নওয়াজের জয়ে মার্কিন প্রভাব কি খর্ব হবে?
ভোটের অঙ্কে স্বস্তি মিললেও প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয়
মেয়াদে নওয়াজ শরিফের সামনে অপেক্ষা করছে চ্যালেঞ্জের কঠিন সব অঙ্ক।
সেনাবাহিনী-আইএসআই ও মোল্লাতন্ত্র তখনই পাকিস্তান সরকারকে পুতুলনাচ নাচিয়ে ছেড়েছে, যখন নির্বাচিত
সরকারটি ছিল দুর্বল। এবারে অন্তত তা হচ্ছে না। কিন্তু দেশ দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ
ধস্ত অর্থনীতির ওপর। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকটের
মতো নৈমিত্তিক সমস্যায় অতিষ্ঠ আমজনতা। নির্বাচনে নওয়াজের স্লোগান ছিল তাই 'শক্তিশালী অর্থনীতি, শক্তিশালী পাকিস্তান।'
সুতরাং তীব্র আর্থিক সংকটের অঙ্কের হিসাবের ঘর পূরণ করতে
হবে নওয়াজকে। আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল ঋণের ভারে ন্যুব্জ পাকিস্তান। আজদাহা
এই জাতীয় ঋণের বোঝা হালকা করতে প্রয়োজন বড় অঙ্কের অনুদান ও অর্থসহায়তা। পারিবারিক
উত্তরাধিকারে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নওয়াজ জানেন, তাঁর শক্তপোক্ত জনসমর্থনের ভিত্তির
অন্যতম কারণ তাঁর অর্থনৈতিক বিচক্ষণতার প্রতি মানুষের আস্থা। খোলাবাজারের
অর্থনীতির সমর্থক নওয়াজ হাঁটতে পারেন ঢালাও বেসরকারিকরণের পথে। ভর্তুকি কমিয়ে
করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টাও হতে পারে। আইএমএফের কাছে নতুন প্যাকেজের আবেদন হতে
পারে উত্তরণের পথ। এই অবস্থায় নওয়াজ কার হাত ধরবেন, ওয়াশিংটন
না কি বেইজিংয়ের? সেটিই আপাতত হিরকমূল্যের প্রশ্ন। জ্বালানি
সংকট মোকাবিলায় ইরানের পাইপলাইন না ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুতি? ওয়াশিংটনের
দিকে যদি ঝোঁকেন নওয়াজ, তবে ভোটের প্রচারপর্বে তাঁর
মার্কিনবিরোধী মন্তব্যের গায়ে স্রেফ 'রাজনীতি'র রং, মনের গহীনে অন্য বার্তা।
ওয়াশিংটনের ওস্তাদি...
নয়া নওয়াজ-জমানার ইসলামাবাদ-ওয়াশিংটন সম্পর্ক কোন পথে
যাবে? আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক ন্যাটো বাহিনী
প্রত্যাহারের আগে দুই দেশের মধ্যে তৈরি হয়েছে যথেষ্ট টানাপড়েন। প্রেসিডেন্ট ওবামা
অবশ্য বলেছেন, 'নতুন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ
করার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।' কিন্তু আমেরিকার
সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে সাহায্য-মদতের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে
মন্তব্য করেছেন নওয়াজ নিজেই। তালেবানি-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে তাই নওয়াজের ভবিষ্যৎ
কর্মপন্থা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। সেনা অভিযানের মতো 'বিবাদী-পন্থার'
বদলে আলোচনার পক্ষপাতী তিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুধু নওয়াজের
পিএমএল-এন ও ইমরানের পিটিআইকেই প্রচারপর্বে ছাড়পত্র দিয়েছিল তালেবান। কারণ দল দুটি
তাদের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন। প্রধানত মার্কিন ড্রোন হামলার বিপক্ষে মানুষের ক্ষোভকে
সম্বল করে ও তরুণ প্রজন্মের একাংশের সমর্থনের ভিত্তিতে ইমরানের সাফল্য।
নির্বাচনী সভা-সমাবেশে ইমরান যেভাবে এবং নওয়াজ
মার্কিনবিরোধী অবস্থান তুলে ধরেন, তা ওয়াশিংটনের জন্য বিরাট অস্বস্তির কারণ। অতএব
নিজেদের স্বার্থে তাঁরা সেনাকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবেন। নওয়াজের
বিপদটাও ঠিক এখানে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নানা কারণে মন্দ। সাবেক
সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট মোশাররফের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শত্রুতার : নওয়াজ
মোশাররফকে সেনা শীর্ষপদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানে নওয়াজকে পদচ্যুত
করেন বদলা নেন মোশাররফ। কিন্তু কেবল মোশাররফই নন, সামরিক
বাহিনীর রাজনৈতিক সক্রিয়তা ঘোর অপছন্দ নওয়াজের। পাকিস্তানে সবচেয়ে স্থায়ী ও
স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠানটি নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনী। তাই মোশাররফের কৃতকর্মের বিচারের
প্রক্রিয়া খুব বেশি দূর এগোলে অথবা কারগিল যুদ্ধ নিয়ে বেশি জলঘোলা হলে সেনাবাহিনী
কেবল দর্শক হয়ে থাকবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই।
আশার কথা, আগামী বছর জেনারেল কায়ানির সরে যাওয়ার
সময় হবে। নতুন সেনাপ্রধানের সঙ্গে নতুনভাবে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে নওয়াজের
বড় দায়িত্ব। পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে কার্যত শেষ কথা বলে
সেনাবাহিনীই। সুতরাং নওয়াজ চাইলেও মার্কিন প্রভাব কতটা কমজোরি করতে পারবেন,
বলা কঠিন।
দিল্লির দহরম...
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে যদি এক ধাপও এগিয়ে নিতে হয়, তবে নব্বই দশকের
দুই দফার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজই একমাত্র আশা। কারণ এই নয় যে উদারমনস্ক নেতা তিনি।
নওয়াজের প্রধান পরিচয় দক্ষিণপন্থী, রক্ষণশীল ও পাঞ্জাবি
জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে, ইসলামী মৌলবাদী শিবিরেরও
আস্থাভাজন তিনি। তাঁর আমলেই পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে চাপে
ফেলেছিল ভারতকে। কারগিল যুদ্ধ হয়েছে তাঁর সময়ে। আবার দিল্লি-লাহোর বাসযাত্রারও
রূপকার তিনি। অন্য কোনো পাকিস্তানি নেতা ভারত-ভ্রাতৃত্বের কথা বললে তাঁর কপালে
হয়তো 'দেশদ্রোহী' কলঙ্ক জুটতে পারত।
কিন্তু রক্ষণশীলতার ঘরানার ভেতর থেকেও নওয়াজের বৈদেশিক (পড়শি) সদ্ভাবের ক্ষেত্রে
সাফল্যের পথ তুলনায় বেশি চওড়া। নওয়াজ ইতিমধ্যে বলেছেন, ২৬/১১-র
ঘটনায় আইএসআইয়ের ভূমিকার তদন্ত করবেন। কারগিল তদন্তের সব তথ্যও ভারতকে দেখাবেন।
এমনকি যৌথভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করবেন।
বেইজিংয়ের বন্ধুত্ব...
প্রেসিডেন্ট জারদারি সাম্প্রতিক সময়ে বার চারেক চীন সফর
করেছেন। সেই তুলনায় নওয়াজ বিগত কয়েক বছরে চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে ততটা যোগাযোগ রক্ষা
করেছেন বলে জানা যায় না। ভারতের সাপেক্ষে জিনজিয়াং প্রদেশের ইসলামী আন্দোলনের
পরিপ্রেক্ষিতে বেইজিংয়ের কিন্তু তার পুরনো ও নির্ভরযোগ্য সঙ্গী ইসলামাবাদকে
প্রয়োজন। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় লভ্য জ্বালানির স্বার্থে এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের তাগিদেও ইসলামাবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া অটুট রাখতে চাইবে
বেইজিং।
সাফল্যের সন্ধি...
উৎসবের রং আর বাজির রোশনাই শেষ হলে, কিভাবে নিজের
প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা কাজে রূপান্তর করেন, তার ওপর সফলতা
নির্ভর করবে নওয়াজের। পাকিস্তানের জন্য নয়- কেবল ভারত, আফগানিস্তানসহ
গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই 'নয়া' নওয়াজের
কৃতকার্যতা কাম্য। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত দ্বিতীয় পাকিস্তান সরকারের
স্থিতি ও গতির ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করবে এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ।
No comments:
Post a Comment