কাবুলের দেওয়াল
লিখন!
‘দি রিট্রিট ফ্রম কাবুল’। নিছক একটি তৈলচিত্র নয়। রানী ভিক্টোরিয়ার সময়কালের নামজাদা
চিত্রশিল্পী এলিজাবেথ বাটলার ছবিটি রাঙিয়েছিলেন আফগানিস্তান থেকে ব্রিটিশ
সেনাবাহিনীর পালিয়ে আসাকে ঘিরে। ১৮৪২ সালের জানুয়ারি মাস। আফগানিস্তানে ব্রিটিশ
সেনানায়ক ডব্লিউ ব্রাইডনের নেতৃত্ব ১৬,৫০০ সেনা। বন্দী দশায় কাবুলে। কনকনে শীতে পালিয়ে আসা। কাবুলের
সেনাছাউনিতে আফগান যোদ্ধাদের হামলা। উপজাতির যোদ্ধাদের আক্রমণে ব্রিটিশ
সেনাবাহিনীর নিকেষ হওয়া। নিখুঁতভাবেই ফুটে উঠেছে এলিজাবেথের তুলির টানে। সম্প্রতি
শিকাগোতে ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে ছবিটি টাঙিয়ে রাখা খুবই প্রাসঙ্গিক ছিলো বলে অনেকেই
সহমত হবেন। কারণ, ‘দি রিট্রিট ফ্রম কাবুল’
ছবিটি স্মরণ করিয়ে দেয়,
বর্তমানে আফগানিস্তানে মার্কিন-ন্যাটো জোটের
অবস্থা অনেকটা একই রকম। প্রায় দেড়শো বছর আগের মতোই ফের এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি
আফগানিস্তানে মুখে। যারা পালিয়ে আসতে চাইছে।
শিকাগোর বৈঠকে
যতোই আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো জোটের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে উত্তপ্ত
বাকবিতণ্ডা হোক না কেন। এটা কিন্তু পরিষ্কার যে, আফগানিস্তানে দ্বাদশ শতাব্দীর অস্ত্রে সজ্জিত
একদল পাহাড়ী যোদ্ধার কাছে দোর্দণ্ড প্রতাপ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাজিতই প্রায়।
এটা সবাই জানে
যে, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের আসল
লক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক। সাধারণ মানুক হত্যা নয়। আমেরিকার নজর ছিলো ক্যাসপিয়ান
বেসিনের তেল সম্পদ দখল। একই সঙ্গে আফগানিস্তানে একটি লেজুর সরকার খাড়া করা। যার
মাধ্যমে চীনের প্রভাব বৃদ্ধিকেও কিছুটা স্তিমিত করা যাবে। কিন্তু এগারো বছর ধরে
প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এই যুদ্ধ চালানোর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র
প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এর মানে সামরিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তানে
পরাজয়ই স্বীকার করে নিতে হয়েছে আমেরিকাকে।
ন্যাটো
সদস্যভুক্ত দেশগুলির কাছে এই যুদ্ধের পরিণাম হয়েছে আরো উদ্বেগজনক। যেহেতু এই
যুদ্ধে ন্যাটোকে জড়িয়েছিলো আমেরিকা। আর আফগানিস্তানে আগ্রাসনের ফলে ন্যাটোর কোন
স্বার্থও পূরণ হতো না। পাশাপাশি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এই যুদ্ধ
মেনেও নেয়নি। তাই ন্যাটোর ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের আগ্রসন চালানোর পরিণাম হয়েছে
ভয়াবহ। ন্যাটো জোটের মধ্যেই এই যুদ্ধতে জড়ানোকে ঘিরে ফাটল দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন
উঠেছে ন্যাটো আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে। এছাড়া আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয়
পশ্চিম ইউরোপে ওয়াশিংটনের প্রভাবকেই কম করেছে।
এদিকে
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারকে ঘিরে অন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা
দিয়েছে। মার্কিন সেনারা ফিরে যাওয়ার পর কতদিন কাবুলে টিকে থাকতে পারবে রাষ্ট্রপতি
হামিদ কারজাইয়ের সরকার। সম্প্রতি ওবামা প্রশাসন কাবুলকে ৪০০ কোটি ডলার সাহায্য
দিয়েছে। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সেই টাকার সদ্ব্যবহার হবে তা! কারজাই ভোট
চুরির মতোই অর্থও তছরুপ করবেন না তো? অথবা আমেরিকার চাপানো পুতুল সরকারের দশা দক্ষিণ ভিয়েতনামে ওয়াশিংটনের
কলকাটিতে নড়া সরকারের মতোই হবে না তো? ১৯৭৫ সালে যে সরকার তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়েছিলো।
বর্তমানে ৩ লক্ষ
৫০ হাজার সেনা কারজাই সরাকারকে রক্ষা করছে। এরমধ্যে একদিকে যেমন আছে
মার্কিন-ন্যাটো জোট সেনা। তেমনই আছে আফগান সেনা ও পুলিস। এছাড়াও কাজ করছে উপজাতি
তাজিক এর উজবেক যোদ্ধারা। যারা টাকার বিনিময়ে লড়াই করছে। আর বাস্তবে আফগানিস্তানের
সংখ্যাগুরু পাখতুন গোষ্ঠীর মানুষের ঘোরশত্রু এই তাজিক এবং উজবেকরা। অন্যদিকে আছে
তালিবান এবং অন্যান্য উগ্রপন্থী গোষ্ঠী। যতদিন যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে
সেনাবাহিনীর টক্কর ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের দক্ষিণের কান্দাহারের মতো বেশ কিছু
শহরে তালিবানরা সমান্তরাল সরকার চালাচ্ছে। তাই একটি আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
মার্কিন-ন্যাটো জোট সেনার ফেরার পর কারজাই সরকারের মেয়াদ ক’দিন। কাবুলের দেওয়াল লিখন কি শিকাগোর বৈঠকে
অনুচ্চারিতই রইলো!
আগ্রাসী ন্যাটোর
শাসনে আফগানিস্তান
আগ্রাসী ন্যাটোর ভয়ঙ্কর রূপের সাক্ষী বিগত এক দশকের আফগানিস্তান।
নব্যসাম্রাজ্যবাদের পেশিশক্তির জোরে বর্তমান আফগানিস্তান একটি মৃতপ্রায় দেশ।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর সাথে তালিবান উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সংঘর্ষ
নিত্যদিনের ঘটনা আফগানিস্তানে। সরকারী হিসেবেই বিগত তিন বছরে আফগানিস্তানে মোট
নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার।
বিগত দশ বছর ধরে আফগানিস্তানকে গণতান্ত্রিক উন্নয়নশীল দেশের
সমমর্যাদায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে শোষণ ও শাসন করে চলেছে আমেরিকা। তারাই
স্থাপন করে দিয়েছে হামিদ কারজাইয়ের পুতুল সরকার।
১৩ই জুন, ২০১২
ন্যাটো মহাসচিব আন্দ্রেস ফগ রাসমুসেন এর মন্তব্য, ‘আফগানিস্তানের নিরাপত্তার শূন্যতা সৃষ্টি করে ন্যাটো বাহিনী চলে যাবে
না। আফগানিস্তানে ন্যাটো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার অভিন্ন
স্বার্থ ও দায়িত্ব রয়েছে।’ তিনি
আরো বলেন,
‘আফগান
প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন না। ন্যাটো জোট আফগানিস্তানে
দশকব্যাপি যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি দেখতে চায়।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মার্কিন আফগান চুক্তি অনুযায়ী এমনিতেই ২০১৪
পর্যন্ত মার্কিনবাহিনী আফগানিস্তানে থাকার কথা। মার্কিনীদের বর্তমান প্রচেষ্টা সেই
সময়সীমাকে আরও বাড়ানোর। প্রকৃতপক্ষে, আফগানিস্তান
জুড়ে মার্কিনীদের ‘শান্তি স্থাপন’ প্রক্রিয়া পুরোপুরি রূপেই ব্যর্থতায়
পর্যবসিত হয়েছে। দশ বছরের বেশি চলতে থাকা এই যুদ্ধে তালিবানদের সম্পূর্ণরূপে
পরাজিত করা সম্ভব হয়নি ন্যাটোর পক্ষে। উলটে বর্তমানে প্রতিদিনই তালিবানদের গেরিলা
আক্রমণে বিদেশী সেনা হতাহত হচ্ছে। ২০১২-তেই প্রথম ছ’মাসে মোট ২১বার তালিবানরা হামলা চালিয়েছে ন্যাটো বাহিনীর ওপর। এখনো
পর্যন্ত ৩০জন মার্কিন সৈন্যর মৃত্যু ঘটেছে। তালিবানরা জেহাদ ঘোষণা করে ইসলাম
রক্ষার শপথ নিয়ে রীতিমতো মরণপণ ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছে ন্যাটোবাহিনীর বিরুদ্ধে।
তালিবানরা আফগান ন্যাশনাল আর্মির মধ্যে থেকেই তাদের পছন্দের লোক খুঁজে নিচ্ছে এবং
গোপনে তাদের সংগঠন বৃদ্ধির কাজটিও করে চলেছে। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের এক তালিবান
কমান্ডারের এশিয়া টাইমস অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুস্পষ্ট তাদের লাইন, ‘বিদেশী শক্তি ইসলামকে ধ্বংস করার
উদ্দেশ্যে এবং আফগানিস্তানের সামাজিক রীতিনীতি নষ্ট করার চক্রান্তে একদশকব্যাপী এই
দখলকারী চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করতেই হবে।’
তালিবান ও ন্যাটোর এই লড়াইয়ের নতুন নামকরণও হয়েছে —
‘Green-on-blue attack’. আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের সমর্থনও ক্রমশ বাড়ছে তালিবানদের প্রতি।
কারণ বিগত এক দশকে মার্কিনী ও ন্যাটোবাহিনীর আঘাতে হাজার হাজার সাধারণ বেসামরিক
মানুষ নিহত হয়েছে। ২০১২-র প্রথম ছ-মাসেই নিহত হয়েছেন প্রায় ৬০০ সাধারণ মানুষ।
সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনাটি ঘটেছে গত জুন মাসে। লগার প্রদেশের একটি বিয়ে বাড়িতে
ন্যাটোর বিমান হামলায় ১৮জন নিহত হন। নিহত ১৮জনের মধ্যে ১৪জনই ছিলেন মহিলা ও শিশু।
ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। মৌলবাদের ধারক হলেও জনসমর্থন
মজবুত হচ্ছে তালিবানীদের। বিগত এক দশকের ‘মিশন
আফগানিস্তান’র মার্কিনী ব্যর্থতায় তালিবানরা পুনরায়
তাদের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছে আফগানিস্তানে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদ, অন্যদিকে মৌলবাদ — গণতন্ত্র কিন্তু অধরাই থেকে যাচ্ছে
আফগানিস্তানে।
কিছু বিচ্ছিন্ন কিন্তু মারাত্মক সংবেদনশীল ঘটনাও কাজ করছে আফগানদের
তীব্র মার্কিন বিদ্বেষের জন্য। যেমন, বাগরাম
বিমান ঘাঁটিতে ন্যাটো সেনাদের দ্বারা ইসলাম ধর্মগ্রন্থ ‘কোরান’ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা। এছাড়া সংঘর্ষে নিহত তালিবান মৃতদেহের ওপর মার্কিন
সেনাদের প্রস্রাব ত্যাগের ঘটনা। মার্কিনীদের হাতের পুতুল হামিদ কারজাই সরকারের
অকমর্ণ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি, আফগানিস্তানের
খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাওয়াদ ওমর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন। ‘আগামী ছ’মাসের মধ্যেই তেল উৎপাদন শুরু করবে আফগানিস্তান।’ ফলে সহজেই অনুমেয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন
ন্যাটো বাহিনী ক্রমশ আরো দৃঢ় করবে তাদের কর্তৃত্ব। এদিকে আফগানিস্তানজুড়ে রোজই
আত্মপ্রকাশ করছে নিত্যনতুন কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। আগামীদিনে তাই ‘Green-on-Blue-attack’
লড়াই আরও
রক্তক্ষয়ী চেহারা নিতে চলেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমান সেরকমই।
আফগান আগ্রাসনের
পরিহাস
‘ফ্যাকাশে মেরে ছিল নাজিয়ার মুখটা।
হাতের চেটো পায়ের পাতা ডলছিলাম। তবু সম্বিত ফেরেনি সাত বছরের আমার মেয়ের’, জানালেন দেল আগা। কাবুলের চারাহি
কাম্বার শরণার্থী শিবিরে। পাশেই আরো অনেকে। দেল’র গ্রামের লোক। সকলেরই ঠিকানা আজ এ শিবির।
এদিকে জমাটে শীত। মাটির ওপর আঠেরো ইঞ্চি পুরু বরফের আস্তরণ। তার
মাঝেই দিনরাত শিবিরে জান কবুল। বড়দের সইলেও, বিপন্ন
শিশুরা। এবার শীতে কাবুলের ওই এক শিবিরেই নাজিয়ার মতো ২০টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
একদিকে মার্কিন ন্যাটো জোটের নির্বিচারে বোমা বর্ষণ। অন্যদিকে তালিবান উগ্রপন্থীদের
জুলুম। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া হয়ে হাজির শীতের ছোবলও। চারাহির মতো শরণার্থী শিবিরে
হাজার হাজার আফগান নাগরিকের নয়া শত্রু।
কয়েক দিন আগের ঘটনা। কান্দহার বিমানবন্দরে তালিবান উগ্রপন্থীরা হামলা
চালায়। এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর আফগানিস্তানে মার্কিন ন্যাটো জোটের সেনা
প্রধান জেনারেল জন অ্যালেন একটি অদ্ভূত বিবৃতি দেন। ‘মোল্লা ওমর তালিবান উগ্রপন্থীদের ওপর
সমস্ত রকমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন, নচেত
তিনি এই হামলার নিন্দা করতেন। একই সঙ্গে তালিবানকে নির্দেশ দিতেন এমন আক্রমণ
থামাতে। যার জন্য সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হচ্ছে’, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন ওই মার্কিন সেনা প্রধান।
এই মোল্লা ওমরই মাত্র সেদিনও, ওয়াশিংটনের
নজরে বিশ্বের প্রথম সারির উগ্রপন্থীদের তালিকায় ছিল। ৯/১১’র সন্ত্রাসবাদী হামলার পর যার খোঁজে
বিশ্বজুড়ে তোলপাড় করেছিল মার্কিনীরা। আজ একটা বিষয় পরিষ্কার। কিছু সময় ধরে মার্কিন
গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে তালিবানের মোল্লা ওমর গোষ্ঠীর
উগ্রপন্থীরা। কিন্তু মোল্লা ওমরকে নিজেদের পছন্দ মাফিক ছাঁচে ঢালতে ব্যর্থ হয়েছে
কুখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ। আবার তালিবানেরই অন্য গোষ্ঠীগুলি
মার্কিন ন্যাটো জোটের সঙ্গে যে কোন রকমের আলোচনার কট্টর বিরোধী। কাবুলে রাষ্ট্রপতি
হামিদ কারজাইয়ের সরকারের অনুমান, এমনই
কোন তালিবান গোষ্ঠীই হামলার নেপথ্যে।
এদিকে দেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা শিকেয়। অসহায় মানুষ। গত চার বছর ধরে
কাবুলের চারাহি কাম্বার শরণার্থী শিবিরে দুই মেয়েকে নিয়ে রয়েছেন আগা। গত সপ্তাহে
তাঁর ছোট মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মতো অনেকেই মার্কিন ন্যাটো জোটের অবিশ্রান্ত
বোমা বর্ষণের কারণে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। তার পর থেকেই সকলের ঠিকানা হয় এই
শরণার্থী শিবির। ‘জীবন এখানে অত্যন্ত কঠিন। এখন আমার বড়
মেয়ের জন্যও চিন্তা হচ্ছে’, জানান
আগা।
কিন্তু দেল আগার মতো আরো অনেক মানুষের করুণ অবস্থার সম্পর্কে
সম্পূর্ণ উদাসীন আফগান সরকার। বিশেষত গত দুই বছর ধরে। যে সময় থেকে তালিবানের
বিভিন্ন গোষ্ঠী মার্কিন-ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে জোরালো হামলা শুরু করেছে। দেশের
দক্ষিণাঞ্চলের একটা বড় অংশে তালিবানের প্রভাব এখন চোখে পড়ার মতো। এখানে সমান্তরাল
সরকার পরিচালনা করছে তালিবান। সেনা ছাউনি, সেনা
আউট পোস্ট,
উড়ানের সময়
মার্কিন-ন্যাটো জোটের সেনা আধিকারিকদের হেলিকপ্টারে তালিবান হামলা একটি বিষয়
স্বচ্ছ করে দিয়েছে। মার্কিন ন্যাটো জোট সেনার অনুগত আফগান সেনাদের মধ্যে যথেষ্ট
প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে তালিবান উগ্রপন্থীরা। তাই তাদের গোপন খবরও পাচ্ছে
উগ্রপন্থীরা। ঘটনাচক্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরপরই আফগানিস্তানে সেনা অভিযানে
গতি বৃদ্ধি করেন ওবামা। আগ্রাসনে সঙ্গত দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ই ইউ)’র কিছু দেশও। সেই সময় ওবামার এই
পরিকল্পনার বিরোধীতা করেছিলেন তৎকালীন কাবুলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কার্ল
একেনব্যেরি। কিন্তু ওবামার যুক্তি ছিল, এখনই
যদিও প্রবল হামলা করা না হয়, তাহলে
আফগানিস্তানে সরকারের পতন হবে। গোটা নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে তালিবানের হাতে। কিন্তু
বাস্তবে ওবামার পরিকল্পনা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। রাষ্ট্রপতি কারজাই প্রশাসনে কারচুপি
করে ভোটে জিতলেও,
দেশে একটি
প্রকৃত সরকার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সঙ্গে সমান তালে বৃদ্ধি পেয়েছে উগ্রপন্থী হামলার
ঘটনাও।
আফগানিস্তানের মানুষ দেশে শান্তি চেয়েছিলেন। তালিবান জামানার অবসান
চেয়েছিলেন। কারণ তালিবান শাসনের প্রচণ্ড দমনপীড়নের তারাই সাক্ষী। সমাজের মহিলারাও
কোন মতে চাননি ফের তালিবান উগ্রপন্থীরা ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু একপাশে কারজাই
সরকারের অপদার্থতা। অন্যপাশে মার্কিন ন্যাটো জোটের কার্যকলাপ। ক্রমশ আফগান সরকারের
সঙ্গে মানুষের দূরত্ব তৈরি করেছে। বিশেষত মার্কিন ড্রোন হামলায় অসহায় শিশু, নারী সহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা
দেশে তালিবান এবং আল কায়েদার মতো উগ্রপন্থী সংগঠনের প্রতি মানুষের একটা অংশের ঘৃণা
প্রশমনে সহায়ক হয়েছে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের তরফে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি কাবুলে
মোল্লা ওমরের খবরদারি ছুঁড়ে ফেলতে একটা সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার
সারভিসেস ইনটেলিজেন্স (আই এস আই) চাপে পড়ে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়েছিলো।
কিন্তু মার্কিন নীতির কারণে সেই আই এস আই’ও
এখন কারজাই সরকারের পাশে আর নেই। মার্কিন এবং ই ইউ’র অবরোধের মুখে ইরান কারজাই সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।
আফগানিস্তানের মুজাহিদদের উত্তরের জোট (নর্দার্ন অ্যালাইন্স)’র সঙ্গে এর ফলে কাবুলের বোঝাপড়া ভেঙে
পড়েছে। অনেকের মতে নর্দার্ন অ্যালাইন্সের প্রধানরা আকন্ঠ দুর্নীতির পাঁকে
নিমজ্জিত। এর মাঝে কারজাই সরকার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ এনেছে। আই এস আই তলায় তলায়
তালিবানের কিছু গোষ্ঠীকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে চলেছে।
ফলত প্রবল হামলার মুখে মার্কিন ন্যাটো জোটের আফগানিস্তানে উপস্থিতি
ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। নির্বাচন করে সাধারণ মানুষকে উগ্রপন্থীদের প্রভাব মুক্ত করার
পশ্চিমী প্রয়াসও জলে গেছে। কারণ ভোটকে ঘিরে কাঁড়ি কাঁড়ি কারচুপির অভিযোগ ওঠেছে।
এতে সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন মানুষ। আজ ওয়াশিংটন ঠারেঠোরেই বুঝতে পারছে
আফগান পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অছিলায়
এই আগ্রাসনে সফল হতে হলে দেশের কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে হবে ওই যুদ্ধবাজ
জোটকে। কিন্তু বর্তমানে ওবামা সরকারের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। তাই আলোচনার মধ্যেই
এই সমস্যার সমাধান তাদেরও কাম্য। আফগানিস্তান থেকে যাতে মার্কিন ন্যাটো জোট
প্রস্থান করতে পারে। জেনারেল জন অ্যালেন’র
গলায়ও তাই অদ্ভূত সুর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যা চরম পরিহাসের!