শাভেজশূন্য ভেনিজুয়েলা মাদুরো কি পারবেন?
ভেনিজুয়েলার লড়াইটা আসলে দিলদরাজ সমাজতন্ত্র বনাম
দীনি-দেরাজি ধনতন্ত্রের। সাম্রাজ্যবাদী দানবের বিরুদ্ধে দেশজ মানবের মাথা তুলে
দাঁড়ানোর যে বিপ্লব,
যার ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন শাভেজ দেড় দশক আগে, তা
সমুন্নত রাখাই এখন মাদুরোর চ্যালেঞ্জ। কে জিতবে, তা 'সময়' জানে এবং জানে যুক্তরাষ্ট্রও! তবে লড়াইয়ের
শুরুতে হোঁচট খেলেন মাদুরো।
ইতিহাসের ছবকে মান্যতা রাখলে, জয়রথ দিনশেষে
গিয়ে দাঁড়ায় ন্যায়ের দুয়ারেই; কিন্তু পথে পথে দুর্গম গিরি
কান্তার মরু। 'কু'-এর বিরুদ্ধে তাই অটল
সাহসিকতায় লড়াই জারি রাখাই 'সু'-এর
কাজ। মাদুরোকে হতে হবে সেই কাজের কাজি। ইস্পাতকঠিন চারিত্র্যগুণে
সমাজতন্ত্রবিরোধীদের লাগাতার ষড়যন্ত্র মোকাবিলা শাভেজের জন্য 'ডালভাত' হয়ে থাকলে মাদুরোর জন্য তা-ই এখন টিকে থাকার
লড়াই। এ লড়াইয়ে তাঁর জয়ে আসলে জিতবে গোটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি মায় তামাম
লাতিন আমেরিকা। আর পরাজয়ের ফসল ঘরে তুলবে লুটেরা আধিপত্যবাদী বিশ্ববণিক পশ্চিমারা,
ফন্দি আঁটা দখলদার আর ঘোঁট পাকানো পুঁজিবাদ। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে
লাতিন আমেরিকার ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের মিলমিশে যে 'গরিব
নেওয়াজবাদী' গণতন্ত্রের চাষাবাদ শুরু করেন শাভেজ, মাদুরোর একার হাতে তার লাঙল, কাঁধে জোয়াল।
ঋতুবৈচিত্র্যের হিসাব কষে রোদ-বৃষ্টি কাজে লাগিয়েই যে তিনি নির্বিঘ্নে আবাদ করতে
পারবেন না, হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় তার পূর্বাভাস মিলছে। সুতরাং
কাণ্ডারি হুঁশিয়ার!
পরিসংখ্যান
গত পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন
মাদুরো_মাত্র এক শতাংশ। সুতরাং গণমানুষের ভোটের নামমাত্র এই ব্যবধানে শাভেজের
উত্তরসূরি মাদুরোর জয় ভেনিজুয়েলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
তুলে আনে। আমজনতা প্রায় আধা-আধি বিভক্ত। প্রত্যক্ষ জনসমর্থনের নিক্তিতে বিরোধী কাপরিলেসের
পাল্লা ঝুলছে তাঁর নাক বরাবর। জনরায়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রায় সমান যোগ্য,
সমান সফল; লড়াইও তাই সমানে সমানে। ২৩ প্রদেশের
প্রাকৃতিক সম্পদে ঠাসা দেশটি কার্যত দুই ভাগে বিভাজিত। শাভেজ অনুগামী ও
শাভেজবিরোধী শিবিরের এই খাড়াখাড়ি বিভক্তির টক্করে ইতিমধ্যে ঝড়ে গেছে অন্তত আটটি
তাজা প্রাণ। বিক্ষোভে, সংঘাতে কারাকাসের রাজপথ যুদ্ধের
ময়দান। কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোট পুনর্গণনার কাপরিলেসের দাবি তাঁর সমর্থকদের যত না
চাঙ্গা করেছে, পশ্চিমাদের মনপছন্দ হয়েছে তার ঢের বেশি। একে
সমাজতন্ত্রী গন্ধ, দুয়ে কট্টর মার্কিন আধিপত্যবাদবিরোধী
শাভেজের মনোনীত উত্তরসূরি_এই দুই দোষে দোষী মাদুরোর শুরুতেই 'নির্বাচনী কারচুপি' করে তৃতীয় দোষে দোষী সাব্যস্ত
হলেন। অথচ ৫৪ শতাংশ ভোটের অডিটে কারচুপির প্রমাণ মেলেনি। সর্বোচ্চ আদালতও বলেছেন,
ভোট পুনর্গণনার নির্দেশ দেওয়ার পক্ষে আইনি ভিত্তি নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের
সাফ কথা, এমন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীকে স্বীকৃতি
দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এই ঢোলের বাড়ি কাপরিলেসের নাচুনি বাড়াবে সন্দেহ নেই। এমন
ডামাডোলের মধ্যেই শপথ নিলেন মাদুরো।
বলিভারীয় বিপ্লব
সুতরাং শাভেজের আকস্মিক মৃত্যু ভেনিজুয়েলার শাসনক্ষমতায়
যে শূন্যতা ডেকে এনেছিল,
নির্বাচন সেই অনিশ্চয়তা পুরোপুরি মেরামত করতে পারেনি। কাপরিলেসের
সঙ্গে মাদুরোর ভোটের ফারাকের দোহাইয়ে তোলা দেশের ভেতরের ভোট পুনর্গণনার দাবি
বাইরেও (সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে) জোরালো প্রতিধ্বনি তুলেছে। শাভেজের মৃত্যুর পর
রাজধানীসহ সারা দেশে শোকের যে আবহ দেখা গেছে, তার কতটা
আন্তরিক, কতটা ছিল মেকি বা সাজানো, পশ্চিমা
গণমাধ্যম এমন অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুললেও রাখঢাক রাখেনি। বিশ্লেষণী প্রতিবেদনগুলোতে
বলা হচ্ছে, মাদুরোর প্রতিন্দ্বন্দ্বী প্রার্থীর ৪৯ শতাংশের
বেশি ভোট পাওয়ার সরল মানে কি এই নয় যে শাভেজের 'বলিভারীয়
বিপ্লবের' অনুসারীর সংখ্যা ভেনিজুয়েলাতেই পড়তির দিকে?
এ যাত্রায় মাদুরো ক্ষমতায় যদি টিকেও যান, তবু কি তাঁর
সংকট কাটবে? এই সংকট তো কেবল ভোটের সংখ্যা আমলে নিয়ে
জনপ্রিয়তার বহর মাপা নয়, প্রশ্নটা শাভেজের পথ ধরে এগিয়ে
যাওয়ার। একই সঙ্গে তা অর্থনীতির সক্ষমতা এবং দেউলিয়াপনারও। বিশ্বের সবচেয়ে বড়
পরীক্ষিত তেলসম্পদের মালিক হয়েও ভেনিজুয়েলায় অর্থনৈতিক রুগ্ণতা ও অনিশ্চয়তা দুই-ই
আছে।
উভয় সংকট
তিন নম্বরধারী দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভেনিজুয়েলারও
তেল-রাজস্বের ৭৫-৮০ ভাগই চলে যেত দেশের বাইরে। নিজেদের আখের গোছানো সুবিধাবাদী
নেতৃত্বের এই 'সম্পদ পাচার' ঠেকালেন শাভেজ। দেশের সম্পদের মালিকানা
যায় দেশের মানুষের হাতে। সুতরাং ভেনিজুয়েলার সমাজ থেকে বৈষ্যমও বিলীয়মান হয় দিন
দিন। শাভেজের শাসনামলের ১৪টি বছর দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে নিরক্ষরতাকে।
বেকারত্বের হার ২০ থেকে নেমে এসেছে সাত শতাংশের ঘরে। বাজেটের প্রায় ৪৫ শতাংশই ব্যয়
করা হয় বিভিন্ন সামাজিক ও কল্যাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে। লাখ লাখ পরিবারের জন্য
বাস্তবায়িত হয়েছে গৃহায়ণ কর্মসূচি। শতবর্ষ ধরে আটকে থাকা কৃষি সংস্কার কার্যক্রমও
এগিয়েছে। ভিটেমাটিহীন-হতদরিদ্রদের পরিচয় হয়েছে অন্তত 'মানুষের',
তারা দাঁড়াতে পেরেছে নিম্নমধ্যবিত্তের কাতারে। এক দশকে যাত্রা শুরু
করেছে ২০টির বেশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
এসব যেমন তথ্য, তেমনি বিপুল অঙ্কের সরকারি ব্যয় ও
ভর্তুকি গরিব, প্রান্তিক ও শ্রমজীবীদের স্বাবলম্বী হওয়ার
প্রেরণা জোগাতে পারেনি, বরং তারা অনেকটা সরকারের ওপর
নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, এটাও তথ্য। ফলে রাজকোষাগারে টান পড়েছে।
মুদ্রাস্ফীতি এখন ৩০ শতাংশের ওপরে। অর্থনীতিবিদদের অনুমান, শাভেজের
দেখানো পথে অবিচল থাকার অর্থ জাতীয় অর্থনীতির শরীর আরও রুগ্ণ হওয়ার আশঙ্কা। আর তার
চিকিৎসা করার মতো সক্ষমতা মাদুরোর আছে কি না, আছে সে
প্রশ্নও। দেশের মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অবস্থা বিবেচনায় নিলে,
শাভেজের 'দিল-দরাজি' গরিবঘনিষ্ঠ
কল্যাণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখা মাদুরোর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। আবার এই তরিকা বাতিল
করে যে ধনতন্ত্রের বিকাশের পথ ধরবেন তিনি, তাতেও আছে বিরাট
ঝুঁকি। সামাজিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখা শুধু নয়, ক্ষেত্রবিশেষে
তার গতি না বাড়ালে মাদুরোর জনপ্রিয়তা কমে যাবে, এতে সন্দেহ
নেই। বিপুলসংখ্যক গরিব দেশবাসীর বিরাগভাজন হবেন মাদুরো। মাদুরো তাই উভয় সংকটে।
আবার শাভেজের ক্ষমতায় বসার সময়ের তুলনায় আজকের
ভেনিজুয়েলায় খুনখারাবি বেড়েছে প্রায় চার গুণ। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১ সালে
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিলে যত মানুষ খুন হয়েছে, সমানসংখ্যক
মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে এক ভেনিজুয়েলাতেই। রাস্তাঘাটে অস্ত্রের ছড়াছড়ি, যখন-তখন তার ঝনঝনানি। হাত পাতলেই পাওয়া যায় মাদক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনীর চেয়ে কোথাও কোথাও মিলিশিয়াদের দাপটই বেশি। জনমনে তাই আতঙ্ক আছে। অপরাধ
দমনের মতো কঠিনতম কাজটিও করতে হবে মাদুরোকে শক্ত হাতে। ফেরাতে হবে জনমনে
নিরাপত্তাবোধ। শাভেজের উত্তরাধিকারী হলেও শাভেজের জনপ্রিয়তা তাঁর নেই। শাভেজের
রাজনৈতিক একচ্ছত্র কর্তৃত্ব অনেকাংশেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্কের ওপরও
নির্ভরশীল ছিল। মাদুরোর সঙ্গে দেশের সামরিক আমলাতন্ত্রের তেমন ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ
নেই।
চ্যালেঞ্জে মাদুরো
পূর্বসূরির পথ ধরে বলিভারীয় বিপ্লবের নিশান উঁচিয়ে রাখার
সঙ্গে লাতিন আমেরিকান মহাজোটের স্বপ্নকেও বাস্তবরূপ দিতে হবে মাদুরোকেই। অতীতের
ভুলগুলো শুধরে বিকল্প সমাজতান্ত্রিক মডেল কতটা এগিয়ে নেওয়া যায়, তার চুলচেরা
হিসাব কষে সামনে এগোতে হবে। তেমনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ
বাড়িয়ে গাঢ় করতে হবে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও। ভুললে চলবে না, শাভেজের
'বলিভারীয় জোট' থেকে কিন্তু বেরিয়ে যায়
বামপন্থী লুলা শাসিত ব্রাজিলও। রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের মতো দেশের সঙ্গে আলাদা জোটের শরিক হয়ে কত দূর
এগোতে পারবে, আজকের শাভেজবিহীন ভেনিজুয়েলা? শুধু মার্কিন-বিরোধিতার হুঙ্কার ছেড়ে এখনকার দিনে দুনিয়ায় কতটা কার্যকরী
বিকল্প গড়ে তোলা সম্ভব? যে পড়শিদের মিত্র ভাবতেন শাভেজ,
সেসব দেশের আস্থা কিন্তু মুক্ত বিশ্বের (পশ্চিমা দুনিয়া) 'অবাধ' গণতন্ত্রেই। শাভেজের মতো ব্যক্তিগত
ক্যারিশমেটিক ভাবমূর্তির কোনো প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপ্রধান এসব দেশের নেই। শাভেজ
তাই গড়ে তুলতে পেরেছিলেন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ের সঙ্গে নিজের দেশের আঞ্চলিক ঐক্য জোট_মার্কোসুর। মেক্সিকো ও পানামাকে পর্যবেক্ষক সদস্য করে ভেনিজুয়েলাসহ লাতিন
আমেরিকার ১২টি দেশ, যারা কিনা মুক্তবাজারের গিনিপিগ ছিল,
গড়ে তুলেছে ইউন্যাসুর নামে বিকল্প অর্থনৈতিক জোট। এক সময়ের মার্কিন
আধিপত্যের প্রধান শিকার ছিল লাতিন আমেরিকা। সেই লাতিন আমেরিকাকে
বিশ্বব্যাংক-আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কবল থেকে মুক্তির পথ দেখান শাভেজ।
সে পথে অনেক দূর এগিয়েও যান তিনি। মাদুরোকে এই মুক্তির পথের দিশারি হতে হবে।
গণতন্ত্রের পথে ক্ষমতায় এলেও শাভেজ তো ঠিক ব্রাজিল, চিলি,
আর্জেন্টিনার বামঘেঁষা রাষ্ট্রপ্রধানদের মতো গণতন্ত্রী ছিলেন না।
গণতন্ত্রকে তিনি তাঁর মতো করে কাজে লাগিয়েছেন। মাদুরোর প্রধান চ্যালেঞ্জটা এখানেই।
শাভেজের সঙ্গেই তাঁর কাজের সফলতা-ব্যর্থতা প্রতিনিয়ত মাপা হবে। এই কঠিন পরীক্ষায়
উতরাতে না পারার মানে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মৃত্যু। আবার শাভেজের ঘেরাটোপ ভেঙে
নিজের ভাবমূর্তি গড়তে না পারলে শেষ বিচারে তিনি বিজেতা নয়, বিজিতই
বিবেচিত হবেন। তাই মাদুরোর লড়াইটা আসলে শাভেজকে ছাপিয়ে যাওয়ার।
No comments:
Post a Comment