Wednesday, May 22, 2013

afgan crisis 1



কাবুলের দেওয়াল লিখন!
দি রিট্রিট ফ্রম কাবুল। নিছক একটি তৈলচিত্র নয়। রানী ভিক্টোরিয়ার সময়কালের নামজাদা চিত্রশিল্পী এলিজাবেথ বাটলার ছবিটি রাঙিয়েছিলেন আফগানিস্তান থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পালিয়ে আসাকে ঘিরে। ১৮৪২ সালের জানুয়ারি মাস। আফগানিস্তানে ব্রিটিশ সেনানায়ক ডব্লিউ ব্রাইডনের নেতৃত্ব ১৬,৫০০ সেনা। বন্দী দশায় কাবুলে। কনকনে শীতে পালিয়ে আসা। কাবুলের সেনাছাউনিতে আফগান যোদ্ধাদের হামলা। উপজাতির যোদ্ধাদের আক্রমণে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নিকেষ হওয়া। নিখুঁতভাবেই ফুটে উঠেছে এলিজাবেথের তুলির টানে। সম্প্রতি শিকাগোতে ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে ছবিটি টাঙিয়ে রাখা খুবই প্রাসঙ্গিক ছিলো বলে অনেকেই সহমত হবেন। কারণ, ‘দি রিট্রিট ফ্রম কাবুলছবিটি স্মরণ করিয়ে দেয়, বর্তমানে আফগানিস্তানে মার্কিন-ন্যাটো জোটের অবস্থা অনেকটা একই রকম। প্রায় দেড়শো বছর আগের মতোই ফের এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আফগানিস্তানে মুখে। যারা পালিয়ে আসতে চাইছে।
শিকাগোর বৈঠকে যতোই আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো জোটের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা হোক না কেন। এটা কিন্তু পরিষ্কার যে, আফগানিস্তানে দ্বাদশ শতাব্দীর অস্ত্রে সজ্জিত একদল পাহাড়ী যোদ্ধার কাছে দোর্দণ্ড প্রতাপ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাজিতই প্রায়।
এটা সবাই জানে যে, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের আসল লক্ষ্য ছিলো রাজনৈতিক। সাধারণ মানুক হত্যা নয়। আমেরিকার নজর ছিলো ক্যাসপিয়ান বেসিনের তেল সম্পদ দখল। একই সঙ্গে আফগানিস্তানে একটি লেজুর সরকার খাড়া করা। যার মাধ্যমে চীনের প্রভাব বৃদ্ধিকেও কিছুটা স্তিমিত করা যাবে। কিন্তু এগারো বছর ধরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে এ‍‌ই যুদ্ধ চালানোর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এর মানে সামরিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তানে পরাজয়ই স্বীকার করে নিতে হয়েছে আমেরিকাকে।
ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগু‍‌লির কাছে এই যুদ্ধের পরিণাম হয়েছে আরো উদ্বেগজনক। যেহেতু এই যুদ্ধে ন্যাটোকে জড়িয়েছিলো আমেরিকা। আর আফগানিস্তানে আগ্রাসনের ফলে ন্যাটোর কোন স্বার্থও পূরণ হতো না। পাশাপাশি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এই যুদ্ধ মেনেও নেয়নি। তাই ন্যাটোর ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের আগ্রসন চালানোর পরিণাম হয়েছে ভয়াবহ। ন্যাটো জোটের মধ্যেই এই যুদ্ধতে জড়ানোকে ঘিরে ফাটল দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ন্যাটো আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে। এছাড়া আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয় পশ্চিম ইউরোপে ওয়াশিংটনের প্রভাবকেই কম করেছে।
এদিকে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারকে ঘিরে অন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মার্কিন সেনারা ফিরে যাওয়ার পর কতদিন কাবুলে টিকে থাকতে পারবে রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের সরকার। সম্প্রতি ওবামা প্রশাসন কাবুলকে ৪০০ কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সেই টাকার সদ্‌ব্যবহার হবে তা! কারজাই ভোট চুরির মতোই অর্থও তছরুপ করবেন না তো? অথবা আমেরিকার চাপানো পুতুল সরকারের দশা দক্ষিণ ভিয়েতনামে ওয়াশিংটনের কলকাটিতে নড়া সরকারের মতোই হবে না তো? ১৯৭৫ সালে যে সরকার তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়েছিলো।
বর্তমানে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার সেনা কারজাই সরাকারকে রক্ষা করছে। এরমধ্যে একদিকে যেমন আছে মার্কিন-ন্যাটো জোট সেনা। তেমনই আছে আফগান সেনা ও পুলিস। এছাড়াও কাজ করছে উপজাতি তাজিক এর উজবেক যোদ্ধারা। যারা টাকার বিনিময়ে লড়াই করছে। আর বাস্তবে আফগানিস্তানের সংখ্যাগুরু পাখতুন গোষ্ঠীর মানুষের ঘোরশত্রু এই তাজিক এবং উজবেকরা। অন্যদিকে আছে তালিবান এবং অন্যান্য উগ্রপন্থী গোষ্ঠী। যতদিন যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর টক্কর ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের দক্ষিণের কান্দাহারের মতো বেশ কিছু শহরে তালিবানরা সমান্তরাল সরকার চালাচ্ছে। তাই একটি আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। মার্কিন-ন্যাটো জোট সেনার ফেরার পর কারজাই সরকারের মেয়াদ কদিন। কাবুলের দেওয়াল লিখন কি শিকাগোর বৈঠকে অনুচ্চারিতই রইলো!

আগ্রাসী ন্যাটোর শাসনে আফগানিস্তান
আগ্রাসী ন্যাটোর ভয়ঙ্কর রূপের সাক্ষী বিগত এক দশকের আফগানিস্তান। নব্যসাম্রাজ্যবাদের পেশিশক্তির জোরে বর্তমান আফগানিস্তান একটি মৃতপ্রায় দেশ। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর সাথে তালিবান উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা আফগানিস্তানে। সরকারী হিসেবেই বিগত তিন বছরে আফগানিস্তানে মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার।
বিগত দশ বছর ধরে আফগানিস্তানকে গণতান্ত্রিক উন্নয়নশীল দেশের সমমর্যাদায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে শোষণ ও শাসন করে চলেছে আমেরিকা। তারাই স্থাপন করে দিয়েছে হামিদ কারজাইয়ের পুতুল সরকার।
১৩ই জুন, ২০১২ ন্যাটো মহাসচিব আন্দ্রেস ফগ রাসমুসেন এর মন্তব্য, ‘আফগানিস্তানের নিরাপত্তার শূন্যতা সৃষ্টি করে ন্যাটো বাহিনী চলে যাবে না। আফগানিস্তানে ন্যাটো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শান্তি প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বার্থ ও দায়িত্ব রয়েছে।তিনি আরো বলেন, ‘আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন না। ন্যাটো জোট আফগানিস্তানে দশকব্যাপি যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি দেখতে চায়।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মার্কিন আফগান চুক্তি অনুযায়ী এমনিতেই ২০১৪ পর্যন্ত মার্কিনবাহিনী আফগানিস্তানে থাকার কথা। মার্কিনীদের বর্তমান প্রচেষ্টা সেই সময়সীমাকে আরও বাড়ানোর। প্রকৃতপক্ষে, আফগানিস্তান জুড়ে মার্কিনীদের শান্তি স্থাপনপ্রক্রিয়া পুরোপুরি রূপেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। দশ বছরের বেশি চলতে থাকা এই যুদ্ধে তালিবানদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি ন্যাটোর পক্ষে। উলটে বর্তমানে প্রতিদিনই তালিবানদের গেরিলা আক্রমণে বিদেশী সেনা হতাহত হচ্ছে। ২০১২-তেই প্রথম ছমাসে মোট ২১বার তালিবানরা হামলা চালিয়েছে ন্যাটো বাহিনীর ওপর। এখনো পর্যন্ত ৩০জন মার্কিন সৈন্যর মৃত্যু ঘটেছে। তালিবানরা জেহাদ ঘোষণা করে ইসলাম রক্ষার শপথ নিয়ে রীতিমতো মরণপণ ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছে ন্যাটোবাহিনীর বিরুদ্ধে। তালিবানরা আফগান ন্যাশনাল আর্মির মধ্যে থেকেই তাদের পছন্দের লোক খুঁজে নিচ্ছে এবং গোপনে তাদের সংগঠন বৃদ্ধির কাজটিও করে চলেছে। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের এক তালিবান কমান্ডারের এশিয়া টাইমস অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুস্পষ্ট তাদের লাইন, ‘বিদেশী শক্তি ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এবং আফগানিস্তানের সামাজিক রীতিনীতি নষ্ট করার চক্রান্তে একদশকব্যাপী এই দখলকারী চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করতেই হবে।
তালিবান ও ন্যাটোর এই লড়াইয়ের নতুন নামকরণও হয়েছে — ‘Green-on-blue attack’. আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের সমর্থনও ক্রমশ বাড়ছে তালিবানদের প্রতি। কারণ বিগত এক দশকে মার্কিনী ও ন্যাটোবাহিনীর আঘাতে হাজার হাজার সাধারণ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। ২০১২-র প্রথম ছ-মাসেই নিহত হয়েছেন প্রায় ৬০০ সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনাটি ঘটেছে গত জুন মাসে। লগার প্রদেশের একটি বিয়ে বাড়িতে ন্যাটোর বিমান হামলায় ১৮জন নিহত হন। নিহত ১৮জনের মধ্যে ১৪জনই ছিলেন মহিলা ও শিশু। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। মৌলবাদের ধারক হলেও জনসমর্থন মজবুত হচ্ছে তালিবানীদের। বিগত এক দশকের মিশন আফগানিস্তানর মার্কিনী ব্যর্থতায় তালিবানরা পুনরায় তাদের হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছে আফগানিস্তানে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদ, অন্যদিকে মৌলবাদ গণতন্ত্র কিন্তু অধরাই থেকে যাচ্ছে আফগানিস্তানে।
কিছু বিচ্ছিন্ন কিন্তু মারাত্মক সংবেদনশীল ঘটনাও কাজ করছে আফগানদের তীব্র মার্কিন বিদ্বেষের জন্য। যেমন, বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে ন্যাটো সেনাদের দ্বারা ইসলাম ধর্মগ্রন্থ কোরানপুড়িয়ে ফেলার ঘটনা। এছাড়া সংঘর্ষে নিহত তালিবান মৃতদেহের ওপর মার্কিন সেনাদের প্রস্রাব ত্যাগের ঘটনা। মার্কিনীদের হাতের পুতুল হামিদ কারজাই সরকারের অকমর্ণ্যতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি, আফগানিস্তানের খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাওয়াদ ওমর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন। আগামী ছমাসের মধ্যেই তেল উৎপাদন শুরু করবে আফগানিস্তান।ফলে সহজেই অনুমেয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ক্রমশ আরো দৃঢ় করবে তাদের কর্তৃত্ব। এদিকে আফগানিস্তানজুড়ে রোজই আত্মপ্রকাশ করছে নিত্যনতুন কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। আগামীদিনে তাই ‘Green-on-Blue-attack’ লড়াই আরও রক্তক্ষয়ী চেহারা নিতে চলেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমান সেরকমই।

আফগান আগ্রাসনের পরিহাস
 ‘ফ্যাকাশে মেরে ছিল নাজিয়ার মুখটা। হাতের চেটো পায়ের পাতা ডলছিলাম। তবু সম্বিত ফেরেনি সাত বছরের আমার মেয়ের’, জানালেন দেল আগা। কাবুলের চারাহি কাম্বার শরণার্থী শিবিরে। পাশেই আরো অনেকে। দেলর গ্রামের লোক। সকলেরই ঠিকানা আজ এ শিবির।
এদিকে জমাটে শীত। মাটির ওপর আঠেরো ইঞ্চি পুরু বরফের আস্তরণ। তার মাঝেই দিনরাত শিবিরে জান কবুল। বড়দের সইলেও, বিপন্ন শিশুরা। এবার শীতে কাবুলের ওই এক শিবিরেই নাজিয়ার মতো ২০টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একদিকে মার্কিন ন্যাটো জোটের নির্বিচারে বোমা বর্ষণ। অন্যদিকে তালিবান উগ্রপন্থীদের জুলুম। গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া হয়ে হাজির শীতের ছোবলও। চারাহির মতো শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার আফগান নাগরিকের নয়া শত্রু।
কয়েক দিন আগের ঘটনা। কান্দহার বিমানবন্দরে তালিবান উগ্রপন্থীরা হামলা চালায়। এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর আফগানিস্তানে মার্কিন ন্যাটো জোটের সেনা প্রধান জেনারেল জন অ্যালেন একটি অদ্ভূত বিবৃতি দেন। মোল্লা ওমর তালিবান উগ্রপন্থীদের ওপর সমস্ত রকমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন, নচেত তিনি এই হামলার নিন্দা করতেন। একই সঙ্গে তালিবানকে নির্দেশ দিতেন এমন আক্রমণ থামাতে। যার জন্য সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হচ্ছে’, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন ওই মার্কিন সেনা প্রধান।
এই মোল্লা ওমরই মাত্র সেদিনও, ওয়াশিংটনের নজরে বিশ্বের প্রথম সারির উগ্রপন্থীদের তালিকায় ছিল। ৯/১১র সন্ত্রাসবাদী হামলার পর যার খোঁজে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় করেছিল মার্কিনীরা। আজ একটা বিষয় পরিষ্কার। কিছু সময় ধরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে তালিবানের মোল্লা ওমর গোষ্ঠীর উগ্রপন্থীরা। কিন্তু মোল্লা ওমরকে নিজেদের পছন্দ মাফিক ছাঁচে ঢালতে ব্যর্থ হয়েছে কুখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ। আবার তালিবানেরই অন্য গোষ্ঠীগুলি মার্কিন ন্যাটো জোটের সঙ্গে যে কোন রকমের আলোচনার কট্টর বিরোধী। কাবুলে রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের সরকারের অনুমান, এমনই কোন তালিবান গোষ্ঠীই হামলার নেপথ্যে।
এদিকে দেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা শিকেয়। অসহায় মানুষ। গত চার বছর ধরে কাবুলের চারাহি কাম্বার শরণার্থী শিবিরে দুই মেয়েকে নিয়ে রয়েছেন আগা। গত সপ্তাহে তাঁর ছোট মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মতো অনেকেই মার্কিন ন্যাটো জোটের অবিশ্রান্ত বোমা বর্ষণের কারণে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। তার পর থেকেই সকলের ঠিকানা হয় এই শরণার্থী শিবির। জীবন এখানে অত্যন্ত কঠিন। এখন আমার বড় মেয়ের জন্যও চিন্তা হচ্ছে’, জানান আগা।
কিন্তু দেল আগার মতো আরো অনেক মানুষের করুণ অবস্থার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন আফগান সরকার। বিশেষত গত দুই বছর ধরে। যে সময় থেকে তালিবানের বিভিন্ন গোষ্ঠী মার্কিন-ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে জোরালো হামলা শুরু করেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটা বড় অংশে তালিবানের প্রভাব এখন চোখে পড়ার মতো। এখানে সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করছে তালিবান। সেনা ছাউনি, সেনা আউট পোস্ট, উড়ানের সময় মার্কিন-ন্যাটো জোটের সেনা আধিকারিকদের হেলিকপ্টারে তালিবান হামলা একটি বিষয় স্বচ্ছ করে দিয়েছে। মার্কিন ন্যাটো জোট সেনার অনুগত আফগান সেনাদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে তালিবান উগ্রপন্থীরা। তাই তাদের গোপন খবরও পাচ্ছে উগ্রপন্থীরা। ঘটনাচক্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরপরই আফগানিস্তানে সেনা অভিযানে গতি বৃদ্ধি করেন ওবামা। আগ্রাসনে সঙ্গত দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ই ইউ)র কিছু দেশও। সেই সময় ওবামার এই পরিকল্পনার বিরোধীতা করেছিলেন তৎকালীন কাবুলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কার্ল একেনব্যেরি। কিন্তু ওবামার যুক্তি ছিল, এখনই যদিও প্রবল হামলা করা না হয়, তাহলে আফগানিস্তানে সরকারের পতন হবে। গোটা নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে তালিবানের হাতে। কিন্তু বাস্তবে ওবামার পরিকল্পনা সঠিক প্রমাণিত হয়নি। রাষ্ট্রপতি কারজাই প্রশাসনে কারচুপি করে ভোটে জিতলেও, দেশে একটি প্রকৃত সরকার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সঙ্গে সমান তালে বৃদ্ধি পেয়েছে উগ্রপন্থী হামলার ঘটনাও।

আফগানিস্তানের মানুষ দেশে শান্তি চেয়েছিলেন। তালিবান জামানার অবসান চেয়েছিলেন। কারণ তালিবান শাসনের প্রচণ্ড দমনপীড়নের তারাই সাক্ষী। সমাজের মহিলারাও কোন মতে চাননি ফের তালিবান উগ্রপন্থীরা ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু একপাশে কারজাই সরকারের অপদার্থতা। অন্যপাশে মার্কিন ন্যাটো জোটের কার্যকলাপ। ক্রমশ আফগান সরকারের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব তৈরি করেছে। বিশেষত মার্কিন ড্রোন হামলায় অসহায় শিশু, নারী সহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা দেশে তালিবান এবং আল কায়েদার মতো উগ্রপন্থী সংগঠনের প্রতি মানুষের একটা অংশের ঘৃণা প্রশমনে সহায়ক হয়েছে বলেই ওয়াকিবহাল মহলের তরফে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি কাবুলে মোল্লা ওমরের খবরদারি ছুঁড়ে ফেলতে একটা সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সারভিসেস ইনটেলিজেন্স (আই এস আই) চাপে পড়ে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়েছিলো। কিন্তু মার্কিন নীতির কারণে সেই আই এস আইও এখন কারজাই সরকারের পাশে আর নেই। মার্কিন এবং ই ইউর অবরোধের মুখে ইরান কারজাই সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। আফগানিস্তানের মুজাহিদদের উত্তরের জোট (নর্দার্ন অ্যালাইন্স)র সঙ্গে এর ফলে কাবুলের বোঝাপড়া ভেঙে পড়েছে। অনেকের মতে নর্দার্ন অ্যালাইন্সের প্রধানরা আকন্ঠ দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত। এর মাঝে কারজাই সরকার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ এনেছে। আই এস আই তলায় তলায় তালিবানের কিছু গোষ্ঠীকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে চলেছে।
ফলত প্রবল হামলার মুখে মার্কিন ন্যাটো জোটের আফগানিস্তানে উপস্থিতি ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। নির্বাচন করে সাধারণ মানুষকে উগ্রপন্থীদের প্রভাব মুক্ত করার পশ্চিমী প্রয়াসও জলে গেছে। কারণ ভোটকে ঘিরে কাঁড়ি কাঁড়ি কারচুপির অভিযোগ ওঠেছে। এতে সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন মানুষ। আজ ওয়াশিংটন ঠারেঠোরেই বুঝতে পারছে আফগান পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অছিলায় এই আগ্রাসনে সফল হতে হলে দেশের কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে হবে ওই যুদ্ধবাজ জোটকে। কিন্তু বর্তমানে ওবামা সরকারের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। তাই আলোচনার মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান তাদেরও কাম্য। আফগানিস্তান থেকে যাতে মার্কিন ন্যাটো জোট প্রস্থান করতে পারে। জেনারেল জন অ্যালেনর গলায়ও তাই অদ্ভূত সুর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যা চরম পরিহাসের!

afganisthan crisis


ওবামার ব্যর্থ প্রজেক্ট আফগানিস্তান

মোট খরচের পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। দু-পক্ষ মিলিয়ে মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।
সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত বিগত এক দশক জুড়ে চলা মার্কিনীদের প্রজেক্ট আফগানিস্তান’-এর। এখনও দমানো গেল না তালিবানদের। বরং নতুন কায়দায় আরও শক্তিবৃদ্ধি করে ফিরে আসছে তালিবানরা। তাদের পরপর গেরিলা হামলায় রোজই প্রাণ হারাচ্ছেন ন্যাটোর সেনারা। জওয়ানদের মৃত্যুর কারণে ইতিমধ্যেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়া। ন্যাটো সদস্যভুক্ত অন্য দেশগুলোর সাধারণ মানুষ বারবার প্রতিবাদ-আন্দোলন সংঘটিত করছেন আফগানিস্তানে ন্যাটো সেনা মোতায়েন রাখার প্রশ্নে। ন্যাটোর বৈঠকেও বিভিন্ন দেশের অসহিষ্ণু মনোভাব টের পাচ্ছে আমেরিকা। উলটোদিকে আরও আগ্রাসী হচ্ছে তালিবানরা। সম্প্রতি দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশে ২ মহিলাসহ ১৭জনের মাথা কেটে খুন করল তালিবানরা। কান্দাহার-এর মতো এদেশে চলছে তাদের সমান্তরাল শাসন ব্যবস্থা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ওয়াশিংটনের পুতুলহামিদ কারজাই। তালিবানিদের চোরাগোপ্তা হামলায় আতঙ্কিত মার্কিন ফৌজও। গেরিলা আক্রমণে নিয়মিত প্রাণ যাচ্ছে তাদের। তালিবান সমস্যার কোন সুষ্ঠু সমাধান হ‍লো না এক দশকে, অথচ দোরগোড়ায় এসে গেল ওবামার নির্বাচন। কপালে চিন্তার ভাঁজ পেন্টাগনের। কাবুলের মার্কিন দূতাবাস ও সেনা ছাউনিগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। প্রতিদিনই সেখানে নিয়ে আসা হচ্ছে তালিবানি হামলায় নিহত মার্কিন সেনাদের দেহ, যেটাকে কফিন বন্দী করে পাঠাতে হচ্ছে মার্কিন মুলুকে। বিদেশের মাটিতে এক দশকেরও বেশি নিজেদের সেনা মোতায়েন রাখার জন্য প্রতিনিয়তই ঘরে বাইরে সমালোচনা ও প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছেন ওবামা। প্রজেক্ট আফগানমনে করিয়ে দিচ্ছে ভিয়েতনামকে।
কৌশলীভাবে ওবামা বলছেন, ২০১৪-এর মধ্যে আফগানিস্তান থেকে তাদের সমস্ত সেনা তুলে নেবে আমেরিকা। কিন্তু আইনের ফাঁকের মতো দখলদারির সূত্র বলছে, মার্কিন সেনাবাহিনীর কিছু অংশ মাত্র ফিরে যাবে স্বদেশে, থেকে যাবে তাদেরই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কয়েক হাজার সেনা এবং সামরিক পরামর্শদাতারা। ফলে ২০২০-তেও সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহার সম্ভব কিনা ভবিষ্যৎ সময়ই তার উত্তর দেবে।
অন্যদিকে ন্যাটো ও মার্কিন সেনার ওপর তালিবানদের গেরিলা আক্রমণের নতুন নামকরণও হয়েছে — ‘গ্রিন অন ব্লু অ্যাটাকস্‌। ক্রমবর্ধমান এই আক্রমণ। ২০১২-এর প্রথম আট মাসেই মোট ২৬ বার হামলা চালিয়েছে তালিবানরা। তারা রীতিমতো জেহাদ ঘোষণা করে ইসলাম রক্ষারশপথ নিয়ে মরণপত্র ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছে। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের এক তালিবান কমান্ডার এশিয়া টাইমস্‌ অন লাইন’-এ সুস্পষ্টভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলছেন বিদেশী শক্তি ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এবং আফগানিস্তানের সামাজিক রীতিনীতি নষ্ট করার চক্রান্তে একদশকব্যাপী এই দখলদারি চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যেই ইসলামকে রক্ষা করতে হবে।
কিছু বিচ্ছিন্ন কিন্তু মারাত্মক সংবেদনশীল ঘটনাও কাজ করছে আফগানদের তীব্র মার্কিন বিদ্বেষের জন্য। যেমন, বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে ন্যাটো সেনাদের দ্বারা ইসলাম ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরানপুড়িয়ে ফেলার ঘটনা। এছাড়া সংঘর্ষে নিহত তালিবান জঙ্গীর মৃতদেহের ওপর মার্কিন সেনাদের প্রস্রাব ত্যাগের ঘটনা।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গ্রিন অন ব্লু অ্যাটাকস্‌’, এখনো পর্যন্ত এরকম বিক্ষিপ্ত হামলায় মারা গেছেন ৫০জনেরও বেশি মার্কিন সেনা। আফগান পুলিস ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ছদ্মবেশে তাদের লোক নিঃশব্দে নিয়োগ করে চলেছে তালিবানরা। সি আই এ-র অধরা থেকে যাচ্ছে তালিবানদের এই গোপন নিয়োগ। চিন্তিত ওবামা ঘন ঘন বৈঠক করছেন কারজাই-এর সাথে। বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার সেনা মার্কিন পুতুলকারজাইকে রক্ষায় ব্যস্ত। প্রসঙ্গত, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, পেন্টাগনের নজর ছিল ক্যাসপিয়ান বেসিনের তেল সম্পদের ওপর কবজা রাখা, যার ভায়া মাধ্যম হবে কাবুলে এক পুতুল সরকার। এর ফলে এই অংশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি ও আটকানো যাবে।
ইতিমধ্যেই খুব সম্প্রতি ওবামা প্রশাসনের জন্য খুশির খবর শুনিয়েছে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এক সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাওয়াদ ওমর ঘোষণা করেন, ‘আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তেল উৎপাদন করবে আফগানিস্তান। ফলে সহজেই অনুমেয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ক্রমশ আরো দৃঢ় করবে তাদের কর্তৃত্ব। এদিকে আফগানিস্তান জুড়ে রোজই আত্মপ্রকাশ করছে নিত্যনতুন সন্ত্রাসবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তালিবানরা। সম্প্রতি তাদের শিকার প্রতিবেশী পাকিস্তানের ১৪ বছরের প্রতিবাদী কিশোরী মালালা ইউসুফজা। ভয়াবহ অবস্থার দিকে ধাবমান সমগ্র আফগানিস্তান। আগামী দিনে ক্ষমতা দখলের লড়াই-এ গ্রিন অন ব্লু অ্যাটাকআরও রক্তক্ষয়ী চেহারা নিতে চলেছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমান সেরকমই। এক দশক মার্কিন দখলদারিতে থেকেও স্পষ্ট নয় কাবুলের দেওয়াল লিখন।


ড্রোন হামলার বাস্তবতা
আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটোর সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে মোট ৩৩৬টি ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি ওবামার আমলেই হয়েছে ২৮৪টি আক্রমণ। রাষ্ট্রপতি বুশের সময় হওয়া ৫২টি ড্রোন হামলার থেকে অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে সাফাই গেয়ে বলা হয়েছে, হামলা গুলির লক্ষ্য ছিল উগ্রপন্থীরা। কিন্তু ড্রোন হামলা থেকে রক্ষা পায়নি শিশুরাও। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ১৭৫টি শিশু। এ ইয়ার অব ড্রোন অ্যাটাকশীর্ষক ওই পরিসংখ্যানটি তৈরি করেছে নিউ আমেরিকান ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা। এর থেকে জানা যায়, ২০১০সালে মোট ১১৪টি ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছিল। রিপোর্টটি থেকে আরো জানা যায়, বুশের সময়ের থেকে ওবামার আমলে ড্রোন হামলার লক্ষ্যেরও পরিবর্তন হয়েছে। বুশের সময় যেখানে ২৫% আল-কায়েদা এবং ৪০% তালিবানী উগ্রপন্থীদের ঠিকানা আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। সেখানে ওবামার আমলে তা কমে যথাক্রমে আল-কায়েদা ৮% এবং তালিবানের ক্ষেত্রে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৫০% হয়েছে। এছাড়া ওবামার সময় ড্রোন হামলায় নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় চার গুণ। ২০০৪সালে থেকে ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২,৬৬০জন। আহতের সংখ্যা ১,০৯৭জন। সব থেকে বেশি হামলা হয়েছে পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে।


ভুলে যাওয়া যুদ্ধের পরিণাম
পরপর হামলায় জওয়ানদের মৃত্যুর কারণে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। এর আগে ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়া একই কাজ করেছে। আফগানিস্তানের তুলনামূলক শান্ত প্রদেশে মোতায়েন ছিল নিউজিল্যান্ডের ১৪০ জওয়ান। কিন্তু একের পর এক হামলায় কিউই সেনাদের মনবল তলানিতে। সকলেই ঘরে ফিরতে মরিয়া। মান খোয়ানোর আতঙ্কে তড়িঘড়ি আফগানিস্তান থেকে সেনা তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ওয়েলিংটন। অবশ্য আফগানিস্তান থেকে হাতে গোনা ওই কজন সেনার বাড়ি ফেরা খবর নয়। বাজার গরম করছে মৌলবাদেই আফগানিস্তানের প্রত্যাবর্তনের গল্প!

ভুলে যাওয়া যুদ্ধ

এক দশকের ওপর কেটে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের আফগানিস্তান আগ্রাসনের। তবু দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদকে নিকেশ করা যায়নি। বরং ক্রমশ শক্তি বাড়াচ্ছে উগ্রপন্থীরা। সম্প্রতি দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশের এক গ্রামে ২জন মহিলাসহ ১৭জনের মাথা কেটে খুন করা তার অন্যতম উদাহরণ। তালিবান আরো আগ্রাসী হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ করতে তৎপর দেশের জনজীবনকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ। সাহায্যের জন্য পশ্চিমপানে চেয়ে রাষ্ট্রপতি কারজাই। উগ্রবাদী আক্রমণে শুধু আফগানরাই নয়, পাশাপাশি প্রাণ হারাচ্ছে মার্কিন সেনারাও। আগামী নভেম্বরে মার্কিন মুলুকে রাষ্ট্রপতি ভোট। তার আগে অনেকেরই মুখে মুখে ফিরছে আফগান প্রসঙ্গ। মানুষের অভিযোগ, ওবামা সরকার এই যুদ্ধ বেমালুম ভুলে গেছে। তাই লাগাতার ইয়াঙ্কি সেনাদের হত্যার ঘটনা ঘটে চললেও পরিস্থিতি সামলাতে সম্পূর্ণ উদাসীন ডেমোক্র্যাটরা। তাই সময় কেটে যাচ্ছে। কিন্তু তালিবানী সমস্যা সেই তিমিরেই। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনা তুলে নেওয়ার ঘোষণা করেছে। যদিও অবস্থা যতটা গোলমেলে, তাতে এই কাজ করতে ওয়াশিংটনকে যে প্রবল অস্বস্তিতে পড়তে হবে বলার প্রয়োজন নেই। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী ফিরে গেলেও থেকে যাবে তাদেরই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কয়েক হাজার জওয়ান এবং সামরিক পরামর্শদাতা। যাদের প্রধান লক্ষ্য থাকবে আল-কায়েদা ও অন্য উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলির হামলা মোকাবিলা করা। একই সঙ্গে মোতায়েন থাকবে মার্কিন বায়ুসেনা। কার্যক্ষেত্রে ওপর ওপর যতই বলা হোক না যে আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালেই ফিরে আসবে মার্কিন সেনা। কিন্তু বাস্তবে তা হবে না। আর ২০২০ সালেও তা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সন্দীহান খোদ পেন্টাগন। বলাবাহুল্য একটা দীর্ঘ সময়ই আফগানিস্তানে মজুত থাকবে আগ্রাসী দখলদাররা।

প্রোজেক্ট আফগান

পরিকল্পনা এক কথা। তা বাস্তবায়িত করা অন্য। ২০০৩ সাল। যে সময় ইরাকের রাজধানী বাগদাদে পা রেখেছিল যুদ্ধউন্মাদ জল্লাদেরা। তখন হোয়াইট হাউস অথবা পেন্টাগনের কর্ণধাররা বোধহয় কল্পনা করতে পারেনি জুনিয়ার বুশের আস্ফালনের পরিণতিও হতে পারে সিনিয়ার বুশ-এর মতো। বছরের পর বছর কেটে যাবে। তবু ইরাকে নাস্তানাবুদ হতে হবে মার্কিন - ন্যাটো জোটকে। তৈরি করতে হবে স্থানীয় সেনা ছাউনি। বাগদাদেই গড়ে উঠবে বিশ্বের সবচেয়ে দামী দূতাবাস। আর সময়ের ফেরে তারই পরিণতি হবে স্ট্রাটেজিক কমান্ড সেন্টারে। কূটনৈতিক কাজের বদলে পরিচালিত হবে সামরিক কর্মকাণ্ডে।
বাগদাদের অনুরূপ অবস্থা আজকের কাবুলেরও। প্রত্যহ ডাঁই হচ্ছে মার্কিন সেনার দেহ। ঘরেবাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে ওবামা প্রশাসন। তাদের অনেকেরই অভিযোগ, ডেমোক্র্যাটরা সামনের বিশ বছর আফগান ভূখণ্ডে পাকাপাকিভাবে থাকার কথা ভাবছে। বিদেশের মাটিতে এতো দীর্ঘ সময় ধরে সেনা রাখার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবাদ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। যা উস্কে দিচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্মৃতিকে। ঘটনাচক্রে সে সময়ই আমেরিকার বড় শহরগুলিতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিল এবং সমাবেশ হয়েছিল। আওয়াজ উঠেছিল ভিয়েতনাম থেকে অবিলম্বে মার্কিন সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনার।
একদিকে দেশের মাটিতে যখন প্রশ্নের মুখে রাষ্ট্রপতি ওবামার আফগান নীতি। একই সময় আফগানিস্তানেও মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে মার্কিন সেনারা। কিছুদিন আগে একটি ঘটনাই যার জ্বলন্ত প্রমাণ। খবরে প্রকাশ, বছর পনেরোর এক আফগান কিশোর মার্কিন সেনা ছাউনিতে চা দেওয়ার কাজ করতো। ঘটনার দিন সেই বালকই আচমকা সেনা বাহিনীর জিমে ঢুকে এলোপাথারি গুলি চালায়। এই ঘটনায় মারা যায় ৩জন মার্কিন সেনা। আহত হয় একজন।
সেই ঘটনার রেশ মিটতে না মিটতেই ফের খবরের শিরোনাম হয় দেশে গ্রামরক্ষী বাহিনীর প্রবীণ স্বেচ্ছাসেবকের গুলিতে ছয়-সাতজন মেরিন স্পেশাল ট্রুপের জওয়ানদের নিহত হওয়ার ঘটনা। স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন, বছর সত্তোরের ওই প্রবীণ স্বেচ্ছাসেবক ঘটনার দিন তাঁর বন্দুকের মুখ উগ্রপন্থীদের বদলে ঘুরিয়ে দেন আগ্রাসী ইয়াঙ্কি সেনাদের দিকেই। দেশের অন্যান্য অংশ থেকেও এমন ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এমন ঘটনা পরিচিত পেয়েছে গ্রিন অন ব্লু অ্যাটাকস্হিসেবে। এই অবস্থার জন্য দেশের পুলিস প্রশিক্ষণ আপাতত বন্ধ। মার্কিন মেরিন সেনারা আফগান যুবকদের প্রশিক্ষণ দিত। কাবুলের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার আফগান যুবক বর্তমানে পুলিস ট্রেনিংসের অপেক্ষায় আছেন। সংবাদসংস্থার খবরে প্রকাশ ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকের পরই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সঙ্কট বাড়ছে

কেউ বলছে গ্রিন অন ব্লু অ্যাটাকস্আবার কারো মুখে ইনসাইডার অ্যাটাকস্। নামে যাই হোক। আফগান বাহিনীর বন্দুকের নল দিকভ্রষ্ট হওয়ার কারণে সঙ্কটে ন্যাটো জওয়ানরা। ইতোমধ্যেই দেশে ৩০টি এমন হামলা হয়েছে। মারা গেছে ৫০ জনের ওপর ন্যাটো সেনা। ২০১২ সালে আফগানিস্তানে হানাহানিতে মৃত্যুর ঘটনার যা ১৪%। নিহত ন্যাটো সেনার বেশির ভাগই আমেরিকার। ৩রা সেপ্টেম্বর কাবুলে মার্কিন সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল থমাস কলিনস এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্য জানান।
বহু ক্ষেত্রেই তালিবান এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এই মৌলবাদী উগ্রপন্থী গোষ্ঠী হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে এমন হামলার ঘটনা এবার থেকে বারবার হবে। কারণ আফগান বাহিনী এবং পুলিসে তাদের অনেক সন্ত্রাসবাদী রয়েছে। যারা শুধুই সময়ের অপেক্ষা করছে।
এদিকে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে দেশে তীব্র সমালোচনার মুখে রাষ্ট্রপতি ওবামা। গোটা বিষয়টি দেখার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক করেছেন। কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতি কারজাইয়ের সঙ্গেও। অবশ্য কাবুল এর দায় নিতে নারাজ। কারজাই গ্রিন অন ব্লুহামলার দায় কৌশলে ইরান এবং পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
বিষয়টির গভীরতা বোঝা যায় সম্প্রতি জয়েন্ট চিফ অব স্টাফর চেয়ারম্যান জেনারেল মার্টিন ডেম্পসির কাবুল সফরকে ঘিরে। এই সফরের সময় তিনি আফগান শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হন। এর পর আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাপ্রধান জেনারেল জন অ্যালেন ৪০জন পদস্থ সেনা আধিকারিকদের বৈঠক ডাকেন। ঐ বৈঠকে এমন হামলার ঘটনা কেমন করে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলি আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার আলোচনা শুরু করায় মহা ফাঁপড়ে হোয়াইট হাউস। স্বভাবতই নিউজিল্যান্ডের সেনারা নিজেদের দেশে ফেরায় বেকায়দায় ওবামা।

north korea



শক্তি দেখাতে উন্মত্ত উত্তর কোরিয়া!
উত্তর কোরিয়া বরাবর দাবি করছে, তাদের নিশানায় রয়েছে এক নম্বর শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যে ক'টি মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, তার সব ক'টিই নাকি ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মাধ্যমে ধরে ফেলা হয়েছে। এমন কি এ কথাও জানানো হয়েছে, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে আমেরিকার অধীনস্ত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পাশাপাশি সুদূর মার্কিন মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতেও প্রস্তুত উত্তর কোরিয়া

পরমাণু হামলা হুঙ্কারের প্রতীক উঠছে উত্তর কোরিয়া। এই মুহূর্তে হাতে যে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি মজুত রয়েছে, তাতে উত্তর কোরিয়া নাকি যে কোনো বিধ্বংসী আক্রমণ চালাতে পারে। সেসব অস্ত্র দিয়ে যে কোনো সময় তারা আক্রমণ চালাতে পারবে দক্ষিণ কোরিয়া, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, জাপান, গুয়াম কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে! উত্তর কোরিয়া বিগত কয়েক মাসে যেসব হুংকার উচ্চারণ করছিল, এটা হলো তার সর্বশেষ গর্জন। এর মধ্যে গত শনিবার তারা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে 'যুদ্ধাবস্থা'র ঘোষণা দেয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরক্ষা বিভাগে নতুন নতুন চমকের মুখ দেখেছে উত্তর কোরিয়া। উন্নত মানের অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে সেনাবাহিনীর হাতে এসেছে অত্যাধুনিক সাঁজোয়া গাড়িও। তার প্রায় প্রতিটিই খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন দেশের সর্বময় কর্তা কিম জং উন স্বয়ং। কোথাও রদবদলের দরকার হলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেটা করিয়ে নিয়েছেন। অবশেষে প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং শত্রুদের সোজাসুজি হুঁশিয়ারিও কিম জং উনের নির্দেশক্রমেই হয়েছে।
উত্তর কোরিয়া বরাবর দাবি করছে, তাদের নিশানায় রয়েছে এক নম্বর শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যে ক'টি মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, তার সব ক'টিই নাকি ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মাধ্যমে ধরে ফেলা হয়েছে। এমন কি এ কথাও জানানো হয়েছে, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে আমেরিকার অধীনস্ত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পাশাপাশি সুদূর মার্কিন মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতেও প্রস্তুত উত্তর কোরিয়া। হুমকি রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যও। আমেরিকার অন্যতম সহযোগী এই রাষ্ট্রের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো সময় হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহের শুরুতে বিবৃতির মাধ্যমে প্রথমে হুঁশিয়ারি দেয় উত্তর কোরিয়া। তার কয়েকদিন পর এসব পরমাণু হামলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশনামাতে স্বাক্ষর করেন উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে 'চেওনান' ডুবোজাহাজ বিপর্যস্ত তৃতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। সিউল মনে করে, উন্নত প্রযুক্তির এই ডুবোজাহাজটির ডুবে যাওয়া মোটেই কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এর পিছনে ছিল উত্তর কোরিয়ার ভয়ঙ্কর মস্তিষ্ক! এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ১৯৫৩ সাল থেকে কার্যকর থাকা যুদ্ধবিরতি চুক্তি সমাপ্ত করার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। ১৯৫০-৫৩ সালের দুই কোরিয়ার যুদ্ধ রাজনৈতিকভাবে এখনও শেষ হয়নি। দুই পক্ষই অস্ত্র সংবরণ করে রয়েছে মাত্র। সীমা লঙ্ঘন করে যাতে পিয়ংইয়ংয়ের বাহিনী না হানা দিতে পারে দক্ষিণ দিকে তার জন্য অন্তত ৪০ হাজার মার্কিন সৈন্য এখনও রয়েছে কোরীয় উপদ্বীপে।
কিম জং উন ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত এক বছরে দুবার পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। প্রথমটি গত ডিসেম্বরে আর সর্বশেষ পরীক্ষাটি হয়েছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি। দুবারই বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে পড়ে কমিউনিস্ট দেশটি। জাতিসংঘ শুরু থেকেই দেশটির ওপর আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজই হয়নি। সর্বশেষ কঠোরতা জানাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য এক বিবৃতিতে বলেন, এবার উত্তর কোরিয়ার আর্থিক লেনদেনও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এসব কারণেই কি আরো বেশি জেদ চেপেছে উত্তর কোরিয়ার? অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমনটিই মনে করছেন। দেশটির অস্থিরমতি প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, কোনো 'বেগতিক অবস্থা' দেখলে হামলা করতে একটুও দ্বিধা করবেন না তিনি। উত্তর কোরিয়া মনে করছে, এরপরও 'হুঁশ' ফিরছে না যুক্তরাষ্ট্রের। কেননা, দক্ষিণ কোরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে একযোগে বি-৫২ স্টিল্থ বোমারু বিমান নিয়ে সামরিক মহড়ায় পর্যন্ত অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অত্যাধুনিক এই বিমান শুধু যে পরমাণু অস্ত্র পরিবহনেই সক্ষম তা নয়, এই বিমানের প্রযুক্তি এমনই যে তার উপস্থিতি রাডারেও ধরা পড়ে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন 'স্পর্ধা' ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মনে করেছে উত্তর কোরিয়া। সে কারণে সম্ভবত শুধু 'কথা' নয়, এবার 'কাজে' নামার পরিকল্পনা করছে উত্তর কোরিয়া। ইতিমধ্যেই সেনাপতিদের জায়গা মতো ক্ষেপণাস্ত্র সাজিয়ে ফেলার নির্দেশও দিয়েছেন। এর মধ্যে গত শনিবার তারা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে 'যুদ্ধাবস্থা'র ঘোষণা দেয়। তবে পিয়ংইয়ংয়ের এমন মনোভাবকে যুক্তরাষ্ট্র 'আগুন' নিয়ে খেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়ার তরফ থেকে আসা যে কোনো হামলার জন্যই তৈরি তারা। আর আক্রমণ করলে তার উপযুক্ত জবাবও পাবে পিয়ংইয়ং। দক্ষিণ কোরিয়া বলেছে, 'উত্তর কোরিয়ার ওপর খুব কাছ থেকে নজর রাখা হচ্ছে। আমাদের কাছে যা খবর, তাতে এখনও পর্যন্ত সীমান্তে কোনো নড়াচড়া চোখে পড়েনি।' এদিকে উত্তর কোরিয়ার মিত্ররাষ্ট্র চীন সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে অসন্তোষ ও ঊষ্মা প্রকাশ করেছে। সবার কাছে সংযমের অনুরোধের পাশাপাশি উত্তর কোরিয়াকে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগেরও পরামর্শ দিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ধ্বংসাত্মক অস্ত্র কোনো সমস্যার সমাধান দেয়নি কখনো। উত্তর কোরয়াির প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের এসব হুমকি ও অস্ত্রসম্প্রসারণ বিশ্বকে আরো বেশি নাজুক করবে। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা ছাড়া এসব হুমকি আর কোনো ইতিবাচক ফল দেবে না।


কোরীয় উপদ্বীপে অস্ত্র সমাবেশের নতুন স্নায়ু যুদ্ধ
এতদিন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার রণহুঙ্কারের কোনো যোগ্য জবাব দিতে পারেনি দক্ষিণ কোরিয়া। এবার আর সেই খামতি রাখলেন না দেশটির প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হাই। আর এভাবেই কোরীয় উপদ্বীপে অস্ত্র সমাবেশের স্নায়ু যুদ্ধ নতুন মাত্রা পেয়েছে।

২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার অধিকারে থাকা একটি দ্বীপে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। বিনা উস্কানির সেই হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার চার নাগরিক। কিন্তু তখন সিউল প্রশাসনের তরফে কঠোর সমালোচনা ছাড়া বেশি কিছু শোনা যায়নি। কিন্তু এবার উত্তর কোরিয়ার রণহুঙ্কারের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরাসরি যুদ্ধজাহাজ নামিয়ে প্রতি আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। হুমকির এ ধরন থেকে বোঝা যায়, এই তিন বছরে প্রস্তুতি বেশ ভালোমতোই নিয়ে ফেলেছে তারা। অন্তত দেশটির সংবাদ সংস্থা 'ইওনহাপ' বারবার আশ্বস্ত করছে দেশের বাসিন্দাদের, হামলা হলে প্রতিরোধ করতে পারবে দক্ষিণ কোরিয়া। গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়ার সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ প্রতিরোধ করতে দক্ষিণ কোরিয়া সাত হাজার ছয়শ' টন ওজনের দু'টি সিজং ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। নৌ-পথ ছাড়াও উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত বরাবর ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ নির্ণায়ক রাডার ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে। 'গ্রিন পাইন' নামের এই ব্যবস্থায় অনেকটা এলাকাজুড়ে পর পর বসানো থাকে শক্তিশালী রাডারগুলো। 'গ্রিন পাইন' ছাড়াও ক্ষেপণাস্ত্র উেক্ষপণের আগাম সতর্ক বার্তা দিতে তৈরি রাখা হয়েছে 'পিস আই' বিমান। মাটির বহু ওপর দিয়ে উড়তে থাকা এই বিমানের রাডার ব্যবস্থা ক্ষেপণাস্ত্র উেক্ষপণের সঙ্গে সঙ্গেই কম্পাঙ্কের পরিবর্তন 'অনুভব' করে খবর পাঠিয়ে দিতে পারে। এর ফলে হামলা আর অতর্কিত থাকে না। মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করা যায় এগোতে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রকে। এর আগে গত সপ্তাহেই দেশের পূর্ব উপকূলে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সমাবেশ শুরু করেছে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতি ঘোষণা, হটলাইন যোগাযোগ ছিন্ন করা, পরিত্যক্ত পরমাণু চুল্লিকে নতুন করে চালু করার চেষ্টাকোনো কিছুতেই ফল না হওয়ায় সত্যি সত্যি ক্ষেপণাস্ত্র সমাবেশের পথে এগিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার শাসক উন। বিদেশি কূটনীতিকরা উত্তর কোরিয়া ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও সহায়তা করার কথাও বলে দিয়েছে সতর্ক করে দিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তাদের আর নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে না।

দেশের পূর্ব উপকূলের একটি ক্ষেপণাস্ত্র উেক্ষপণ কেন্দ্রে যে ক্ষেপণাস্ত্রকে তৈরি করতে দেখা গেছে সেটি 'মুসুদান'। কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনের তথ্য অনুযায়ী উত্তর কোরীয় এই ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। ক্ষেপণাস্ত্র সমাবেশের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম দ্বীপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্ত পোক্ত করার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে মার্কিন সেনারাও। গুয়ামের 'অ্যান্ডারসন বেস' এই এলাকায় আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। গুয়ামের পাশাপাশি আলাস্কাতেও ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থাকে 'তৈরি থাকার' নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

যদিও এখনও পর্যন্ত 'মুসুদান' ক্ষেপণাস্ত্রর কোনো পরীক্ষামূলক উেক্ষপণ উত্তর কোরিয়া করেছে বলে জানা যায়নি, তবু সতর্কতার কোনো ঘাটতি রাখতে চায় না মার্কিন প্রশাসন ও তার 'বন্ধুরাষ্ট্র' জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাদের দেখা গেছে সীমান্ত এলাকায় উত্তরের আক্রমণের মোকাবিলায় তৈরি হতে। সেখানে মোতায়েন মার্কিন সেনারাও রাসায়নিক যুদ্ধের মহড়া শুরু করে দিয়েছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে গুয়াম দ্বীপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন জানিয়েছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই সেখানে 'টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স' সিস্টেম বসিয়ে ফেলবে আমেরিকা। তবে পরিস্থিতি গরম হওয়ার পর থেকে উত্তর কোরিয়াকে নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে দেরি করেনি আমেরিকা। আইজেনহাওয়ারের আমলে ব্যবহূত বি-৫২, রোনাল্ড রিগানের আমলের বি-২ এবং হালের জর্জ বুশের আমলের এফ-২২সবই পাক খেয়েছে কোরীয় উপদ্বীপের ওপর। পিয়ংইয়ংকে চমকে দেয়ার মতো আর কোনো বিমান নেই আমেরিকার।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা আসলে কতটুকু: এই ক্ষমতার আস্ফাালন নিয়ে কৌতূহল সবার। সেই ২০০৬ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া ক্রমাগত দাবি করছেপরমাণু অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে তারা। সঙ্গে দূরপাল্লার এমন ক্ষেপণাস্ত্র, যা নাকি অনায়াসে পার করে ফেলতে পারে অর্ধেক পৃথিবী। আদৌ কি এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পেরেছে উত্তর কোরিয়া? কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনস-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পাল্লার নিরিখে উত্তর কোরিয়ার হাতে এখন মাঝারি থেকে দূরের লক্ষ্যে আঘাত করার মতো চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এক হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আঘাত করতে পারে নদং ক্ষেপণাস্ত্র। গোটা দক্ষিণ কোরিয়া তো বটেই, এমনকি জাপানের বেশ কিছুটা এলাকাও এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার আওতায় পড়ে। তাপোদং-১ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। অর্ধেক মঙ্গোলিয়া আর জাপানের সম্পূর্ণ এলাকায় আঘাত হানতে সক্ষম উত্তর কোরিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র 'মুসুদান'-এর পাল্লা চার হাজার কিলোমিটার। অর্ধেক রাশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছুটা অংশে (মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কাম্বোডিয়া) এই ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানতে পারে। তাপোদং-২ হলো উত্তর কোরিয়ার হাতে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র। পাল্লা ছয় হাজার কিলোমিটার। গোটা ভারত-পাকিস্তান পার করে পশ্চিমে ইরান সীমান্ত পর্যন্ত এবং পূর্বে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে আলাস্কা পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। তবে ১০ হাজার কিলোমিটার পাল্লা বিশিষ্ট যে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দাবি করেছেন কিম জং উন, তা সত্যি বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। কাজেই সরাসরি মার্কিন ভূখণ্ডে আঘাত করার জায়গায় এখনও নেই পিয়ংইয়ং। তবু সাবধানের মার নেই। কখন কী করে বসেন অস্থিরমতি কিম জম উন, তা বলতে পারেন না কেউই। কেননা উত্তর কেরিয়ার 'রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট' যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। রাষ্ট্রের সর্বময় নেতা কিম জং উনের নির্দেশ সেখানে শেষ কথা। সে কারণে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে উত্তর কোরিয়ার সংসদের পরিচয় 'রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট' নামে। সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তা নেন পিয়ংইয়ংয়ের একমাত্র শাসক কিম জং উন। তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাতে সহমত পোষণ করেন মাত্র। সব শেষে সেই সিদ্ধান্তে পড়ে সরকারি সিলমোহর। ভয়টা সে কারণে সবচেয়ে বেশি।

taliban, afganistan, pakistan...



নওয়াজের নেতৃত্বে পাকিস্তান ও ন্যাটো পরবর্তী আফগানিস্তান
তালিবান জঙ্গিরা কি আরো ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে

পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন পিএমএল-এন দল বিজয়ী হওয়ায় নতুন সরকার গঠন নিয়ে এখন নানা কথাবার্তা চলছে। বিজিত দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় তাদেরকে খুব স্বাভাবিকভাবেই জোট সরকার গঠনের দিকে যেতে হচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশ্লেষকদের মাঝে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তাদের মতে, তের বছর পর ক্ষমতায় আসা নওয়াজ সংঘাতময় পাকিস্তানে তালিবান জঙ্গিদের কতখানি দমাতে পারবেন? তিনি কি একটি রক্তপাতহীন পাকিস্তান উপহার দিতে পারবেন? নাকি তার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গিরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে? দেশটিতে দিনে দিনে জঙ্গি হামলা মারাত্মক আকার ধারণ করায় এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। একই ধরনের কথা উঠছে আফগানিস্তানের বেলায়ও। সেখানেও বলা হচ্ছে আগামী বছর ন্যাটো বাহিনী চলে গেলে তালিবান জঙ্গিরা এ সুযোগে কি তাদের ফায়দা লুটবে না? প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বা তা কতটুকু সামাল দিতে পারবেন?
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে এক অর্থে বলা যেতে পারে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দু'দেশেই বছরের পর বছর তালিবান জঙ্গিরা শক্তভাবে আস্তানা গেড়ে আছে। তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ক্রমশ সক্রিয় আত্মঘাতী চক্রকে তারা ব্যবহার করছে। এতে প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে অনেক লোক। এমনকি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না তাদের হামলা থেকে। সমপ্রতি পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচারণাকালে মারা গেছে শতাধিক মানুষ। অপহরণ করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির পুত্র আলি হায়দার গিলানিকে। তালিবানের পক্ষ থেকে প্রাণনাশের হুমকির পর দেশ ছেড়েছেন বিলাওয়াল ভুট্টো। অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণাকালে নওয়াজ শরীফ বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে তারা দেশের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নিজেদের সম্পৃক্ততার ইতি টানবেন। যদি তা-ই হয় তাহলে হয়তো তারা তালিবানের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে কোন শান্তিপূর্ণ পথ তৈরি করতে যাবেন। তবে সবই নির্ভর করছে তালিবানরা কতখানি আন্তরিক তার উপর। কেননা পথভ্রষ্ট মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা কম কষ্টকর নয়। নওয়াজ শরীফের দল বিজয়ী হওয়ার পর আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, আসুন সন্ত্রাস তথা জঙ্গিবাদ দমনে আমরা এক হয়ে কাজ করি। আমরা এর শিকড় উত্পাটনে একতাবদ্ধ হই। এগুলো যদি কথার ফুলঝুরি হয় তাহলে তো আর কোন কিছুুই থাকে না। আর যদি সত্যিকার অর্থে তা-ই বুঝায় তাহলে ভবিষ্যতে এটি যে দুটো দেশের জন্য এক বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা পাকিস্তানে নতুন সরকার আসায় তার প্রভাব যে আফগানিস্তানেও পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। অবশ্য বিবিসির খবরে বলা হয়, পাকিস্তানে নতুন সরকার আসায় আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না। তবে যত যা-ই হোক দু'দেশের যে জঙ্গিই প্রধান সমস্যা তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। একদিকে পাকিস্তানে দাবানলের মতো জঙ্গিরা দেশটাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংসের শেষপ্রান্তে নিয়ে গেছে। অপরদিকে আফগানিস্তানও ওই একই আগুনে পুড়ছে। উভয় দেশই এখন জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা হিসাবে ব্যবহূত হচ্ছে। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দুই দেশেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আন্তরিক উদ্যোগের প্রয়োজন। এদিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত তেহরিকই তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি নওয়াজের নেতৃত্বাধীন সম্ভাব্য নতুন সরকারের কাছে শান্তি ও সংলাপের প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, সরকার অস্ত্রবিরতিতে রাজি হলে তারা সংলাপে বসতে রাজি। এক্ষেত্রে সরকারের যা দরকার তাহলো শুধু আন্তরিকতার। টিটিপি মুখপাত্র এহসানউল্লাহ এহসান বলেন, সংলাপে বসলে হামলা বন্ধ হবে, উম্মুক্ত হবে নানা সমাধানের পথ। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসেও এই সংগঠনটি তত্কালীন জোট সরকারকে শর্তযুক্ত আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তখন তা সরকারের ইতিবাচক সাড়ার অভাবে আলোর মুখ দেখেনি। উল্লেখ্য পাকিস্তানের বহু হত্যাকাণ্ড ও চলমান সহিংসতার জন্য মূলত এ সংগঠনটিকেই দায়ী করা হয়। চলতি সপ্তাহের গোড়ার দিকে নওয়াজ শরিফ বলেছিলেন, তালিবানের আলোচনার প্রস্তাবকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। নওয়াজের এ বক্তব্যকে তারা শ্রদ্ধার চোখেই দেখেন বলে জানান এহসান। এরকম একটা বক্তব্যের পর বিশ্লেষকরা তালিবানের এ প্রস্তাবকে মঙ্গলজনক বলেই মনে করছেন।

এবার দেখা যাক ন্যাটো নেতৃত্বাধীন ইসাফ বাহিনী (ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোর্সেস) ২০১৪ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেলে দেশটির অবস্থা কোন পথে গিয়ে দাঁড়ায়। বিবিসির ডেভিড লয়েন সমপ্রতি তার এক নিবন্ধে বলেছেন, সম্ভবত সামনের বছর জুনের দিকে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী সমগ্র দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ১৯৯২ সালে দেশটিতে রাশিয়া সমর্থিত সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর এই প্রথম তারা ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পাকতিকা প্রদেশের (এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে) ক্যাম্প থান্ডারের কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ শরিফ ইয়াফটুলি বলেন,আমি গর্বিত যে এখানে নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদলের উত্থান ঘটেছে। তিনি বলেন,তালিবানের আর আফগানিস্তান পুনরায় দখল করার মতো সামর্থ্য নেই। কারণ তারা সামনা-সামনি যুদ্ধ করতে পারে না। যদি তারা শক্তিশালী হতো তাহলে তারা কাপুরুষের মতো স্কুলে গিয়ে মেয়েদের উপর হামলা চালাতো না। তারপরও তিনি তালিবানদের 'ভাই' উল্লেখ করে বলেন, আফগান সৈন্যদের তাদের মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট শক্তি ও সামর্থ্য রয়েছে। কর্ণেল আব্দুল কাদির বলেন, পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সেনাবাহিনীকে অবশ্যই তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
এদিকে ২০১৪ সালে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী চলে গেলে দেশটির নিরাপত্তার জন্য ৯টি স্থায়ী ঘাঁটি থাকার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কারজাই বলেছিলেন, আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যরা যে থাকতে চাচ্ছেন তা আমাদের ভালোর জন্যই। শর্ত হচ্ছে এখানকার শান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তার প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ে যদি ন্যাটো বাহিনী চলে যায় তাহলে জঙ্গি অধ্যুষিত দেশটির নিরাপত্তা যে প্রশ্নের সন্মুখীন হবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? আবার নওয়াজ শরীফ নির্বাচনে জয়লাভের পর দেশটিতে মার্কিন ড্রোন হামলা বন্ধের আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, এটা দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড্রোন হামলাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের নতুন সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কেননা আমেরিকা চায় তালিবান ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সামরিক অভিযান চালাক। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনী মার্কিন এ নীতির বিরোধিতা করে পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, আমেরিকা উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় অভিযানের পরিণতির বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। সবমিলিয়ে আমেরিকাকে দূরে রেখে নওয়াজ জঙ্গি দমনে কতটা সার্থক হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আবার তালিবানের সঙ্গে নমনীয় থেকেও তার চলার পথ কতটা সহজ হবে তাও বলা দুষ্কর। তাই সংঘাতময় পাকিস্তানে সত্যিকার অর্থে কোন কিছুর ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ নয়। এক্ষেত্রে সময়ই বলে দিবে কোন পথে হাঁটছে পাকিস্তান।

drone, taliban and nawaz sharif



ড্রোন, তালিবান এবং নওয়াজ শরিফ

সদ্যসমাপ্ত সংসদ নির্বাচন বিভিন্ন কারণেই পাকিস্তানের ইতিহাসের একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কেবল যে সে দেশের ইতিহাসে এ প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচিত সরকার মেয়াদ পূর্ণ করল তা নয়, ভোটার সংখ্যাও ছিল সর্বোচ্চ। ভোটাররা ভোট দিয়েছেন সে দেশের তালিবানদের হুমকি উপেক্ষা করে। তাছাড়া প্রাথমিক হিসেবে দেখা যায় নারীদের অংশগ্রহণ এবার আগের তুলনায় বেশি।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের বিষয়ে দুই প্রধান দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ একমত হতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত সংবিধানে দেওয়া ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন ২৫ মার্চ সরকারপ্রধানকে নির্বাচিত করেছে। তা মেনে নিয়েই দুপক্ষ নির্বাচনে যোগ দিয়েছে।  এ বিষয়ে কোনো দলই আর বাক্যব্যয় করার প্রয়োজনবোধ করেনি। সরকারপ্রধান বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ঐকমত্যে পৌঁছুতে পারেনি বলে তারা ভোটাভুটি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সে খবর জানা সত্ত্বেও আমরা গত দেড় মাসে এ নিয়ে বিতর্ক শুনতে পাইনি। বিদায়ী ক্ষমতাসীন দল পিপিপির মনোনীত ব্যক্তিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছেন। কিন্ত নির্বাচনের ফল তাদের অনুকূলে যায়নি। বিজয়ী হয়েছে নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ।
নির্বাচনের ফলাফল থেকে বলা যায় যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে দুই প্রধান দলের যে আধিপত্য তা ভেঙ্গে পড়েনি। কিন্ত এর বাইরে তৃতীয় দল হিসেবে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের উপস্থিতি স্পষ্ট হয়েছে। যারা ইমরান খানের দল আরও ভালো করবেন বলে আশা করছিলেন তারা আশাহত হলেও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে দলটি বিকল্প হিসেবে জনগণের কল্পনায় জায়গা করে নিচ্ছে।
২৪৯ আসনের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে দেশের ইসলামপন্থী দলগুলো অন্যবারের চেয়ে ভালো তো করেইনি বরং খারাপ করেছে। ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন জমিয়াতে উলেমায়ে ইসলাম পেয়েছে দশটি আসন, জামায়াতে ইসলাম জিতেছে মাত্র দুটো আসনে। এ আসনগুলো সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারে তাদের মোটেই সাহায্য করবে না। নির্বাচনে অন্তত ২৫ আসনে বিজয়ী হয়েছেন নির্দলীয় প্রার্থীরা, আরও কয়েকজন বিজয়ী হতে পারেন।
সব মিলিয়ে পাকিস্তানের জন্য এ নির্বাচন বড় ধরনের ইতিবাচক ঘটনা। পাকিস্তান বিষয়ে নিঃসংকোচে এ ধরনের কথা বলার সুযোগ আসে না। দেশটিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য এগুলো শুভসংবাদ। এ অঞ্চলের একটি দেশে গণতন্ত্রের পথে যৎসামান্য অগ্রগতি লক্ষ্য করলেও এর প্রতি ইতিবাচকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোই বাঞ্ছনীয়। কেননা বিশ্বায়নের এ যুগে আঞ্চলিক ঘটনাবলীর প্রভাব অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরে পড়বে না তা মনে করার কারণ নেই। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যে সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে গণতন্ত্রের পক্ষে রায় দিলেন তা যে কোনো গণতন্ত্রকামী মানুষেরই চোখে পড়ার কথা।

দুই

পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। দেশের অর্থনীতির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। চার শতাংশের কম প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেশটি যে বেশিদূর যেতে পারবে না তা সকলেই জানেন। দেশের মানুষ আশা করেন যে নতুন সরকার তা মোকাবেলা করবে। জ্বালানি সংকট, বিশেষ করে বিদ্যুত সরবরাহ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দেশের কোনো কোনো এলাকায় আঠারো ঘণ্টাই বিদ্যুত থাকে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি তালিবানের সঙ্গে চলছে লড়াই। প্রতিবেশি আফগানিস্তানের অশান্তির কারণ পাকিস্তান না তার শিকার পাকিস্তান সে প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে কাকে এ প্রশ্ন করা হচ্ছে তার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছে টানাপড়েন। অব্যাহত ড্রোন হামলার ফলে যেমন জঙ্গীদের মৃত্যু ঘটছে তেমনি প্রাণ হারাচ্ছেন নিরপরাধ মানুষ। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্ন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক রাজনীতিদুইয়েরই অংশ। এসবের মোকাবেলা করতে হবে নওয়াজ শরিফ সরকারকে। নওয়াজ ক্ষমতায় নতুন নন, কিন্ত এখন সংকট অনেক বেশি।

নওয়াজ শরিফের মুশাররফ সমস্যা
পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাশাসন জারি করে তখনকার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মিয়া নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তখন নিশ্চয়ই কল্পনাও করেননি যে একদিন তার ভাগ্য, এমনকি তার জীবন নির্ভর করতে পারে মিয়া নওয়াজের ওপরই। ১১ মে ২০১৩-এর নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিজয়ের পর অবস্থা তাই দাঁড়িয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট মুশাররফ এ বছরের মার্চ মাসে স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসার পর তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মামলা দায়ের করার জন্য দেশের আইন বিভাগ ও সিনেটের সদস্যরা সরকারের কাছে প্রথমে দাবি তোলে এবং শেষে চাপপ্রয়োগ করে। ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারি, সংবিধান স্থগিতকরণ এবং প্রধান বিচারপতিসহ বিচারকদের চাকুরিচ্যুতি ও গৃহবন্দী করে রাখার কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন লাহোর কোর্ট বার এসোসিয়েশনের রাওয়ালপিণ্ডি শাখার সভাপতি এডভোকেট তৌফিক আসিফ।
এ আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের দু সদস্যের একটি বেঞ্চ সরকারকে এ মর্মে নির্দেশ দেয় যেন সরকার ১৯৭৩ সালের হাইট্রিজন অ্যাক্টেরআওতায় মুশাররফের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মামলা দায়ের করে। মৌলভি ইকবাল হায়দারের একই ধরনের আরেকটি আবেদন আদালতের ভিন্ন একটি বেঞ্চ বিবেচনায় নেয়। আদালতের এসব নির্দেশ আসে সে সময় যখন দেশের নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।
এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মীর হাজার খান খোসোর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন তার সরকারের কাজ হচ্ছে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, এর বাইরে জরুরি কাজ ছাড়া তার সরকার কিছু করবে না। তিনি বলেছিলেন যে নির্বাচিত সরকারই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এখন মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে চলেছে। সে কারণে অনেকেই ভাবছেন স্বৈরশাসক মুশাররফের ভাগ্যে কী আছে তা নিয়ে। মার্চে দেশে ফেরার আগে তার জন্য কী অপেক্ষা করছিল মুশাররফ মনে হয় তা অনুমান করতে পারেননি। নিজের দল মুসলিম লীগের একাংশকে গুছিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন এবং সম্ভবত বিজয়ী হবেন এমন আশা করে ফিরেছিলেন তিনি।
কিন্তু কেবল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকেই তিনি বঞ্চিত হননি, সারাজীবন রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবেন না বলেও আদালত রায় দিয়েছে। এ মামলার আশংকা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ঝুলছে আরও অনেক মামলা যার অন্যতম হল দুটো হত্যা মামলা২০০৬ সালে বালোচ প্রধান নওয়াব আকবর বুগতি এবং ২০০৭ সালে বেনজির ভুট্টোকে হত্যা।
নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় নওয়াজ শরিফ এ ইঙ্গিতই দিয়েছেন যে যদিও তিনি প্রতিহিংসায় বিশ্বাসী নন, কিন্ত মুশাররফের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার মামলা দায়েরের বিষয়টি তিনি বিবেচনা করবেন। এ ধরনের মামলা কেবলমাত্র সরকারই দায়ের করতে পারে; ফলে আদালতের নির্দেশ থাকলেও সরকার তা করবেন কিনা সেটা সামনের দিনগুলোতে দেখা যাবে।
তার বিরুদ্ধে আদৌ এ মামলা করা যায় কিনা এ বিষয়ে পাকিস্তানের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কারও কারও মতে, মুশাররফ দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংবিধানসম্মতভাবে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। কিন্ত যদি কোনো আদালত জরুরি অবস্থা জারিকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় তবেই কেবল পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নেবে।
যারা মনে করেন যে মুশাররফের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা উচিত তাদের বক্তব্য হল, তিনি দেশের সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের বরখেলাপ করেছেন। সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কেউ যদি অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করে বা করার চক্রান্ত করে তবে তা বিশ্বাসঘাতকতা বলে বিবেচিত হবে। এসব আইনি বিতর্কের জন্য নিশ্চয়ই সামনে অনেক দিন পড়ে আছে, কিন্ত এখন পাকিস্তানে নির্বাচনের পর এটা স্পষ্ট যে পারভেজ মুশাররফকে সামনের দিনগুলোতে হয়তো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে।
প্রশ্ন হল পারভেজ মুশাররফের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সেনাবাহিনী তাতে আপত্তি করবে কিনা। দেশের আদালত মুশাররফের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর আজীবন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরদিন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আশরাফ কায়ানি এক বক্তৃতায় তার অসন্তোষের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সরাসরি পারভেজ মুশাররফের কথা উল্লেখ না করে জেনারেল কায়ানি বলেন আমার মতে, গণতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের মধ্যেকার এ লুকোচুরি খেলার অবসান ঘটাতে পারে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ, শাস্তিপ্রদান নয়
অতীতে যে দুবার নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় ছিলেন সে সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার ও তার দলের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। ফলে এখন পারভেজ মুশাররফকে কেন্দ্র করে তিনি আবারও সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি করবেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়, বিশেষ করে যেখানে তার সামনে বড় ধরনের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে এবং সে সব বিষয়ে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।

ড্রোন এবং তালিবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা
বিজয়ী হলে পাকিস্তানের ভেতরে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা বন্ধ করবেন বলে নওয়াজ শরিফ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেটাই হবে তার প্রথম ও সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এ জন্য সেনাবাহিনীর সহযোগিতা দরকার হবে সবার আগে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জঙ্গীদের মোকাবেলা করার জন্য সীমিত আকারে হলেও ড্রোন হামলা অব্যাহত রাখার পক্ষে বলেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
অন্যদিকে পেশোয়ার হাইকোর্টে ফাউন্ডেশন ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটস নামের একটি সংগঠনের দায়ের করা মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি দোস্ত মোহাম্মদ খান বলেছেন, এ ধরনের হামলা দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী এবং তা বন্ধ করার জন্য দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের ড্রোন হামলা বন্ধের আগে পাকিস্তানের কাছ থেকে আফগান তালিবানদের প্রতি সমর্থনবন্ধের নিশ্চয়তা চাইবে বলে অনুমান করা যায়।
নওয়াজ শরিফ তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে পাকিস্তানি তালিবানের সঙ্গে কোনোরকম পূর্বশর্ত ছাড়াই আলোচনা করতে রাজি আছেন। আফগান সীমান্ত বরাবর ট্রাইবাল এলাকায় এখন প্রায় দেড় লাখ পাকিস্তানি সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। গত কয়েক বছরে সেখানে তালিবানের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছে প্রায় চার হাজার সৈন্য।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোনোরকম স্থায়ী শান্তির ব্যবস্থার নিশ্চয়তা না পেলে সৈন্যপ্রত্যাহারে রাজি হবে বলে মনে হয় না। অতীতে তালিবানের সঙ্গে সব চুক্তি তালিবানদের কারণেই ভেস্তে গেছে বলেই তাদের ধারণা। সেটা একেবার ভিত্তিহীন নয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে এ ধরনের কোনো চুক্তির আওতায় যদি সৈন্যপ্রত্যাহার করা হয় তবে এ এলাকায় আফগান তালিবান এবং হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রভাব কেবল বাড়বেই তা নয় এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে চলে যেতে পারে।
তবে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সৈন্যপ্রত্যাহার করে নেবে সেহেতু তাদের জন্য এখন বিষয়টি স্পর্শকাতর। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না যে পাকিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটুক। তবে পাকিস্তানের নতুন সরকার জানে, আফগানিস্তানের কাছ থেকে যুদ্ধাস্ত্র থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভিন্ন সরঞ্জাম সরিয়ে আনার জন্য পাকিস্তানের সহযোগিতা ও ওই পথ তার দরকার হবে।
নওয়াজ শরীফের জন্য আরেকটা ইতিবাচক দিক হল ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নির্বাচনে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভালো ফলাফল করেছে এবং সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনওয়ালা প্রদেশে তার দল ক্ষমতাসীন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইমরান খান এ প্রশ্নে মুসলিম লীগের সঙ্গে একমত যে পাকিস্তানি তালিবানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান আসবে।

তিন

পাকিস্তানের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে আশা করি তা মোকাবেলায় নওয়াজ শরিফ সরকারের সাফল্য বিচারের জন্য আমাদের সামনে পাঁচ বছর থাকবে। কিন্ত আশু বিষয় হল যেসব কারণে পাকিস্তানিরা মুসলিম লীগকে আবার ক্ষমতায় এনেছে নওয়াজ শরিফ ও তার দল সেটা বুঝতে পারবেন কিনা।