সন্ত্রাস কি ফের ফিরল আমেরিকায়?
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম যুদ্ধের স্মরণে এপ্রিল মাসের
তৃতীয় সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'পেট্রিয়টস ডে' হিসেবে
পালিত হয়। ১৮৯৭ সাল থেকে এ দিনটিতেই হয়ে আসছে ২৬ দশমিক ২ মাইল পাল্লার বোস্টন
ম্যারাথন। নানা দেশ থেকে যোগ দেওয়া প্রতিযোগীদের শুশ্রূষার জন্য চিকিৎসকদের ছাউনি
ছিল এবারও। তাই হয়ে উঠল প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র। ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় দুপুর
৩টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই, মিনিট দশেক বাকি। ম্যারাথনের আসর
জমজমাট। বয়েলস্টন স্ট্রিটের দুই ধারে দাঁড়ানো হাজারও মানুষের হর্ষধ্বনি। ৭৪টি দেশ
থেকে আসা ২৩ হাজার দৌড়বিদের অর্ধেকের বেশিই ততক্ষণে ফিনিশিং লাইনে পা রেখে
ফেলেছেন। পিছিয়ে পড়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা তখনো অদম্য মনোবলে
ছুটছেন ফিনিশিন লাইন ছুঁতে। হঠাৎ কানের পর্দা অকার্যকর করে দেওয়ার মতো আওয়াজ,
বিকট-বিরাট। দৌড়াতে থাকা মানুষগুলো এদিক-ওদিক ছিটকে পড়লেন। কারো
হাত-পা শরীর থেকে ছিঁড়ে পাক খেতে খেতে লাফিয়ে উঠল শূন্যে! দর্শক সারিতে থাকা
মানুষগুলোও হুড়মুড় মাটিতে গড়িয়ে পড়লেন মাটিতে ভবনধসের মতো। তাঁদের মধ্যে কারো বাবা,
কারো বা ভাই-বোন-বন্ধু রয়েছেন দৌড়ে। অনেকে জড়ো হয়েছিলেন শুধুই
খেলার টানে_স্রেফ ক্রীড়াপ্রেমী তাঁরা। কিন্তু কোথা থেকে কী
হলো, মুহূর্তে আনন্দের বাতাসে বারুদগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল।
ম্যারাথনের ট্র্যাক নিমেষে রক্তে পিচ্ছিল। হর্ষোল্লাস পরিণত হলো করুণ আহাজারিতে। উৎসবের
আঙিনা লণ্ডভণ্ড করে দিল সন্ত্রাস। হতবিহ্বল বিভ্রান্ত মানুষ প্রাথমিক ধাক্কা সামলে
না উঠতেই ১৩ সেকেন্ডের মাথায় কয়েক শ ফুট দূরেই আবার বিস্ফোরণের আওয়াজ। ১৫ এপ্রিলের
এই জোড়া বিস্ফোরণে তিনটি তাজা প্রাণ চলে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাবার জন্য হাসিমুখে
অপেক্ষা করে থাকা খুদে বালক রিচার্ডও। আহত কম করে ১৮০ জন। রিচার্ডের মা আর বোনও
রয়েছেন আহতের তালিকায়। বোনটির একটি পা খোয়া গেছে। মা ডেন্সির মস্তিস্কের আঘাতও
গুরুতর। বাবা বিল ছিলেন দৌড়ে।
২.
গত এক দশকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার আর সাবওয়েতে দুবার
নাশকতা ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেসব সফল হয়নি। সে দিক থেকে ৯-১১-এর পর এই
প্রথম আবার সন্ত্রাসের সামনে পড়ল যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো জঙ্গি সংগঠন
হামলার দায় স্বীকার করেনি। ঘটনার পরপরই দেওয়া বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাও
একে সরাসরি জঙ্গি হামলা বলেননি। পরে অবশ্য এই ঘটনাকে 'কাপুরুষোচিত
সন্ত্রাস' বলে বর্ণনা করেন তিনি।
তার মানে ৯-১১-র পর এত বছর মোটামুটি সন্ত্রাসমুক্ত
নিরুপদ্রবে কেটেছে মার্কিনিদের জীবন। তাদের মনে একটা নিরাপত্তার বোধ তৈরি হয়েই
গিয়েছিল। যদিও গত এক-দেড় বছরেই দেশটিতে ঘটেছে কমবেশি ১৭-১৮টি 'অস্ত্রবাজি-সন্ত্রাসের'
(গান ভায়োলেন্স) ঘটনা। ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে
বছর পাঁচেক আগে ৩২ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি এখনো অনেকের মনে দগদগে। গত
১৪ ডিসেম্বর কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের নিউটাউন শহরের স্যান্ডি হুক স্কুলের মর্মন্তুদ
ঘটনার কেউই ভোলেননি। ওই দিন অ্যাডাম ল্যানজার নামের এক তরুণের বন্দুক হামলায় এক
লপ্তে ঝড়ে যায় ছয় থেকে সাত বছরের ২০টি ফুটফুটে শিশুর প্রাণ। বেঘোরে মারা পড়েন আরো
ছয়জন। নিজের প্রাণটিও নিজে কেড়ে নেয় 'খুনি' অ্যাডাম। এই তো সেদিনও, ২১ এপ্রিল, সিয়াটলে এক অস্ত্রধারীর গুলিতে চারজনের জীবনদীপ নিভে গেল। পুলিশের গুলিতে
প্রাণ হারায় খুনিও। এ সব অবশ্য মার্কিনিদের চোখে 'পাপ'
নয়। জন্মে মার্কিনি হলে আর ধর্মে 'অমুসলিম'
(পড়ুন খ্রিস্টান!) হলে, খুনিদের 'মানসিক অসুস্থতার' প্রশ্ন ছাড়া অন্য কোনো কিছু আর
ভাবতে পারে না সরকার-প্রশাসন। পশ্চিমি গণমাধ্যমেও চলে তারই সাফাই। ফলে 'ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের' ঘটনাগুলো বাদ দিলে
নাশকতার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা খানিক ভুলতে বসেছিল মার্কিন জনতা। বোস্টনের ঘটনা
জনজীবনের মেরুদণ্ডে ফের হাড়হিম স্রোত বইয়ে দিয়েছে।
৩.
জরুরি প্রশ্নটি হলো, কে বা কারা ঘটাল এই নাশকতা? রুটিনমাফিক প্রথমেই দুঁদে মার্কিন গোয়ন্দাসহ ধুরন্ধর প্রশাসনের সন্দেহের
প্রথম তীরটি ছোড়া হয় অন্ধকারে! এই 'অন্ধকারের' নাম জঙ্গিবাদ। আরেকটু খোলাসা করে বললে তা কট্টর ইসলামপন্থা। হয় তালেবান,
নয় আল-কায়েদা। এ দুই জঙ্গিগোষ্ঠী 'মিস'
হলে তাদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকা কোনো ছোটো-বড় গ্রুপ বা তাদের
ভাবশিষ্যের কাজ হবে নির্ঘাত। কিন্তু যদি কোনো বিদেশি গোষ্ঠীর হাত থাকে এর পেছনে,
তবে তারা নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটনের মতো জায়গা টার্গেট না করে বস্টনে
হামলা চালাত কি না, ওঠে সে প্রশ্নও। তবে কি স্থানীয় স্তরে
গড়ে ওঠা কোনো জেহাদি সংগঠন সক্রিয় হলো? প্রথমেই গোয়েন্দাদের
সন্দেহের চোখে ধরা পড়ে সৌদি আরব থেকে সেখানে পড়তে যাওয়া এক যুবক। বিস্ফোরণে ওই
যুবকও কিছুটা আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তাকে দীর্ঘক্ষণ জেরা; 'গল্প' বের করার মতো কিছু পাওয়া যায় না। এর মধ্যেই
বিভিন্ন সিসিটিভিতে ধারণ করা সচলচিত্র দেখে সন্দেহভাজন দুইজনকে শনাক্ত করে ফেলেন
করিৎকর্মা গোয়েন্দারা। তাঁরা হলেন চেচেন বংশোদ্ভূত মার্কিন দুই নাগরিক জোখার
সারনায়েভ (১৯) ও তামেরলান সারনায়েভকে (২৬)। সম্পর্কে তাঁরা দুজন সহোদর।
৪.
ইতিমধ্যে বড় ভাই তামেরলান গুলিতে বেঘোরে মারা পড়েছেন।
অপরাধ কবুল বা অভিযোগ অস্বীকার করার ফুরসত তিনি পাননি। পশ্চিমি গণমাধ্যমে
তামেরলানের মৃত্যুর দুই রকম কারণের কথায় তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। এক. পুলিশি অভিযানের
সময় গুলি লেগে তামেরলামের প্রাণ গেছে। দুই. পুলিশ তাঁকে পাকড়াও করে হাতকড়া পড়ানোর
সময় ছোট ভাই জোখার গুলি করে তাঁর প্রাণ নিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে জোখারের
মারাত্মক আহত হওয়ার খবরের পাশাপাশি তিনি নিজে মুখের ভেতর গুলি করে আত্মহত্যার
চেষ্টার কথাও চাউর করা হয়েছে। এই দুই ভাইয়ের পরবর্তী হামলার লক্ষ্য নাকি ছিল টাইমস
স্কয়ার। ফাঁদা হয়েছে এমন 'বিশ্বাসযোগ্য' গালগল্পও! গাড়ি ছিনতাই করে তাতে
অস্ত্রশস্ত্র মজুদ, ছুটছিলেন তাঁরা নিউ ইয়র্কের পথে। কিন্তু
পথে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। শুরু হয় বন্দুকবাজি। তামেরলান মারা পড়লেও গুলিবিদ্ধ
মারাত্মক জখম জোখার পালিয়ে যান। পরে তাঁকে পাকড়াও করা হয়। হাসপাতালের শয্যায় চলে
জেরা। গুলিতে বাকশক্তি হারালেও জোখারের সচল হাতে কলম ধরিয়ে অপরাধের ফিরিস্তি
রেকর্ড করেন তদন্তকারীরা। অভিযুক্ত জোখারের বিচার শুরু হবে মে মাসে। তার পরিণতি কী
হতে পারে, কারো অনুমানের বাইরে নয় তা।
কিন্তু এই দুই ভাইয়ের মা-বাবার কথা শুনুন, 'গোয়েন্দা
সংস্থাগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে এ হামলা পরিচালনা করেছে। এর পেছনে অবশ্যই কোনো
কাহিনী আছে। কিন্তু তারা সব দায় আমাদের ছেলেদের ওপর চাপিয়েছে।' কোনো দেশের এক সরকারের অনুরোধে নাকি ২০১১ সালে তামেরলানকে এফবিআই
জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল একবার। এর পর তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগও করেছে সংস্থাটি।
সারনায়েভ ভাতৃদ্বয়ের এই ঘটনা বাংলাদেশি যুবক নাফিসের ঘটনা সামনে টেনে আনে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে
নাফিসকে গত ১৭ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে এফবিআই। তাঁর পরিবারের দাবি, ষড়যন্ত্রের শিকার নাফিস। জোখার-তামেরলামের মা-বাবাও তাঁদের ছেলেদের
নির্দোষিতার দাবি করেছেন। এফবিআই বা সিআইয়ের মতো বিশ্বসেরা বিশ্ব-চর সংস্থার
হাজারও পাতায় লেখা অভিযোগের সামনে জোখার বা নাফিসের পরিবারের মুখের দাবি কি টিকতে
পারবে? সন্দেহের বশে বছরের পর বছর 'নিরাপরাধীকে'
কারাগারে আটকে রাখার কারিগর মার্কিন প্রশাসন। গুয়ানতানামো বে
কারাগারে আটক এখনো যে ১৬৬ বন্দি দুনিয়ার আলোহাওয়াবঞ্চিত, তাঁদের
গত ১০-১২ বছরেও বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। তবু এই আটকাবস্থা জায়েজ! এবার অনাহারে
থেকে হার-না-মানার লড়াইয়ে নেমেছেন বন্দিরা। অনশন করছেন তাঁরা। এসব হতভাগ্য বন্দির
আর্তনাদ কখনো কারাগারের দেওয়াল টপকে বাইরে যায় না। তাঁদের পরিবারের আর্তি
পশ্চিমাদের কানে পৌঁছে না। কিন্তু কোথাও পান থেকে চুন খসলেই কর্ণগোচর হয় তাঁদের!
এফআইএর 'ফাঁদ পাতা' অভিযানে (স্টিং
অপারেশন) কে কখন ধরা পড়ে, কে জানে!
No comments:
Post a Comment