Wednesday, May 1, 2013

agriculture crisis in india



দেশের কৃষকরা কৃষি সংকট থেকে
মুক্তি চান

ভয়ঙ্কর অবস্থা বাজারের। কিছুতেই হাত দেওয়া যায় না। সবজি, মাছ, মাংসের আগুন দাম। আগে তো বিশেষ তিথি, উৎসব, পরবে দর বাড়তো। দাম বাড়তো বাজেট ধরে। সিগারেট, বিড়ি, দিশি-বিলিতি মদ, কোল্ড ড্রিঙ্কস, বনস্পতি, সরষের তেল, সাইকেল, মোটর গাড়ি, চিনি, ডাল, সিমেন্ট, লোহার রড ইত্যাদির দাম নিয়ে টানাপোড়েন চলতো। বাজেটের আগে আগে সিগারেট উধাও বাজার থেকে, সেই চেনা ছবি তো এখন উধাও। ছোটবেলায় দেখেছি মুদি দোকানে মূল্যতালিকা ঝোলানো থাকতো। টিনের বোর্ডের ওপর আইটেমের নাম। পাশে চক দিয়ে লেখা সেদিনের দাম। আট-নয় দশকে কলকাতা আর তার গা-লাগোয়া মফ্‌সলে এটাই ছিলো চেনা ছবি। আর এখন এ বেলায় এক দাম, ও বেলায় আরেক।
সস্তা খাদ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক দশকের বেশি সময়ে কর্পোরেট বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। খাদ্যদ্রব্যকে জনগণের আয়ত্তের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্যশুধু খাবারের জন্য ৩৩টির বেশি দেশে দাঙ্গা হয়েছে। ভারতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। কারণ খুঁজতে নানা রকম যুক্তি হাজির করা হয়েছে, বলা হয়েছে বেড়ে গেছে জনসংখ্যাঅথচ, গত বছরে খাদ্যমূল্য দ্বিগুণ হয়েছে, জনসংখ্যা তো নয়!
কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে কৃ‍ষি তথা খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার দ্রুত কমছে। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির গড় হার ছিল বার্ষিক ৩.২৭ শতাংশ।  কিন্তু  ২০০০ থেকে ২০০৭ সালে সেই হার কমে ‌দাঁড়িয়েছে‍‌ ১.৭৪ শতাংশ। এই হার আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকেও কম। ২০১১-১২ শস্যবর্ষে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিলো ২৫কোটি ৯৩লক্ষ টনেরও বেশি। ২০১২-১৩ শস্যবর্ষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫কোটি টনের সামান্য বেশি। প্রায় ৯০লক্ষ টন উৎপাদন কম হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রক। হ্রাসের পরিমাণ ৩.৫শতাংশ। কেন্দ্রের পরিসংখ্যান সংস্থা জানিয়েছিল, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে। এক দশকে বৃদ্ধির হার এখনই সবচেয়ে কম। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া তার একটি বড় কারণ
তথ্য বলছে, আগের শস্যবর্ষে (জুলাই-জুন) চাল উৎপাদন হয়েছিল ১০কোটি ৫৩লক্ষ টন। ২০১২-১৩-তে হতে চলেছে ১০কোটি ১৮লক্ষ টন। আগের বার গম উৎপাদন হয়েছিল ৯কোটি ৪৮লক্ষ টন, এবারে হবে ৯কোটি ২৩লক্ষ টন। নিম্নবর্গের তণ্ডুল উৎপাদন হয়েছিল ৪কোটি ২০লক্ষ টন, এবারে হবে ৩কোটি ৮৪লক্ষ টন। শুধু ডালের উৎপাদন সামান্য বেড়েছে। আগের শস্যবর্ষে হয়েছিল ১কোটি ৭০লক্ষ টন, এবারে হবে ১কোটি ৭৫লক্ষ টন। খাদ্যশস্য-বহির্ভূত উৎপাদনেও উদ্বেগজনক অবনতি ঘটেছে। আখের উৎপাদন আগের বছরে ছিলো ৩৬কোটি ১০লক্ষ টন, এবারে তা হবে ৩৩কোটি ৪৫লক্ষ টন। তুলোর উৎপাদন গত বছরে ছিলো ৩কোটি ৫২লক্ষ বেল, এবারে তা হবে ৩কোটি ৩৮লক্ষ বেল।
১৯৯১সালের পর থেকে এদেশে মাথাপিছু খাদ্যের জোগান নেমে এসেছে। ভারতে ৪০ শতাংশ কৃষকের অবস্থা এমন শোচনীয় যে, অন্য কোন জীবিকা পেলে তাঁরা চাষ ছেড়ে দিয়ে বাঁচেন। কারন, বহুজাতিক-প্রভাবে অগ্নিমূল্যে কৃষি-উপকরণ কিনে চাষ করেও ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। দেশে কৃষি উৎপাদনের বিকাশের হার অনেকদিন ধরেই শ্লথ। কৃষিতে সরকারী বিনিয়োগ হ্রাস, সার-বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, কৃষি সহায়তার সরকারী উদ্যোগে ভাঁটা, কৃষি ঋণের অভাবকে মুখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। উলটে মহাজনী ঋণের জালে জড়িয়ে রাজ্যে রাজ্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। ২০০১সালের জনগণনা রিপোর্ট আমাদের জানিয়েছে, ১৯৯১থেকে ২০০১এই দশ বছরেই দেশে ৮০লক্ষ কৃষক চাষ ছেড়েছেন।
একদিকে পানীয় জলের সঙ্কট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে অন্যদিকে বাজারে কৃষিপণ্য খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে বাড়ছে গরিব মানুষের অসহায়তা নিরাপত্তাহীনতা পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে অনিবার্যভাবে কৃষি উৎপাদন মার খাবে কৃষি উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না এর নেতিবাচক প্রভাবে অর্থনীতির সামগ্রিক বিকাশের হারও কমবে এর নিট ফল দারিদ্র্য বেকারী বৃদ্ধি এবং মজুরি হ্রাস বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কৃষি নির্ভর মানুষের জীবনে নেমে আসবে অসহনীয় অবস্থা
গোটা ভারতে এটাই নির্মম বাস্তবতা। মানুষ যখন খেতে পাচ্ছেন না। খোলা আকাশের নিচে তখনই পড়ে পড়ে নষ্ট হয় লাখো লাখো টন শস্য। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী এবার দেশে আনুমাণিক ৬০লক্ষ টন শস্য নষ্ট হতে পারে। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৫০কোটি ডলার। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষতির আকার তার চেয়েও অনেক বেশি। অন্তত ১কোটি ৯০লক্ষ টন খাদ্য শস্য নষ্ট হবে। কারণ, এই বিপুল পরিমাণ শস্য খোলা আকাশের তলায় পড়ে আছে। মূলত উত্তর ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানার মতো রাজ্যে। এমনকি অনেক জায়গায় বস্তায় ঠাসা টাল টাল শস্য ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখার কোনো ব্যবস্থা করেনি প্রশাসন। 
সরকার কৃষকদের থেকে পূর্বনির্ধারিত দামে চাল এবং গম কেনে। আমরা যাকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বলে থাকি। তথ্য বলছে, ২০০৭সালের পর সহায়ক মূল্য প্রায় ৭০শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎসাহিত কৃষকরা বেশি উৎপাদনে আকৃষ্ট হয়েছেন। বর্তমানে দেশে মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণ সর্বাধিক। ৫কোটি টন। সরকারী লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২গুণ বেশি। একদিকে দেশে যখন খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ছে। তখন সরকার কিন্তু সেই উৎপন্ন খাদ্যশস্য যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ অথবা বাণিজ্য সংক্রান্ত সময়োপয়োগী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগতাই কৃষকরা অতি উৎপাদনের সমস্যায় পড়লেও সরকার তাদের সঠিক দিশা দেখাতে পারেনি। অথবা ব্যবস্থা করেনি প্রয়োজনীয় হিমঘরেরও। যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে শস্য ভাল ভাবে রাখা সম্ভব। ফলে চোখের সামনে পচছে অতিরিক্ত শস্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফ সি আই) দেশে উৎপন্ন এক তৃতীয়াংশ খাদ্যশস্য কিনে থাকে। এর থেকে বন্টন করা হয় বিভিন্ন কল্যাণকর প্রকল্পে। মজুত করা হয় জরুরী পরিস্থিতির জন্যও। কিন্তু তার পর অবশিষ্ট শস্য নিয়ে কি হবে সে বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই।
খাদ্য সংকটের অন্যতম কারণ অনিয়মিত বৃষ্টিপাত দেশের মোট কৃষি জমির মাত্র ৪০ শতাংশ সেচের আওতায় বাকি ৬০ ভাগ পরোপুরি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল খরিফ চাষ প্রধানত বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল রবি চাষ বেশিটাই হয় সেচের জলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ফি বছর খরিফ চাষ যেমন মার খাচ্ছে তেমনি দেশের সমস্ত সেচ জলাধারে জলের পরিমাণ অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় এবং ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ায় মার খাচ্ছে রবিশস্যও ফলে কৃষি উৎপাদন সামগ্রিকভাবে অনেকটাই হ্রাস পাচ্ছে এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতির বিকাশে
দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল মোট জাতীয় উৎপাদনের (জি ডি পি) ১৭ শতাংশ আসে কৃষি থেকে আবার জাতীয় আয়ের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আসে কৃষি থেকে অর্থাৎ মোট জি ডি পি বা মোট জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে কৃষি তুলনামূলকভাবে কম হলেও দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস হলো কৃষি দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ কৃষি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন শহরাঞ্চলের গরিব মানুষের একটা বড় অংশই গ্রামের কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে আসা মানুষ এমন একটা পরিস্থিতিতে কৃষি সংকট মানে দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে দুর্দশা নেমে আসা
কৃষি উৎপাদনে অস্থিতিশীলতা প্রকট হয়েছে প্রধানত নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে তখন থেকেই কৃষিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমতে থাকে সরকারী বিনিয়োগ হ্রাস মানে মাঝারি বৃহৎ সেচ প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং পুরানো প্রকল্পগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া এর ফলে ভূপৃষ্টের জলে সেচের কাজ ব্যাহত হতে শুরু করে বিপরীতে বেড়ে যায় ভূগর্ভস্থ জলে সেচের কাজ তাতে ভূগর্ভের জলস্তর বিপজ্জনকভাবে কমতে থাকে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংকটও বাড়ে কৃষি বিকাশের স্বার্থে কৃষি পরিকাঠামো তৈরি উন্নয়নে কিছু ভরতুকি ঋণদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়
উচ্চফলনশীল শস্যের চাষ যত বাড়ানো হয়েছে, ভূগর্ভস্থ জলের ভাঁড়ারে ততই টান পড়েছে সেচের প্রয়োজনে। ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের নব্বই শতাংশই ব্যবহার করা হয় চাষের কাজে। নাসার একটি প্রতিবেদনে এই মর্মে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে যে, উত্তর ভারতে জলস্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানে পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। সেন্ট্রাল গ্রাউণ্ড ওয়াটার বোর্ড-এর মতে, দক্ষিণ ভারতে এবং অসম, বিহার, ওড়িশা ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের সমভূমিতেও হু হু করে নামছে জলস্তর। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সাল নাগাদ দেশের সব কটি বড় শহরই শুকিয়ে যাবে। অথচ, ২০৩০ নাগাদ দেশে জলের চাহিদা হবে দ্বিগুণ। এখনই বলা হচ্ছে, প্রতি তিন জন ভারতীয়ের মধ্যে এক জন জলসঙ্কটের শিকার।
বীজদাম বিনিয়ন্ত্রণের পর বহুগুণ বেড়ে গেছে বীজের দাম। যেমন গমের বীজ তিন বছরে ৬৮০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার টাকা কেজি। ধান, জোয়ার বীজ এসময়ে বেড়েছে ৪১ থেকে ১২০ শতাংশ। সবজির বীজের দামও এসময় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। যেমন নানা প্রকৃতির টমেটোর বীজের দাম ৪৭৫ টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা প্রতি কেজির দাম হয়েছে। ক্যাপসিকামের দাম একইভাবে ৩ হাজার ৬৭০ টাকা থেকে ৬৫ হাজার ২০০ টাকা। বেগুন বীজ এসময়ে ১ হাজার ৭৬০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৭৩০ টাকা। ঢ্যাড়সের দাম ১৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪২৫ টাকা। গাজর ৫৯০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৭০০ টাকা। ধনে ৭০ টাকা থেকে ২৭০ টাকা। বিনস ১৫৩ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। একদিকে বীজের দাম বেড়েছে অন্যদিকে বিনিয়ন্ত্রণের ফলে ভেজাল বীজ খোলা বাজারে বেড়ে গেছে। এতে স্বাভাবিকভাবে কৃষিতে ক্ষতি হচ্ছে।
বীজ, সারের দাম বেড়েছে সরকারী নীতিতে। একইভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় তা কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়িয়েছে। জুন ২০১০ থেকে মে ২০১১ এই মাত্র এক বছরে কৃষিতে উৎপাদনের খরচ বেড়েছে ৪৫.৮৩ শতাংশ হারে। সরকারী পাইকারি মূল্যসূচক অনুসারেই এই হার। সরকারী হিসাব অনুসারে ২০১০-১১ সালে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ, তুলোর খরচ বেড়েছে ১৮.৭৮ শতাংশ, ডালের খরচ বেড়েছে ৯ থেকে ১২ শতাংশ, তৈলবীজের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু, ফসলের বাজার সহায়ক মূল্য যা নির্ধারণ হচ্ছে তাতে এই হারে বৃদ্ধি হচ্ছে না। ফলে সঙ্কট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
কৃষির বিকাশের অঙ্গ হিসেবে যে সবুজ বিপ্লব সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সেটা আসলে কৃষিকে প্রকৃতি নির্ভরতা থেকে সরিয়ে শিল্প নির্ভর ও পুঁজি নির্ভর করে তোলার প্রক্রিয়া। একাজ করতে গিয়ে একদিকে যেমন জলের ব্যবহার অতিরিক্ত পরিমাণে বাড়ে অন্যদিকে বাড়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার এবং কীটনাশকের ব্যবহার। ফলে জলের প্রাকৃতিক উৎসগুলি সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং মাটির স্বাভাবিক উর্বরা শক্তি কমতে থাকে। যার নীট ফল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, জলাভাব এবং কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হওয়া
সবুজ বিপ্লব চিরাচরিত ফসলের চাষ এবং কৃষক কর্তৃক বীজ সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়ে উচ্চ ফলনশীল দেশী-বিদেশী সংস্থার তৈরি বীজের ব্যবহার বাড়ায়। ফলে ফসলের বৈচিত্র্য দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তেমনি উচ্চ ফলনশীল বীজের সুফল পেতে দরকার প্রচুর পরিমাণে সেচের ব্যবস্থা এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের। এগুলি বড় বড় শিল্প সংস্থার উৎপাদন। এইভাবে কৃষির উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। কৃষকদের পক্ষে আর নিজ সামর্থ্যে চাষ করা সম্ভবপর হয় না। জরুরী হয়ে পড়ে ঋণের। কৃষি দ্রুত পুঁজি নির্ভর হয়ে পড়ে। যত পুঁজি নির্ভরতা বাড়ে ততোই কৃষক জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে অকৃষক মজুরে পরিণত হতে থাকে। জমি কেন্দ্রীভূত হতে থাকে বৃহৎ মালিক বা সংস্থার হাতে। ধাপে ধাপে কৃষির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় দেশী-বিদেশী বৃহৎ পুঁজির হাতে।
বাজারে যখন খাদ্যপণ্যের দাম চড়া, ফসলের মাঠে তখন অধিকাংশ কৃষিপণ্যেরই ন্যায়সঙ্গত দাম মিলছে না। কোনো কোনো কৃষিপণ্যের দাম পড়েছে অত্যন্ত বেশি মাত্রায়। ২০১০-র ডিসেম্বর এবং ২০১১-র ডিসেম্বরের তুলনামূলক হিসেবে দেখা যাচ্ছে জওয়ার ও ভুট্টা ছাড়া সব প্রধান খাদশস্যেরই দাম পড়েছে। ধানের দাম  ২০১০-র ডিসেম্বরে গড়ে ছিলো কুইন্টালপ্রতি ১২৫১ টাকার। ২০১১-র ডিসেম্বরে কমে দাঁড়িয়েছে ১১৩৮ টাকা। ৯শতাংশ কমে গেছে। গমের দাম ছিলো কুইন্টালপ্রতি ১৫৬৭টাকা, হয়েছে ১৩৩৩টাকা। কমেছে ১৫শতাংশ। বাজরা ছিলো ১০৯২টাকা, কমে হয়েছে ৯১২টাকা। কমেছে ১৭শতাংশ। ছোলার দাম ছিলো ৫৪২৬টাকা, কমে হয়েছে ৫০৩২টাকা। কমার হার ৭শতাংশ। সোয়াবিন ছিলো ২২৬১টাকা, কমে হয়েছে ২১০৬টাকা। কমার হার ৭শতাংশ। এক ধাক্কায় ১০শতাংশ দাম পড়েছে তুলোর। কুইন্টালে হিসেব করলে  কুইন্টালপ্রতি ৪৩০৩টাকা থেকে ৩৮৮৬টাকা। প্রধান প্রধান কৃষিপণ্যের দাম গড়ে ৯শতাংশ কমে গেছে।                
২০১১-১২সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে কৃষি ও সমবায় খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে ১,২৭১কোটি টাকার বেশি। খাদ্য ও গণবন্টন খাতে বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে ৬,৪১৫কোটি টাকার বেশি। গ্রাম উন্নয়ন খাতেও বরাদ্দ কমানো হলো ২,২৩৪কোটি টাকার বেশি (তথ্য : কেন্দ্রের ওয়েবসাইট indiabudget.nic.in) সারের ওপর ভরতুকি তুলে নিতে চালু হয়েছে উদ্ভিদের মুখ্য খাদ্য উপাদান ভিত্তিক ভরতুকি (এন বি এস) প্রকল্পতুলে নেওয়া হয়েছে সারের দামে সমস্ত সরকারী নিয়ন্ত্রণ। সারের দামের ওপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে সারের খুচরো দাম ঠিক করার অধিকার দেওয়া হয়েছিলো সার শিল্পের বেসরকারী মালিকদেরই। তারপরেই কয়েক লাফে সারের দাম দ্বিগুনের বেশি হয়ে তা সাধারণ কৃষকের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বাজেটের হিসেব অনুযায়ী, ২০১১-১২সালে সারে ভরতুকি মিলেছে ৬৭হাজার ১৯৮কোটি ৯৪লক্ষ টাকা। আর ২০১২-১৩ সালের জন্য ভরতুকি কমিয়ে ৬০হাজার ৯৭৪কোটি ১০লক্ষ টাকা করা হয়েছে। ডিজেল-পেট্রোলের মতো পেট্রোপণ্যে ভরতুকি ছাঁটা হয়েছে ১৪,৭৪৬কোটি টাকা।


কৃষির বেহাল দশা
কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়েছে, খাদ্যশস্য চাষের সামগ্রিক এলাকা কমছে। ২০১০-১১সালে যেখানে ১২৬৭.৬৫লক্ষ হেক্টর জমিতে খাদ্যশস্যের চাষ হয়েছিলো, সেখানে ২০১১-১২সালে তা নেমেছে ১২৫৪.৯২হেক্টরে। উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার দিক থেকেও ভারত বিশ্বমানের অনেক পেছনে। সমীক্ষায় স্বীকার করা হয়েছে, দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা প্রাতিষ্ঠানিক সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ পান না। ন্যূনতম সেচের সুযোগের অভাবে কৃষকরা আজও প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফসল সংরক্ষণ ব্যবস্থাও অপ্রতুল। বহুজাতিক কৃষি কোম্পানিগুলির লুট থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় সরকারী বরাদ্দ ও বিনিয়োগ পায়না ভারতের কৃষিক্ষেত্র। সমীক্ষা প্রস্তাব করেছে, ‘যথাযথ গ্রামীণ পরিকাঠামো, পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা, ফসল সংরক্ষণ ও সরবরাহের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, গবেষণা ও উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধি, কৃষি-প্রযুক্তির বিকাশ, কৃষকের কাছে ঋণের সাথে উন্নতমানের বীজ-সার-কীটনাশক পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমেই কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব।
 () যেখানে যতটুকু চাষ সম্ভব তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা তারজন্য বীজ, সার, ঋণ থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের কৃষি উৎপাদন উপকরণ কৃষকদের কাছে চটজলদি সরবরাহের ব্যবস্থা করা () পরিস্থিতির সু‍‌যোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করতে না পারে তার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া খাদ্যদ্রব্যে যাবতীয় মজুতদারি কালোবাজারি বন্ধ করা বাজারে খাদ্যদ্রব্যের জোগান চাহিদার ওপর নিয়মিত তীক্ষ্ণ নজরদারি রাখা এবং প্রয়োজনে আমদানি করে হলেও জোগান ঠিক রাখা () সর্বজনীন গণ-বণ্টন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তাতে সম্ভাব্য সব ধরনের খাদ্যশস্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা রেশনে নিয়ন্ত্রিত দরে খাদ্যদ্রব্যের বিকল্প বণ্টন ব্যবস্থা থাকলে তার প্রভাবে খোলাবাজারে দাম বাড়ার সুযোগ থাকে না () কৃষকদের ঋণ মকুবের ব্যবস্থা এখনই সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা ঋণ প্রক্রিয়া এমনভাবে করা যাতে সাধারণ কৃষকরা তার সুযোগ পায় () কৃষি উৎপাদন কম হবে ধরে নিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্যের সংগ্রহমূ্ল্য বাড়ানো এবং রেশনে তার দাম আরও কমানোর উদ্যোগ এখন থেকে নেওয়া () কৃষি মার খেলে কৃষক, কৃষি মজুর এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের যে মাত্রায় রোজগার কমবে তা পূরণ করার জন্য সরকারী উদ্যোগে পর্যাপ্ত কাজের ব্যবস্থা করা

No comments:

Post a Comment