সিরিয়া ইস্যুতে অবশেষে আশার আলো?
সিরিয়ার দিনগুলো রাতের মতো! বোমাবারুদের ধোঁয়ায় ঢাকা
আকাশ। সূর্যের আলো কেড়ে নেওয়ার চেয়েও অধিক অন্ধকার সময় এখন সিরিয়ায়। কালরাত্রির
সেই সময় গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে মানুষের রক্তে ভেজা-পিচ্ছিল পথ ধরে! তৃতীয় বছরে গড়ানো এই
সমূহ ধ্বংসযাত্রার শেষ কোথায়? লাখদার ব্রামিহি বলছেন, বেশুমার প্রাণহানি, খতিয়ানহীন ধ্বংসের মধ্য দিয়ে
ক্রমে শেষ হতে যাওয়া দেশটির জন্য এই প্রথম একটি আশার খবর শোনা গেল! অবশেষে একটা
রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে একমত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল; আন্তর্জাতিক
মহল মানে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া। সংঘাতের গোড়া থেকে দুই মেরুতে থাকা এ দুই
বিশ্বমাতব্বরের 'বোধোদয়' হয়েছে,
একটা কিছু করা দরকার। মানুষের মনে রাখার ব্যাপ্তিকালের মধ্যে
সিরিয়ায় নাকি সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট চলছে! ইতিহাসবেত্তা ও তথ্যাভিজ্ঞ মহলের এমন
সশঙ্ক ভাষ্যেও নিজেদের লাভালাভের হিসাবনিকাশ থেকে এক চুল সরেনি পরাশক্তিরা! এবার
তাঁরা সরেছেন বটে, তবে হিসাবের খাতায় যোগ হয়েছে অন্য খতিয়ান।
২.
দিন দশেক আগে প্রায় তিন দিনের ব্যবধানে সিরীয় সামরিক
ঘাঁটিতে দুই-দুইবার বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। তাদের জবানিতে দুনিয়াজুড়ে বিশেষ
করে পশ্চিমা মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে এলান করা রূপকথাটি (!) হলো, ইরানের তৈরি ফতেহ-১১০ নামের ক্ষেপণাস্ত্রের একটি চালান গুঁড়িয়ে দেওয়া
হয়েছে। ওই চালানের গন্তব্য ছিল হিজবুল্লাহ। আরেকটি সিরীয় সামরিক ঘাঁটিতে
হিজবুল্লাহর তরে মজুদ রাখা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র বোমা মেরে ভস্ম করে দেওয়া
হয়েছে। তেল আবিব তাদের দাবির সপক্ষে অন্তত একটি 'বিশ্বাসযোগ্য'
তথ্যসূত্র উল্লেখ করেছে, সেটি 'পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্র'। এক ঝটকায় এই গোয়েন্দা
সূত্রের পটভূমিতে ইরাকে আগ্রাসন চালানোর পক্ষে পশ্চিমা দুঁদে গোয়েন্দাদের
কংক্রিটসম শক্তপোক্ত তথ্যসূত্রের কথা অনেকের মনে পড়তে পারে। তখনো পশ্চিমারা ইরাকি
আগ্রাসনকে জায়েজ করার তাগিদে গলাবাজির চূড়ান্ত করেছে গোয়েন্দা সূত্রের জেরেই। কিন্তু
দিন শেষে গোয়েন্দা তথ্যের সত্যতা কর্পূরের মতো উবে গেছে হাওয়ায়। বাস্তবতা দাঁড়িয়ে
আছে হাজারো প্রাণহানি আর এন্তার ধ্বংসের ওপর। ইরাক আজ এক ধ্বংসস্তূপের নাম।
৩.
হামলা চালানোর অজুহাত খুঁজতে 'বেনামি' গোয়েন্দা সূত্রের আশ্রয় নিয়ে ইসরায়েলের
লুকোচুরি তাই বিশ্ববাসীর সন্দেহ ঘনীভূত করে। একে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার দায়
স্বীকার না করে আত্মরক্ষার অধিকারের ধুয়া তুলেছে। দুই- এ ব্যাপারে ঝেড়ে কাশছে না
তাদের জিগরি দোস্ত পশ্চিমারাও; কিন্তু সাফাই গাইছে ষোলো আনা
ছাড়িয়ে আঠারো আনা। আর তিন নম্বরে যে কথাটির মীমাংসা হয় না, তা
হলো, প্রেসিডেন্ট আসাদ সরকার যখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে
রাখার প্রশ্নে দেশের অভ্যন্তরে লড়াইয়ে জড়িয়ে পেরেশান, সেখানে
কোন যুক্তিতে হাত খালি করে তিনি অস্ত্র পাঠাবেন দেশের বাইরে? তাও আবার উন্নত ও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র? শত্রু
(বিদ্রোহী) খতমে অস্ত্র এস্তেমাল না করে হিজবুল্লাহর হাতে তা তুলে দেওয়ার মতো 'পাগল' কি আসাদ?
৪.
ইসরায়েলের এই 'ইতরামি' অবশ্য নতুন নয়। সিরিয়ায় বিদ্রোহ শুরুর পর থেকেই তারা আসাদের জিম্মায় থাকা
রাসায়নিকসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র হিজবুল্লাহর হাতে চলে যেতে পারে বলে জিগির
তুলেছে। গত জানুয়ারিতেও দামেস্কের উপকণ্ঠে একটি সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়
তারা। ওই হামলাসহ এবারের দ্বিতীয় হামলাটির কথা কবুল করেছে খোদ আসাদ সরকারও। একই
সঙ্গে তারা অবশ্য হুঁশিয়ারিও দিয়েছে, নতুন করে আর কোনো হামলা
হলে তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা জবাব দেওয়া হবে। রাশিয়ার কাছ থেকে এসএ-২২, পান্তসির-এস১ ও এসএ-২৬-এর মতো আধুনিক ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য
ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে সিরিয়া। তাই তাদের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী।
তার পরও সিরিয়া কেন ইসরায়েলি হামলার তাৎক্ষণিক জবাব দেয়নি? অনুমান
করা হচ্ছে, তাদের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই
ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
৫.
ইরানের তৈরি ফতেহ-১১০ ক্ষেপণাস্ত্র, যদি সেটা সর্বশেষ সংস্করণ হয়, তবে এটি আড়াই থেকে তিন
শ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। এই হিসাবের ভেতর ইসরায়েলের
ভয়ের ছবিটি হলো, লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেল আবিবে হামলা
তাহলে ডাল-ভাত হয়ে যাবে হিজবুল্লাহর কাছে। তাই যেনতেন প্রকারে তাদের হাতে
ক্ষেপণাস্ত্রের চালান পৌঁছানোর বন্দোবস্ত ঠেকাতে হবে। আর আসাদ ভিন্ন
ইসরায়েলবিদ্বেষী কট্টর হিজবুল্লাহর যেহেতু আর কোনো গায়ে-গা-লাগা প্রতিবেশী দোসর
নেই, সুতরাং দামেস্ক থেকে অস্ত্রের চালান লেবাননমুখী হবেই।
এই 'কপোলকল্পিত' আশঙ্কায়
ভর করে অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরে অনায়াসে বিমান হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল। এতে
তাদের কোনো দোষ হয় না। মার্কিন কর্তৃপক্ষও পরোক্ষে ইসরায়েলের হামলা জায়েজ করার
লক্ষ্যে দাবি করে, আসাদ সরকার লেবাননে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতে
চায়। ইসরায়েলি বিমান হামলার নিন্দা করে না ইউরোপীয় ইউনিয়নও। ব্রিটেনের গলায়
মার্কিন সুর, আত্মরক্ষার অধিকার আছে ইসরায়েলের। হামলার
বিপক্ষে পশ্চিমাদের এই নীরবতার অর্থ কি এই নয় যে এতে তাদেরও পুরো সায় আছে। স্যার
টমাস ম্যুরের কথা অগ্রাহ্য করলেও ইসরায়েলি হামলার বিরোধী অন্তত নয় পশ্চিমা বিশ্ব,
এটা পরিষ্কার।
তবে কি সিরীয় যুদ্ধে পশ্চিমারা সরাসরি জড়িয়ে পড়ল এবার? কারণ ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যে ঘাঁটি গাড়লেও তাদের গোড়াটি পশ্চিমা মুলুকেই
পোঁতা। পশ্চিমাদের এ ক্ষেত্রে তুরন্ত জবাব হতে পারে, ইসরায়েল
তো কেবল হিজবুল্লাহগামী অস্ত্রের চালান নিশানা করে হামলা চালিয়েছে। তাদের হামলার
লক্ষ্য সরকার বা বিরোধী অন্য কোনো পক্ষ নয়। কিন্তু এ কথার জের ধরে যে বার্তাটি
সামনে আসে, এসব অস্ত্র ব্যবহার করেই তো বিদ্রোহীদের কুপোকাত
করতে চাইছে আসাদবাহিনী। ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য এ রকম ক্ষেপণাস্ত্র
বিদ্রোহীদের ওপর ছুড়েছে সরকারি বাহিনী- এ অভিযোগ স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের। আর দ্বিতীয়
কথা আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে, যেখানে রাসায়নিক অস্ত্র
ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে
হাত কাঁপার তো কোনো কারণই নেই। তার মানে, সিরীয় সরকারি
বাহিনীর অস্ত্র মজুদ ধ্বংস করার 'বিশ্বাসযোগ্য' কারণটি হলো, আসাদকে কমজোরি করা। তাঁর হাতের অস্ত্রের
রসদে টান ফেলা। যাতে তাঁর সরকারকে বিদ্রোহীরা সহজেই উৎখাত করতে পারে, তার পথ সুগম করাই ইসরায়েলের হামলার উদ্দেশ্য। মোটা দাগে, এই হামলা সিরিয়ার রণাঙ্গনে পশ্চিমাদের সরাসরি শামিল হওয়া বলেই প্রতিভাত
হয়। তা না হলে হিজবুল্লাহর কাছে আসাদ সরকারের অস্ত্র পাচারের পাঁয়তারাসংক্রান্ত
অভিযোগের যুৎসই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যেখানে দিনকে দিন অধঃখাতে গড়ানো ভয়াবহ
যুদ্ধে আসাদ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ভারী অস্ত্র ব্যবহারে কসুর করছেন না, যেখানে নিজের হাত খালি করে সেগুলো দেশের বাইরে পাঠাতে চাইছেন, তা কিভাবে সম্ভব? পশ্চিমাদের অভিযোগের মূল কথাটি তো
এই।
৭.
অথচ পশ্চিমাদের দিন-রাত অভিযোগের এক বুলি, সিরিয়ার রণাঙ্গনে ইরান ও হিজবুল্লাহ হস্তক্ষেপ করছে। তারা হয়তো সংঘাতে
জড়িয়ে পড়েছে বটে এবং অবশ্যই তা আসাদের পক্ষে, তবে পশ্চিমা
মিডিয়ায় কোনো কিছু যতটা রটে ঠিক ততটা বটে নয়। বিপরীতে এ কথাও তো সত্যি, পশ্চিমারা ঠিকঠাক স্বীকার না করলেও, প্রশিক্ষণসহ
নানাভাবে বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে। অস্ত্র দিয়ে সরাসরি সহায়তার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে
ব্রিটেন। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে জোর তৎপরতা
চালাচ্ছে। বিদ্রোহীদের অস্ত্রের জোগান দিয়ে যাচ্ছে কাতার আর সৌদি আরব, এটাও তো সত্যি। কিন্তু সিরীয় বিদ্রোহীদের ভাষ্য, অস্ত্র
পাচ্ছি বটে, তবে ঠিক ততটা নয়। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা
অবশ্য এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে কোনো মন্তব্য করেননি।
বিশেষ করে ইরাক, আফগানিস্তান বা লিবিয়ার মতো নতুন করে কোনো
যুদ্ধে জড়াতে তাঁর ঘোর আপত্তি আছে। ওইসব যুদ্ধের স্মৃতি মনে রেখে সিরিয়ার বিরুদ্ধে
সামরিক অভিযানের ব্যাপারে তাই তাড়াহুড়ো করতে চান না ওবামা। তবে কংগ্রেসের অনেক 'যুদ্ধবাজ' আইনপ্রণেতাই অভিযান চালানোর জন্য চাপ
দিচ্ছেন।
৮.
সম্প্রতি সিরিয়ার উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র
ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক আইনে ভয়াবহ এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার
নিষিদ্ধ। ওবামা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, সত্যি সত্যি রাসায়নিক
অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটালে সিরিয়া প্রশ্নে মার্কিন নীতির খোলনলচে পাল্টে যাবে। তাই
কানাঘুষা চলছে, সিরিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের
হস্তক্ষেপ ত্বরান্বিত করতে পারে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ। তার পরও এ
পটভূমিতে শেষতক জন কেরির মস্কো সফরের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন-মস্কো একজোট হয়েছে। এর
অংশ হিসেবে চলতি মাসের শেষভাগে সিরিয়া বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের
তোড়জোড় চলছে। তাই একে 'আশাজাগানিয়া' উদ্যোগ
বলে মনে করছেন সিরিয়াবিষয়ক জাতিসংঘ ও আরব লিগের বিশেষ দূত ব্রাহিমি। তাঁর
পূর্বসূরি কফি আনানের উদ্যোগে গত বছর জুনে সিরিয়া বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত
হয়েছিল জেনেভায়, তার আলোকে এবার সমাধানের কথা বলা হচ্ছে।
সেদিকেই এখন তাকিয়ে বিশ্ব।
No comments:
Post a Comment