নওয়াজ পরিবর্তন আনতে পারবেন?
জাতীয় নির্বাচনে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নওয়াজ
শরিফের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পাকিস্তানে সরকার গঠন করেছে। নতুন সরকারের সামনে দেশকে
সন্ত্রাসমুক্ত করা,
দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো
রয়েছে। নিরন্তর লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা লাঘব, বেকারদের
কর্মসংস্থান, প্রতিবেশী ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন_ সর্বোপরি সেনাবাহিনীর অযাচিত
হস্তক্ষেপ বন্ধের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে সুসংহত করার মতো বিষয়েও রয়েছে
সাফল্য অর্জনের বিরাট জনপ্রত্যাশা। নওয়াজ শরিফ কি পারবেন এ প্রত্যাশা পূরণ করতে?
তিনি কি পারবেন পাকিস্তানকে নতুন পথের দিশা দিতে?
পাকিস্তানে এই প্রথম একটি নির্বাচিত সরকার মেয়াদ পূর্ণ
করে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সম্মানজনকভাবে বিদায়
নিতে পারল। আরও একটি আশ্চর্যের বিষয় হলো, সদ্য বিদায় নেওয়া আসিফ আলি জারদারির
নেতৃত্বাধীন জোট সরকার তাদের ক্ষমতার মেয়াদকালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার
উদ্দেশ্যে প্রতিহিংসামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নেয়নি। রাজনৈতিক কারণে কোনো বিরোধী দলের
নেতাকর্মী হয়রানি বা জেল-জুলুমের শিকার হননি। স্বভাবতই নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন
মুসলিম লীগ সরকারও একই আচরণ করবে, এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক নয়
কি!
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার আচরণ
দৃশ্যমান না হলে পাকিস্তানে ভবিষ্যতে এক উন্নত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখা
যাবে। রাজনৈতিক দলাদলির ফাঁক গলে শক্তিমান বলে কথিত সেনাবাহিনীর অবৈধভাবে
ক্ষমতারোহণের পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে।
পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনী ফলাফলকে সবাই নত মস্তকে
মেনে নেওয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অঙ্গ জনরায়কে সম্মান করার মানসিকতা
স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ফলে অগণতান্ত্রিক যে সংস্কৃতি এতদিন পাকিস্তান সামরিক
বাহিনী ও কুচক্রী মহল নিজেদের রাজনৈতিক একাধিপত্য বজায় রাখার অশুভ উদ্দেশ্যে চালু
রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ায় শক্ত জমিন পাওয়া যাবে। এটা নিশ্চয়ই
পাকিস্তানের জনগণের জন্য কম প্রাপ্তি নয়।
জারদারি সরকার অনেকটা নড়বড়ে ছিল। তদুপরি জারদারিকে
অনেকাংশে শরিক দলগুলোর মনমর্জি মেনে চলতে হয়েছে। ফলে তাকে সামরিক বাহিনীর
হুমকি-ধমকিকে বেশি আমল দিতে হয়েছে। শেষ দিকে এসে বিচার বিভাগের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে
পড়ার কারণে তার সরকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল।
চতুর জারদারি সে বিপদও সামাল দিতে পেরেছেন।
নওয়াজ শরিফ কিন্তু এককভাবে মুসলিম লীগ সরকার গঠনে সক্ষম
হয়েছেন। এতে তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে। জারদারির যেমন
সামরিক বাহিনীকে অনেক ক্ষেত্রেই তোয়াজ করে চলতে হয়েছে, নওয়াজের
পাঞ্জাবি শক্তিশালী রুট, এককভাবে সরকার গড়তে পারা ও শিল্প
সাম্রাজ্যের মালিক হওয়ার কারণে তিনি এসব নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অনেকটা নমনীয়তা
প্রদর্শন করতে পারবেন। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পাকিস্তানি তালেবান
সমস্যাকে তিনি কীভাবে মোকাবেলা করেন সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। তালেবানদের
তোয়াজ করে যেমন তিনি পাকিস্তানকে মডারেট ধারায় নিয়ে যেতে পারবেন না, আবার জনগণকে সঙ্গে নেওয়া ছাড়া সরাসরি সংঘাতে গিয়েও তিনি ওদের বিষদাঁত ভেঙে
দিতে পারবেন না। এখানেই তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রশাসক হিসেবে দক্ষতা পরখ হয়ে
যাবে। এতে সাফল্য অর্জন মানেই তার ব্যক্তিগত ও পাকিস্তানের সামগ্রিক রাষ্ট্রিক ইতিবাচক
বিরাট অর্জন হবে। আর এর ফলে আফগানিস্তানের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন
সহযোগিতার অধ্যায় যুক্ত হবে। আসলে এই একটি বিষয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একবিন্দুতে এসে মিলেছে। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে সফল হোক এটা
তার প্রধান মিত্র ও উন্নয়ন সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রও চায়। অন্যদিকে পাকিস্তানের
দীর্ঘকালের জাতিগত সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তার কাঁধে।
পাকিস্তানের অর্থনীতির হাল ফেরানোর সঙ্গেও তার পররাষ্ট্র
ও নিরাপত্তা নীতির যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটানোর বাধ্যবাধকতা জড়িয়ে আছে। এজন্য তাকে
ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী
নিশ্চয়ই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। আর এটা বুঝেই হয়তো ঝানু ব্যবসায়ী বুদ্ধিসম্পন্ন
নওয়াজ প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র_ এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখে
দিয়েছেন। অর্থাৎ এ ব্যাপারে তিনি নিজেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এসব বিষয়ে
বোঝাপড়া করতে চান।
নওয়াজ ভালো করেই জানেন যে, তিনি নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে
ক্ষমতায় থাকাকালে যখন ভারতের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে দু'দেশের
মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য অটল বিহারি বাজপেয়ির সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত
হয়েছিলেন, তখন সামরিক বাহিনী জেনারেল মোশাররফের নেতৃত্বে
তাকে কারগিল যুদ্ধ উপহার দিয়েছিল এবং সেবার শেষ পর্যন্ত মোশাররফ তাকে ক্ষমতা থেকে
উৎখাত করে ছেড়েছিল। তাই এবার ভারতের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে পা ফেলতে
তিনি তার সাহসের সঙ্গে মাথাও যথেষ্ট খাটাবেন।
নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে চীনের অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে নওয়াজ
স্বাগতই জানাবেন। কিন্তু চীনের ইসলামী জঙ্গিরা এখনও পাকিস্তানের মাটিতে প্রশিক্ষণ
পাচ্ছে_ এতে চীন তাদের ওপর নাখোশ। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ওপর তাই
যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনেরও সন্দেহ রয়েছে। মধ্য এশিয়ার ৫টি দেশও ইসলামী জঙ্গি
প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ওপর বিরক্ত।
আফগানিস্তান, ভারত ও রাশিয়া তো রয়েছেই। আন্তর্জাতিক ও
আঞ্চলিক এই বৈরী পরিস্থিতির সুবিধা নিশ্চিতভাবেই নওয়াজ সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতার পৃথিবীটা দ্রুত ছোট হয়ে আসছে কিনা!
পাকিস্তানের অর্থনীতির হাল ফেরাতে হলে যে বিরাট অঙ্কের
বিদেশি বিনিয়োগ দরকার পড়বে,
সেটা কোন সূত্র থেকে পাওয়া যাবে তা নবনির্বাচিত নওয়াজ শরিফের মুসলিম
লীগ সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। নওয়াজ ভালো করেই জানেন যে, পাকিস্তানের
ট্র্যাডিশনাল মিত্র যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন আর্থিক মন্দায় জর্জরিত। তাই তার পক্ষে
বাড়তি সাহায্যের জোগান দেওয়া আর সম্ভব হবে না। তাকে এখন ব্যালেন্স অব পেমেন্টের
সংকটও জরুরি ভিত্তিতে মেটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের
দ্বারস্থ হতে হবে তাকে। এখানেও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দরকার পড়বে। তাই ড্রোন হামলা
নিয়ে যতই বাহ্যিক হম্বিতম্বি করা হোক না কেন নওয়াজ ভালো করেই জানেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা আশঙ্কাকে আমল দেওয়া ছাড়া তাদের কাছ থেকে সহায়তা
মিলবে না।
বেশ কিছুদিন থেকেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অবশ্য
প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তারা এখনও দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা
নীতি প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত
করার ক্ষেত্রে জারদারি সরকার অর্থবহ কোনো অগ্রগতি সাধন করতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীই বাগড়া দিয়েছে। ফলে
দেশটির ধ্বংসোন্মুখ অর্থনীতির সামনে উজ্জীবনের পথও উন্মুক্ত করা যায়নি। একইভাবে
আফগানিস্তানের সঙ্গে স্থিতিশীল মৈত্রীর সম্পর্কও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অথচ
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থেই আফগানিস্তানের সঙ্গে তালেবানি
সন্ত্রাস প্রতিরোধে যৌথ কার্যকর সহযোগিতা গড়ে ওঠা প্রয়োজন ছিল। পাকিস্তান
সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে বাধার প্রাচীর খাড়া করে রেখেছে। যে কারণে জারদারির দুর্বল
সরকারের পক্ষে এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়নি। এখন নতুন পরিস্থিতিতে
নওয়াজের পক্ষে সামরিক বাহিনীর হাত থেকে প্রতিরক্ষা পুরোপুরি না হোক পররাষ্ট্রনীতি
পুরোপুরি মুক্ত করা সম্ভব হবে। তখন দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত শান্তি, স্থিতিশীলতা ও
উন্নয়নের সুবাতাস একসঙ্গে বইতে শুরু করবে। দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা
সার্ক নতুন জীবন পাবে। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান আবার নতুন করে হারিয়ে ফেলা
ঐক্যসূত্র আবিষ্কারে ব্রতী হবে। সত্যিই পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা আমাদের
এই অঞ্চলে পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে ওঠার ক্ষমতা ধরে। নওয়াজ শরিফ সরকারের পক্ষে এ
জন্য বিনা দ্বিধায় বাজি ধরা যায়।
No comments:
Post a Comment