Sunday, May 19, 2013


নওয়াজের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ...

নওয়াজ শরিফ বলেছেন, তাঁর এবারের আমলে এশিয়ার বাঘ হবে পাকিস্তান। নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার দুই দিন পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন নওয়াজ।
নওয়াজের ওই বক্তব্যের পেছনে নানা উত্থান-পতনের পর আবার প্রধানমন্ত্রিত্ব ফিরে পাওয়ার উচ্ছ্বাস কাজ করে থাকবে। বিজয়-পরবর্তী আবেগের রেশ কাটলে শিগগিরই শুরু হবে বাস্তবতার সঙ্গে বোঝাপড়া।
পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) প্রধান নিজেই বলেছেন, দেশের অর্থনীতিকে পথে ফিরিয়ে আনা হবে তাঁর প্রধান কাজ। সর্বব্যাপী দুর্নীতির রাশ টানা (একই সঙ্গে নিজে ও ঘনিষ্ঠজনদের তা থেকে দূরে রাখা), সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত মোকাবিলা, তীব্র জ্বালানি সংকটের মতো সমস্যার সুরাহা আর বিচার বিভাগের সঙ্গে সঠিক বোঝাপড়া হবে নওয়াজের সামনে উপস্থিত গুরুদায়িত্বগুলোর কয়েকটি। 

১১ মের সাধারণ নির্বাচনে নওয়াজের অঙ্গীকার ছিল কাজ শুরু করার প্রথম তিন মাসে বেকারত্ব ও দুর্নীতিসহ দেশে শিকড় গাড়া বিভিন্ন সমস্যা ও অনিয়ম দূর করা। দীর্ঘদিন পর দেশের মানুষ যে প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর হাতে আবার ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, তা পূরণে ব্যর্থ হলে আবার তিনি অপ্রিয় হয়ে উঠবেন। 

পাকিস্তানের এবারের সাধারণ নির্বাচন নানা দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ। সবচেয়ে বড় কথা (যা পুনরুক্তি হলেও না বলে উপায় নেই) দেশের ইতিহাসে এই প্রথম নির্বাচিত সরকার পূর্ণ মেয়াদ পার করার পর আবার নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে যাচ্ছে। ভোটের বিরুদ্ধে আল-কায়েদা ও তালেবানের মারাত্মক হুমকি ও হত্যাযজ্ঞের পরও বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনায় মোটের ওপর সুষ্ঠুভাবে হয়েছে এ নির্বাচন। নিবন্ধিত আট কোটি ৬১ লাখের বেশি ভোটারের মধ্যে পাঁচ কোটির বেশি ভোট দিয়েছে। পাকিস্তানে নির্বাচনে ৬০ শতাংশ ভোট পড়ার ঘটনা এটাই প্রথম। এ ঘটনা সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তানকে সবচেয়ে বড় না হলেও সবচেয়ে সাহসী গণতন্ত্রের দেশহিসেবে সুখ্যাতি এনে দিয়েছে। 

এক হিসাবে এর মধ্যেই নওয়াজ শরিফ নিজেকে পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশটিতে তিনিই একমাত্র রাজনৈতিক নেতা, যিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক জীবনে অনেক বিরূপ পরিস্থিতিকেও জয় করেছেন তিনি। আগে ক্ষমতায় থাকতে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিযোগের কারণেই তাঁর জনপ্রিয়তায় ধস নামে। পরবর্তী সময়ে তিনি যেসব ঝড়ঝাপটা সামলান এর মধ্যে রয়েছে পারভেজ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়া, কারাবরণ ও বিদেশে নির্বাসনে যাওয়া। 

নওয়াজ শরিফ শেষবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ছিলেন নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। ১৯৯৯ সালে তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন। সেনাপ্রধানের সঙ্গে নওয়াজের আগে থেকেই দ্বন্দ্ব চলছিল, যার চূড়ান্ত পরিণতি ওই অভ্যুত্থান। বিদেশ সফরে যাওয়া পারভেজ মোশাররফের বিমান পাকিস্তানে অবতরণ করতে না দিয়ে পতন ডেকে আনেন নওয়াজ। এর জের ধরেই তাঁকে কারাবন্দী করা হয়। পরে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয় সৌদি আরব। ঘটনাচক্রে সেই মোশাররফই এখন বন্দী। আর নওয়াজ আবার ক্ষমতায়। এখন তিনি মোশাররফের ওপর আইনি বা বেআইনি পথে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টাও করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে প্রভাবশালী সেনাবাহিনী নওয়াজকে কতটা সহযোগিতা করবে, তা এখনই বলা যাবে না। 

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, প্রতিশোধের চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে সবার আগে নওয়াজের কাজ হবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে মনোনিবেশ করা। দিনের পর দিন বঞ্চিত সাধারণ মানুষ তাকিয়ে আছে নওয়াজের দিকে। সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম কাজটি হবে সংযমের চর্চা করা। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির চিন্তা বাদ দিয়ে অঙ্গীকার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে তাঁকে। নতুন সরকার জটিল সমস্যাগুলো জাদুমন্ত্রের মতো এক ফুঁতেই যে দূর করতে পারবে, সে আশা কেউ করে না। তবে নওয়াজের সরকারকে দেখাতে হবে তাদের চেষ্টার বিরাম নেই। 

নওয়াজের শরিফের বিজয়কে যে ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে তার একটি সূচক হচ্ছে ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে গেছে দেশের শেয়ার বাজারের সূচক। তা ছাড়া নওয়াজ দেশের একটি বিশিষ্ট শিল্পপতি পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাণিজ্যের বিষয়টি তিনি নিজেই ভালো বোঝেন। অনুকূল পরিবেশ যথাযথভাবে কাজে লাগালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর সরকার যে সাফল্য পাবে, তা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়। পাকিস্তানের কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দাবি করছেন, তাঁদের পরামর্শমতো চললে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শিগগিরই দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অলৌকিক সাফল্য আশা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞজনেরা। 

নওয়াজের বিজয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গেও সম্পর্ক নবায়ন তথা উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হচ্ছে ভারত ও আফগানিস্তান। নির্বাচিত হয়েই নওয়াজ ঘোষণা করেছেন, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে কাজ করবেন তিনি। তাঁর আগ্রহের মাত্রাটি বোঝা যায় এ ঘোষণা থেকেই যে আমন্ত্রণ আসুক আর না-ই আসুক, নয়াদিল্লি সফরে যাবেন তিনি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর সীমান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সীমান্তে শান্তি বজায় রেখে সম্পর্ক ভালো রাখতে নওয়াজ কী কৌশল নেন, তা দেখার বিষয়। লস্কর-ই-তায়েবার মতো পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর ভারতে ঢুকে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো অনেক দিন ধরেই দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে কাঁটা হয়ে রয়েছে। এই বিষয়ে পাকিস্তানের সাবেক কোনো সরকার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নওয়াজের এখানে বিচক্ষণতা দেখানোর সুযোগ রয়েছে। 

এদিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সেনাদের সরে যেতে নওয়াজ সহযোগিতামূলক ভূমিকা নেবেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকবে সবাই। আফগানিস্তান সে দেশের সন্ত্রাসবাদের জন্য পাকিস্তানকে প্রায়ই দায়ী করে। পূর্ব ঘোষণামতো আগামী বছর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনারা চলে গেলে পাকিস্তানের ওপরও তার চাপ পড়বে। ওই সময় আফগানিস্তানে আল-কায়েদা ও তালেবান জঙ্গিদের তৎপরতা বেড়ে যাবে বলেই মনে করা হয়। একই সঙ্গে সক্রিয় হবে তাদের পাকিস্তানি দোসরেরা। ওই পরিস্থিতিতে নওয়াজ সঠিক ও জোরালো পদক্ষেপ নিতে না পারলে বড় ধরনের সমস্যা হবে। 

দেশের অভ্যন্তরে অপরাধ, সাম্প্রদায়িকসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা দমন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কাজ হবে নওয়াজের জন্য। তালেবানসহ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতায় নওয়াজের দলকে ছাড় দিলেও ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারকে ছাড় দেবে কি না, এর নিশ্চয়তা নেই। নওয়াজ শরিফ যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে দূরত্ব রাখার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়েছেন। আবার বলেছেন, তালেবানকেও খুব একটা ছাড় দেবেন না। বোঝাই যায় দক্ষ রাজনীতিকের মতো ভারসাম্য রক্ষার খেলায় অবতীর্ণ হবেন তিনি। তাঁর ফলাফল কী হবে, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি হবে নওয়াজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি। পারভেজ মোশাররফের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তান যতটা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে, বিদায়ী পিপিপি সরকারের আমলে তা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। পাকিস্তানকে না জানিয়ে সে দেশের ভেতরে লাদেন হত্যায় মার্কিন অভিযান ও প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির চিঠি-বিষয়ক কেলেঙ্কারির পর দুই দেশের সম্পর্কের রীতিমতো অবনতি ঘটে। এর জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্যে পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ আর্থিক সহায়তাও উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিয়েছে। নওয়াজের কাজ হবে দুই দেশের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভও দূর হবে আবার, পাকিস্তানের স্বার্থও ক্ষুণ্ন হবে না। 



  •  ১৯৪৯ সালে লাহোরের এক বিশিষ্ট শিল্পপতি পরিবারে জন্ম
  •  সামরিক শাসক জিয়াউল হকের সময় ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নিজ প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন
  •  এর আগে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
  •  পারভেজ মোশাররফের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও কারাদণ্ড
  •  সমঝোতার মাধ্যমে সৌদি আরবে নির্বাসনে যান
  •  ফিরে আসেন ২০০৭ সালে

No comments:

Post a Comment