পড়শি দেশে
ভোটের খেলা শুরু
মৌর্য
সাম্রাজ্যের সময় মহাঋষি কৌটিল্য কূটনৈতিক আচার-আচরণ নিয়ে যা লিখেছিলেন, আজও তা
আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত।
কৌটিল্যের
বিধান, কোনও দেশের রাজ প্রতিনিধি অন্য দেশের খবরাখবর নিজের দেশে পাঠাতে পারেন। প্রয়োজনে
গোয়েন্দাগিরিও চালাতে পারেন। কিন্তু সে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারেন
না। অন্য দেশের সঙ্গে নিজের দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট থাকাই রাষ্ট্রদূতের বড়
দায়িত্ব। কৌটিল্যের সেই বাণীর প্রতিফলন ছিল ১৬৪৮ সালের ‘ওয়েস্ট ফেলিয়া’ সন্ধিতেও।
যার কথা প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিব হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর একাধিক বইয়ে
প্রশংসাসূচকভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, কোনও দেশের
আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের উপর নিষেধাজ্ঞা। সেই পথেই ১৯৬১ সালের
ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, কূটনীতিকরা অন্য দেশের আইনের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এবং সে দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। কনভেনশনের ৯
অনুচ্ছেদে চুক্তিভুক্ত দেশগুলিকে যে কোনও বিদেশি কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার
অধিকার দিয়েছে।
আমেরিকা
নিজের দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো কখনও সহ্য করেনি। আর
তাই ভিয়েনা কনভেনশনের বহু যুগ আগে, ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে
ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড সেকভিলকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছিল আমেরিকা। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ
সরকার লর্ড সেকভিলকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকেই অপসারিত করতে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী
সময়েও আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দায়ে আমেরিকা বহু বিদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার
করেছে। ২০২১ সালে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে ১০ জন
রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল মার্কিন প্রশাসন। এই বহিষ্কারের তালিকা বেশ
লম্বা। গোটা দুনিয়াকেই এই শক্তি দিয়েছে ভিয়েনা কনভেনশন।
অথচ, বাংলাদেশে
নির্বাচনের মেঘ ঘনালেই আমেরিকা, জাপান, পশ্চিমের দেশগুলি
সক্রিয়তা বাড়াতে থাকে! নড়ে বসে চীন, রাশিয়াও। শুধু নির্বাচন
তো নয়, বাংলাদেশে যে কোনও রাজনৈতিক সঙ্কট এলেই তৎপর হতে দেখা
গিয়েছে সে দেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যার শুরু।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে পরবর্তীতে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন, এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরে প্রতিটি রাজনৈতিক ওঠাপড়ায়,
কমবেশি সব নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি শক্তির সক্রিয়তা প্রকাশ্যে এসেছে।
আবার কোনও ক্ষেত্রে তা থেকে গিয়েছে গোপনে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলাদেশে
নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে বিতর্ক!
ঘটনার
সূত্রপাত গত ১৪ ডিসেম্বর সকালে। অত্যন্ত গোপনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকার
শাহিনবাগে নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে যান। প্রায় এক দশক ধরে
সাজেদুল নিখোঁজ। সাজেদুলের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের
স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’–এর সমন্বয়কারী। শাহিনবাগের ওই বাড়িতে
যাওয়ার আগে থেকেই ‘মায়ের কান্না’ নামে
আরেকটি সংগঠন সেখানে জড়ো হয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে ফাঁসি হওয়া
সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের পরিবার নিয়ে এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। তাদের দাবি,
জিয়ার আমলে ও সামরিকবাহিনীর সদস্যদের আসলে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা
করা হয়েছে।
বাড়ির ভিতরে
নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের পরিবারের সঙ্গে আধ ঘণ্টার বেশি আলোচনার পর বেরিয়ে আসেন
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গাড়িতে ওঠার সময় তাঁকে ঘিরে ধরে স্মারকলিপি দেওয়ার
চেষ্টা করে ‘মায়ের কান্না’-র সদস্যরা। স্মারকলিপিতে দাবি করা হয়,
জিয়ার আমলে ফাঁসি হওয়া সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের হত্যার ঘটনার আন্তর্জাতিক
তদন্তে আমেরিকার সহযোগিতা চাই। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাঁদের কথা না শুনেই তড়িঘড়ি
করে গাড়িতে উঠে যান। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্বেগ
জানাতে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি
তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
জানান। উদ্বেগ প্রকাশ করে ওয়াশিংটনও। আর এই ঘটনা ঘিরে আসরে নেমে পড়ে রাশিয়া। মস্কোয়
বসে আমেরিকার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রুশ বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া
জাখারোভা। মারিয়ার অভিযোগ, ঘটনাটি মার্কিন কূটনীতিকের
তৎপরতার প্রত্যাশিত ফল। যিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষার নামে
ক্রমাগত দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি
তাঁর ব্রিটেন ও জার্মান কূটনৈতিক মিশনের সহকর্মীরা একই লক্ষ্যে যুক্ত থেকে আগামী
সংসদ নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার
বিষয়ে খোলামেলাভাবে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এই টানাপড়েনে বোঝাই
মুশকিল, বাংলাদেশে আসন্ন ভোটে লড়াইয়ে নেমেছেন কারা?
বাংলাদেশের
আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন কূটনীতিক নাক গলিয়েছেন কি না সেই প্রশ্নের থেকেও সংবাদকর্মীদের
ব্যস্ততায়, গ্রামীণ চায়ের আড্ডায়, শহুরে হোয়াটসঅ্যাপের গোপন
চ্যাটে পিটার হাস এখন নজরকাড়া চরিত্র হয়ে উঠেছেন। হাসের ভঙ্গিতে সাহস ও আকর্ষণ রয়েছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ নামে এক অনুষ্ঠানে হাস পরিষ্কার করেই জানিয়েছিলেন, তিনি ও তাঁর সরকার কী
চাইছে। তাঁদের চাওয়ার ফর্দ বড় নয়। তবে যথেষ্ট স্পর্শকাতর উপাদান রয়েছে তাতে। বিশেষ
করে আমেরিকা চাইছে, ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের পাশে থাকুক
বাংলাদেশ। এ জন্য তারা দু’টি সামরিক চুক্তিও করতে চায়, যা
তাদের মতে ‘প্রয়োজন’। এসব প্রস্তাব
বাংলাদেশের জন্য কিছুটা বিব্রতকর। কারণ, একই অঞ্চলে আমেরিকার
স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে চীন। রয়েছে ভারতও। সকলের স্বার্থ এক রকম
নয়। বাংলাদেশ এখন কী করবে? কার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে?
বিশ্বজুড়ে
চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও তার ছাপ পড়তে
শুরু করেছে। দ্রুতগতিতে এই তল্লাটে মেরুকরণ ঘটছে। এ রকম জটিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার
ময়দানে বাংলাদেশ কীভাবে কোনও একক শক্তির ‘বন্ধু’ হতে পারে?
অবস্থা এমনও নেই, বাংলাদেশ পক্ষপাতহীন অবস্থান
নেবে। বাংলাদেশের রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগের কথা আমেরিকার অজানা নয়। সে তো শ্রীলঙ্কা
হতে চাইবে না। তাকে আইএমএফের কাছে যেতে হবে। এ রকম টানাপোড়েনে ‘নিরপেক্ষ’ থাকা কঠিন। ‘নিরপেক্ষতা’
একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু তার জন্য অর্থনৈতিক হিম্মত
থাকতে হয়। নিরপেক্ষ থাকতে শক্তিশালী স্বরাজ লাগে। জাতীয় ঐকমত্য দরকার হয়।
বাংলাদেশের সেসব নেই। সমস্যাটা কোথায়, পোড় খাওয়া কূটনীতিক পিটার হাস নিশ্চিত জানেন।
নিজে থেকেই বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক
ওয়াশিংটন-ঢাকা বন্ধুত্বে কোনও বাধা হওয়ার কথা নয়। যদিও বিষয়টি অত্যন্ত জটিল।
কারণ, বাংলাদেশের
সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখন আর দু’টি দেশের সাধারণ সৌজন্যে আটকে নেই। ৪৭ বছরে তা
ক্রমাগত কাছে এসেছে। উভয়ের এখনকার বন্ধন বহুমাত্রিক এবং অনেক গভীর। চীনের শত শত
কোম্পানি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, বাংলাদেশে গত
কয়েক দশকে পরিকাঠামোগত যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে চীনের বিপুল সাহায্য
রয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রেও তাই। একাত্তরে স্বীকৃতি দিতে দেরি করে ভুল করেছিল বেজিং।
পরে সেটা পুষিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে চীনের প্রতিপক্ষ আমেরিকার সঙ্গে মাখামাখি
করা কঠিন। রয়েছে তাইওয়ান প্রশ্নও। বাংলাদেশ তাইওয়ানের পৃথক স্বাধীন সত্তা স্বীকার
করে না। অথচ, আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ানকে সুরক্ষা
দেওয়া। তবে বাংলাদেশে চীনের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবেদন দুর্বল। ভারত বা আমেরিকা সেই
জায়গায় অনেক এগিয়ে। তাই বাংলাদেশকে শুধু চীনের সঙ্গে নয়, তিন
সীমান্তের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।
তাহলে বাংলাদেশ
কোন দিকে হাত বাড়াবে? এই অঙ্কই কষছেন পিটার হাস। তাদের হাতে রয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ, রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং নানা মিশনের
প্রভাব-প্রতিপত্তি। আমেরিকা ও ইইউ দেশগুলি এখন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড়
বাজার। বিশাল সংখ্যায় প্রবাসীরা রয়েছেন এসব দেশে। যাঁদের আয়ে চলছে দেশে লাখ লাখ
পরিবার। বিপরীতে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, চীন তার ‘বন্ধু’দের এককভাবে বাঁচাতে পারে না। নেপালিদেরও একই রকম অবস্থা। অর্থনৈতিক
দুরবস্থায় পড়ে পাকিস্তানকেও আইএমএফের কাছে ছুটতে হয়েছে। শুধু বেজিংয়ের উপর ভরসা
করে থাকতে পারেনি। আর এও সত্য— অর্থনৈতিক দুরবস্থায় নিরপেক্ষতা
কোনও কাজের কৌশল নয়। সুইজারল্যান্ড যা পারে, বাংলাদেশ তা
পারবে না। সময়ও পাল্টাচ্ছে দ্রুত। নতুন বিশ্ববাস্তবতার মুখে সুইডেন-ফিনল্যান্ডের
মতো দেশকেও নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এসব বাস্তবতা অগ্রাহ্য করবে
কীভাবে? পিটার হাস হয়তো তাই এই রকম দুর্বল গ্রন্থিগুলিতেই
বাজি ধরেছেন!
সবসময়ই
ছোট ইঁদুর শিকার করা বিড়ালের পক্ষে সহজ। আর এই শিকার বিড়াল তার নিজের প্রয়োজনেই
করে। ফলে বাংলাদেশের আসন্ন সংসদীয় নির্বাচন ঘিরে যে শক্তিশালী দেশগুলির খবরদারি
বাড়বে— তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
No comments:
Post a Comment