন,
এখন এই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু আমি জানি,
এটা সে রকম কিছু নয়। সত্য হলো,
আমরা এখনো মুক্ত নই। আমরা শুধু মুক্ত হওয়ার
স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি, নিপীড়িত না
হওয়ার অধিকারটুকুই আমাদের আয়ত্তে এসেছে। আমরা আমাদের অভিযানের চুড়ান্ত পদক্ষেপটি
নিতে পারিনি। আরও দীর্ঘ ও কঠিন পথে প্রথম পদক্ষেপটি ফেলতে পারিনি। মুক্ত হওয়া মানে
শুধু একজনের শৃঙ্খল খুলে ফেলা নয়। বরং এমনভাবে বসবাস করা,
যা অন্যকে শ্রদ্ধা করে এবং অন্যের স্বাধীনতার
পরিসরকে বাড়ায়। স্বাধীনতার সত্যিকার আস্বাদের পথযাত্রা সবে আমরা শুরু করেছি।’
মুক্তির দীর্ঘ পথ
১৯১৮: দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকুলের
ছোট্ট একটি গ্রামের এক আদিবাসী গোত্রে জন্নগ্রহণ করেন রলিলালা দালিভুংগা
ম্যান্ডেলা। পরে স্কুলের এক শিক্ষকের কাছ থেকে পান তাঁর ইংরেজি নাম নেলসন।
১৯১৯: সাদা চামড়ার এক ম্যাজিস্ট্রেটের
নির্দেশে নিজের বেশির ভাগ অর্থ, ভু-সম্পত্তি আর
গবাদিপশু হারালেন ম্যান্ডেলার বাবা।
১৯২৭: বাবার মৃত্যুর পর ম্যান্ডেলার
দেখাশোনার দায়িত্ব পেলেন থেমবু গোত্রের সর্দার জনগিনটাবা ডালিনডিয়েবো।
১৯৪৩: সাধারণ একজন কর্মী হিসেবে যোগ
দিলেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসিতে।
১৯৪৪: ঘনিষ্ঠ বন্ধু অলিভার টেম্বো আর
ওয়াল্টার সিসুলু এএনসির যুবদল গঠন করলেন। এ বছরই বিয়ে করেন তাঁর প্রথম স্ত্রী
এভেলিনকে। ১৯৫৭ সালে বিয়েবিচ্ছেদের আগে তাঁদের ঘরে জন্ন নেয় তিনটি সন্তান।
১৯৫৫: শ্বেতাঙ্গদের সমান সম্পত্তির
অধিকার ও মানবাধিকার চেয়ে স্বাধীনতা সনদ উপস্থাপিত হলো কংগ্রেস অব দ্য পিপলে।
১৯৫৬: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও
বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হলো ম্যান্ডেলাসহ আরও ১৫৫ জন রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে।
অবশ্য চার বছরের বিচার শেষে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বাতিল করে দেওয়া হয়।
১৯৫৮: বিয়ে করলেন উইনি মাডিকিজেলাকে।
১৯৬০: কালোদের অধিকার খর্ব করে−এমন একটি আইনের প্রতিবাদ করার সময় নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর গুলি চালায়
পুলিশ। এতে মারা যায় ৬৯ জন। এএনসিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং গুপ্ত সামরিক শাখা
গঠন করলেন ম্যান্ডেলা।
১৯৬৪: এক বছরেরও বেশি সময় পালিয়ে
বেড়ানোর পর পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। রাষ্ট্রদোহ আর অন্তর্ঘাতের অভিযোগে আজীবন
কারাদন্ড হলো তাঁর এবং অন্তরিন করে পাঠানো হলো রোবেন দ্বীপে। তাঁর মুক্তির জন্য
প্রচারণা শুরু করলেন স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলা।
১৯৬৮ ও ১৯৬৯: ম্যান্ডেলার মা এবং গাড়ি
দুর্ঘটনায় তাঁর ছোট ছেলে মারা যায়। কিন্তু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অনুমতি
পেলেন না ম্যান্ডেলা।
১৯৮০: ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে তাঁর
নির্বাসিত বন্ধু টেম্বো এক আন্তর্জাতিক প্রচারণার আয়োজন করলেন।
১৯৮৬: আন্তর্জাতিকভাবে দক্ষিণ
আফ্রিকাকে সাহায্য ও ঋণ দিতে কঠোরতা আরোপ করা হলো।
১৯৯০: আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এএনসির
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক। বহু গোত্রভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার
বিষয়ে আলোচনা শুরু করল এএনসি আর সাদাদের ন্যাশনাল পার্টি।
১৯৯২: অপহরণ ও সন্ত্রাসী হামলায়
সহযোগিতা করার জন্য অভিযুক্ত হওয়ায় স্ত্রী উইনিকে তালাক দিলেন ম্যান্ডেলা।
১৯৯৩: রক্তাক্ত ও বিক্ষুব্ধ এক অবস্থা
থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরণে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য যৌথভাবে নোবেল শান্তি
পুরস্কার জয় করলেন নেলসন ম্যান্ডেলা এবং ডি ক্লার্ক।
১৯৯৪: দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে
প্রথমবারের মতো বহু জাতির অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট
নির্বাচিত হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। জাতীয় সংসদে ৪০০ আসনের মধ্যে ২৫২টিই লাভ করল
তাঁর দল এএনসি।
১৯৯৮: আশিতম জন্নদিনে বিয়ে করলেন
মোজাম্বিকের সাবেক প্রেসিডেন্টের বিধবা স্ত্রী গ্রাশা ম্যাশেলকে।
১৯৯৯: প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিলেন
ম্যান্ডেলা।
২০০০: বুরুন্ডির গৃহযুদ্ধ নিরসনের
মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মনোনীত করা হলো তাঁকে।
২০০১: ৮৩ বছর বয়সে প্রোস্টেট ক্যান্সার
ধরা পড়ল তাঁর শরীরে।
২০০৪: ১৫ জুলাই ব্যাংককে ১৫তম
আন্তর্জাতিক এইডস কনফারেন্সে ভাষণ দেন। এখানেই ৪৬৬৬৪ ক্যাম্পেইনের ঘোষণা দিলেন
ম্যান্ডেলা। বললেন, আপনার জীবনের একটি মিনিট এইডস
ক্যাম্পেইনের জন্য ব্যয় করুন।
২০০৭: ব্রিটেনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে
পৃথিবীর মহত্তম নেতা হিসেবে ভাস্কর্য স্থাপন করা হলো তাঁর।
২০০৮: নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে
নব্বইতম জন্নদিন উদযাপন।
৪৬৬৬৪
রোবেন দ্বীপে বন্দী থাকা অবস্থায় বর্ণবাদবিরোধী
আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার শনাক্তকারী সংখ্যা বা প্রিজন নম্বর
ছিল ৪৬৬৬৪। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে গ্রেপ্তার করে রোবেন দ্বীপে
পাঠানো হয় ম্যান্ডেলাকে। তিনি ছিলেন ৪৬৬ নম্বর কয়েদি। রোবেন দ্বীপে কয়েদিদের কখনো
তাঁদের নাম ধরে চিহ্নিত করা হতো না। তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো নম্বর আর আটক
হওয়ার বছরের সাহায্যে। সে সুত্রে, রোবেন দ্বীপে
ম্যান্ডেলার পরিচয় তথা শনাক্তকারী সংখ্যা বা নম্বর হয় ৪৬৬৬৪। সম্ভবত জাতিগত অধিকার
আদায়ের জন্য যুদ্ধরত কৃষ্ণাঙ্গদের হেয় করার উদ্দেশ্য নিয়েই নামহীন সংখ্যার মাধ্যমে
পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো তাঁদের। মূলত এ কারণেই তাঁর এইডসবিরোধী প্রচারাভিযানের
প্রতীক হিসেবে এ সংখ্যাটিকেই বেছে নিয়েছেন ম্যান্ডেলা।
ম্যান্ডেলার এ ৪৬৬৬৪ ক্যাম্পেইনের
সুচনা হয় ২০০৩ সালে। তখনই ম্যান্ডেলা প্রথম উপলব্ধি করলেন,
বিশ্বের তরুণ সমাজের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছে
দিতে হলে অবশ্যই তাঁকে সংগীত, খেলাধুলাসহ
বিভিন্ন পর্যায়ের তারকাশিল্পীদের সাহায্য নিতে হবে। ডেভ স্টুয়ার্ট,
ব্রায়ান মে, রজার টেইলর আর বনোর সহায়তায় ২০০৩ সালের নভেম্বরে কেপটাউনে
এইচআইভি/এইডস সচেতনতার এক কনসার্টের আয়োজন করেন। বিশ্বজুড়ে রেডিও,
টেলিভিশন আর ইন্টারনেটে প্রচারিত হওয়া এ
অনুষ্ঠান এইডসবিরোধী প্রচারাভিযানে খুব শক্তিশালী এক প্রতীক হিসেবে উপস্থিত করল
৪৬৬৬৪ সংখ্যাটিকে। এইডসবিরোধী ৪৬৬৬৪ ক্যাম্পেইনের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে
পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকার জর্জ (২০০৫), স্পেনের মাদ্রিদ (২০০৫) আর নরওয়ের ট্রমসোতে (২০০৫) আয়োজিত হয় আরও
কয়েকটি কনসার্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না যে একসময় একজন মানুষকে হেয় করার জন্য
ব্যবহার করা হয়েছে যে সংখ্যা, তাই এখন
বিশ্বব্যাপী পরিণত হয়েছে মানবতার এক শক্তিশালী প্রতীকী চিহ্নে।
লং ওয়াক টু ফ্রিডম
নিজের সঙ্গে কথোপকথন
ব্যক্তিগত চিঠিপত্র,
ভাষণ, সাক্ষাৎকার, বহু দশকের পুরোনো দলিল-দস্তাবেজ একত্র
করে ম্যান্ডেলার যাপিত জীবনকে তুলে আনা হয়েছে কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ বইয়ে। উঠে
এসেছে দিনপঞ্জির আদলে কারাগারে অতিবাহিত তাঁর সেই নিরানন্দ মামুলি দিনের বিবরণ
থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,
সেসবও। এখানে ম্যান্ডেলাকে পাওয়া যায় একজন
পণ্ডিত ও রাজনীতিক হিসেবে, একজন সংসারী মানুষ ও বন্ধু হিসেবে;
দেখা যায় একজন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতাকে।
ম্যান্ডেলা তাঁর আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন লং ওয়াক টু ফ্রিডম। সেই অসমাপ্ত
আত্মজীবনীর পরের অংশও বলা যায় এ গ্রন্থকে। তাঁর জীবনের দীর্ঘ অভিযাত্রার অনেক
অজানা কাহিনি ও ভিন্নতর পথপরিক্রমার গল্প নতুনভাবে আবিষ্কারে সুযোগ করে দেবে নতুন
এই বই।
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
আমরা কখনোই বহুজাতিক সমাজকে মেনে
নিইনি। আমরা চেয়েছি অসাম্প্রদায়িক একটি সমাজ, কারণ তুমি যখন বহুজাতের কথা বলো, তুমি আসলে অনেক সম্প্রদায়ের কথাই বলো: তুমি বলতে চাও তোমার এ দেশে
একসঙ্গে অনেক জাতির মানুষের বসবাস করে। আর এভাবেই আসলে বংশ বা জাতির ধারণা টিকিয়ে
রাখা হচ্ছে, তাই আমরা এমন একটি সমাজব্যবস্থার
স্বপ্ন দেখি, যেখানে জাতি,
ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।
সেখানে মানুষকে বিভক্ত করা হয়, এমন কোনো কথাই
উচ্চারিত হবে না।
...অনেক চিন্তাভাবনা করেই আমরা এ
কথাগুলো বলেছি। ব্যাপারটি নিয়ে অনেক গভীরভাবে ভেবেছিও। আমরা কোনোমতেই বহু
সম্প্রদায়ভিত্তিক সমাজকে স্বীকার করি না। আমাদের লক্ষ্য এমন একটা সমাজ ও
রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন, যেখানে কোনো মানুষ আরেকজনের গায়ের রংকে
ভিত্তি করে কথা বলবে না। (৯. পৃষ্ঠা: ১১৮) সম্পাদক ও লেখক,
ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী: লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এর
লেখায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।
রিভনিয়া বিচারের রায়
আহমেদ কাতরাদার সঙ্গে কথোপকথন
রিভনিয়া বিচারের রায় কী হবে,
এই চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মুখে ‘আমি এসব নিয়ে ভাবছি না’,
‘যা হবার হবে’—এসব কথা খুব বলা যায়,
কিন্তু ভেতরে ভেতরে মামলার রায় কী হবে,
সেই দুশ্চিন্তা আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছিল।
রিভনিয়া মামলায় আমাদের মৃত্যুদণ্ড হবে, মোটামুটি ধারণা করতে পারছিলাম। কারণ রায়ের আগের দিন সকালেও পুরো জেলে
আমাদের মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারটিই আলোচিত হচ্ছিল। সরকারের চোখে আমরা মৃত্যুদণ্ড
পাওয়ার মতোই ‘অপরাধী’। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,
কেউ যখন তোমার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা
করছে: ‘তোমার জীবন এখানেই শেষ’,
তা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে
মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা শোনাটা বেশি কষ্টের। তবে রায়ের আগে এই অনুভূতিটা আমরা ভুলে
থাকার চেষ্টা করছিলাম। একে অপরকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে মনের দিক দিয়ে আমার
সঙ্গীরা সে সময়ে আমার চেয়েও বেশি শক্ত ছিল। এটা না বললে খুবই অন্যায় হবে। শেষ
পর্যন্ত অবশ্য বিচারক আমাদের মৃত্যুদণ্ড দেননি সেই মামলায়। (১৬. পৃষ্ঠা: ১২৪)
আহমেদ কাতরাদা: বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মী, রাজনীতিক, প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক
উপদেষ্টা
জেনি ও জেন্দজিকে লেখা চিঠি
শেষবার তোমাদের দেখেছি,
তা প্রায় আট বছর হয়ে গেল। এক বছর আগে তোমাদের
মাকেও গ্রেপ্তার করেছে ওরা।
গত বছর দুটো চিঠি লিখেছিলাম তোমাদের।
আমি নিশ্চিত, সেগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছানো হয়নি।
কারণ তোমাদের কারোর বয়সই ১৬ হয়নি, তাই এ চিঠি
তোমাদের কাছে পৌঁছানোর কথাও নয়। অপেক্ষা করছি, কবে তোমরা একজন কয়েদির সঙ্গে দেখা করার মতো বড় হবে,
আমি সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছি।
পাবে না জেনেও আমি তোমাদের চিঠি লিখি
কেন জানো? তোমাদের যখন লিখি,
অসম্ভব আনন্দ পাই। মনে হয়,
আমি তোমাদের সঙ্গেই আছি। তোমাদের ভালোমন্দের
খোঁজ নিচ্ছি। তাই যখনই সময় পাই, চিঠি লিখতে বসি
তোমাদের। এই কারাবাসে আমি সবচেয়ে বেশি চিন্তায় থাকি তোমাদের নিয়ে। এক বছরেরও বেশি
হয়ে গেছে, এ পর্যন্ত তোমাদের ব্যাপারে বলতে গেলে
নির্ভরযোগ্য কোনো খবরই পাইনি। জানি না, কীভাবে চলছে তোমাদের। কীভাবে তোমরা স্কুলে যাচ্ছ,
তোমাদের স্কুলের বেতনই বা আসছে কোত্থেকে। ছুটির
দিনগুলো কীভাবে কাটে তোমাদের, কে তোমাদের
খাওয়ার ব্যবস্থা করছে, কে তোমাদের কাপড়চোপড় কিনে দিচ্ছে।
তোমরা চিঠি পাবে না, তার পরও তোমাদের লিখি,
কারণ আমি বিশ্বাস করি,
একদিন নিশ্চয়ই ভাগ্য আমাদের সহায় হবে,
তোমরা আমার সব চিঠি পাওয়া শুরু করবে। তোমাদের
চিঠি লেখার আরেকটা কারণ আছে: মা, মনিরা,
আমি তোমাদের অসম্ভব ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার
কথা তোমাদের এই চিঠি ছাড়া আর কোনোভাবে বলার সুযোগ নেই। চিঠিগুলো লিখে আমি তোমাদের
না দেখতে পাওয়ার কষ্টও ভুলি, মনে শান্তি পাই।
(১৬. পৃষ্ঠা: ১৮০)
জেলখানার গান
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
জেলে থাকার সময় চুনাপাথরের খনিতে কাজ
করতে হতো আমাদের। চুনাপাথরের খনির কাজ অসহনীয়, কঠোর পরিশ্রমের। খনিতে কাজ করার সময় আমাদের দেওয়া হতো একটি লোহার
শাবল। সেই শাবল দিয়ে আমাদের চুনাপাথরের শক্ত-কঠিন স্তরগুলো ভাঙতে হতো। ব্যাপারটি
যে কী কষ্টের, বলে বোঝানো যাবে না। খনিতে কাজ করতে
পাঠানোর পেছনে কারা কর্তৃপক্ষের একটা যুক্তি ছিল, তারা মনে করত, জেল খাটা কোনো আনন্দদায়ক ব্যাপার নয়। এখানে কেউ
বেড়াতে আসে না, কাজেই জেলে এলে তাকে কষ্ট করতেই হবে।
কয়েদিদের খনিতে কাজ করাটা যেন শাস্তিরই অংশ।
খনিতে কাজ করতে করতে আমরা অসম্ভব
ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। মনোবল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হতো। বুঝতে পারতাম,
মনোবল ভাঙতেই ওরা আমাদের দিয়ে এত কষ্ট করায়।
এটা ভেবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতাম। খনিতে কাজ করতে করতে আমরা তাই গণসংগীত গাইতাম। সেসব
মুক্তির গান। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের বিমূর্ত প্রতিবাদ ফুটে উঠত সেসব গানে। গণসংগীত
শুনে সবাই চাঙা হয়ে উঠত। শোষকের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগ্রামের জন্য গর্ব করত।
খনির এই ভয়াবহ পরিশ্রমের মাঝেও কাজ
করতে করতে কয়েদিরা গণসংগীত গাইছে, গণসংগীতের
উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে, এটা ভালো লাগল
না কারা কর্তৃপক্ষের। কারা আচরণবিধি সংশোধন করে সব ধরনের সংগীত নিষিদ্ধ করল তারা।
এই নিষেধাজ্ঞা আমরা মেনে নিইনি। চুনাপাথরের খনির কারারক্ষীদের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে
আমরা গান গাইতে পারতাম না ঠিক, কিন্তু সন্ধ্যায়
নিজেদের সেলে ফিরেই চিৎকার করে গান গাইতে শুরু করতাম। নববর্ষে কিংবা বড়দিনে আরও
বেড়ে যেত আমাদের গানের আওয়াজ। একসময় কারা কর্তৃপক্ষের কাছেও ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে
গেল। গান গাইলে তারা আর বাধা দিতে আসত না। (১০. পৃষ্ঠা: ১৪১)
নির্বাসনের একাকিত্ব
রিচার্ড স্টেঙ্গেলের সঙ্গে কথোপকথন
নির্বাসন খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার।
বিশেষ করে তুমি যখন জেলে বন্দী। একে তো কারাগারের একাকিত্ব,
তার পর যদি তোমাকে সতীর্থদের থেকেও আলাদা করে
রাখা হয়, এর চেয়ে নির্মম আর অমানবিক কিছু হতে
পারে না। রিভনিয়া বিচারের রায় ঘোষণার পর জেলখানায় বিভিন্ন দাবি নিয়ে আমি সোচ্চার
হই। এর মধ্যে প্রধান এবং মৌলিক দাবিটি ছিল আমাদের রাজবন্দীর মর্যাদা দেওয়া,
এই দাবি তোলায় আমাকে অন্য কারাবন্দীদের কাছ
থেকে আলাদা করে ফেলা হলো। এমন ব্যবস্থা করা হলো, যেন আমি কারও সঙ্গে দেখা করতে না পারি। এমনকি
আমার প্রতিদিনের খাওয়াও আলাদা করে দেওয়া হলো। একজন কারারক্ষী আমাকে খাবার দিয়ে
যেত। ওই রক্ষী ছাড়া আর কোনো মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হতো না। নিয়ম করে সকালে
আধঘণ্টা ও রাতে আধঘণ্টার জন্য আমাকে সেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। সে সময় অনেক
চেষ্টা করেও আমি অন্য কারাবন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। দেখা করতে পারব কী করে,
আমাকে যখন সেলের বাইরে আনা হতো,
অন্য কয়েদিদের তখন পাঠিয়ে দেওয়া হতো ‘লক আপে’ তাদের নিজেদের সেলে। (১৪. পৃষ্ঠা: ১৪৮)
স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি
শেষ পর্যন্ত আমার পরিবারের একটা ছবি
পেলাম। কী চমৎকার ছবি! ম্যাকগাথো আর ওর বোনদের সঙ্গে তোমাকে কী চমৎকার দেখাচ্ছে!
এই ছবিটা আমার এই নিঃসঙ্গ কারাজীবনের একমাত্র আনন্দের উৎস। তবে ছবিটা দেখতে দেখতে
আনন্দের পাশাপাশি আমার অন্য রকম এক অনুভূতিও হয়। তোমার চেহারায় এক অব্যক্ত স্থায়ী
দুঃখের ছাপ পড়ে যাচ্ছে, অন্যমনস্কতাও। তার পরও তোমার চেহারার
সেই অসাধারণ সৌন্দর্য এখনো অটুট আছে। তোমার সৌন্দর্য এখনো আমার মাথা খারাপ করে
দেয়। বিয়ের পরের ১০ বছর কী দারুণ আনন্দে কেটেছে আমাদের। সেই স্মৃতি আমার মনে ঝাপসা
হয়ে যায়নি। আমার মনে হচ্ছে, এ ছবির মধ্য দিয়ে তুমি আমার কাছে
অব্যক্ত কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে চেয়েছ। সেটা আমি বুঝে নিয়েছি। তবে একটা কথা
তোমাকে বলি, ছবিটি দেখার পর আমার মনের অনেক
দুঃখকষ্ট দূর হয়ে গেছে। চমৎকার এক সুখানুভূতি ঘিরে আছে এখন আমাকে। তোমার প্রতি
আমার ভালোবাসা যেন আরও গভীরভাবে অনুভব করছি, স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি ভীষণ রকম, মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের ছোট্ট সুন্দর বাড়িটাকে...। (১৯. পৃষ্ঠা: ১৫৩)
মায়ের মৃত্যু (এই চিঠি লেখা হয় ১৪
অক্টোবর ১৯৬৮ সালে)
গত বছরের সেপ্টেম্বরে শেষবারের মতো আমি
মাকে দেখেছি। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে চলে যাওয়ার সময় কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল,
মাকে আমি আর কোনো দিন দেখতে পাব না। আমার মা
আমার খুব প্রিয় মানুষদের একজন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে হতবাক করে দিল। মনে হলো
আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অসাড় করে দিয়েছে মায়ের মৃত্যুসংবাদ। চারপাশের পৃথিবীটা যেন
একদম শূন্য হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর শোকের মধ্যেও আমার জেলখানার বন্ধুরা,
আমার সহবন্দীরা আমার পাশে থেকেছে,
সান্ত্বনা দিয়েছে। আমার মাতৃশোক ভুলিয়ে দেওয়ার
চেষ্টা করেছে তারা আপ্রাণ, শোক কাটিয়ে মনোবল চাঙা করতে সাহায্য
করেছে সব সময়। মায়ের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে না পেরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে,
কিন্তু যখন শুনেছি,
মায়ের শেষ বিদায়ের সময় আমার আত্মীয়স্বজন ও
বন্ধুবান্ধব উপস্থিত ছিল, শুনে ভীষণ খুশি হয়েছি। তারা সবাই
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমার মাকে বিদায় দিয়েছে, তার মৃত্যুতে তারা চোখের জল ফেলেছে—আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। (১. পৃষ্ঠা: ১৫৯)
ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে
খুব ভালো বক্তা ফিদেল কাস্ত্রো। দক্ষিণ
আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর একটি অনুষ্ঠানে কাস্ত্রোর সঙ্গে ভাষণ দেওয়ার
সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দেখলাম, তিন ঘণ্টা টানা
বলে গেল, কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই। তিনি বলছেন,
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছেন,
কাউকে উদ্ধৃত করছেন। সত্যিই অবাক হওয়ার মতো
ব্যাপার। এই পুরো সময়টা তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন। এ সময় কেউ
হলের বাইরে গেল না। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার তাড়াও যেন ভুলে গেল। পুরো বক্তৃতায় তিনি
অনেকবারই আমেরিকাকে ধুয়ে দিলেন, বললেন,
ওরা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া।
বক্তৃতা শেষে আমরা একসঙ্গে গাড়িতে করে
শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি চুপচাপ বসে আছেন, আমি একাই শুধু সাধারণ মানুষের উদ্দেশে হাত
নাড়লাম। একটা পর্যায়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম, উনি কেবল কালো মানুষদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। সন্দেহ হলো,
ব্যাপারটি কি তিনি আমাকে খুশি করার জন্য করছেন?
নাকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করছেন। আমার চিন্তা ভুল
ছিল, পরে দেখলাম ভিড়ের মধ্যে করমদর্নের সময়
তিনি প্রথমে একজন সাদা পরেরজন একজন কালোকে বেছে নিচ্ছেন। আমি উপলব্ধি করলাম,
তিনি আন্তরিকভাবেই এটা করছেন। কাস্ত্রো
মনে-প্রাণে একজন আন্তরিক মানুষ। (১৫. পৃষ্ঠা: ৩৮৯)
কনভারসেশনস উইথ মাইসেলফ
(নেলসন ম্যান্ডেলার সাম্প্রতিক
প্রকাশিত গ্রন্থ ‘কনভারসেশনস উইথ
মাইসেলফ’ নিয়ে গার্ডিয়ান
পত্রিকার আন্তর্জাতিক সংস্করণে ১৭ অক্টোবর, ২০১০ সাংবাদিক পিটার গডউইনের একটি রিভিউ
প্রকাশিত হয়।)
চুয়াল্লিশ বছর
বয়সে কারান্তরীণ হয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন। পরবর্তী সিকি
শতক ধরে, তিনি হয়ে গেলেন একজন রহস্যময় মানুষ,
একজন হারিয়ে যাওয়া নেতা। অবশেষে ১৯৯০ সালে তিনি
যখন বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন, মানুষ তাঁর কথা শোনার জন্য অবদমিত
আকাঙ্খা নিয়ে ছুটলেন। তখন থেকেই, তাঁকে নিয়ে লেখা
বই এবং তাঁর লেখা বই পরিনত হয়েছে একটি শিল্পে, বলতে গেলে তাদের একটি নিজস্ব সাহিত্য শাখাঃ বিপুল সংখ্যক আত্নজীবনী,
অনুমোদিত এবং অননুমোদিত শিশুতোষ বই,
তাঁর নেতৃত্ব শৈলী উপস্থাপন করে বই,
বানিজ্যিক বই এবং শিল্পকলার বই বেরিয়েছে।
সেখানে সত্যিকারভাবেই কি আরেকটি বই ম্যান্ডেলা নামক স্ফিত বইয়ের তাকে নিজের জায়গা
করে নিতে পারবে? আর কিইবা বলার আছে নতুনকরে?
এই বইটি পেরেছে, খুব ভালোভাবেই উতরে গেছে।
‘কনভারসেশনস উইথ মাইসেলফ’কে প্রথাগত বইয়ের চেয়ে বরং সাহিত্য সংকলন বলা ভালো,
এতে আছে ম্যান্ডেলার জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনার
বর্ণনা, ডাইরীর পাতা,
দিনপঞ্জি, চিঠি এবং এমনকি রিচার্ড স্টেনগেল, যিনি ম্যান্ডেলার আত্নজীবনী ‘লং ওয়ার্ক টু ফ্রিডম’ এর অনুলেখক ছিলেন (এবং বর্তমানে টাইম ম্যাগাজিনের সম্পাদক),
তাঁকে দেওয়া প্রায় পঞ্চাশ ঘন্টার কথোপকথনের
প্রতিলিপি। এতে আরো স্থান পেয়েছে ম্যান্ডেলার একটি আত্নজীবনীর কিছু অনুচ্ছেদ,
যেটি থেকে তিনি নিজেই কিছু মুহূর্ত ইতঃস্ততভাবে
বইটিতে সন্নিবেশ করেছেন, কিন্তু আবার চূড়ান্ত পর্যায়ে বাদ দিয়ে
বইটি সংকলন করতে দিয়েছেন।
সব বিষয় কিছুটা
অগোছালো ও পরিপাটিহীনভাবে উপস্থাপিত হওয়ার আশঙ্কা থাকত,
অদ্ভুত ব্যাপার এই যে,
এতে করে এমনটি হয় নি। এই বইটি গভীরভাবে গতিময়,
নৈসর্গিক এবং হস্তক্ষেপহীন,
এতে প্রকৃত সময়কে তুলে ধরা হয়েছে পারিপার্শ্বিক
সকল পরিবর্তনসহ, বছরের পর বছর,
বিরস মুহূর্তগুলো মিশে গেছে অতীব গুরুত্বপূর্ন
সময়ের সাথে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়, স্বপ্ন, রাজনৈতিক পদক্ষেপ সব একত্রে উঠে এসে,
ম্যান্ডেলার এই পর্যন্ত সবচেয়ে পূর্নাঙ্গ
জীবনের ছবি প্রকাশ করেছে।
ভার্ন হ্যারিস,
ম্যান্ডলা সেন্টার অব মেমরি অ্যান্ড ডায়ালগের
পরিচালক, যিনি সংকলনের জন্য এই দলিলগুলো বাঁছাই
ও সন্নিবেশিত করার প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি মুখবন্ধে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে,
নতুন দক্ষিন আফ্রিকার কিংবদন্তীতূল্য
বিনির্মানে ম্যান্ডেলা একটি অংশ হয়ে আছে। সর্বসাধারণে প্রচারিত তাঁর কথাগুলোর
সবটুকুই তাঁর নিজের লেখা নয়, এমন কি তাঁর
আত্নজীবনী ‘লং ওয়ার্ক টু ফ্রিডম’
এএনসির সহকর্মীদের তত্ত্বাবধানে সংকলিত হয়েছে,
যারা অনুধাবন করতে পারত এই লেখাটি রাজনৈতিক
আন্দোলনের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। ‘কনভারসেশনস উইথ মাইসেলফ’
বইটিতে, ম্যান্ডেলার ‘লং ওয়ার্ক টু ফ্রিডম’
বইটির উপরে এএনসি নেতা আহমেদ ক্যাথরাডা’র চমৎকার কিছু খসড়া পঠন আলোচনার প্রতিলিপি
সন্নিবেশিত আছে। ক্যাথরাডা পুস্তক প্রকাশক কর্তৃক প্রচারিত বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনকে
উদ্ধৃত করে, ম্যান্ডেলার বিভিন্ন অন্তরঙ্গ সময়ের আরো
অধিকতর ব্যক্তিগত মুহূর্তকে বইটিতে সন্নিবেশ করতে আহবান জানিয়েছিলেন। সেই বইটিতে,
এক জন লৌহমানব পাথুরে ম্যান্ডেলাকে খুব কমই
একজন মানবিক অনুভিতশীল ম্যান্ডেলায় দেখা গেছে। “কেমন লাগত সে দিনগুলোতে?”
এই ধরনের প্রশ্ন উত্তর দিতে প্রায় সময় তাঁকে
নির্লিপ্ত দেখা গেছে।
এটা
নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ম্যান্ডেলার এই চাপা স্বভাবই ‘কনভারসেশনস উইথ মাইসেলফ’
বইটিকে এমন একটি আবশ্যকীয় বইয়ে রূপ দিয়েছে।
তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত নোটখাতাগুলো পড়ে, আমরা অবশেষে আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া একজন মানুষকে যেন এক ঝলক দেখতে
পাই। সৌভাগ্যক্রমে এমন হয়েছে যে, ম্যান্ডেলা
প্রায় সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংরক্ষণ করে রাখতেন এবং প্রচুর নোট লিখতেন,
যদিও পুলিশ তাঁর লেখা বহু নোটখাতা বছরের পর বছর
ধরে জব্দ করে নিয়ে গেছে, যেগুলো আজ অনিবার্যভাবেই অন্ধকারের অতল
গহবরে হারিয়ে গেছে।
বন্দী দিনগুলোতে,
এক জন ব্যক্তির প্রবল প্রত্যাশাগুলো
স্বাভাবিকভাবেই ক্রমশ হারিয়ে যায়। ম্যান্ডেলা বলেছেন,
“যত দিন আমি জেলে বন্দী ছিলাম,
আমার স্মৃতি শক্তির ক্ষমতার উপর সেভাবে কখনই
ভরসা করতে পারি নি”। তাঁর পরিবার পরিজন এবং বন্ধু
বান্ধবদের কাছে থেকে, তাঁর লেখা কিছু চিঠির সারসংক্ষেপ নেওয়া
হয়েছে বইটিতে, অবশ্য সরকারী সেন্সরশীপে বাঁধাগ্রস্ত
হয়ে অনেক চিঠিই তার প্রাপকের কাছে পৌছাতে পারে নি। ম্যান্ডেলা তাঁর শক্ত বাঁধাই
করা নোটখাতাটিতে, এই সব চিঠির একটি অনুলিপি লিখে রাখতেন
( এই নোটখাতাটিও কর্তৃপক্ষ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ২০০৪ সালে এক অনুতপ্ত সাবেক
নিরাপত্তারক্ষী পুলিশ সদস্য এটি ফেরত দেন)। এই নোটখাতাটি এই বইয়ে সংযুক্ত করার ফলে,
বন্দী নম্বর ও নোটখাতাটির উপরে ডানকোণের
ডাকটিকিটসহ ম্যান্ডেলার নিখুত পরিপাটি লেখাগুলো দেখার সুযোগ আমরা পাই।
বইটি আমাদের
সংশোধনক্ষম প্রবনতার জন্য সহায়ক হবে, অতীত ঘটনাবলীকে পর্যালোচনা করে ইতিহাসকে দেখার,
যা কিছু ঘটেছিল তার কতকটা অপরিহার্য ছিল,
ভাবার। সেই সময়ের রুবেন দ্বীপের বন্দীদের কাছে,
এক সময়ের প্রবল পরাক্রমশীল বর্ণবাদী
রাষ্ট্রটিকে পরাজীত করা ছিল একটি দূরবর্তী স্বপ্ন, তথাপি সেদিনের মত আজকের দিনেও এটি একটি
মর্যাদাশীল সংগ্রাম হিসেবে বিবেচিত। বইয়ের এই উজ্জ্বল পাতাগুলো প্রত্যেককে সেই
সংগ্রামমুখর দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়, যেমন, ৪৬৬/৬৪ নম্বর বন্দীটি কয়েক দশক আগেই
মুক্তি পেতে পারত, যদি বন্দীকারীদের তৈরী কালো ‘স্বদেশভূমি’র যে কোনো একটিতে মুক্তি নিতে চাইতো এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র
সংগ্রাম আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করত। কিন্তু সে এমনটি করেন নি। পরবর্তীতে,
১৯৮৭ সালে দক্ষিন আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর
করা এক আবেদনে, ম্যান্ডেলা তাঁর আইন ডিগ্রী থেকে
ল্যাটিন পেপারটি উঠিয়ে নিতে বলেন, তিনি
নিরাবেগভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন যে, তাঁর পক্ষ্যে কোনোভাবেই সত্যিকারের আইন ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়,
“কেননা আমি যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাঁজা
খাটছি”।
নিজের প্রতি দয়া
বিহীন এক জন মানুষ এভাবেই আবির্ভূত হয়েছেন এখানে, যিনি নিজের ক্ষমতা,
বিত্ত ও মর্যাদা বৃদ্ধির প্রলোভন থেকে মুক্ত
ছিলেন। একটা ক্ষেত্রে, তিনি তাঁর আত্নজীবনীর অনুলেখক রিচার্ড
স্টেনগেলকে সতর্ক হওয়ার জন্য জোর দিয়েছিলেন, কেননা সামরিক প্রশিক্ষন নিয়ে আলোচনার সময়,
তিনি নিয়মিতভাবেই তাঁর লক্ষ্য থেকে সরে
যাচ্ছিলেন।
বইটি প্রত্যককে
আরো স্মরন করিয়ে দেয় যে, ম্যান্ডেলাকে ইতিহাসের কতটা খাড়া পথ
পাড়ি দিতে হয়েছে, তিনি কতটা অবিসংবাদিত। তিনি সব ধরণের
বই পড়তেন, ‘ওয়ার এন্ড পিস’
থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিতেন,
যখনই কোনো ‘সংগ্রাম’ এর প্রস্তুতি শুরু করতেন,
পরামর্শের জন্য নানা রকম বই যেমন ম্যাকিয়াভেলি,
ক্ল’জওয়িটয, মাও জেদং এবং মেনাকেমের সাযায্য নিতেন।
তিনি অ্যাংলো-বোয়ের যুদ্ধ সম্পর্কে সবিস্তারে পড়াশুনা করেছিলেন,
এবং পরবর্তীকালে এটি তিনি তাঁর নিজস্ব
কারারক্ষীদের বিপক্ষে আফ্রিকান্সভাষী-বিষয়ক যুক্তি-তর্কে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু
ম্যান্ডেলার ক্ষেত্রে, আমরা তাঁকে এখানে একজন রূঢ়ভাবে
আত্নসমালোচনাকারী হিসেবেও দেখতে পাই। তাঁর স্ত্রী, উইনিকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’
থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন,
“মধুরতা দুঃখ যন্ত্রনা ভোগ থেকে আসে….”,
এর পর তিনি বলেন, তিনি তাঁর পূর্বে দেওয়া কিছু ভাষণের প্রতিলিপি
পরীক্ষা করে দেখেছেন, “এই ভাষণগুলোতে আনুষ্ঠানিকতার উপর অধিক
মনোযোগ, কৃত্রিমতা এবং মৌলিকতার অভাব তাঁকে
মর্মাহত করেছে। মানুষেকে মুগ্ধ করা ও নিজেকে প্রচারের বাসনা সেখানে খোলাখুলিভাবেই
দৃশ্যমান”।
বইটি একটি
মূল্যবান দৃষ্টি সহায়ক কাঁচের মত, যাতে চোখ রেখে
দেখা যায় কিভাবে ম্যান্ডেলা তাঁর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন –
মার্কসীয় দর্শন, তাঁর খ্রিস্টিয় বিশ্বাস,
সশস্ত্র সংগ্রাম এবং নিরীহ সমর্থনকারী ও অপরাধ
সংঘটনকারীদের উপরে কর্তৃপক্ষের দুর্দমনীয় অত্যাচারী মনোভাব সম্পর্কে তিনি কি
ভাবতেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি রোল মডেল হিসেবে তিনি গান্ধীজির
চেয়ে নেহুরুকেই বেশি পছন্দ করতেন। এটাও খোলাসা করে বলেন যে,
তিনি অহিংস নীতিকে আদর্শ হিসেবে নয়,
বরং কৌশল হিসেবেই বিশ্বাস করতেন,
যদিও তাঁর বিচারের সময় এগুলো সে বলেন নি। তিনি
আলোচনা করেছেন কিভাবে তিনি ঠিকভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন,
তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে,
কেমন লাগবে আপনার কাছে যখন আপনি চিন্তা করবেন,
“এক জন বিচারক আপনার দিকে এগিয়ে আসবে
এবং আপনাকে এখনি বলবে, ‘আপনার জীবনের শেষ সময় উপস্থিত’
– ”।
বিষাদময়
ব্যক্তিগত বিষয়গুলোও এখানে তুলে ধরা হয়েছে, – উদাহারন হিসেবে বলা যায়, তাঁর প্রথম স্ত্রী, এভিলিনকে একবার
প্রহার করেছিলেন এই মর্মে তাঁর বিরূদ্ধে অভিযোগ, “তিনি তাঁর গলা টিপে ধরে ছিলেন”। (ম্যান্ডেলার নিজস্ব অভিমত হল,
একবার তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে,
এভিলিন চুলা থেকে লাল উত্তপ্ত খুন্তি বের করে
তাঁর মুখের দিয়ে এগিয়ে আসছিল, এবং তিনি তাঁর
হাত থেকে খুন্তিটি কেড়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিয়েছিল।) ১৯৬৮ সালে,
তাঁর ৭৬ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা তাঁর গ্রাম
ট্রানসকেই থেকে একাই রুবেন দ্বীপে তাঁকে দেখতে আসেন, ম্যান্ডেলা লিখেছেন,
“আমার সাথে সাক্ষাত শেষ হলে,
আমি তাঁকে ধীরে ধীরে নৌকার দিকে হেঁটে যেতে
দেখি, যেটি তাঁকে মূল ভূখন্ডে আবার ফিরিয়ে
নিয়ে যাবে, এবং তখনি আমার মনের মাঝে একটি চিন্তাই
বার বার দোলা দিচ্ছিল যেন, আমি শেষ বারের মত আমার মাকে দেখছি”।
ম্যান্ডেলার
কথাই ঠিক হল – কয়েক মাস পরেই তাঁর মা মারা যান,
এবং তাঁকে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার
জন্য অনুমতি দেওয়া হয় নি, এমনকি নিরাপত্তাক্ষী দ্বারা বন্দী
অবস্থায়ও নয়। দশ মাস পরে তাঁর বড় ছেলে, থেম্বি মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ১৩ জুলাই,
১৯৬৯ সালে রুবেন দ্বীপ কারাগারের কমান্ডিং
অফিসার বরাবর, ম্যান্ডেলা তাঁর ছেলের
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকার অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখেন,
এটি পড়লে যে কারো হৃদয় ভেঙে যাবে কষ্টে।
কর্তৃপক্ষ এটিও প্রত্যাখান করে।
‘কনভারসেশনস উইথ মাইসেলফ’ বইটিতে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে খাটো করে দেখা হয় নি (ম্যান্ডেলা
বইটিকে নিয়ন্ত্রন করার কোনো চেষ্টা করেন নি) এবং পারিবারিক জীবনকে প্রারম্ভেই বড়
করে তুলে ধরা হয়েছে। যখন উইনি তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন,
তাঁর জন্য “কিছু সিল্কের পায়জামা এবং নাইট গাউন…”
নিয়ে আসতেন। ম্যান্ডেলা সেগুলো ফিরিয়ে দিয়ে
বলতেন, “এই পোষাক এই জায়গায় ব্যবহারের জন্য নয়”। জেলখানার বন্দী দিনগুলোতে,
ম্যান্ডেলা ও স্টেনগেলের মধ্যে যৌনতা বিষয়ক
প্রশ্ন এবং ঐসব দিনগুলোতে ম্যান্ডেলাকে না পেয়ে উইনি কি করত,
তা নিয়ে ইতস্তত কথা হত,
এই সময় ম্যান্ডেলাকে প্রচন্ডভাবে আত্ন সংযমী
দেখা যেত।
স্টেনগেল
গভীরভাবে অনুসন্ধান করে বলতেন, “তাঁরও (উইনি)
বাইরে আলাদা একটা জীবন আছে, সে অন্য পুরুষের সাথে মেলামেশা করে….”। কিন্তু ম্যান্ডেলার মাঝে কোনো ঈর্ষা প্রকাশ
পেত না। পরবর্তীতে, উইনি যখন নিজেই জেলে অন্তরীণ হলেন,
কিভাবে জেল জীবন মানিয়ে নিতে হয়,
তা জানিয়ে ম্যান্ডেলা উপদেশ পাঠাতেন,
বিছানায় ঘুমোতে যাওয়ার পনের মিনিট ধ্যান করার
জন্য তাঁকে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু উইনি ছিলেন তাঁর স্বামীর থেকে একেবারেই আলাদা
ধাঁচের। যখন ম্যান্ডেলার স্বল্পবয়স্ক মেয়েরা তাঁর সাথে দেখা করে চলে যেত,
তিনি তাঁর স্ত্রীকে চিঠি লিখে জানাতো,
কত সুন্দরভাবে বেড়ে উঠছে মেয়েগুলো,
তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে বলেন যে,
“এমন হত, আমি যেন বড় ধরণের বিশ্বাসঘাতকতা করেছি…..সে আমাকে মনে করিয়ে দিত,
‘তুমি নও, আমিই বড় করে তুলেছি এই বাচ্চাগুলোকে,
যাদেরকে তুমি আমার চেয়েও বেশি প্রিয় ভাবছো!’
আমি বিষ্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতাম”।
বইটিতে কিছু
স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিজ্ঞানের উল্লেখ আছে, বিশেষকরে ম্যান্ডেলা কর্তৃক আলাপ আলোচনার বর্ণনা,
যার মাধ্যমে বর্ণবাদনীতি বিলুপ্ত হয়। যখন
কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাঁর সহকর্মীদের থেকে আলাদা করে অন্য স্থানে নিয়ে এলেন,
তাঁদের থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন,
তিনি এই অবস্থান্তরকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলেন, কেননা এটি তাঁকে খোলাখুলিভাবেই
বর্ণবাদী কর্তৃপক্ষের সাথে গোপন আলোচনার সুযোগ প্রদান করবে,
তাঁর সহকর্মীদের সাথে কোনো ধরণের পরামর্শ
ছাড়াই। “আমি তাঁদের না জানিয়েই সেই মত আলাপ
আলোচনা শুরু করলাম, এবং পরবর্তীতে তাঁদের মুখোমুখি হয়ে বলি,
যা হবার হয়ে গেছে,
এখন আর ফেরানোর পথ নেই”। তিনি অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
ম্যান্ডেলার
দিনপঞ্জি থেকে একটি বিষয় কুড়িয়ে তুলে আনা হয়েছে এখানে,
যখন তাঁকে বন্দী করা হল,
পৃথিবীর চারিদিকে তাঁকে ঘিরে সংঘঠিত পদক্ষেপগুলো
কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর কাছে। তাঁর মুক্তির জন্য জন সাধারণের আদালতে করা
আবেদনপত্র, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁকে সম্মানজনক
আচার্য্য করার উদ্যোগ, এমনকি জন্মদিনের কার্ড –
যা প্রায়ই শিশুতোষভাবে ফেলে দেওয়া হত,
নিষ্ফল আন্দোলন ও পদক্ষেপসমুহ –
এগুলো পরিষ্কারভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর
মনোবল ধরে রাখতে।
বইটিতে
অপ্রত্যাশিত কিছু আনন্দদায়ক মুহূর্তের বর্ণনাও আছে। আমরা ম্যান্ডেলাকে একজন
চলচিত্র সমালোচক হিসেবে দেখতে পাই – তিনি ‘অ্যামাডিউস’
এর সমাপ্তীকে পেয়েছিলনে “কিছুটা বিরস” ও নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে খুব মিলে যায়,
এবং “দি নার্ডস টেক রিভেঞ্জ” (আমার মনে হয়, তিনি অবশ্যই “রিভেঞ্জ অফ দি নার্ডস”
এর কথা বলেছেন) চমৎকার। এখানেই শেষ নয়,
এই বইটিতে আরো প্রকাশ পেয়েছে “ফ্রম দি ডেস্ক অফ ম্যান্ডেলা”
নামক চিঠি লেখার খাতার মুদ্রিত ছবি,
যার ডান কোণে শোভা পাচ্ছে একটি দেঁতো হাসির
গার্ফিল্ড কার্টুনের ছবি।
এক নজরেঃ
Conversations with Myself By
Nelson Mandela
শক্ত মলাটে
বাঁধাইঃ ৪৮০ পৃষ্টা
প্রকাশকঃ Farrar,
Straus and Giroux (১১ অক্টোবর,
২০১০)
মূল্যঃ $২৮.০০
ভাষাঃ ইংরেজী
আইএসবিএন –
১০: ০৩৭৪১২৮৯৫২
আইএসবিএন –
১৩: ৯৭৮-০৩৭৪১২৮৯৫১
No comments:
Post a Comment