রাশিয়ায় গোয়েন্দাগিরি
গোয়েন্দাগিরি। সোভিয়েত রাশিয়ার আকাশপথে মার্কিন গোয়েন্দা বিমানগুলি এই কাজেই লিপ্ত ছিল সে সময়। কেন? কারণ একটাই। তথ্য চাই। আরো অনেক অনেক তথ্য। সোভিয়েত রাশিয়ার শক্তি বা যুদ্ধাস্ত্র, শিল্প, সম্পদ সম্পর্কে চাই গোপন নথিপত্র। আর এই তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েই আমেরিকা বলির পাঁঠা করেছিল শয়ে শয়ে আমেরিকান যুবকদের। মৃত্যুর মুখে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিলো বেশ কিছু রাশিয়ানও। যারা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে কোনো এক সময়ে বিতাড়িত হয়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছিল। আর শেষে আমেরিকার চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছিল ওই সব গোপন ক্রিয়াকলাপে। কৌশলে এদেরকেই কাজে লাগিয়েছিল আমেরিকা।
কিন্তু
তারপর? এতসব তথ্য কি হলো? এগুলি দিয়ে কোন্ মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছিল আমেরিকার? সরা বিশ্বেরই বা কি এসে গিয়েছিল এতে? গোছা গোছা রিপোর্ট, ফাইলের পর ফাইল, ফটোগ্রাফ, গাদা গাদা প্রিন্টআউটের ওপর পড়তে শুরু করলো ধুলোর আস্তরণ। তা ক্রমশ আরও শুরু হলো। শেষে আমেরিকা ও পশ্চিম জার্মানির রাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের ঘরগুলি হয়ে উলো ধুলোয় ঢাকা এক একটি আবর্জনা কক্ষ। এর কিছুই আর শেষপর্যন্ত ফিরে দেখা হয়নি। তাহলে কেন এত উদ্যোগ? আসলে শত্রুতা। কমিউনিস্ট দেশের প্রতি সাম্রাজ্যবাদীদের শত্রুতা। সে সময়ে আমেরিকার ওই আগ্রাসী মনোভাব বিন্দুমাত্র স্বস্তি দেয়নি সোভিয়েত রাশিয়াকে।
‘সোভিয়েত রাশিয়া।’ সে সময়ে আপাদমস্তক এক রহস্যময় দেশ বিশ্ববাসীর কাছে। চার্চিলের ভাষায়, ‘কি এক অপার রহস্য যেন ছাইচাপা হয়ে আছে শক্তিধর এই দেশটিতে। সেটা খুঁজে বার করতেই হবে।’ ১৯৪০-এর দশক থেকে সেই চেষ্টাই চলেছে অবিরত। প্রথমদিকে ইউ এস মিলিটারি, সি আই এ এবং জাতীয় সুরক্ষা বাহিনী বিমান পাঠাতো তথ্য সংগ্রহের জন্য। চলতো ইলেকট্রনিক ডাটা বা বৈদ্যুতিন তথ্য আহরণের কাজ। সোভিয়েত নিউক্লিয়ার পাওয়ার বা মিসাইল সম্পর্কে গোপনে খুঁটিনাটি জেনে নেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। তুর্কি ও ইরানের বেসক্যাম্প থেকে ছোটো ছোটো বিশেষ এক ধরনের আধুনিক গোয়েন্দা বিমান উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হতো সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে। এর সঙ্গে ছিল স্যাটেলাইট, সাবমেরিন, টেলিফোনে আড়িপাতার ইলেকট্রনিক যন্ত্র। সবকিছুর মাধ্যমেই নজরদারির পাকা ব্যবস্থা। এক এক সময়ে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই প্লেনগুলি সোভিয়েতের ওপর চক্কর কাটতো। নেমে পড়তো ছোটোখাটো কোনো গোপন ডেরাতে। তবে বেশিরভাগ সময়েই লুকিয়ে লক্ষ্যবস্তুর ফটো নেওয়া চলতো। র্যাডারের সিগন্যাল বুঝে তা জ্যাম করা বা সোভিয়েত সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য এক বিপদজনক গোয়েন্দাগিরির খেলায় নেমেছিল মার্কিন প্রতিরক্ষার এজেন্টরা। অনেকক্ষেত্রেই এই ধরনের বিমানগুলি ধরা পড়ে যেতো সোভিয়েত বাহিনীর হাতে। সোভিয়েত যুদ্ধ বিমান বা অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট ফায়ারের মাধ্যমে এগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া — তেমন কোনো ব্যাপারই ছিল না তাদের কাছে। গুলি করে সেগুলিকে অকেজো করে দিয়ে মাটিতে নামিয়ে আনা হতো অনেক বিমানকেই। বিমানের ভেতর বেঁচে যাওয়া শত্রুদের বন্দী করে ফেলা হতো নিমেষেই।
১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে যে নজরদারি বিমানকে গুলি করে নামানো হয়েছিল রাশিয়ার বুকে। তাতে বিমানের ১০ জনই মারা যায় শেষপর্যন্ত। ১৯৬৯ সালে এরকম এক ঘটনায় নিহত হলো ৩১ জন। জাপান সাগরের ওপরে এ ঘটনা ঘটে। এটা ঘটায় উত্তর কোরিয়ার এক যুদ্ধ বিমান। আর এই মধ্যবর্তী প্রায় ১০ বছর সময়ের মধ্যে প্রায় গোটা বার এরকম ঘটনা ঘটেছে বলে খবর। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকান এয়ারক্র্যাফট এবং এই কমিউনিস্ট দেশের যুদ্ধ বিমানের আঘাত ও পালটা আঘাতের ঘটনা ঘটেছে ঝুরি ঝুরি।
সে সময়ে শুধুই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর সংখ্যা ও তাদের পরিণতি নিয়ে। যখন মার্কিন যুদ্ধ বিমানগুলিকে গুলি করে বা ভয় দেখিয়ে জোর করে নামিয়েছিল সোভিয়েত বাহিনীর জওয়ানরা তখন এগুলির সংখ্যা নিয়ে ব্যাখ্যা পালটা ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজও চলছিল পুরোদমে। ১৯৯২ সালে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন ৯টি ইউ এস যুদ্ধ বিমানকে গুলি করে নামানো হয়েছিল ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে। বেঁচে যাওয়া ১২ জন আমেরিকানকে বন্দী করা হয়েছিল। তাদের পরিণতি এখনো ঠিক হয়নি। এর পাঁচমাস পরে রাশিয়ার প্রাক্তন জেনারেল ও রাশিয়ান-ইউ এস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান গোটা বিষয়টি অনুসন্ধান করেন। নিরুদ্দেশ আমেরিকানদের প্রসঙ্গে তিনি একটি ইউ এস সেনেটে বলেন, ওই ঠাণ্ডা যুদ্ধে নজরদারি চালানোর জন্য ৭৩০ জন এয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের পরিণিত নিয়েও যথেষ্টই ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে।
ঠিক যা ঘটেছিল ইউ-২ বিমানের ক্ষেত্রে। ১৯৬০ সালের ১লা মে প্লেনটিকে গোপনে নামিয়ে আনা হয়েছিল রাশিয়ার বুকে। সে সেই বিমান এ নয়। অন্যান্য যে কোনো বিমান থেকে এটি ছিল আধুনিক ও উচ্চতাসম্পন্ন। চট করে একে নাগালের মধ্যে পাওয়া কঠিন ছিল। এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ফ্রান্সিস গ্যারি পাওয়ার। হঠাৎ করে এটির নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা নিয়ে আমেরিকা খুবই বিব্রত ছিল সে সময়ে। সারা দেশে হইচই। দেশের লোকের কাছে তো আর মুখরক্ষা হয় না। কি জবাব দেওয়া যায়? কিছু বললেই তো প্রকাশ পাবে যে রাশিয়ার শক্তির কাছে হেরে গেছে আমেরিকা। শেষে নানারকম মুখরোচক গল্প বানিয়ে মানুষের কাছে বলা ছাড়া আর কোনো উপায় তাদের ছিল না। সত্যিটা প্রকাশ পেল শেষে। যখন রাশিয়ানরা প্লেন এবং পাইলটকে সবার সামনে হাজির করলো। এই ধরনের একটি অত্যাধুনিক মেঘভেদী বিমানকেও যে তারা কবজায় আনতে পারে এটা প্রথমেই বিশ্বাসই করতে পারেনি আমেরিকার সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর কর্তারা। তারা বললো রাশিয়ানদের অনেক গোপন খবর বার করার ক্ষমতা ছিল এই বিশেষ বিমানের। খবর পাওয়াও গিয়েছে নাকি বেশ কিছু।
অনেক সময়ে সোভিয়েত বিমান বাহিনী আমেরিকার বিমানের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে বলে অভিযোগ এনে তার বিরোধিতা করেছিল আমেরিকা। তাদের বক্তব্য সোভিয়েত সীমানার বাইরে গিয়ে জাপান সাগরের ওপর তারা এটা করেছে। যদিও নজরদারি ও খবর সংগ্রহকারী বিমানগুলি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পড়ে। রাশিয়ার মানুষের বক্তব্য তারা ঠিকই করেছে। এই ইউ-২ এর কারণেই প্যারিসের আইজেনহাওয়ার-ক্রুশ্চেভ বৈঠক শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। সে সময়ে সারা পৃথিবীর মানুষ সেদিকেই তাকিয়েছিল।
ইউ-২ এর ঘটনা কি সত্যিই এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমেরিকার কাছে? ইতিহাস কি বলে? কর্নেল ফ্লেচার প্রাউটি শোনালেন একটু অন্যরকম কথা। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রাউটি ছিলেন সি আই এ এবং পেন্টাগনের মধ্যে সংযোগকারী বিশেষ প্রতিনিধি। তাঁর বই ‘সিক্রেট টিম’-এ প্রকাশ সি আই এ-র একাংশ এবং পেন্টাগনের কয়েকটি এজেন্ট নাকি এর পেছনে ছিল। তারা চক্রান্ত করেই উধাও করেছিল এই বিশেষ বিমানটিকে। কারণ ঠাণ্ডা যুদ্ধের টেনশন তারা বরদাস্ত করেনি। এ ধরনের বক্তব্য থেকেও কি কিছু পরিষ্কার হলো? সবই শেষপর্যন্ত ধোঁয়াশাই থেকে গেল সবার কাছে।
তবে এর ব্যাখ্যা একটা দিয়েছিলেন প্রাউটি। বিমানটি উধাও হওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে বলেছিলেন, ইউ-২ এর ইঞ্জিনে পর্যাপ্ত লিকুইড হাইড্রোজেনের প্রয়োজন ছিল ওই উচ্চতায় যাওয়ার জন্য। যদি তুর্ক থেকে ওড়ার আগে হাইড্রোজেনের আধারটি আংশিক ভর্তি করা হয় তবে তা সোভিয়েত এলাকায় ঢোকার পরপরই হয়তো নেমে আসতে বাধ্য হবে। এক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার দাবি তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। প্লেনটি হঠাৎ নিচে নেমে এসেছিল বলেই তা সোভিয়েত বাহিনী গুলি করে নামিয়ে নিতে পেরেছিল। ১৯৮৩ সালেই সোভিয়েত ইউনিয়ন দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিমান ধ্বংস করেছিল গোয়েন্দাগিরির অপরাধে। প্রাউটি মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে একটি বিদেশী রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক বিমানকে ক্যামেরায় গোয়েন্দাগিরি করতে দেখা গেছে।
রাশিয়ানদের
কাছে গোয়েন্দা বিমান হলো মহাকাশে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী এক আতঙ্ক। কিন্তু আমেরিকা কি বলেছিল? তারা বলেছিল গোয়েন্দা বিমান সব দেশেরই আছে। তারা তথ্যও সংগ্রহ করে। যদিও এটা সবাই জানতো যে আমেরিকার আকাশে কোনো সোভিয়েত প্লেন দেখা যায়নি। সোভিয়েত রাশিয়ার আতঙ্ক অনভিপ্রেত ছিল না মোটেই। তাদের বক্তব্য এই ধরনের গোয়েন্দা বিমানগুলি যথেষ্ট উত্তেজনা সৃষ্টিকারী। তাতে বোমাও থাকতে পারে। সেটা মোটেই বিচিত্র কিছু নয়। কারণ রাশিয়ার মানুষ ভুলে যাননি নাজিদের আগ্রাসী ভূমিকার কথা। কিংবা ১৯৫৮ সালে এপ্রিলের সেই ঘটনা কথা। সেখানে র্যাডারের ভুল সচেতক সিগন্যালের কারণে একটি মার্কিন যুদ্ধ বিমান পরমাণু বোমা নিয়ে উড়ে গিয়েছিল সোভিয়েতের দিকে। ভুল ধরা পড়ার পর অবশ্য তা ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
না, আমেরিকানরা বোমা না ফেললেও ভেতর থেকে ফোপরা করে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বহু মানুষকে তারা নামিয়ে দিয়েছিল রাশিয়ার মাটিতে চূড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে। তারা প্রায় সকলেই ছিল রাশিয়ার মানুষ। সি আই এ এবং আরো কয়েকটি এজেন্সি তাদের নিয়োগ করেছিল এ কাজে। এ অভিভাসন সংস্থাগুলি ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব রাশিয়ান সলিডারিটিস বা ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব লেবার (এন টি এস) বলে পরিচিত।
রুশ বিপ্লবের পর অনেক রাশিয়ান ছেলেই আমেরিকা ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে চলে গিয়েছিল। এছাড়াও অনেকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী আমেরিকায় থাকার কথা ভেবেও রাশিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কাজে লাগিয়েছিল আমেরিকা। দুটি গ্রুপই নাজিদের সঙ্গে যৌথভাবে যুক্ত হয়েছিল যুদ্ধের সময়ে। যদিও এন টি এস সাধারণভাবে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীভুক্ত অভিভাসন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে — তাদের এই যৌথ ক্রিয়াকলাপ স্তালিনবাদের বিরুদ্ধেই কাজ করতো।
এই এন টি এস এর মূল ভিত্তি পশ্চিম জার্মানি। ১৯৫০ সালের পুরোটা জুড়েই এই সংস্থার সাহায্যকারী ছিল সি আই এ। জার্মানিতে সি আই এ-র স্কুল বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল ইনস্টিটিউ ফর দ্য স্টাডি অব দ্য ইউ এস এস আর এই নাম। একই ধরনের স্কুল ছিল ব্রিটেন ও আমেরিকাতেও। এই এজেন্সি এন টি এস সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতো সোভিয়েতের মাটিতে নামানোর আগে। তারা রীতিমতো তৈরি হয়েই নামতো। নানারকম অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, কোলাপসিবল সাইকেল নিয়ে, ফ্রগম্যান স্যুট পরে তারা প্লেন থেকে নেমে পড়তো। বিপজ্জনক এলাকার বিদ্যুৎবাহী তার প্রতিরোধ করার জন্য তাদের সঙ্গে থাকতো রবার ম্যাট। তাদের লাগানো হতো মিলিটারি নথিপত্র বা বিভাগগুলির খোঁজ খবরের জন্য। এগুলিই সে সময় তথ্য হিসেবে পেতে চাইতো পশ্চিমীরা। এছাড়া তাদের মাধ্যমে সন্ত্রাসমূলক কাজও করাতো মার্কিন মদতপুষ্ট ওই এজেন্সিগুলি। ব্রিজ ও রেলের লাইন উপড়িয়ে বিশৃঙ্খলা, গণ্ডগোলের সৃষ্টি করে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে অস্ত্র যুদ্ধে নেমেছিল।
কতনজকে
এভাবে আনা হয়েছিল তার হিসাব নেই। শুধুই আকাশপথে নয়, নৌকাযোগে বর্ডার পেরিয়েও তাদের আনা হয়েছে। শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ‘কট্ ইন দ্য অ্যাক্ট’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে প্রায় ২৪ জনের তালিকা রয়েছে যাদের রাশিয়ানরা গ্রেপ্তার করেছিল ওইভাবে অনুপ্রবেশের জন্য। বেশ কয়েকজনের জেল হয়েছিল। কয়েকজনকে মেরে ফেলাও হয়েছিল সে সময়ে। জার্মান অধিকৃত সোভিয়েত অঞ্চলে এমন একজনকে ধরা হয়েছিল যে বহু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বইতে বলা হয়েছে, এমন বহুলোককে ধরা হয়েছে যাদের কোনো তালিকা করা সম্ভব হয়নি। রাশিয়ানদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে পশ্চিম জার্মানিতে নানা ধরনের চক্রান্ত গড়ে উঠেছিল সে সময়ে। এইসব অনুপ্রবেশকারীদের সম্বন্ধে রাশিয়ানরা বলেছিল এরা অনেকেই বিভিন্ন তার ও রেডিও বিকনস ছিনতাই করতো — সেগুলি আমেরিকানদের বোমা বানানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করতো। তাদের কেউ পশ্চিমে ফিরতো নানা তথ্য নিয়ে। কাউকে আবার অন্য কোনো কাজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হতো সোভিয়েত রাশিয়ারই অন্য কোনো জায়গায়। সেখানে তারা এজেন্টের কাজ করবে বলে প্রস্তুতি নিতো। ‘অ্যান্টি কমিউনিজম’-এর প্রচারপত্র ছড়ানো হতো রাশিয়ার মাটিতে। সেগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতো। জলে ভাসতো তার কিছু।
সোভিয়েত
নাগরিকদের
অনেকেই
পশ্চিমে
এসেছিল
এন টি এস সদস্যদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। তাদের খবরের কাগজ আর বইপত্র রাশিয়া ইউক্রেনে বিলি করতো। তারা (এন টি এস) বিভিন্ন এলাকায় কালো বাজারের মাধ্যমে চালাতো তাদের কর্মপ্রক্রিয়া। ছোটো ছোটো দোকান করতো। সস্তায় জিনিস বিক্রিবাটা করতো। এভাবেই তারা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। নর্থ আফ্রিকা থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া নেটওয়ার্ক ছিু সি আই এ-র। নাবিক, পর্যটক, চাকুরিজীবী, খেলোয়াড় এবং পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গেও গোপনে যোগাযোগ রাখতো। তাদের ওপর কাজ করতো। তথ্যের সন্ধানে চর হিসাবে নিযুক্ত করার জন্য লোভ দেখাতো মুক্ত বিশ্বের। কখনো কখনো ভয়ও দেখাতো। সোভিয়েত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের উত্যক্ত করারও উদ্যোগ নেওয়া হতো মাঝে মধ্যেই। শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে হয়রানি করার জন্য। ‘অ্যান্টি কমিউনিজম’ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
এই ধরনের বক্তব্য বা বিষয় এরপর আমেরিকার সরকারকে বই প্রকাশনার ব্যবসায়ে উৎসাহিত করেছিল। বিভিন্ন মার্কিন ও বিদেশী প্রকাশক এবং ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্সির সঙ্গে ব্যবস্থাপনায় ১৯৬৭ সালে প্রায় এক হাজার বই শুধুমাত্র প্রচারের উদ্দেশ্যেই প্রকাশিত হয়েছিল। বহু বই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও অন্যান্য দেশে বিক্রি হয়েছিল। তবে আশঙ্কা ছিল এত বই প্রকাশ করার। যখন সি আই এ এবং ইউ এস আই এ প্রচুর সংখ্যক বই নিজেরা কিনে নেবে বলে সম্মত হলো, সে সময়েও বেশ কিছু বই লেখা ও প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিপুল আর্থিক বিনিয়োগের ফলাফল নির্ধারণ করার কোনো পথ অবশ্য ছিল না। এক্ষেত্রে খোদ আমেরিকা সরকারের সরাসরি হাত না থাকলেও বিভিন্ন লেখক লেখিকাদের সাহায্য করার জন্য ওয়াশিংটন নানা তথ্য জোগাতো বলে অভিযোগ ছিল রাশিয়ানদের। ১৯৬৭ সাল নাগাদ এই ধরনের কাজ শেষ হয়ে এলো। যদিও অন্যান্য দেশে এদিক ওদিকে তা ভালোই চলছিল। ১৯৭৬ সালে একটি সেনেট কমিটি বললো কয়েক বছর ধরে যখন এই পদ্ধতি চলছে, সি আই এ প্রায় ২৫০টি বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। বেশিরভাগই বিদেশী ভাষায়। পরে তাদের আবার কয়েকটি পুনর্মুদ্রণ ঘটেছিল আমেরিকায়। বেশিরভাগ বই এর প্রকৃত পরিচয় এখনো পর্যন্ত বিশেষভাবে সংরক্ষিত। তবে তাদের মধ্যে কিছু প্রকাশ পেয়েছে। সেগুলি হলো — দ্য ডায়নামিকস অব সোভিয়েত সোসাইটি — ওয়াল্ট রস্টো; দ্য নিউ ক্লাস — মিলোভান ডিজিলাস; কনসাইস হিস্টরি অব দ্য কমিউনিস্ট পার্টি — রবার্ট এ বারবন; ইন পারস্যুট অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার — রিচার্ড এন গার্ডনার; দ্য ফরেন এইড প্রোগ্রামস অব দ্য সোভিয়েত ব্লক অ্যান্ড কমিউনিস্ট চায়না — কুর্ট মুলেট; পিকিং অ্যান্ড পিপলস ওয়ার — মেজর জেনারল স্যাম গ্রিফিথ; দ্য ইয়েনানা ওয়ে — ইয়োডেসিও র্যাভিনস; লাইফ অ্যান্ড ডেথ ইন সোভিয়েত রাশিয়া — ভ্যালেন্টিন গঞ্জালেস; দ্য অ্যান্টহির্ল — সুজানে লাবিন; দ্য পলিটিকস অব স্ট্রাগল : দ্য কমিউনিস্ট ফ্রন্ট অ্যান্ড পলিটিক্যাল ওয়ারফেয়ার — জেমস ডি অ্যাটকিনসন; ফ্রম কলেনিয়ালিজম টু কমিউনিজম — হোয়াং ভ্যান চি; হোয়াই ভিয়েতনাম — ফ্র্যাঙ্ক ট্র্যাগার; টেরর ইন ভিয়েতনাম — জে মালিন। সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক, এর বাইরে সি আই এ জর্জওরেল এর ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ কার্টুন সারা পৃথিবীজুড়েই বিনিয়োগ ও বণ্টন করেছিল।
নানারকম
বিদ্বেষপূর্ণ
তথ্য সে সময় সমাজতন্ত্রের ছড়ানো হয়েছিল রেডিওর মাধ্যমে। সারাদিন ধরে অনবরতই চলতো প্রচার। রেডিও লিবার্টি, রেডিও ফ্রি রাশিয়া, রেডিও ফ্রি ইউরোপ, রেডিও ইন আমেরিকান সেক্টর — আমেরিকার কোণায় কোণায় এবং ভয়েস অব আমেরিকা সারা বিশ্বে। সবই বিভিন্ন প্রাইভেট সংস্থার বিনিয়োগ যা গিফ্ট হিসাবে আসতো। তা সে আমেরিকান কর্পোরেশনরই হোক বা নাগরিকদের অনুদানই হোক অথবা কোনো ব্যক্তিগত উৎস থেকেই হোক না কেন। আসলে সি আই এ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় সব খরচাই গোপনে বিভিন্ন মাধ্যমে বহন করেছিল।
এই স্টেশনগুলি কমিউনিস্টদের ‘মিডিয়া গ্যাপ’গুলি পূরণ করতো। সারা পৃথিবীর ভালো ভালো ছবি তুলে ধরতো তাদের নিজেদের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল কমিউনিস্টদের যা কিছু হচ্ছে সবই খারাপ — এ কথা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা। প্রাক্তন সি আই এ অফিসিয়াল ভিক্টর মারসেট্টি বলেছিলেন পূর্ব ইউরোপের ভালো হচ্ছে এবং কমিউনিস্ট সরকারের খারাপ হচ্ছে — এটা প্রচার করাই রেডিওগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল।
রাশিয়ানরা
যারা ওইসব স্টেশনে স্টেশনে কাজ করতো আর স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবতার প্রচার করতো, পরে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের চিহ্নিত করেছিল আমেরিকার বিচার বিভাগ। হিটলারের কুখ্যাত এইনস্যাটজগ্রুপেন সদস্য হিসেবে ওই রাশিয়ানরা কাজ করতো বলে বিচার বিভাগের অভিমত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচুর সংখ্যক জিউকে হত্যা করেছিল এরাই। এদের মধ্যেই একজন স্ট্যানসিল স্ট্যানকিয়েভিচ। যার হুকুমে এক ব্যাপক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল বাইলো রাশিয়াতে। তথ্য ও অস্ত্র বাঁচাতে মৃত বাচ্চাদের সঙ্গে জ্যান্ত বাচ্চাদেরও কবর দেওয়া হয়েছিল। সে রেডিও লিবার্টিতে কাজ করতো। জার্মান যুদ্ধের ভিলেনরা যারা সি আই এর হয়ে কাজ করতো — তারাও সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন’ চালাতো।
কিন্তু
প্রতিটি
ক্ষেত্রেই
সোভিয়েত
সম্পর্কে
তথ্যগুলি
কোনো কাজে আসেনি। অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে নানারকম তথ্য — যেগুলি জোগাড় হয়েছিল তা ছিল নিষ্ফল ও অন্তঃসারশূন্য। কিন্তু এই তথ্যই শেষপর্যন্ত ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছু লোকের কাছে। যুদ্ধোত্তরকালে পশ্চিম ইউরোপে চলে যাওয়া ওই সকল অভিভাসীদের জীবিকা ছিল ‘তথ্য ব্যবসা’। এটাই তাদের পণ্য। সোভিয়েত নাগরিকদের সঙ্গে কোনো বৈঠক, কথাবার্তা অথবা কাল্পনিক কোনো মিটিং থেকে একটি সাধারণ রিপোর্ট তৈরি করে একটি রাজনৈতিক রঙ মিশিয়ে বাজার ছাড়া হতো। একই সময়ের মধ্যে রিপোর্টের চারটি বয়ান তৈরি হতো। বিভিন্ন তথ্য সাজিয়ে চারজন সেগুলি লিখতো। এগুলি আলাদাভাবে আমেরিকা, ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানির ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাছে বিক্রি করা হতো। সি আই এ-র কাছে সব বক্তব্যই থাকতো। এগুলি অন্যান্য দেশের এজেন্সির কাছে পাঠানো হতো সোর্স গোপন করে। ফলে রিপোর্টর পর রিপোর্ট জমা হয়ে ফাইল মোটা হতো ক্রমশ।
এভাবেই
ওয়াশিংটন
সি আই এ-র রাশিয়ান ফাইল পাহাড় প্রমাণ হয়ে গেল। হিজিবিজি তথ্যে ভগের গেল ঘরবাড়ি। অনেক তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে চিঠিপত্র আদান প্রদানের মারফৎ পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যেই হয়েছিল এসব। ১৯৭৯ সালে পোস্ট অফিস কাউন্সিল থেকেই এ তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তারা বলেছিল ‘If there was no national
security mail cover Prograss, the FBI might be inhibited in finding out if a nation was Planning war
against US.” আসলে আতঙ্ক। শক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি আমেরিকার দিকে এগিয়ে আসে তাহলে কি হবে? এই ভয়েই আমেরিকা সে সময়ে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। প্রাক্তন সি আই এ আধিকারিক হ্যারি রসিজকে লিখেছিলেন অভিভাসীদের প্রাথমিক কাজ হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করানো হয়েছিল ওই আতঙ্ক থেকেই। একই কারণে গোয়েন্দা বিমানও পাঠানো হয়েছিল সোভিয়েতের আকাশে। মনে করা হতো সোভিয়েত বুঝি ধেয়ে আসছে পশ্চিমের দিকে। যে কোনো দিনই ইংলিশ চ্যানেল পার করে এসে পড়বে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর জওয়ানরা।
কিন্তু
বাস্তবে
এ ধারণা ছিল নিতান্তই অমূলক। এরকম কোনো যুদ্ধের সতর্কবাণী রাশিয়ার দিক থেকে কখনো এসেছে বলে এজেন্টদের রিপোর্টে কিছু ছিল না। প্রবল কমিউনিস্ট বিরোধী হ্যারি রসিজকের লেখাতে সে কথাই প্রকাশ পেয়েছে।