Monday, February 27, 2023

 

প্রতারক স্যাম, কিপ্টো দুনিয়ার পতন

অশরীরী মুদ্রার খেলা দেখেছিল আমেরিকা!

গত বছর ঠিক এই সময় ন্যাশনাল ফুটবল লিগ জিতেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস র‌্যামস। ফাইনালে হেরে গিয়েছিল সিনসিনাটি বেঙ্গলস। শুধু খেলা নয়, সেই রাতে প্রায় ১০ কোটি দর্শকের চোখ আটকে গিয়েছিল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলগুলির প্রচারিত বিজ্ঞাপনে। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে আমেরিকানরা দেখেছিলেন, খেলার ফাঁকে ফাঁকে ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সির ‘অবাক করা’ বিজ্ঞাপন। যেখানে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম ‘এফটিএক্স’র বিজ্ঞাপন। তাতে ক্রিপ্টোর নিরাপদ ও সহজ পথ হিসেবে পরিচিত করাতে আসরে নামানো হয় আমেরিকার বিখ্যাত কমেডিয়ান ল্যারি ডেভিডকে। কোকাকোলা কিংবা জেনারেল মোটরসের মতো প্রথম সারির কোম্পানিগুলিকে পিছনে ফেলে ডিজিটাল মুদ্রার এমন ‘দামী’ বিজ্ঞাপন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে যায়। তাহলে কি এতদিনে ডিজিটাল মুদ্রা সাবালক হয়ে উঠল? উত্তর পেতে বেশি সময় লাগেনি।

দুনিয়াজুড়ে এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা ক্রিপ্টোলজি ব্যবহার করে যে বৈদ্যুতিন মুদ্রা তৈরি হয়, তারই নাম ক্রিপ্টোকারেন্সি। এই মুদ্রা হাতে ছোঁয়ার উপায় নেই, এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র ভার্চুয়াল জগতে। ব্লকচেননামে এক প্রযুক্তি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে এই অশরীরী মুদ্রা। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি লেনদেন যেভাবে ডিজিটাল ব্লকের মাধ্যমে চিহ্নিত করা থাকে, সেই ব্লকচেনভেদ করা প্রযুক্তিগত ভাবে অসম্ভব, এমনটাই দাবি। এই আর্থিক ব্যবস্থায় ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা আমেরিকার ফেডারেল ব্যাঙ্কের মতো কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। যে কোনও দুই সংস্থা বা ব্যক্তির ক্রিপটোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট থাকলে তাঁরা কোনও নগদ ছাড়াই নিজেদের মধ্যে ক্রিপটোকারেন্সি লেনদেন করতে পারেন। কোনও বিপণির ক্রিপটোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট থাকলে সেখান থেকে গ্রাহকরা ক্রিপটোকারেন্সিতেই জিনিসপত্র কিনতে পারেন। ছাপোষা মানুষের ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে প্রচলিত ধারা মেনে বিনিয়োগ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। অর্থাৎ টাকা-ডলার-পাউন্ড ভাঙিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনে আশা রাখতে হবে যে এর মূল্য দিন দিন বাড়বে। নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই আর্থিক ব্যবস্থার পক্ষে দীর্ঘদিন ধরেই সওয়াল করে আসছেন পৃথিবীর প্রযুক্তিবিদদের একাংশ।

এই মুদ্রার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, এতে লেনদেনকারীর পরিচয় গোপন থাকে। তার বদলে ব্যবহার হয় সঙ্কেতলিপি। অর্থাৎ, অন্য ডিজিটাল লেনদেনে যেমন বলা যায়, তা কার কাছ থেকে কার কাছে গিয়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। শুধু জানা যায় এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যটিতে তার লেনদেন হয়েছে। তবে যদি এক্সচেঞ্জে এর লেনদেন (ট্রেডিং) করতে চান অথবা ক্রিপ্টোকারেন্সি ভাঙিয়ে টাকা হাতে নিতে চান, তা হলে পরিচয় গোপন রাখা শক্ত। বিনিয়োগের সুফল দ্রুত মিলবে, এমন আশ্বাসে ক্রেতা টেনেছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনার প্ল্যাটফর্মগুলি। তথাকথিত ক্রিপ্টো ওয়ালেটকে ব্যাঙ্কের সঞ্চয়ী হিসেবের মতো করে তৈরি করা হয়। এতে উচ্চ হারে সুদের অফারও রয়েছে। প্রচলিত মুদ্রার উপর যাঁরা আস্থা হারিয়েছেন, তাঁদের কাছে ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগের বাড়তি সুবিধা হল, লেনদেনের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী কোনও নিয়ন্ত্রক নিয়ে চিন্তা নেই।

কিন্তু অশরীরী মুদ্রার উপর মানুষের বিশ্বাস জমাট বাধার আগেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে প্রথাগত আর্থিক মডেলের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি। একের পর এক। গত বছর মে মাসে ‍দুই ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা টেরাইউএসডি ও লুনার ব্যাপক পতন হয়। প্রায় সব দর হারায় মুদ্রা দু’টি। রাতারাতি ক্রিপ্টোমার্কেট থেকে উধাও হয়ে যায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিপ্টো হেজ ফান্ড থ্রি অ্যারোজ ক্যাপিটাল। এরপরই দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার আবেদন করে ভয়েজার ডিজিটালসেলসিয়াস নেটওয়ার্ক। দু’টি প্রতিষ্ঠানই অর্থ ধার দিয়েছিল থ্রি অ্যারোজ ক্যাপিটালকে। ‘এফটিএক্স’-এর পতন হয় আরও কয়েক মাস পরে। গত নভেম্বরে। পরের মাসেই উত্তর আমেরিকার বাহামাস থেকে গ্রেপ্তার হন এফটিএক্সের প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল বেঞ্জামিন ব্যাংকম্যান-ফ্রিড। যাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় প্রতারণার অভিযোগ। আমেরিকার সিয়াটেল ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের অধ্যাপক টিম লিউংয়ের কথায়, আগামী দিনে আরও অনেক দুঃসংবাদ হাজির হবে। দুনিয়ায় ক্রিপ্টো শীতের বদলে ক্রিপ্টো বরফ যুগ আসার শঙ্কাই বেশি...

কিপ্টোকারেন্সির কিং স্যামের পতন যতটা হতাশাজনক, উত্থান তার চেয়েও অনেক নাটকীয়। ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ এফটিএক্স আত্মপ্রকাশ করে ২০১৯ সালে। এর আগে স্যাম ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার মার্কেটে শেয়ার লেনদেনকারী হিসেবে কাজ করতেন। অঙ্কে মেধাবী, ধারালো বুদ্ধির স্যাম শেয়ার ব্যবসায়ী পুরনো ব্যবসা ছেড়ে এসেছিলেন ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসায়। তাঁর সঙ্গে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন গুগলের প্রাক্তন কর্মী গ্যারি ওয়াং। তাঁদের হাত ধরেই এফটিএক্স বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জে পরিণত হয়েছিল। যার গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। প্রতিদিন এখানে এক হাজার কোটি ডলারের ক্রিপটোকারেন্সি লেনদেন হতো। মাত্র পাঁচ বছরে স্যাম আয় করেছিলেন ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তরুণ বিলিয়নিয়ারের তালিকায় নাম লেখান এই মার্কিন বিনিয়োগকারী। রাতারাতি ধনী হওয়ার গল্প তখন আমেরিকার ঘরে ঘরে। কী করেন, কী খান, কেমন জীবনযাপন—সব।

নিরামিষাশি স্যাম রাতে ঘুমোন মাত্র ৪ ঘণ্টা। ভিডিও গেম খেলা তাঁর নেশা। প্রিয় গেম লিগ অব লিজেন্ডস। কেন তিনি এই গেম খেলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করে একাধিক টুইটে স্যাম বলেছিলেন, ‘এই লড়াইয়ের খেলা খেলতে খেলতেই তার মাথা থেকে কোম্পানির প্রতিদিনের কোটি কোটি ডলারের ব্যবসার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।’ ফরচুন ম্যাগাজিন একসময় স্যামকে আগামীদিনের ওয়ারেন বাফেট হিসেবেও বলা শুরু করেছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে গত নভেম্বরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেউলিয়া হন কিপ্টোকারেন্সির এই বিলিয়নিয়ার। ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্মগুলি যখন কুখ্যাত, তখনও এফটিএক্স নিজেদের বিশ্বস্থ হিসেবে জানান দিত। রাজনীতিবিদদের তহবিলে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যোগান দিয়েছিলেন এমআইটির একসময়ের তুখোড় ছাত্র স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রিড। সবসময় দাবি করতেন, তাঁর অর্থ উপার্জনের একমাত্র কারণ ভালো কাজ করা। কিন্তু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন জানিয়েছে, ব্যক্তিগত সুবিধের জন্যই গ্রাহকদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নয়ছয় করেছেন তিনি। কমিশনের দাবি, স্যাম প্রতারণা শুরু করেছিলেন একেবারে প্রথম থেকেই।

‘দ্য উইজার্ড অব লাইজ’ গ্রন্থের লেখক ডায়না হেনরিকসের কথায়, গড়পড়তা বিনিয়োগকারীরা বিনাপ্রশ্নে স্যামকে বিশ্বাস করেছিলেন। একজন প্রতারকের সবচেয়ে অপরিহার্য গুণ, তারা এমনভাবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন যা কখনও টলে না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও নেতিবাচক তথ্য মানুষের জানা থাকলেও। এফএফটিএক্সের গ্রাহকদের কাছেও সংস্থাটিকে বিশ্বাস করার মতো পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ছিল না। তারপরও তারা স্রেফ বিশ্বাসের উপর ভর করে বিনিয়োগে এগিয়ে গিয়েছিলেন। স্যাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা যায়, ৫০টি বড় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে এফটিএক্সের দেনার পরিমান তিনশো কোটি ডলারের বেশি। এফটিএক্স-এ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করে কারা কারা অর্থ খুইয়েছেন তার সম্পূর্ণ তালিকা এখনও জানা যায়নি। তবে এই প্ল্যাটফর্মটির ইকুইটি ইনভেস্টর ছিলেন মার্কিন ফুটবলার টম ব্যাডি ও তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী, মডেল জিজেল বুন্ডশেন প্রমুখ। এফটিএক্স’র বিজ্ঞাপনেও দেখা গিয়েছিল তাঁদের। এই কোম্পানিকে সমর্থন জানাতে দেখা গিয়েছে কমেডিয়ান ল্যারি ডেভিড, টেনিস তারকা নাওমি ওসাকা, প্রাক্তন বাস্কেটবল তারকা শাকিল ও’নিল ও মার্কিন টিভি সিরিজ শার্ক ট্যাঙ্ক তারকা কেভিন ও’লিরিকে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন পর্ষদের রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশবাসীর ক্রিপ্টো হাতে রাখার ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে ইউক্রেন (১২.৭ শতাংশ) ও রাশিয়া (১১.৯ শতাংশ)। গত ফেব্রুয়ারি থেকে যুদ্ধ চলছে যাদের মধ্যে। তার পরে যথাক্রমে ভেনেজুয়েলা (১০.৩ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৯.৪ শতাংশ), কেনিয়া (৮.৫ শতাংশ) ও আমেরিকা (৮.৩ শতাংশ)। ২০টি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান সপ্তম। আর এর মধ্যে ১৫টিই উন্নয়নশীল দেশ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এর ব্যবহার বেড়েছে মূলত দ্রুত লেনদেনের সুবিধা থাকায় এবং মুদ্রার দামের পতন ও মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি এড়ানোর মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু তা তৈরি করছে বেশ কিছু আশঙ্কাও। যেমন এতে বাড়তে পারে ক্রিপ্টোর মাধ্যমে কর ফাঁকি, বেআইনি লেনদেন। প্রথাগত মুদ্রায় কমতে পারে নিয়ন্ত্রকের দখল। ক্রিপ্টোর ব্যবহার বিপুল বাড়লে তা আঘাত করতে পারে দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্বেও। বিশেষত যে সব দেশে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে নেমেছে, তাদের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টো বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কেমন ঝুঁকি, তা টের পাচ্ছে আমেরিকা!

সেই কবে ডায়না হেনরিকস লিখেছিলেন, ‘চোখের পলকে এক সুদর্শন রাজপুত্র কুৎসিত ব্যাঙে পরিণত হয়েছে।’

No comments:

Post a Comment