Friday, February 24, 2023

 

আছে যুদ্ধআছে মৃত্যুআছে বাণিজ্য

নো আর্মস বিজনেস উইদাউট এনিমিস ইজ পসিবল!

শত্রু ছাড়া যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধ ছাড়া অস্ত্র ব্যবসাও হয় না। তাই প্রথমে শত্রু বানাওএরপর যুদ্ধ বাঁধাও। আর তারপর অস্ত্র ব্যবসার খেলা শুরু। আসলে ‘যুদ্ধ’ সফল ব্যবসার ভিন্ন নাম, বলেছিলেন সার্বিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক ম্লাডেন ডরদেভিচ।

একদিকে রাশিয়াঅন্যদিকে ইউক্রেন। বিপুল শক্তিধর রাশিয়ার মোকাবিলায় ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে আমেরিকা ও তার পশ্চিমী মিত্র দেশগুলি। কিয়েভ যত বেশি বিদেশি অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছেপাল্লা দিয়ে হামলার তেজ বাড়াচ্ছে মস্কো। এই দুইয়েরই যোগফল— দিনে দিনে যুদ্ধ আরও রক্তক্ষয়ীআরও ধ্বংসাত্মক হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বৈশাখে ভরা পৌষ মাস একটি অংশেরইতারা অস্ত্র ব্যবসায়ী!

ইউক্রেন যুদ্ধ লাগিয়ে’ দিয়ে এরমধ্যেই বড়সড় একটি অস্ত্রবিক্রির হাট বানিয়ে ফেলেছে আমেরিকা। এই হাটের অস্ত্র ক্রেতা এখন গোটা ইউরোপের দেশগুলি। আর অস্ত্র বিক্রেতা আমেরিকা একাই। মহামারীর ধাক্কা সামলে জেনারেল ডায়নামিকস, রেথিয়নলকহিড মার্টিনের মতো সংস্থাগুলির পোয়াবারো। সামরিক ব্যয়ের উন্মাদনা বাড়াতে অস্ত্র কোম্পানিগুলি গোটা দুনিয়ায় ক্রেমলিন জুজুকে কাজে লাগাচ্ছে। ইউক্রেন হয়ে উঠেছে ‘সোনার খনি’।

ফিরে চলুন, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। আমেরিকায় তখন মন্দার ঢেউ। ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া এই মহামন্দায় আমেরিকার শিল্প উৎপাদন কমে যায় ৪৭ শতাংশ। জিডিপির সঙ্কোচন হয় ৩০ শতাংশ। বেকারত্ব পৌঁছায় ২৫ শতাংশে। এর প্রভাব পড়ে আমেরিকার রপ্তানি আয়ে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমেরিকার অংশগ্রহণ কমে যায় ৬৭ শতাংশ। ত্রিশের দশকের শেষদিকে আমেরিকা এই মহামন্দা থেকে নিস্তার পেতে শুরু করেফিরতে থাকে মন্দা পূর্ববর্তী অবস্থায়। তবেএই প্রক্রিয়া ছিল তুলনামূলক বেশ ধীরগতিতে। এর মধ্যেই আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। পাল্টে যায় অর্থনৈতিক সূচকগুলি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান আক্রমণ করে পার্ল হারবারে। আমেরিকাও সরাসরি জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি ও এসবের ফরমাশ পেয়ে আমেরিকার অস্ত্র শিল্প ফুলেফেঁপে ওঠে।

যুদ্ধকালীন পাঁচ বছরের মধ্যে আমেরিকার জিডিপি ৮৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে। বেকারত্বের হার ১৪ শতাংশ থেকে কমে নেমে যায় ২ শতাংশের নীচে। এই অভিজ্ঞতা আমেরিকার একটি স্বতন্ত্র অস্ত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেয়। মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পারেন, যুদ্ধই বদলে দিতে পারে অর্থনীতির গতিমুখ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতায় আমেরিকা আরও কয়েকটি নতুন নতুন যুদ্ধে জড়িয়েছে। পঞ্চাশের দশকে আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে কোরিয়ান যুদ্ধেপরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। সত্তরের দশকে তুঙ্গে ওঠে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে জড়ায় আমেরিকা। এই অর্ধশতাব্দীতে টানা যুদ্ধাবস্থায় আমেরিকার অর্থনীতির একটা বড় ক্ষেত্র উঠে অস্ত্র শিল্প। অনন্ত যুদ্ধে’ জড়িয়ে থাকা তাই আমেরিকার অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি। তা আজও টের পাওয়া যায়।



সম্প্রতি করোনার আঘাতে জর্জরিত অর্থনীতি চাঙা করতে আমেরিকার সামনে দরকার ছিল ইউক্রেনের মতো একটি বাজার। কে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলকে ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিল— পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের দাপটে সেইসব প্রশ্ন আজ গৌণ। এর নেপথ্য অবশ্যই আমেরিকার অস্ত্রবিক্রির দূরভিসন্ধি। ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আবারও অস্ত্র বিক্রির হাট বসিয়েছে আমেরিকা। আর রমরমা হয়ে উঠেছে মার্কিন অস্ত্রের বাজার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঠিকই বলেছেন, আমেরিকানদের এখন বিশ্রামের সময় নয়!

ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নানা ধরনের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার জন্য আমেরিকার কাছে ছুটে গিয়েছে। বিভিন্ন দেশ তাদের অস্ত্র চাহিদার তালিকা আমেরিকার কাছে পেশ করেছে। লকহিড মার্টিন কোম্পানি নির্মিত ৮৮টি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে জার্মানি। আমেরিকার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও কিনতে চেয়েছে। ইউরোপের আরও এক দেশ পোল্যান্ড। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচিত এই দেশটি জরুরিভিত্তিতে আমেরিকার কাছ থেকে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম রিপার ড্রোন কেনার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এছাড়া পূর্ব ইউরোপের আরও বেশ কিছু দেশ বিমান বিধ্বংসী স্টিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। ফ্রান্সসুইডেননরওয়েএস্তোনিয়ার মতো দেশগুলি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে শুরু করেছে। এসব অনুরোধ ও দাবি পূরণের জন্য পেন্টাগন একটি কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে অস্ত্র রপ্তানি ৪.৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন সংকটের কারণে এখন অস্ত্র রপ্তানি ১৯ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির সদস্য সিমন ওয়েজেম্যানের মতেইউরোপ এখন সমরাস্ত্র কেনার নতুন হটস্পট।

প্রশ্ন একটাই, এই যুদ্ধে জয়ী কে? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবশ্যই অস্ত্র ব্যবসায়ীরা!

No comments:

Post a Comment