Monday, June 17, 2013

BLACK MONEY 2

ধান্দার ধনতন্ত্র
কালো টাকা নিয়ে সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে এতে চরম উদাসী মনোভাব। যেমন দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কালো টাকা নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ‘এ সমস্যা সমাধানে আমরা আন্তরিক। কিন্তু কোন জাদুদণ্ড নেই।পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁর অপারগ অবস্থা। কালো টাকার রমরমা নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি তার বাজেট ভাষণে প্রচুর পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন। কালো টাকা কোথায় রয়েছে তার জন্য কমিটি ঘোষণা হয়েছে। বাজেটের পর আর কোন উচ্চবাচ্য নেই। সম্প্রতি দেশে আবার এতে জনরোষ দেখে ফের কমিটি। অবস্থা এরকম পর্যায়ে গেছে যে শুধু কালো টাকা কোথায় তা খুঁজতেই তিনদিনের ব্যবধানে দুটি কমিটি। এর মধ্যে রামদেবের সঙ্গে রফা করার সময়ও একটা কমিটি ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা হলো দেশের একের পর এক দুর্নীতি ফাঁস হচ্ছে। মন্ত্রী, আমলা, কংগ্রেস নেতারা জেলে যাচ্ছে। এসব দুর্নীতির কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী কারো কোন বক্তব্য নেই। হাজার গণ্ডা কমিটি হলেও দেশের মধ্যে দুর্নীতির ফলে যে কালো টাকার পাহাড় তৈরি হয়েছে, তা উদ্ধারের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কেন্দ্রের বিভিন্ন তদন্ত কমিটিতে আদালতে রায়ে লোপাট হওয়া কালো টাকার অঙ্ক পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হলেও তা উদ্ধারে কোন উদ্যোগই নেই কেন্দ্রের।

কালো টাকা উদ্ধার নয় গোপন করাই কেন্দ্রের লক্ষ্য এই অভিযোগ সাধারণের মানুষের শুধু নয়, সর্বোচ্চ আদালতের এরকম ধারণা। বার বার একারণে আদালতে ভর্ৎসিত হয়েছে কেন্দ্র। যেমন পুনের ঘোড়া ব্যবসায়ী হাসান আলির মামলা। ৮০ হাজার কোটি টাকার কর খেলাপি হাসান আলি। বার বার ছাড় পেয়েছে আলি। ইতোমধ্যে আইনজীবী রামজেট মালানি কর খেলাপি কালো টাকার কারবারীদের বিরুদ্ধে আদালতে যে মামলা দায়ের করেছেন তাতে ঐ আলির নাম উঠে এসেছে। সুইস ব্যাঙ্কে আলি তার টাকা সরিয়ে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এই মামলায় ঋণ খেলাপি আলির বিরুদ্ধে কেন্দ্রের বিভিন্ন সংস্থার ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহ দেখে তার তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, দেশে ‍‌কি অরাজকতা চলছে? কেন ঐ ঋণ খেলাপিকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা যাবে না। পরের দিনই অর্থমন্ত্রকের এনফোর্সমেন্ট দপ্তর তাকে গ্রেপ্তার করে। বছরের পর টাকা লোপাট করার সুযোগ দিয়ে অবশেষে গ্রেপ্তার। তাও আদালতের ভর্ৎসনাসহ নির্দেশে। নিলর্জ্জতার চরমে পৌঁছে বোধহয় এভাবেই ভর্ৎসনা করতে বাধ্য হচ্ছে আদালতও। এরপরও কিন্তু চৈতন্য নেই। আবার ভর্ৎসনা জুটেছে সেই আদালতেই। সুইস ব্যাঙ্কে প্রচুর কালো টাকা জমা রাখার কারবারীদের নাম এসে পৌঁছেছে কেন্দ্রের কাছে। ঐ নাম প্রকাশের দাবি উঠলে তা প্রকাশ করা যাবে না বলে এককথাতেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। এতে আদালতে ফের মামলা হয়। মামলায় আদালত ফের কেন্দ্রের কঠোর সমালোচনা করে। জনস্বার্থবাহী এ মামলায় বিচারপতি এস রেড্ডি এবং এস এস নির্জ্জর বলেছিলেন, ‘এটা একবারে পরিষ্কার সহজ সরল দেশের অর্থ লোপাট করার ঘটনা। আমরা এখন অপরাধের মানসিকতার কথা বলছি। আমরা এনিয়ে নানা চুক্তির খুঁটিনাটির বিষয়ে যেতে চাই না। এটা নিছক কর ফাঁকির মামলা না। এই টাকা আবার বাজারে প্রমিসারি নোটের মাধ্যমে লগ্নী হয়েছে। যারা লগ্নী করলো তারা চর, উগ্রপন্থী নাকি অন্য কেউ তা জানার জন্য তো উদ্বেগ থাকে। নাম প্রকাশের জন্য এভাবেই বার বার আদালতে তিরষ্কৃত হয়েছে কেন্দ্র। তবু তা গোপন করতে আগ্রহী কেন্দ্র। এতে যদিও নানা চুক্তির অজুহাত দেওয়া হয়েছে। যার কোন ভিত্তি নেই বলে অনেকের ধারণা। উল্লেখ্য, জার্মানির থেকে লিয়েচটেনস্টেইনের এল জি টি ব্যাঙ্কে দেশের কারা কালো টাকা জমা রেখেছে তর তালিকা পায় ভারত। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড তাদের দেশের কর খেলাপিদের নামের তালিকা পেয়ে তাতে ব্যবস্থা নিয়েছে। ভারত এতে চুপ করে শুধু বসে নেই, তাদের নাম প্রকাশও করছে না এই ছিল অভিযোগ।

অর্থমন্ত্রী দেশের কালো টাকার পরিমাণ জানতে একের পর এক কমিটি গড়ে চলেছেন। এমন একটা ধারণা তৈরির চেষ্টা যে কত কালো টাকা তার কোন নাকি হিসাব নেই সরকারের। এই ভাবনা গোলমেলে। যুক্তিতে এর কোন অর্থ নেই। কেন্দ্রের স্ট্যাটিসটিকাল অর্গানাইজেনের তথ্য অনুযায়ী বছরে দে‍‌শের আর্থিক মোট উৎপাদনের পরিমাণ হলো ৬১ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। যার এখন ৪০ শতাংশ কালো টাকায় রূপান্তর হচ্ছে। অর্থাৎ এর পরিমাণ হলো ২৫ লক্ষ কোটি টাকা। যা হবে আনুমানিক ৫০০ বিলিয়ন ডলার। যদি এই কালো টাকা কর্পোরেট অথবা ধনীদের সাদা টাকা হিসাবে ঘোষণা করানো যায় তবে এতে ৩০ শতাংশ কর বসানো যাবে। এতে সরকারের কর বাবদ আয় হবে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। যা ২০০৯-১০ সালে মোট কর বাবদ আয় ৬ লক্ষ ৪১ হাজার কোটি টাকার থেকে বেশি। আনুমানিক বছরে এভাবে অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা কালো টাকার উপর কর বসিয়ে তা আদায় করতে পারে। কালো টাকার অর্থনীতির বিষয়ে গবেষক অধ্যাপক অরুণ কুমার এই তথ্য জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে এতে কোন আগ্রহ নেই কেন্দ্রের। সংসদে প্রতিটি অধিবেশনে লিখিত প্রশ্নে কর খেলাপিদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চান সাংসদরা। বহুবার বামপন্থী সাংসদরাও কর খেলাপিদের থেকে কর আদায়ে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করেছেন সংসদে। সি আই টি ইউ নেতা দীপঙ্কর মুখার্জি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, প্রতিবার আমরা লিখিত প্রশ্নের জবাবে দেখেছি বকেয়া কর খেলাপির সংখ্যা এক টাকার অঙ্ক বেড়েই চলেছে। যেমন ২০১০-১১ সালে কর খেলাপির টাকার অঙ্কের পরিমাণ হলো ২ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী তার সর্বশেষ কমিটিকে এখন কর খেলাপিকে চিহ্নিত করে তার তালিকা ঘোষণা করতে বলেছেন। এর হিসাব তো কমিটি গড়ে বার করার বিষয় নেই। তাকে অর্থদপ্তরে রয়েছে সংসদীয় লিখিত প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট। শেষ হিসাব মতো ২ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা কর খেলাপির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? কত টাকা উদ্ধার হয়েছে? কিছুই হয়নি। বছরের পর পর সংসদে বলেও যা করানো যাচ্ছে না তা কমিটি ঘোষণা করলেই হয়ে যাবে এটা বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়।

কালো টাকা খুঁজতে দফায় দফায় কমিটি। অথচ নির্বাচনে এই কালো টাকার রমরমার বহুদিন থেকে অভিযোগ উঠছে। কর্ণাটকে অন্ধ্র প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের সময় তা প্রত্যক্ষ করেছেন দেশের মানুষ। খনি মাফিয়া রেড্ডি ভাইদের কালো টাকার রমরমা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলছে কংগ্রেস। কারণ তারা এখন বি জে পি-র স্নেহধন্য। একই অভিযোগ অন্ধ্র প্রদেশের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডির বিরুদ্ধেও। খনি মাফিয়ারা কারবারের অংশীদার হয়ে বসে আছে কংগ্রেস-বি জে পির বড় নেতারাই। এখন রাজশেখর রেড্ডি মারা যাওয়ায় তার পুত্র জগনমোহন রেড্ডি মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার হতে চান। কিন্তু সমীকরণ বদলে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। জগনমোহন রেড্ডি এবারে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে পালটা দল গড়ে কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলেছে। রেড্ডি পরিবারের ঐ কারবারের বিপুল অর্থ জোগান নিয়ে বরাবর অভিযোগ ছিলো। নির্বাচনে জিততে তা কাজে লাগায় এনিয়ে টু শব্দ করেনি কংগ্রেস। এবারে জগনমোহন রেড্ডি কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলায় তার ঐ বিপুল টাকা এবারে কালো বলে প্রচার করছে কংগ্রেস। একইভাবে কর্ণাটক নির্বাচনের সময় রেড্ডি ভাইদের বিপুল টাকা খরচ নিয়ে কোনো শব্দ শোনা যায়নি কংগ্রেসের মুখে। কারণ সেসময় দুরাজ্যে কংগ্রেস-বি জে পি উভয়েই তার সুযোগ নেয়। সমীকরণ বদলে যাওয়ায় বি জে পি-র বিরুদ্ধে কংগ্রেস কর্ণাটকে এনিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। একই কাণ্ড এবারে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে। বড় শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ার সময় নির্বাচনে দলের প্রচারে চলেছে বিপুল অর্থ খরচ। যা কালো টাকা বলে অভিযোগ করেছেন বামপন্থীরা। হেলিকপ্টার থেকে মিডিয়ার খরচ কোথা থেকে আসছে তার হিসাব চাওয়া হলেও একটি শব্দ শোনা যায়নি কেন্দ্রের তরফে। নির্বাচন কমিশনও তথৈবচ। অন্ধ্র, কর্ণাটক কালো টাকার কারবার নির্বাচনে চলেছে কংগ্রেস প্রচার করলেও পশ্চিমবঙ্গে তা নিয়ে নিশ্চুপ। এখানে বামপন্থীদের হারানো গেছে। ফলে কংগ্রেস তৃণমূলের প্রচার‍‌ জলুসে কোটি কোটি টাকা নিয়ম ভেঙে খরচ হলেও তা কালো নয়, সাদাই বটে। অর্থমন্ত্রীর হাল আমলের কমিটির বিবেচ্য বিষয়ে, নির্বাচনে কালো টাকার সন্ধান করার কোনো নির্দেশও তাই স্থান পায়নি।

কালো টাকার রমরমা নিয়ে এই অভি‍‌যোগ হঠাৎ ওঠেনি। বহুদিন ধরেই তা চলছে। কিভাবে তার মোকাবিলা করে দেশের সম্পদ বাড়ানো যায় তার উদ্যোগ মাঝেমধ্যে দেখা যেত। তবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, যেমন ১৯৬১ সালে কালো টাকা উদ্ধারে প্রথম স্বেচ্ছায় সম্পত্তি ঘোষণা প্রকল্প শুরু হয়। ১৯৬১ সালের পর ১৯৬৫ সালে ঐ প্রকল্প দুবার ঘোষণা হয়। এতে যথাক্রমে ১০ কোটি এবং ৩০ কোটি টাকা স্বেচ্ছাঘোষিত আয়কর বসিয়ে আদায় করে কেন্দ্র। ১৯৭৫ সালে হয় স্বেচ্ছা আয় ও সম্পদ ঘোষণা আইন। এতে কর বাবদ আয় হয় ২৫৬ কোটি টাকা। ১৯৮৫ সালে প্রশাসনিক নির্দেশে দুবছর অভিযান চলে। তাতে কর বাবদ আয় হয় ৪৫৮ কোটি টাকা। ১৯৯১ সা‍‌লে স্বেচ্ছা জমা প্রকল্প হয়। এতে জমা পড়ে ১৫৪ কোটি টাকা। বিদেশী মুদ্রা প্রকল্প এবং উন্নয়ন বন্ড প্রকল্প চালু হয় ১৯৯৭ সালে। এতে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় হয়। ১৯৯৭ সালে ফের স্বেচ্ছা আয় ঘোষণা প্রকল্প হয়। এতে ৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা কর বাবদ আয় হয়। কিন্তু এই সময়ে কেন্দ্রের বিভিন্ন কমিটির রিপোর্ট লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কালো টাকার রমরমা এতো বিস্তৃতি ঘটেনি যা এখন হচ্ছে। ১৯৫৫ সালে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নিকোলাস কালডোর তার রিপোর্টে দেখিয়েছেন দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ৪/৫ শতাংশ কালো টাকা। ১৯৬৯ সালে ওয়াষ্ণু কমিশন জানায় দেশে কালো টাকার পরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকা। ১৯৮০-৮১ সালে রাজা চেলিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়। তারা জানায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ২০ শতাংশ কালো টাকা। যার পরিমাণ ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। ১৯৯১-৯২ সালে এস ‍‌বি গুপ্ত কমিটি জানায় ১৯৮৭-৮৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪১ শতাংশ। ফলে দেখা যাচ্ছে কালো টাকা উদ্ধারে যেটুকু ব্যবস্থা কেন্দ্র নিয়েছে তাতে তার অগ্রগতি রোখা যায়নি ক্রমশ তা প্রসারিত হয়েছে।

নয়া উদারনীতির জমানায় এই কালো টাকার রমরমা এবারে বিশাল আকার নিয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবে আমলা, রাজনীতিক, কর্পোরেট মিডিয়ার মধ্যে আঁতাত গড়ে উঠেছে। বেপরোয়া দুর্নীতি তাকে আড়াল করে লোপাট হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে যথেষ্ট যুক্তিসহ তা উদ্ধারে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। এবং কালো টাকার উৎস বোঝাতে নয়া উদারনীতির গলদের দিকগুলি চিহ্নিত করেছে। এই যুক্তিসম্মত প্রস্তাবও তার জনমতকে একেবারে অবান্তর বলে খারিজ করার দরকার ধান্দাবাজ ধনতন্ত্রের। তাই মিডিয়ায় আজ তা স্থান পায় না। বিরোধী পরিসরে তাই ঠেলে তোলা হয় রামদেবদের। যেখানে অর্থনীতির উৎস হিসাবে নয়া উদারবাদের নীতির বিরুদ্ধে কোনো চ্যালেঞ্জ আসবে না। উপরি কিছু মামুলি সংস্কার যা দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে তাতে দায় সেরে ফেলা যাবে। এভাবে প্রশ্নহীন আনুগত্য থাকবে উদারনীতির প্রতি। এতে যুক্তিবোধকে কার্যত অবাস্তব ধারণা বলেই আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়ার তোরজোর। তবু তার আওয়াজ বাড়লে কণ্ঠরোধের নানা দাওয়াই। মনন জগতে ধোলাই থেকে লাঠিপেটা করতেও কসুর করা হবে না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরবর্তী ঘটনাবলী তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কেন দেশের উৎসনীতিকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে কালো টাকার রমরমায়তা দু-একটি তথ্যতে স্পষ্ট হবে। উদারনীতির জমানা শুরু হয়েছে ১৯৯১-৯২ সালে। সরকারী তথ্য অনুসারে বড় দুর্নীতির ঘটনা ১৯৯৬-৯৭ সালে ঘটেছে ২৬টি। এবারে ২০০৫-০৮ এই তিনবছরে বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে ১৫০টি। জলের দরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে দেওয়া, টেলিকম লাইসেন্স বিলিতে বেনিয়মের সুযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকার আয় বরবাদ করে বেসরকারী সংস্থাকে বেআইনী আয়ের সুযোগ করে দেওয়া। বল্গাহীন বেসরকারীকরণে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া এরকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। উদারনীতির নামে উদারভাবে তা লুটের বন্দোবস্ত করা হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। এতে একদিকে সরকারের আয় কমেছে অন্যদিকে বেআইনী আয় পুঞ্জিভূত হয়েছে কর্পোরেট শিবিরে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সি পি চন্দ্রশেখর তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্ট্রিগিটির রিপোর্ট অনুসারে ১৯৪৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কালো টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তার প‍‌রিমাণ হবে মোট ৪৬২ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল পাচার হওয়া টাকার ৬৮ শতাংশ হয়েছে নয়া উদারবাদের দুদশকের জমানায়। দেশে বড় বড় দুর্নীতির সংখ্যা যত বেড়েছে ততো টাকা পাচার হওয়ায় পরিমাণও বেড়েছে। কালো টাকার উৎস উদারনীতি এটা নিয়ে তাই কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। এতে যারা ফায়দা তুলছে সেই কর্পোরেট ও তার অনুগত মিডিয়াতে একথা প্রচারিত হওয়ার তাই কোনো কথাই নেই।
দেশে উদারবাদের জনক হলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তিনি কর্পোরেট শিবিরের এই দুর্নীতি দেখে আক্ষেপ করে তা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমবা ধান্দার ধনতন্ত্র বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর কথাতেই বলা যায়, ঐ ধান্দার ধনতন্ত্র কিন্তু রোখার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। উলটে তার চলার পথ আরো সুগম করেছেন। ফলে আনন্দে আত্মহারা ধান্দার ধনতন্ত্রের সুবিধাভোগীরা। কালো টাকার উৎস বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নেই। শিবঠাকুরের আপন দেশে তাই সর্বনেশে আইনকানুন ঘেঁটে কণ্ঠরোধের চেষ্টা। তবে তা সফল হয়নি ইতিহাসে তা দেখা গেছে। মানুষ তা রুখবেন।

No comments:

Post a Comment