পেগাসাস, টিম জর্জ, এরপর কী?
ইজরায়েলি
নাগরিক তাল হানানকে হাতেনাতে ধরা অত সহজ ছিল না!
একসময় ইজরায়েলের
স্পেশাল ফোর্সের কর্মী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে দিমোম্যান ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি
কোম্পানি খোলেন। তাঁর ‘মোদিন’–এর বাড়ি ছিল ওই কোম্পানির ঠিকানা। প্রতিরক্ষা
মন্ত্রক থেকে রপ্তানির লাইসেন্সও জুটিয়ে ফেলেছিলেন। হানানের ছদ্মনাম ‘জর্জ। তাঁর
নেতৃত্বে পরিচালিত হয় ‘টিম জর্জ’ নামে একটি
সংস্থা। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দু’দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে
প্রভাব বিস্তারের কাজ করে চলেছে এই টিম জর্জ। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের তথ্য
সংগ্রহ, প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ানো এবং সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে জনমত গঠন করেছে। এভাবেই
টিম জর্জ বিশ্বের প্রায় ৩৩টি দেশে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে
ভারতও। ভুয়ো তথ্যকে অস্ত্র বানিয়ে তারা এতটাই দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করে যে তথ্যের
উৎস সম্পর্কে কেউই জানতে পারে না। করপোরেট দুনিয়ায়ও তারা একইভাবে কাজ করে চলেছে। লন্ডনের
রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সঙ্গেও দীর্ঘ সময় কাজ
করেছে তাল হানানের ‘টিম জর্জ’। ফেসবুক তথ্য কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বন্ধ করে দিতে
হয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। কিন্তু টিম জর্জ কাজ চালিয়ে গিয়েছে গোটা দুনিয়াকে
চোখে ধুলো দিয়ে।
টিম
জর্জের কর্মকাণ্ডের পিছনে একটি নিয়ন্ত্রণাতীত ক্রিয়া যুক্ত— ডিজিটাল প্রযুক্তির
ব্যবহার। সোশ্যাল মিডিয়াই হোক, আর টেলি-কমিউনিকেশনই হোক, বিভিন্ন
দেশের নাগরিকরা এখন রাষ্ট্রের এক অভূতপূর্ব গোপন জালে বাঁধা পড়েছেন। অজান্তে। গ্যাজেট
যত আধুনিক, হানার আশঙ্কা তত বেশি। ভারতের কথাই ধরুন। গোটা
দেশকে নড়িয়ে দিয়েছিল পেগাসাস। বিরোধীদের মোবাইলে আড়ি পাতার অভিযোগ। পেগাসাসই
প্রথম দেখিয়েছিল, জাতীয় স্বার্থে ব্যবহারের জন্য সংগৃহীত অতি-আধুনিক স্পাইওয়্যার
প্রযুক্তি দিয়ে অনৈতিকভাবে সাধারণ ব্যক্তি-নাগরিকের জীবনেও কীভাবে নজরদারি চালানো যায়।
এবার ‘টিম জর্জ’। ভোটের আগে ভুয়ো
প্রচারে জনমত প্রভাবিত করার অভিযোগ। কংগ্রেসের দাবি, মোদি
সরকার গত লোকসভা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে টিম জর্জের সাহায্য নিয়েছিল কি না,
তা স্পষ্ট করুক। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়
পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কংগ্রেসের দাবি, ট্যুইটারের মোদির ৬০
শতাংশেরও বেশি ফলোয়ার ভুয়ো। প্রায় ১৮ হাজার ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট বিজেপির হয়ে ভুয়ো
খবর ছড়াচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি
অব ইস্ট অ্যাংলিয়া-র স্কুল অব ল’-এর অধ্যাপক, যিনি তথ্যপ্রযুক্তি
নিয়ে গবেষণা করেন, সেই পল বার্নাল দেখিয়েছেন, নজরদারি ব্যবস্থা যে অজুহাতে চালু রাখা হয়, সেই ‘নিরাপত্তা’ই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নজরদারি
ব্যবস্থার জন্য! ২০১৩ সালে হার্ভার্ড ল’ জার্নাল-এ প্রকাশিত
নিবন্ধে নিল রিচার্ডস বলেছিলেন, তথ্য হল শক্তি বা ক্ষমতা।
কিন্তু এখানে ব্যক্তিমানুষের তথ্যের উপর রাষ্ট্রের সর্বময়তা এক ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা
তৈরি করছে, তা হল দমনের ক্ষমতা। গোপন নজরদারির প্রধান
বৈশিষ্ট্যই হল মানুষের উপর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো। এই কারণেই গণতান্ত্রিক
দেশের রাজনৈতিক শাসক বা স্বৈরতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনায়কদের ডিজিটাল নজরদারি
ব্যবস্থা খুবই পছন্দের। সেই সুযোগই নিয়েছে ‘টিম জর্জ’।
ইজরায়েলি
দলটির অনৈতিক কাজের নানা দিক ফাঁস হয়েছে দ্য কনসোর্টিয়াম অব জার্নালিস্টের আট
মাসের অনুসন্ধানে। ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান, ফ্রান্সের লা মঁদে, দেল স্পিগ্যাল, এল প্যারিসসহ বিশ্বের ৩০টি সংবাদমাধ্যমের
সাংবাদিকরা এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে কাজ করেছেন। ছদ্মবেশে টিম জর্জের কাছে
যান রেডিও ফ্রান্স, হারেৎজ ও দ্য মার্কারের তিন সাংবাদিক। তাঁদের
সাহায্য করেছে ফরাসি প্রতিষ্ঠান ফরবিডেন স্টোরিজ। তিন সাংবাদিকের সঙ্গে কথাবার্তার
গোপন ভিডিও ফুটেজে উঠে এসেছে টিম জর্জের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড।
রেডিও
ফ্রান্স, ইজরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ ও হিব্রুভাষী দ্য মার্কার–এর
তিন সাংবাদিক আফ্রিকার একটি দেশের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন— এমন পরিচয়ে টিম জর্জের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান। তাঁরা বলেন, যেকোনও উপায়ে
তাদের দেশের ভোট পিছিয়ে দিতে হবে। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ওই তিন
ছদ্মবেশী সাংবাদিকের সঙ্গে টিম জর্জের সদস্যদের একাধিক বৈঠক হয়। গোপনে যার ভিডিও তুলে
রাখা হয়। প্রথমে হানান ও তাঁর দলের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে মুখোমুখি হন তিন
সাংবাদিক। পরে ইজরায়েলের তেল আবিব শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ‘মোদিন’ শিল্পাঞ্চলে ‘টিম জর্জ’-এর কার্যালয়ে সশরীরে মিটিং হয়। শুরুতেই হানান তাঁর দলকে ‘গ্র্যাজুয়েট অব গভর্নমেন্ট এজেন্সি’ বলে পরিচয় দেন।
বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার এবং ‘মনস্তাত্ত্বিক
লড়াই’-এ দক্ষ তাঁর দল। বিশ্বব্যাপী তাঁদের অন্তত ছ’টি
কার্যালয় রয়েছে। হানানের ভাই জোহারসহ তাঁদের দলের চারজন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
জোহারকে গ্রুপের সিইও বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বৈঠকে হানান দাবি করেন, ‘আমরা এখন আফ্রিকায় একটি নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি। গ্রিস ও আরব আমিরশাহিতে
আমাদের দল রয়েছে। বিভিন্ন দেশে ৩৩টি নির্বাচনে কাজ করে ২৭টিতে সফল হয়েছি আমরা।’
ছদ্মবেশী
তিন সাংবাদিকের কাছে তাল হানান স্বীকার করেন, গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক
দল ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে জনমত তৈরি করাই তাদের কাজ। আফ্রিকা, লাতিন ও মধ্য আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত তাঁদের কাজ। টিম জর্জের হাতে
রয়েছে অত্যাধুনিক সফটওয়্যার প্যাকেজ— অ্যাডভান্সড ইমপ্যাক্ট মিডিয়া সলিউশনস (এআইএমএস)।
এই সফটওয়্যার বিশ্বব্যাপী ৩০ হাজারের বেশি প্রোফাইল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর
মাধ্যমে ফেসবুক, ট্যুইটার, লিংকডইন,
টেলিগ্রাম, জিমেল, ইনস্টাগ্রাম
ও ইউটিউবে হাজার হাজার ভুয়ো প্রোফাইল বানিয়ে ভুয়ো তথ্য প্রচার করা হয়। টিম জর্জ
সেই ভুয়ো প্রোফাইলের নাম দিয়েছে ‘অবতার’। কিছু কিছু অবতারের আবার অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম
অ্যামাজান ও এয়ারবিএনবিতে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এআইএমএস সফটওয়্যার ব্যবহারকারীকে ৫
হাজার পর্যন্ত বট তৈরির সুযোগ করে দেয়, যাতে দ্রুত ‘অপপ্রচার’ চালানো যায়। ১৭টি নির্বাচনে এই সফটওয়্যার
ব্যবহার করা হয়েছে। হানান জানিয়েছেন, এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড,
মেক্সিকো, সেনেগাল, ভারত
সহ প্রায় ২০টি দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো প্রচার চালানো হচ্ছে। কেউ টের পায়নি।
ইজরায়েলের
সংবাদমাধ্যম ‘হারেৎজ’ জানিয়েছে, ট্যুইটারে একটি অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল নাম ‘ক্যানাইলান’। দেখতে সাধারণ ব্যবহারকারী বলে মনে হয়।
শ্বেতাঙ্গ এক ব্যক্তির ছবি দেওয়া প্রোফাইলের মানুষটির বাস শেফিল্ডে বলে উল্লেখ করা
রয়েছে। কিন্তু আদতে এটি ভুয়ো প্রোফাইল। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চালাতে এআইএমএস
সফটওয়্যার দিয়ে এই ভুয়ো প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। ওই ভুয়ো প্রোফাইলের কাজ আড়ি পেতে
প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ও পরিকল্পনার আঁচ করা।
এ যুগের
গুপ্তচরবৃত্তি হয়তো এমনই! তথ্য-প্রযুক্তির খেলা। অনেক পথ পেরিয়ে তা আজকের ইজরায়েলে
পৌঁছেছে। অন্যদিকে,
ইন্টারনেটের যুগ হাট করে খুলে দিয়েছে জনতার গোপনীয়তা, গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ব্যক্তিগত তথ্য। গুপ্তচরবৃত্তিও হচ্ছে যন্ত্রের
সাহায্যে। কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরার অভিযোগ, ‘ওই ইজরায়েলি
সংস্থা যেভাবে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করে জনমত পাল্টানোর কথা জানিয়েছে, তার সঙ্গে বিজেপির আইটি শাখার কর্মপদ্ধতির ভীষণ মিল রয়েছে।’ তাঁর প্রশ্ন,‘আদানির কোন সংস্থা মোদি সরকারকে কত টাকা দিয়েছে? সেই
টাকা কোথায় ব্যবহার হয়েছে, পেগাসাসে না টিম জর্জে।’
২০১৭ সালে
প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইজরায়েল সফরে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর ‘এয়ার
ইন্ডিয়া ওয়ান’ বিমান তেল আভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের টারম্যাক ছোঁয়ার সঙ্গে
সঙ্গেই ভারতের বিদেশনীতিতে শুরু হয়েছিল একটি নতুন অধ্যায়। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে
মর্যাদা দিতে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিজেই চলে এসেছিলেন
বিমানবন্দরে। সেই ইজরায়েল সফরটির সাফল্য যে আসলে বিজেপির সাফল্য ছিল, ভারতের সাফল্য
নয়— তা বুঝতে আরও তিন বছর কেটে যায়। ফাঁস হয়ে যায় মার্কিন সংবাদপত্র ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর ‘দ্য
ব্যাটল ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’স মোস্ট পাওয়ারফুল সাইবারওয়েপন’
শীর্ষক প্রতিবেদনে। রিপোর্টে দাবি করা হয়, ২০১৭
সালের জুলাইয়ে মোদির সফরের সময়ই ইজরায়েল থেকে প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা নজরদারি
সরঞ্জাম কিনতে প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি
সই হয়েছিল। ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি সেই ‘প্রতিরক্ষা
চুক্তির’ তালিকায় অন্যতম ছিল ফোনে আড়ি পাতার স্পাইঅয়্যার
পেগাসাস। এই পেগাসাস ব্যবহার করেই বিভিন্ন বিরোধী নেতানেত্রীদের ফোনে আড়ি পাতা
হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে ২০২০ সালে। পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে যে বিতর্ক প্রবল ঝড়ে
পরিণত হয়েছে, সেই বিতর্কের অবসান কিন্তু এখনও হয়নি। বরং,
তা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে। এই আবহেই ‘টিম
জর্জ’-এর কারিকুরি ফাঁস। সেখানেও জড়িয়ে পড়েছে মোদির ভারত।
ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান অন্তত তেমনই জানিয়েছে।
মানুন
কিংবা না মানুন, মোদিজি যে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, আর যা বাস্তবে হচ্ছে—
তার নাম আসলে ‘সার্ভেল্যান্স ইন্ডিয়া’!
No comments:
Post a Comment