Monday, February 27, 2023

 

প্রতারক স্যাম, কিপ্টো দুনিয়ার পতন

অশরীরী মুদ্রার খেলা দেখেছিল আমেরিকা!

গত বছর ঠিক এই সময় ন্যাশনাল ফুটবল লিগ জিতেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস র‌্যামস। ফাইনালে হেরে গিয়েছিল সিনসিনাটি বেঙ্গলস। শুধু খেলা নয়, সেই রাতে প্রায় ১০ কোটি দর্শকের চোখ আটকে গিয়েছিল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলগুলির প্রচারিত বিজ্ঞাপনে। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে আমেরিকানরা দেখেছিলেন, খেলার ফাঁকে ফাঁকে ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সির ‘অবাক করা’ বিজ্ঞাপন। যেখানে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম ‘এফটিএক্স’র বিজ্ঞাপন। তাতে ক্রিপ্টোর নিরাপদ ও সহজ পথ হিসেবে পরিচিত করাতে আসরে নামানো হয় আমেরিকার বিখ্যাত কমেডিয়ান ল্যারি ডেভিডকে। কোকাকোলা কিংবা জেনারেল মোটরসের মতো প্রথম সারির কোম্পানিগুলিকে পিছনে ফেলে ডিজিটাল মুদ্রার এমন ‘দামী’ বিজ্ঞাপন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে যায়। তাহলে কি এতদিনে ডিজিটাল মুদ্রা সাবালক হয়ে উঠল? উত্তর পেতে বেশি সময় লাগেনি।

দুনিয়াজুড়ে এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা ক্রিপ্টোলজি ব্যবহার করে যে বৈদ্যুতিন মুদ্রা তৈরি হয়, তারই নাম ক্রিপ্টোকারেন্সি। এই মুদ্রা হাতে ছোঁয়ার উপায় নেই, এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র ভার্চুয়াল জগতে। ব্লকচেননামে এক প্রযুক্তি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে এই অশরীরী মুদ্রা। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি লেনদেন যেভাবে ডিজিটাল ব্লকের মাধ্যমে চিহ্নিত করা থাকে, সেই ব্লকচেনভেদ করা প্রযুক্তিগত ভাবে অসম্ভব, এমনটাই দাবি। এই আর্থিক ব্যবস্থায় ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা আমেরিকার ফেডারেল ব্যাঙ্কের মতো কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। যে কোনও দুই সংস্থা বা ব্যক্তির ক্রিপটোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট থাকলে তাঁরা কোনও নগদ ছাড়াই নিজেদের মধ্যে ক্রিপটোকারেন্সি লেনদেন করতে পারেন। কোনও বিপণির ক্রিপটোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট থাকলে সেখান থেকে গ্রাহকরা ক্রিপটোকারেন্সিতেই জিনিসপত্র কিনতে পারেন। ছাপোষা মানুষের ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে প্রচলিত ধারা মেনে বিনিয়োগ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। অর্থাৎ টাকা-ডলার-পাউন্ড ভাঙিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনে আশা রাখতে হবে যে এর মূল্য দিন দিন বাড়বে। নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই আর্থিক ব্যবস্থার পক্ষে দীর্ঘদিন ধরেই সওয়াল করে আসছেন পৃথিবীর প্রযুক্তিবিদদের একাংশ।

এই মুদ্রার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, এতে লেনদেনকারীর পরিচয় গোপন থাকে। তার বদলে ব্যবহার হয় সঙ্কেতলিপি। অর্থাৎ, অন্য ডিজিটাল লেনদেনে যেমন বলা যায়, তা কার কাছ থেকে কার কাছে গিয়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। শুধু জানা যায় এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যটিতে তার লেনদেন হয়েছে। তবে যদি এক্সচেঞ্জে এর লেনদেন (ট্রেডিং) করতে চান অথবা ক্রিপ্টোকারেন্সি ভাঙিয়ে টাকা হাতে নিতে চান, তা হলে পরিচয় গোপন রাখা শক্ত। বিনিয়োগের সুফল দ্রুত মিলবে, এমন আশ্বাসে ক্রেতা টেনেছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনার প্ল্যাটফর্মগুলি। তথাকথিত ক্রিপ্টো ওয়ালেটকে ব্যাঙ্কের সঞ্চয়ী হিসেবের মতো করে তৈরি করা হয়। এতে উচ্চ হারে সুদের অফারও রয়েছে। প্রচলিত মুদ্রার উপর যাঁরা আস্থা হারিয়েছেন, তাঁদের কাছে ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগের বাড়তি সুবিধা হল, লেনদেনের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী কোনও নিয়ন্ত্রক নিয়ে চিন্তা নেই।

কিন্তু অশরীরী মুদ্রার উপর মানুষের বিশ্বাস জমাট বাধার আগেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে প্রথাগত আর্থিক মডেলের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি। একের পর এক। গত বছর মে মাসে ‍দুই ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা টেরাইউএসডি ও লুনার ব্যাপক পতন হয়। প্রায় সব দর হারায় মুদ্রা দু’টি। রাতারাতি ক্রিপ্টোমার্কেট থেকে উধাও হয়ে যায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিপ্টো হেজ ফান্ড থ্রি অ্যারোজ ক্যাপিটাল। এরপরই দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার আবেদন করে ভয়েজার ডিজিটালসেলসিয়াস নেটওয়ার্ক। দু’টি প্রতিষ্ঠানই অর্থ ধার দিয়েছিল থ্রি অ্যারোজ ক্যাপিটালকে। ‘এফটিএক্স’-এর পতন হয় আরও কয়েক মাস পরে। গত নভেম্বরে। পরের মাসেই উত্তর আমেরিকার বাহামাস থেকে গ্রেপ্তার হন এফটিএক্সের প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল বেঞ্জামিন ব্যাংকম্যান-ফ্রিড। যাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় প্রতারণার অভিযোগ। আমেরিকার সিয়াটেল ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের অধ্যাপক টিম লিউংয়ের কথায়, আগামী দিনে আরও অনেক দুঃসংবাদ হাজির হবে। দুনিয়ায় ক্রিপ্টো শীতের বদলে ক্রিপ্টো বরফ যুগ আসার শঙ্কাই বেশি...

কিপ্টোকারেন্সির কিং স্যামের পতন যতটা হতাশাজনক, উত্থান তার চেয়েও অনেক নাটকীয়। ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ এফটিএক্স আত্মপ্রকাশ করে ২০১৯ সালে। এর আগে স্যাম ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার মার্কেটে শেয়ার লেনদেনকারী হিসেবে কাজ করতেন। অঙ্কে মেধাবী, ধারালো বুদ্ধির স্যাম শেয়ার ব্যবসায়ী পুরনো ব্যবসা ছেড়ে এসেছিলেন ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসায়। তাঁর সঙ্গে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন গুগলের প্রাক্তন কর্মী গ্যারি ওয়াং। তাঁদের হাত ধরেই এফটিএক্স বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জে পরিণত হয়েছিল। যার গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। প্রতিদিন এখানে এক হাজার কোটি ডলারের ক্রিপটোকারেন্সি লেনদেন হতো। মাত্র পাঁচ বছরে স্যাম আয় করেছিলেন ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তরুণ বিলিয়নিয়ারের তালিকায় নাম লেখান এই মার্কিন বিনিয়োগকারী। রাতারাতি ধনী হওয়ার গল্প তখন আমেরিকার ঘরে ঘরে। কী করেন, কী খান, কেমন জীবনযাপন—সব।

নিরামিষাশি স্যাম রাতে ঘুমোন মাত্র ৪ ঘণ্টা। ভিডিও গেম খেলা তাঁর নেশা। প্রিয় গেম লিগ অব লিজেন্ডস। কেন তিনি এই গেম খেলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করে একাধিক টুইটে স্যাম বলেছিলেন, ‘এই লড়াইয়ের খেলা খেলতে খেলতেই তার মাথা থেকে কোম্পানির প্রতিদিনের কোটি কোটি ডলারের ব্যবসার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।’ ফরচুন ম্যাগাজিন একসময় স্যামকে আগামীদিনের ওয়ারেন বাফেট হিসেবেও বলা শুরু করেছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে গত নভেম্বরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেউলিয়া হন কিপ্টোকারেন্সির এই বিলিয়নিয়ার। ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্মগুলি যখন কুখ্যাত, তখনও এফটিএক্স নিজেদের বিশ্বস্থ হিসেবে জানান দিত। রাজনীতিবিদদের তহবিলে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যোগান দিয়েছিলেন এমআইটির একসময়ের তুখোড় ছাত্র স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রিড। সবসময় দাবি করতেন, তাঁর অর্থ উপার্জনের একমাত্র কারণ ভালো কাজ করা। কিন্তু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন জানিয়েছে, ব্যক্তিগত সুবিধের জন্যই গ্রাহকদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নয়ছয় করেছেন তিনি। কমিশনের দাবি, স্যাম প্রতারণা শুরু করেছিলেন একেবারে প্রথম থেকেই।

‘দ্য উইজার্ড অব লাইজ’ গ্রন্থের লেখক ডায়না হেনরিকসের কথায়, গড়পড়তা বিনিয়োগকারীরা বিনাপ্রশ্নে স্যামকে বিশ্বাস করেছিলেন। একজন প্রতারকের সবচেয়ে অপরিহার্য গুণ, তারা এমনভাবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন যা কখনও টলে না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও নেতিবাচক তথ্য মানুষের জানা থাকলেও। এফএফটিএক্সের গ্রাহকদের কাছেও সংস্থাটিকে বিশ্বাস করার মতো পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ছিল না। তারপরও তারা স্রেফ বিশ্বাসের উপর ভর করে বিনিয়োগে এগিয়ে গিয়েছিলেন। স্যাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা যায়, ৫০টি বড় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে এফটিএক্সের দেনার পরিমান তিনশো কোটি ডলারের বেশি। এফটিএক্স-এ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করে কারা কারা অর্থ খুইয়েছেন তার সম্পূর্ণ তালিকা এখনও জানা যায়নি। তবে এই প্ল্যাটফর্মটির ইকুইটি ইনভেস্টর ছিলেন মার্কিন ফুটবলার টম ব্যাডি ও তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী, মডেল জিজেল বুন্ডশেন প্রমুখ। এফটিএক্স’র বিজ্ঞাপনেও দেখা গিয়েছিল তাঁদের। এই কোম্পানিকে সমর্থন জানাতে দেখা গিয়েছে কমেডিয়ান ল্যারি ডেভিড, টেনিস তারকা নাওমি ওসাকা, প্রাক্তন বাস্কেটবল তারকা শাকিল ও’নিল ও মার্কিন টিভি সিরিজ শার্ক ট্যাঙ্ক তারকা কেভিন ও’লিরিকে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন পর্ষদের রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশবাসীর ক্রিপ্টো হাতে রাখার ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে ইউক্রেন (১২.৭ শতাংশ) ও রাশিয়া (১১.৯ শতাংশ)। গত ফেব্রুয়ারি থেকে যুদ্ধ চলছে যাদের মধ্যে। তার পরে যথাক্রমে ভেনেজুয়েলা (১০.৩ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৯.৪ শতাংশ), কেনিয়া (৮.৫ শতাংশ) ও আমেরিকা (৮.৩ শতাংশ)। ২০টি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান সপ্তম। আর এর মধ্যে ১৫টিই উন্নয়নশীল দেশ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এর ব্যবহার বেড়েছে মূলত দ্রুত লেনদেনের সুবিধা থাকায় এবং মুদ্রার দামের পতন ও মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি এড়ানোর মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু তা তৈরি করছে বেশ কিছু আশঙ্কাও। যেমন এতে বাড়তে পারে ক্রিপ্টোর মাধ্যমে কর ফাঁকি, বেআইনি লেনদেন। প্রথাগত মুদ্রায় কমতে পারে নিয়ন্ত্রকের দখল। ক্রিপ্টোর ব্যবহার বিপুল বাড়লে তা আঘাত করতে পারে দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্বেও। বিশেষত যে সব দেশে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে নেমেছে, তাদের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টো বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কেমন ঝুঁকি, তা টের পাচ্ছে আমেরিকা!

সেই কবে ডায়না হেনরিকস লিখেছিলেন, ‘চোখের পলকে এক সুদর্শন রাজপুত্র কুৎসিত ব্যাঙে পরিণত হয়েছে।’

Friday, February 24, 2023

 

আছে যুদ্ধআছে মৃত্যুআছে বাণিজ্য

নো আর্মস বিজনেস উইদাউট এনিমিস ইজ পসিবল!

শত্রু ছাড়া যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধ ছাড়া অস্ত্র ব্যবসাও হয় না। তাই প্রথমে শত্রু বানাওএরপর যুদ্ধ বাঁধাও। আর তারপর অস্ত্র ব্যবসার খেলা শুরু। আসলে ‘যুদ্ধ’ সফল ব্যবসার ভিন্ন নাম, বলেছিলেন সার্বিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক ম্লাডেন ডরদেভিচ।

একদিকে রাশিয়াঅন্যদিকে ইউক্রেন। বিপুল শক্তিধর রাশিয়ার মোকাবিলায় ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে আমেরিকা ও তার পশ্চিমী মিত্র দেশগুলি। কিয়েভ যত বেশি বিদেশি অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছেপাল্লা দিয়ে হামলার তেজ বাড়াচ্ছে মস্কো। এই দুইয়েরই যোগফল— দিনে দিনে যুদ্ধ আরও রক্তক্ষয়ীআরও ধ্বংসাত্মক হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই বৈশাখে ভরা পৌষ মাস একটি অংশেরইতারা অস্ত্র ব্যবসায়ী!

ইউক্রেন যুদ্ধ লাগিয়ে’ দিয়ে এরমধ্যেই বড়সড় একটি অস্ত্রবিক্রির হাট বানিয়ে ফেলেছে আমেরিকা। এই হাটের অস্ত্র ক্রেতা এখন গোটা ইউরোপের দেশগুলি। আর অস্ত্র বিক্রেতা আমেরিকা একাই। মহামারীর ধাক্কা সামলে জেনারেল ডায়নামিকস, রেথিয়নলকহিড মার্টিনের মতো সংস্থাগুলির পোয়াবারো। সামরিক ব্যয়ের উন্মাদনা বাড়াতে অস্ত্র কোম্পানিগুলি গোটা দুনিয়ায় ক্রেমলিন জুজুকে কাজে লাগাচ্ছে। ইউক্রেন হয়ে উঠেছে ‘সোনার খনি’।

ফিরে চলুন, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। আমেরিকায় তখন মন্দার ঢেউ। ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া এই মহামন্দায় আমেরিকার শিল্প উৎপাদন কমে যায় ৪৭ শতাংশ। জিডিপির সঙ্কোচন হয় ৩০ শতাংশ। বেকারত্ব পৌঁছায় ২৫ শতাংশে। এর প্রভাব পড়ে আমেরিকার রপ্তানি আয়ে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমেরিকার অংশগ্রহণ কমে যায় ৬৭ শতাংশ। ত্রিশের দশকের শেষদিকে আমেরিকা এই মহামন্দা থেকে নিস্তার পেতে শুরু করেফিরতে থাকে মন্দা পূর্ববর্তী অবস্থায়। তবেএই প্রক্রিয়া ছিল তুলনামূলক বেশ ধীরগতিতে। এর মধ্যেই আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। পাল্টে যায় অর্থনৈতিক সূচকগুলি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান আক্রমণ করে পার্ল হারবারে। আমেরিকাও সরাসরি জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি ও এসবের ফরমাশ পেয়ে আমেরিকার অস্ত্র শিল্প ফুলেফেঁপে ওঠে।

যুদ্ধকালীন পাঁচ বছরের মধ্যে আমেরিকার জিডিপি ৮৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে। বেকারত্বের হার ১৪ শতাংশ থেকে কমে নেমে যায় ২ শতাংশের নীচে। এই অভিজ্ঞতা আমেরিকার একটি স্বতন্ত্র অস্ত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেয়। মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা বুঝতে পারেন, যুদ্ধই বদলে দিতে পারে অর্থনীতির গতিমুখ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতায় আমেরিকা আরও কয়েকটি নতুন নতুন যুদ্ধে জড়িয়েছে। পঞ্চাশের দশকে আমেরিকা জড়িয়ে পড়ে কোরিয়ান যুদ্ধেপরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। সত্তরের দশকে তুঙ্গে ওঠে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে জড়ায় আমেরিকা। এই অর্ধশতাব্দীতে টানা যুদ্ধাবস্থায় আমেরিকার অর্থনীতির একটা বড় ক্ষেত্র উঠে অস্ত্র শিল্প। অনন্ত যুদ্ধে’ জড়িয়ে থাকা তাই আমেরিকার অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি। তা আজও টের পাওয়া যায়।



সম্প্রতি করোনার আঘাতে জর্জরিত অর্থনীতি চাঙা করতে আমেরিকার সামনে দরকার ছিল ইউক্রেনের মতো একটি বাজার। কে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলকে ইউক্রেনকে আশ্বস্ত করে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিল— পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের দাপটে সেইসব প্রশ্ন আজ গৌণ। এর নেপথ্য অবশ্যই আমেরিকার অস্ত্রবিক্রির দূরভিসন্ধি। ইউক্রেনে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আবারও অস্ত্র বিক্রির হাট বসিয়েছে আমেরিকা। আর রমরমা হয়ে উঠেছে মার্কিন অস্ত্রের বাজার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঠিকই বলেছেন, আমেরিকানদের এখন বিশ্রামের সময় নয়!

ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নানা ধরনের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদি কেনার জন্য আমেরিকার কাছে ছুটে গিয়েছে। বিভিন্ন দেশ তাদের অস্ত্র চাহিদার তালিকা আমেরিকার কাছে পেশ করেছে। লকহিড মার্টিন কোম্পানি নির্মিত ৮৮টি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে জার্মানি। আমেরিকার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও কিনতে চেয়েছে। ইউরোপের আরও এক দেশ পোল্যান্ড। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচিত এই দেশটি জরুরিভিত্তিতে আমেরিকার কাছ থেকে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম রিপার ড্রোন কেনার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এছাড়া পূর্ব ইউরোপের আরও বেশ কিছু দেশ বিমান বিধ্বংসী স্টিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। ফ্রান্সসুইডেননরওয়েএস্তোনিয়ার মতো দেশগুলি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে শুরু করেছে। এসব অনুরোধ ও দাবি পূরণের জন্য পেন্টাগন একটি কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে অস্ত্র রপ্তানি ৪.৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন সংকটের কারণে এখন অস্ত্র রপ্তানি ১৯ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির সদস্য সিমন ওয়েজেম্যানের মতেইউরোপ এখন সমরাস্ত্র কেনার নতুন হটস্পট।

প্রশ্ন একটাই, এই যুদ্ধে জয়ী কে? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবশ্যই অস্ত্র ব্যবসায়ীরা!

 


নীরবতার সংস্কৃতি, ভয়ের সংস্কৃতি

কাশ্মীর যেন শান্তির নিকেতন। তিন দশকের অন্ধকার পেরিয়ে উপত্যকায় এখন আলোর ঝলকানি। গত বছর এই অক্টোবরেই বলেছিলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অরুণ মিশ্র।

দেশের প্রাক্তন বিচারপতি সেদিন বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের জন্যই জম্মু-কাশ্মীরে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। সেই যুগ, রাজ্য দ্বিখণ্ডীকরণ ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের মধ্য দিয়ে যার শুরু, তা পুরোপুরি অমিত শাহের মস্তিষ্কপ্রসূত। সেই সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিক, সাহসী ও যুগান্তকারী।

অমিত শাহের বন্দনা ঠিক সেই সময় করা হয়েছিল, যখন উপত্যকার ঘড়ি পিছিয়ে গিয়েছিল বত্রিশটা বছর। ফিরে এসেছিল টার্গেটেড কিলিং-এর দিন। আপেল সংগ্রহ শিকেয় তুলে দলে দলে বিহার-ছত্তিশগড়ের শ্রমিকদের ফিরে যেতে হয়েছিল ভিটেতে। শাহ-বন্দনার এক সপ্তাহের মধ্যে খুন হয়েছিলেন ১১ জন। সেই সংখ্যা বেড়েছে ক্রমশ। বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল গোটা কাশ্মীর উপত্যকা। তবুও প্রশ্নহীন আনুগত্যের নমুনা পেশ করতে উপত্যকায় ‘শান্তি’ খুঁজে পেয়েছিলেন অরুণ মিশ্র।

আসলে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর জম্মু-কাশ্মীরে কোনটা সত্য-কোনটা অসত্য, কোনটা রঞ্জিত-কোনটা অতিরঞ্জিত বোঝার কোনও উপায় আর নেই। কারণ, উপত্যকাজুড়ে নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের আর কোনও চিহ্নই নেই। কে করবে বিরোধিতা? মোদি-অমিত শাহরা বলেছেন, কাশ্মীরে গণতন্ত্র তৃণমূল স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। সুসময় স্রেফ দুহাত দূরে। অপেক্ষায়। স্বপ্ন দেখিয়েছেন কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্মকেও। বলেছেন, আগের প্রজন্মের মতো আপনাদের আর কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে না। চাকরি দেব। মুখে হাসি ফোটাব। সোনালি দিন উপহার দেব। ঘটা করে তা প্রচারও হচ্ছে। দেশ-বিদেশকে জানানো হচ্ছে, কীভাবে বিশ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প একদা উপদ্রুত এই ভূখণ্ডে রূপায়ণ হচ্ছে। সরকারি এই তথ্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে কে? তা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামান্তর। কাশ্মীরিয়ৎ’-এর কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হয়ে গিয়েছে কবেই! কাশ্মীরে এখন নীরবতার সংস্কৃতি, ভয়ের সংস্কৃতির বীজ বপন হচ্ছে। সেটাই ভবিষ্যৎ।

যাঁরা দাবি করেন, সত্তর বছরে দেশ উচ্ছন্নে গিয়েছে, যা কিছু উন্নয়ন গত আট বছরে এবং তাঁরাই এই কাশ্মীরের রূপকার। সেই মোদি-অমিত শাহের এখন একমাত্র অ্যাজেন্ডা ভূস্বর্গকে আবদুল্লা-মুফতি-গান্ধীমুক্তকরা। পরোক্ষে সেই কাজ করে চলেছে ডিলিমিটেশন কমিশন। কারও কোনও ওজর-আপত্তি ধোপে টিকছে না। লক্ষ্য, হিন্দুত্ববাদের প্লাবন ঘটিয়ে ক্রমে কাশ্মীরের ভারতীয়করণ। কিন্তু এভাবে কি কাশ্মীরিদের দেশের মূল স্রোতে ফেরানো যায়?

খোঁজ নিন, দেশের কোথাও না কোথাও কাশ্মীরি শাল-বিক্রেতারা লুণ্ঠিত হচ্ছেন, কোথাও ভারতমাতা ও রামের নামে জয়ধ্বনি দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে— তাঁরা কাশ্মীরি এবং মুসলিম। হিন্দু পণ্ডিতদের তাঁরাই পিটিয়ে ঘরছাড়া করেছেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে জানিয়েছিল, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলসসিনেমা রিলিজের পর কাশ্মীরি মুসলিমদের প্রতি হিন্দু ভারতীয়দের একাংশের মনোভাব আরও কঠোর হয়েছে। কাশ্মীরের দুর্দশার জন্য কারা দায়ী, কীভাবে দায়ী, কোন রাজনীতির বোড়ে হয়েছে উপত্যকা, সেসব পূর্ণ সত্যএই সিনেমায় ঠাঁই পায়নি। এই উপাখ্যান রচনার উদ্দেশ্য উগ্র-হিন্দুত্ববাদের পালে বাতাস জোগানো। অনেক হিন্দু পরিবারের কাছেই এই সিনেমা ক্যাথারসিস ঘটাবে, যন্ত্রণা দেবে— এটাই দস্তুর। নির্মাতার সেই লক্ষ্য আঠারো আনা সফল। তর্কাতীতভাবে সত্যএটাই। নইলে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে কর মকুবের এমন ধুম দেখা যেত না। লক্ষ্মীর কৃপাধন্য হওয়ার পাশাপাশি পরিচালক নিজেকে শাসকপ্রিয়ও করে তুলেছেন। তাঁকে মাথায় তুলে নাচানাচি তারই প্রমাণ। গেরুয়া শিবির চায় কাশ্মীর ফাইলস জাতীয় মন্দ ইতিহাসকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক স্বার্থ গুছিয়ে নিতে। বলেছিলেন, সোপিয়ানের আপেল ব্যবসায়ী রশিদ আহমেদ।

২০০৫ সাল। দ্য কাশ্মীর ফাইলসতখন কোথায়? মুক্তি পেয়েছিল পারজানিয়া। ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গায় এক পার্শি পরিবারের সন্তান হারানোর রক্তাক্ত স্মৃতি সিনেমার মধ্য দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল। আমেদাবাদে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার ঠিক আগে, পরিচালক রাহুল ঢোলাকিয়াকে মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনতলব এবং সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয়, স্থানীয় বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গি অনুমতিদিলে তবেই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিটি দেখানো যাবে! গুজরাতের তৎকালীন সরকার এই ঝামেলায় কোনও হস্তক্ষেপ করেনি। ফলে, সিনেমাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না ঢোলাকিয়ার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি সত্যউদ্‌ঘাটনের জন্য দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর দলের সাংসদদের ছবিটি দেখতে উৎসাহিত করেছেন, সেই তিনিই ছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। আসলে এই নেতারা এবং তাঁদের পক্ষপাতদুষ্ট স্তাবক দল কোনওদিনই ইতিহাসের তেতো সত্যের মুখোমুখি হতে চায় না।

নরেন্দ্র মোদির নতুনভারতের প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র প্রচলিত ইসলামোফোবিকঘৃণার রাজনীতিকেই উসকে দিতে চায়, যা ইতিমধ্যে গোটা দেশের সমাজকে দ্রুত গ্রাস করছে। স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গি মানেই মুসলিমএই আখ্যান লেপটে গিয়েছে ভূস্বর্গের মাটিতেও। মেরুকরণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক নির্ভুলতা অন্বেষণের সময় কোথায়? ইসলামি চরমপন্থার উচ্চকিত জোয়ার এবং হিন্দু জাগরণ’-এর মাঝে গোত্তা খেয়ে একটা গোটা প্রজন্ম যেন অপরকরার ভাবনাতেই মগ্ন। অপরকে ভয় এবং ঘৃণার চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। অতএব, সেনাবাহিনীর হাতে কাশ্মীরকে ছেড়ে দেওয়া।কমপ্লিট ইমিউনিটি ফর দি আর্মি। এটাই কাশ্মীরের নিউ নর্মাল

কাশ্মীর নিয়ে ভারত কী ভাবে, আর ভারত নিয়ে কাশ্মীর কী ভাবে, এই আলোচনা এখনও এ দেশে ঠিকমতো শুরুই হয়নি। সেই ৯০ সাল থেকে বছর বছর সেনা অত্যাচারের অভিযোগে উপত্যকা তোলপাড় হয়েছে। গাওয়াকাদাল, হান্ডোয়ারা, সোপোর, বিজবেহরা, কুপওয়ারা— অগুনতি অভিযোগ। এমন অভিযোগও প্রমাণিত, পদোন্নতির অদম্য তাড়নায় নিরপরাধ কাশ্মীরিদের হত্যার পর জঙ্গিতকমা সাঁটা হয়েছে। কেউ ফেক এনকাউন্টার’-, কেউ সেনা অত্যাচারে, কেউ পুলিসের হেফাজতে, কেউ অতর্কিতে ছোড়া গ্রেনেডে, কেউ জঙ্গি হানায়, কত-শত স্রেফ বেপাত্তা! কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুর্দশা যতটা সত্য’, কাশ্মীরি মুসলমানদের দুর্দশাও ততটাই। নফরত ফয়লানা বহত আসান হ্যায়, প্যায়ার বাটনা মুশকিল। সুপারহিট ফিল্ম বজরঙ্গি ভাইজান-এর সেই সাড়া জাগানো লাইনের সারবত্তা টের পাওয়া যায় কাশ্মীরের মাটিতে দাঁড়ালেই। সত্যই তো, হিংসা ছড়ানো খুব সহজ কাজ, কিন্তু ভালোবাসা ভাগ করে নেওয়াটাই চাপের...

কাশ্মীরের ক্রমাবনতির দায় কেউ ঝেড়ে ফেলতে পারে না। একদিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত, অন্যদিকে কেন্দ্র-রাজ্যের ক্ষমতাসীনদের অনুসৃত নীতি, আমলাশাহি, সেনা ও আধা-সামরিক বাহিনী কিংবা পুলিস-গোয়েন্দা প্রত্যেকে নিজের মতো করে কাশ্মীরনামে গিনিপিগকে হিংস্র পশুতে পরিণত করেছে। যে-রাজ্য আটের দশকের শেষার্ধ পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই ভূস্বর্গ ছিল। যেখানকার মানুষ ছিল শান্তিপ্রিয়, ঘরকুনো, অলস ও আয়েশি। খুন-খারাপির ধারকাছ দিয়েও যাদের চলাফেরা ছিল না। রাতারাতি কীভাবে তারা রক্তের হোলিতে মত্ত হয়ে ওঠে?

গোটা দেশে হিজাব, হালাল, আজান বিতর্ক যত তীব্র হচ্ছে, ধর্মগুরুরা যত জোরে গণহত্যার হাঁক পাড়ছেন, ততই তীব্র হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন এবং গভীর হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ফাটল। কাশ্মীর উপত্যকাতেও সেই অনুরণন পরিলক্ষিত। অনুকূল পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতির পরিবেশ তৈরি কীভাবে সম্ভব? কে করবেন লগ্নি, কিংবা ব্যবসা, যদি একদিকে সেনাবাহিনীর চাপ ও অন্যদিকে উগ্রপন্থী হামলা অব্যাহত থাকে? কোনও অঞ্চলের যুবশক্তির আস্থা হারিয়ে ফেললে তাকে আর উন্নয়ন-কাজে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। এ সবই প্রধানমন্ত্রী জানেন, কিন্তু তবু তাঁকে রাজনীতির প্রয়োজনেই শূন্যগর্ভ ঘোষণা চালিয়ে যেতে হয়।

কাশ্মীরে পর্যটকদের ঢল যে স্বাভাবিকতার নমুনা নয়, কবুল না করলেও দেশের সরকার তা বোঝে। নিরাপত্তায় ছিটেফোঁটা ঢিলেমিতে তাই তারা রাজি নয়। স্বাভাবিককাশ্মীর আজও তাই নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বন্দি। প্রশ্ন হল, অবশিষ্ট ভারত স্বাভাবিক না হলে কাশ্মীর কি স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারে? সংখ্যালঘুর প্রতি বৈষম্য’-র যে ছবি জ্বলজ্বলে, যার উল্লেখ সরকারকে ক্ষিপ্ত করে, সেই মানসিকতার বদল না হলে কাশ্মীর কী করে স্বাভাবিক হবে?

কে না জানে, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হানা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোলযোগ চিরকালই হাত ধরে পাশাপাশি চলেছে। যখনই ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের, কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা হয়েছে, তখনই অতর্কিত ভাবে কেঁপে উঠেছে উপত্যকা। দাম দিয়েছেন উপত্যকার বিপন্ন সাধারণ মানুষ। এই ভাবেই হয়তো কাশ্মীরি মানুষের নিরাপত্তা বারবার বিনষ্ট হবে, ভারতীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমতার দাবি বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ওদিকে গোয়েন্দা-জঙ্গি-বিচ্ছিন্নতাবাদীর দুষ্টচক্র যেমন বহাল তবিয়তে ছিল, তেমনই থাকবে। কাশ্মীরের ভাগ্যে যা-ই থাকুক, একের পর এক বালাকোট কিংবা পুলওয়ামার ঘটনা হয়তো ঘটেই চলবে। লোকসভা ভোটের আগে এমন আশঙ্কাও তাড়া করছে ভূস্বর্গকে।

এটা যেন স্থায়ী নকশাযার ক্ষয়ও নেই, লয়ও নেই। নকশাটি অবশ্য সুপরিচিত!

 

পড়শি দেশে ভোটের খেলা শুরু

মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় মহাঋষি কৌটিল্য কূটনৈতিক আচার-আচরণ নিয়ে যা লিখেছিলেন, আজও তা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত।

কৌটিল্যের বিধান, কোনও দেশের রাজ প্রতিনিধি অন্য দেশের খবরাখবর নিজের দেশে পাঠাতে পারেন। প্রয়োজনে গোয়েন্দাগিরিও চালাতে পারেন। কিন্তু সে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারেন না। অন্য দেশের সঙ্গে নিজের দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট থাকাই রাষ্ট্রদূতের বড় দায়িত্ব। কৌটিল্যের সেই বাণীর প্রতিফলন ছিল ১৬৪৮ সালের ‘ওয়েস্ট ফেলিয়া’ সন্ধিতেও। যার কথা প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিব হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর একাধিক বইয়ে প্রশংসাসূচকভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, কোনও দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের উপর নিষেধাজ্ঞা। সেই পথেই ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, কূটনীতিকরা অন্য দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এবং সে দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদে চুক্তিভুক্ত দেশগুলিকে যে কোনও বিদেশি কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার অধিকার দিয়েছে।

আমেরিকা নিজের দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো কখনও সহ্য করেনি। আর তাই ভিয়েনা কনভেনশনের বহু যুগ আগে, ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড সেকভিলকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছিল আমেরিকা। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার লর্ড সেকভিলকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকেই অপসারিত করতে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী সময়েও আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দায়ে আমেরিকা বহু বিদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। ২০২১ সালে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে ১০ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল মার্কিন প্রশাসন। এই বহিষ্কারের তালিকা বেশ লম্বা। গোটা দুনিয়াকেই এই শক্তি দিয়েছে ভিয়েনা কনভেনশন।

অথচ, বাংলাদেশে নির্বাচনের মেঘ ঘনালেই আমেরিকা, জাপান, পশ্চিমের দেশগুলি সক্রিয়তা বাড়াতে থাকে! নড়ে বসে চীন, রাশিয়াও। শুধু নির্বাচন তো নয়, বাংলাদেশে যে কোনও রাজনৈতিক সঙ্কট এলেই তৎপর হতে দেখা গিয়েছে সে দেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যার শুরু। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে পরবর্তীতে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন, এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরে প্রতিটি রাজনৈতিক ওঠাপড়ায়, কমবেশি সব নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি শক্তির সক্রিয়তা প্রকাশ্যে এসেছে। আবার কোনও ক্ষেত্রে তা থেকে গিয়েছে গোপনে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে বিতর্ক!

ঘটনার সূত্রপাত গত ১৪ ডিসেম্বর সকালে। অত্যন্ত গোপনে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকার শাহিনবাগে নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে যান। প্রায় এক দশক ধরে সাজেদুল নিখোঁজ। সাজেদুলের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক’–এর সমন্বয়কারী। শাহিনবাগের ওই বাড়িতে যাওয়ার আগে থেকেই মায়ের কান্নানামে আরেকটি সংগঠন সেখানে জড়ো হয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে ফাঁসি হওয়া সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের পরিবার নিয়ে এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। তাদের দাবি, জিয়ার আমলে ও সামরিকবাহিনীর সদস্যদের আসলে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

বাড়ির ভিতরে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের পরিবারের সঙ্গে আধ ঘণ্টার বেশি আলোচনার পর বেরিয়ে আসেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গাড়িতে ওঠার সময় তাঁকে ঘিরে ধরে স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করে মায়ের কান্না-র সদস্যরা। স্মারকলিপিতে দাবি করা হয়, জিয়ার আমলে ফাঁসি হওয়া সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের হত্যার ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তে আমেরিকার সহযোগিতা চাই। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাঁদের কথা না শুনেই তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে যান। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্বেগ জানাতে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানান। উদ্বেগ প্রকাশ করে ওয়াশিংটনও। আর এই ঘটনা ঘিরে আসরে নেমে পড়ে রাশিয়া। মস্কোয় বসে আমেরিকার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রুশ বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। মারিয়ার অভিযোগ, ঘটনাটি মার্কিন কূটনীতিকের তৎপরতার প্রত্যাশিত ফল। যিনি বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষার নামে ক্রমাগত দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি তাঁর ব্রিটেন ও জার্মান কূটনৈতিক মিশনের সহকর্মীরা একই লক্ষ্যে যুক্ত থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার বিষয়ে খোলামেলাভাবে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এই টানাপড়েনে বোঝাই মুশকিল, বাংলাদেশে আসন্ন ভোটে লড়াইয়ে নেমেছেন কারা?

বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন কূটনীতিক নাক গলিয়েছেন কি না সেই প্রশ্নের থেকেও সংবাদকর্মীদের ব্যস্ততায়, গ্রামীণ চায়ের আড্ডায়, শহুরে হোয়াটসঅ্যাপের গোপন চ্যাটে পিটার হাস এখন নজরকাড়া চরিত্র হয়ে উঠেছেন। হাসের ভঙ্গিতে সাহস ও আকর্ষণ রয়েছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর মিট দ্য অ্যাম্বাসেডরনামে এক অনুষ্ঠানে হাস পরিষ্কার করেই জানিয়েছিলেন, তিনি ও তাঁর সরকার কী চাইছে। তাঁদের চাওয়ার ফর্দ বড় নয়। তবে যথেষ্ট স্পর্শকাতর উপাদান রয়েছে তাতে। বিশেষ করে আমেরিকা চাইছে, ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের পাশে থাকুক বাংলাদেশ। এ জন্য তারা দু’টি সামরিক চুক্তিও করতে চায়, যা তাদের মতে প্রয়োজন। এসব প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য কিছুটা বিব্রতকর। কারণ, একই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রয়েছে চীন। রয়েছে ভারতও। সকলের স্বার্থ এক রকম নয়। বাংলাদেশ এখন কী করবে? কার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে?

বিশ্বজুড়ে চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও তার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। দ্রুতগতিতে এই তল্লাটে মেরুকরণ ঘটছে। এ রকম জটিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে বাংলাদেশ কীভাবে কোনও একক শক্তির বন্ধুহতে পারে? অবস্থা এমনও নেই, বাংলাদেশ পক্ষপাতহীন অবস্থান নেবে। বাংলাদেশের রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগের কথা আমেরিকার অজানা নয়। সে তো শ্রীলঙ্কা হতে চাইবে না। তাকে আইএমএফের কাছে যেতে হবে। এ রকম টানাপোড়েনে নিরপেক্ষথাকা কঠিন। নিরপেক্ষতাএকটা সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু তার জন্য অর্থনৈতিক হিম্মত থাকতে হয়। নিরপেক্ষ থাকতে শক্তিশালী স্বরাজ লাগে। জাতীয় ঐকমত্য দরকার হয়। বাংলাদেশের সেসব নেই। সমস্যাটা কোথায়, পোড় খাওয়া কূটনীতিক পিটার হাস নিশ্চিত জানেন। নিজে থেকেই বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ওয়াশিংটন-ঢাকা বন্ধুত্বে কোনও বাধা হওয়ার কথা নয়। যদিও বিষয়টি অত্যন্ত জটিল।

কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখন আর দু’টি দেশের সাধারণ সৌজন্যে আটকে নেই। ৪৭ বছরে তা ক্রমাগত কাছে এসেছে। উভয়ের এখনকার বন্ধন বহুমাত্রিক এবং অনেক গভীর। চীনের শত শত কোম্পানি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে পরিকাঠামোগত যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে চীনের বিপুল সাহায্য রয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রেও তাই। একাত্তরে স্বীকৃতি দিতে দেরি করে ভুল করেছিল বেজিং। পরে সেটা পুষিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে চীনের প্রতিপক্ষ আমেরিকার সঙ্গে মাখামাখি করা কঠিন। রয়েছে তাইওয়ান প্রশ্নও। বাংলাদেশ তাইওয়ানের পৃথক স্বাধীন সত্তা স্বীকার করে না। অথচ, আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তাইওয়ানকে সুরক্ষা দেওয়া। তবে বাংলাদেশে চীনের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবেদন দুর্বল। ভারত বা আমেরিকা সেই জায়গায় অনেক এগিয়ে। তাই বাংলাদেশকে শুধু চীনের সঙ্গে নয়, তিন সীমান্তের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।

তাহলে বাংলাদেশ কোন দিকে হাত বাড়াবে? এই অঙ্কই কষছেন পিটার হাস। তাদের হাতে রয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ, রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং নানা মিশনের প্রভাব-প্রতিপত্তি। আমেরিকা ও ইইউ দেশগুলি এখন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার। বিশাল সংখ্যায় প্রবাসীরা রয়েছেন এসব দেশে। যাঁদের আয়ে চলছে দেশে লাখ লাখ পরিবার। বিপরীতে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, চীন তার বন্ধুদের এককভাবে বাঁচাতে পারে না। নেপালিদেরও একই রকম অবস্থা। অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়ে পাকিস্তানকেও আইএমএফের কাছে ছুটতে হয়েছে। শুধু বেজিংয়ের উপর ভরসা করে থাকতে পারেনি। আর এও সত্য অর্থনৈতিক দুরবস্থায় নিরপেক্ষতা কোনও কাজের কৌশল নয়। সুইজারল্যান্ড যা পারে, বাংলাদেশ তা পারবে না। সময়ও পাল্টাচ্ছে দ্রুত। নতুন বিশ্ববাস্তবতার মুখে সুইডেন-ফিনল্যান্ডের মতো দেশকেও নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এসব বাস্তবতা অগ্রাহ্য করবে কীভাবে? পিটার হাস হয়তো তাই এই রকম দুর্বল গ্রন্থিগুলিতেই বাজি ধরেছেন!

সবসময়ই ছোট ইঁদুর শিকার করা বিড়ালের পক্ষে সহজ। আর এই শিকার বিড়াল তার নিজের প্রয়োজনেই করে। ফলে বাংলাদেশের আসন্ন সংসদীয় নির্বাচন ঘিরে যে শক্তিশালী দেশগুলির খবরদারি বাড়বে— তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

 @saptahikbartaman

প্রযুক্তির আতঙ্ক

তাহলে কি গুগলের আয়ু ফুরিয়ে এল?

গত নভেম্বরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি বাজারে আসার পর এমন আশঙ্কাই তাড়া করছে জি-মেল নির্মাতা পল বাখাইটকে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা এই চ্যাটজিপিটি এক বা দুই বছরের মধ্যে গুগলের ব্যবসা ধ্বংস করতে পারে বলে বাখাইটের আশঙ্কা। এরই মধ্যে মাসে ১০ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী নিয়মিত চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছেন।

পল বাখাইট জানিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির কারণে ভবিষ্যতে সার্চ ইঞ্জিনের রেজাল্ট পেজের (এসইআরপি) অস্তিত্বই থাকবে না। আর এখান থেকেই গুগল সবচেয়ে বেশি আয় করে। ব্রাউজারের সার্চ বারে ব্যবহারকারী কোনও প্রশ্ন লিখলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানিয়ে দেবে চ্যাটজিপিটি। শুধু তাই নয়, প্রাসঙ্গিক তথ্য ও লিঙ্কযুক্ত করে ফলাফল সংক্ষিপ্তভাবে তুলেও ধরবে। ফলে গুগল সার্চ ইঞ্জিনের ফলাফল দেখে একাধিক ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে না।

চ্যাটজিপিটি প্রোগ্রামিং ভাষা দিয়ে এমন চ্যাটবট তৈরি করা যেতে পারে যে, অনেক সময় এ প্রান্তের ব্যবহারকারী হয়তো বুঝতেও পারবেন না, যে অপর প্রান্তে আদতে কোনও মানুষ নেই। এই চ্যাটবটগুলি গ্রাহক পরিষেবা, ই-কমার্স এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মতো জনপ্রিয় অ্যাপগুলিতে ব্যবহার করা যাবে। অনলাইনভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষার মতো আরও অ্যাপ্লিকেশনেও ব্যবহার করা যেতে পারে চ্যাটজিপিটি। এআই প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ রিচার্ড ডিভের কথায়, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বে কর্মশক্তির ২০ শতাংশ চ্যাটজিপিটির দখলে চলে যেতে পারে। চ্যাটজিপিটি কোনও পাগলামি নয়। এটা প্রযুক্তির নতুন বিপ্লব।

চ্যাটজিপিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মানুষের মতো লেখা বা টেক্সট তৈরি করার ক্ষমতা। নির্ভুল শব্দচয়ন ও ভাষা ব্যবহার করায় চ্যাটবটের লেখা পড়ে বোঝার উপায় নেই সেটা মানুষ না যন্ত্র লিখেছে। ই-মেল, স্কুল-কলেজের রচনা, নিবন্ধ কিংবা নিত্যদিনের পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য আমরা যা কিছু মগজ খাঁটিয়ে লিখি, তার সবই এখন লিখে ফেলছে যন্ত্র। চ্যাটজিপিটি নীরবে বদলে দিচ্ছে সব কিছু। কবিতা কিংবা নাটকের চিত্রনাট্য রচনার মতো প্রতিভানির্ভর সৃষ্টিশীল কাজও এই প্রযুক্তি দখল করে নিতে পারে এমনও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে তার চেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, চ্যাটজিপিটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য বড় বিপদ হতে পারে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গণতন্ত্রের লড়াইয়ে মানুষের জায়গা দখল করবে। আর তা করবে ভোটার আকর্ষণের দিক থেকে ততটা নয়, যতটা করবে লবিংয়ের দিক থেকে। এমনই মনে করছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞানী নাথান ই স্যান্ডার্স ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের লেকচারার ব্রুস শ্নেইরের মতো বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে তাঁরা লিখেছেন, চ্যাটজিপিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় কারও হয়ে স্থানীয় খবরের কাগজের সম্পাদককে ই-মেল লিখতে পারে। প্রতিদিন অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত লাখ লাখ সংবাদ কিংবা নিবন্ধের লিঙ্কে, ব্লগে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে দ্রুত মন্তব্য করতে পারে। তা করতে পারে নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা ধরেই। ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে রাশিয়ার সংস্থা রাশিয়ান ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি কোটি কোটি ডলার খরচ করে শত শত কর্মী নিয়োগ করে যেভাবে প্রচার চালিয়েছিল, সেই ধরনের অর্থ ও লোকবল ব্যয় না করেই চ্যাটজিপিটি একই কাজ করতে পারে অনায়াসে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সক্রিয় হচ্ছে তাতে কোন মেসেজটি আসল অর্থাৎ মানুষের পাঠানো, আর কোনটি স্বয়ংক্রিয় তা বেছে আলাদা করাই কঠিন হয়ে পড়ছে।

চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে এবার যে কারও ইনবক্স স্বয়ংক্রিয় কায়দায় ই-মেল দিয়ে ভরে ফেলা যাবে। চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্র দিয়ে বেছে বেছে টার্গেট করে করে যে কারওকে বিভ্রান্ত করা যাবে। আমরা যখন এই কাজ করি তখন তাকে বলি লবিংবা প্রভাব খাটানো। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কেতাদুরস্ত ভাষায় মেসেজ লেখা ও সেগুলিকে টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজের জন্য অনেক পেশাদার সংস্থা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। এখন চ্যাটজিপিটি-সজ্জিত লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলি ড্রোনের মতো প্রচারাস্ত্র প্রয়োগ করবে।

এটি এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা কি না রাজনৈতিক নেটওয়ার্কগুলির গতিপ্রকৃতিও বুঝতে পারে। চ্যাটজিপিটির টেক্সচুয়াল জেনারেশন ক্ষমতা ব্যবহার করে এই সিস্টেম নেতাদের কে কোন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কতটা প্রভাবশালী, কোন নেতা করপোরেট কর নীতি আর কোন নেতা সামরিক ব্যয় সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণে প্রভাব খাটাতে সক্ষম তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের করে ফেলতে পারে। একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকা নেতাদের সক্ষমতা ও প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এটি দিয়ে হ্যাক করা এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা সম্ভব।

ভয় একটাই— দিন যত যাবে ততই এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষিত হবে। আর ততই গণতন্ত্র বিপদে পড়বে!

Thursday, February 23, 2023

পেগাসাস, টিম জর্জ, এরপর কী?

ইজরায়েলি নাগরিক তাল হানানকে হাতেনাতে ধরা অত সহজ ছিল না!

একসময় ইজরায়েলের স্পেশাল ফোর্সের কর্মী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে দিমোম্যান ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানি খোলেন। তাঁর মোদিন’–এর বাড়ি ছিল ওই কোম্পানির ঠিকানা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে রপ্তানির লাইসেন্সও জুটিয়ে ফেলেছিলেন। হানানের ছদ্মনাম ‘জর্জ। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় টিম জর্জনামে একটি সংস্থা। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দু’দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের কাজ করে চলেছে এই টিম জর্জ। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের তথ্য সংগ্রহ, প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ানো এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে জনমত গঠন করেছে। এভাবেই টিম জর্জ বিশ্বের প্রায় ৩৩টি দেশে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে ভারতও। ভুয়ো তথ্যকে অস্ত্র বানিয়ে তারা এতটাই দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করে যে তথ্যের উৎস সম্পর্কে কেউই জানতে পারে না। করপোরেট দুনিয়ায়ও তারা একইভাবে কাজ করে চলেছে। লন্ডনের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সঙ্গেও দীর্ঘ সময় কাজ করেছে তাল হানানের ‘টিম জর্জ’। ফেসবুক তথ্য কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বন্ধ করে দিতে হয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। কিন্তু টিম জর্জ কাজ চালিয়ে গিয়েছে গোটা দুনিয়াকে চোখে ধুলো দিয়ে।

টিম জর্জের কর্মকাণ্ডের পিছনে একটি নিয়ন্ত্রণাতীত ক্রিয়া যুক্ত— ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার। সোশ্যাল মিডিয়াই হোক, আর টেলি-কমিউনিকেশনই হোক, বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এখন রাষ্ট্রের এক অভূতপূর্ব গোপন জালে বাঁধা পড়েছেন। অজান্তে। গ্যাজেট যত আধুনিক, হানার আশঙ্কা তত বেশি। ভারতের কথাই ধরুন। গোটা দেশকে নড়িয়ে দিয়েছিল পেগাসাস। বিরোধীদের মোবাইলে আড়ি পাতার অভিযোগ। পেগাসাসই প্রথম দেখিয়েছিল, জাতীয় স্বার্থে ব্যবহারের জন্য সংগৃহীত অতি-আধুনিক স্পাইওয়্যার প্রযুক্তি দিয়ে অনৈতিকভাবে সাধারণ ব্যক্তি-নাগরিকের জীবনেও কীভাবে নজরদারি চালানো যায়। এবার টিম জর্জ। ভোটের আগে ভুয়ো প্রচারে জনমত প্রভাবিত করার অভিযোগ। কংগ্রেসের দাবি, মোদি সরকার গত লোকসভা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে টিম জর্জের সাহায্য নিয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট করুক। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কংগ্রেসের দাবি, ট্যুইটারের মোদির ৬০ শতাংশেরও বেশি ফলোয়ার ভুয়ো। প্রায় ১৮ হাজার ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট বিজেপির হয়ে ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে।

ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়া-র স্কুল অব ল’-এর অধ্যাপক, যিনি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেন, সেই পল বার্নাল দেখিয়েছেন, নজরদারি ব্যবস্থা যে অজুহাতে চালু রাখা হয়, সেই নিরাপত্তাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নজরদারি ব্যবস্থার জন্য! ২০১৩ সালে হার্ভার্ড লজার্নাল-এ প্রকাশিত নিবন্ধে নিল রিচার্ডস বলেছিলেন, তথ্য হল শক্তি বা ক্ষমতা। কিন্তু এখানে ব্যক্তিমানুষের তথ্যের উপর রাষ্ট্রের সর্বময়তা এক ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা তৈরি করছে, তা হল দমনের ক্ষমতা। গোপন নজরদারির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল মানুষের উপর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো। এই কারণেই গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক শাসক বা স্বৈরতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনায়কদের ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা খুবই পছন্দের। সেই সুযোগই নিয়েছে টিম জর্জ

ইজরায়েলি দলটির অনৈতিক কাজের নানা দিক ফাঁস হয়েছে দ্য কনসোর্টিয়াম অব জার্নালিস্টের আট মাসের অনুসন্ধানে। ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান, ফ্রান্সের লা মঁদে, দেল স্পিগ্যাল, এল প্যারিসসহ বিশ্বের ৩০টি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে কাজ করেছেন। ছদ্মবেশে টিম জর্জের কাছে যান রেডিও ফ্রান্স, হারেৎজ ও দ্য মার্কারের তিন সাংবাদিক। তাঁদের সাহায্য করেছে ফরাসি প্রতিষ্ঠান ফরবিডেন স্টোরিজ। তিন সাংবাদিকের সঙ্গে কথাবার্তার গোপন ভিডিও ফুটেজে উঠে এসেছে টিম জর্জের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড।

রেডিও ফ্রান্স, ইজরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ ও হিব্রুভাষী দ্য মার্কারএর তিন সাংবাদিক আফ্রিকার একটি দেশের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন এমন পরিচয়ে টিম জর্জের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যান। তাঁরা বলেন, যেকোনও উপায়ে তাদের দেশের ভোট পিছিয়ে দিতে হবে। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ওই তিন ছদ্মবেশী সাংবাদিকের সঙ্গে টিম জর্জের সদস্যদের একাধিক বৈঠক হয়। গোপনে যার ভিডিও তুলে রাখা হয়। প্রথমে হানান ও তাঁর দলের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে মুখোমুখি হন তিন সাংবাদিক। পরে ইজরায়েলের তেল আবিব শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মোদিন শিল্পাঞ্চলে টিম জর্জ-এর কার্যালয়ে সশরীরে মিটিং হয়। শুরুতেই হানান তাঁর দলকে গ্র্যাজুয়েট অব গভর্নমেন্ট এজেন্সিবলে পরিচয় দেন। বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার এবং মনস্তাত্ত্বিক লড়াই-এ দক্ষ তাঁর দল। বিশ্বব্যাপী তাঁদের অন্তত ছ’টি কার্যালয় রয়েছে। হানানের ভাই জোহারসহ তাঁদের দলের চারজন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। জোহারকে গ্রুপের সিইও বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বৈঠকে হানান দাবি করেন, ‘আমরা এখন আফ্রিকায় একটি নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি। গ্রিস ও আরব আমিরশাহিতে আমাদের দল রয়েছে। বিভিন্ন দেশে ৩৩টি নির্বাচনে কাজ করে ২৭টিতে সফল হয়েছি আমরা।

ছদ্মবেশী তিন সাংবাদিকের কাছে তাল হানান স্বীকার করেন, গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে জনমত তৈরি করাই তাদের কাজ। আফ্রিকা, লাতিন ও মধ্য আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত তাঁদের কাজ। টিম জর্জের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক সফটওয়্যার প্যাকেজ— অ্যাডভান্সড ইমপ্যাক্ট মিডিয়া সলিউশনস (এআইএমএস)। এই সফটওয়্যার বিশ্বব্যাপী ৩০ হাজারের বেশি প্রোফাইল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর মাধ্যমে ফেসবুক, ট্যুইটার, লিংকডইন, টেলিগ্রাম, জিমেল, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে হাজার হাজার ভুয়ো প্রোফাইল বানিয়ে ভুয়ো তথ্য প্রচার করা হয়। টিম জর্জ সেই ভুয়ো প্রোফাইলের নাম দিয়েছে অবতার। কিছু কিছু অবতারের আবার অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজান ও এয়ারবিএনবিতে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এআইএমএস সফটওয়্যার ব্যবহারকারীকে ৫ হাজার পর্যন্ত বট তৈরির সুযোগ করে দেয়, যাতে দ্রুত অপপ্রচারচালানো যায়। ১৭টি নির্বাচনে এই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। হানান জানিয়েছেন, এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, মেক্সিকো, সেনেগাল, ভারত সহ প্রায় ২০টি দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো প্রচার চালানো হচ্ছে। কেউ টের পায়নি।

ইজরায়েলের সংবাদমাধ্যম ‘হারেৎজ’ জানিয়েছে, ট্যুইটারে একটি অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল নাম ক্যানাইলান। দেখতে সাধারণ ব্যবহারকারী বলে মনে হয়। শ্বেতাঙ্গ এক ব্যক্তির ছবি দেওয়া প্রোফাইলের মানুষটির বাস শেফিল্ডে বলে উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু আদতে এটি ভুয়ো প্রোফাইল। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চালাতে এআইএমএস সফটওয়্যার দিয়ে এই ভুয়ো প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। ওই ভুয়ো প্রোফাইলের কাজ আড়ি পেতে প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ও পরিকল্পনার আঁচ করা।

এ যুগের গুপ্তচরবৃত্তি হয়তো এমনই! তথ্য-প্রযুক্তির খেলা। অনেক পথ পেরিয়ে তা আজকের ইজরায়েলে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, ইন্টারনেটের যুগ হাট করে খুলে দিয়েছে জনতার গোপনীয়তা, গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ব্যক্তিগত তথ্য। গুপ্তচরবৃত্তিও হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরার অভিযোগ, ‘ওই ইজরায়েলি সংস্থা যেভাবে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি করে জনমত পাল্টানোর কথা জানিয়েছে, তার সঙ্গে বিজেপির আইটি শাখার কর্মপদ্ধতির ভীষণ মিল রয়েছে।’ তাঁর প্রশ্ন,‘আদানির কোন সংস্থা মোদি সরকারকে কত টাকা দিয়েছে? সেই টাকা কোথায় ব্যবহার হয়েছে, পেগাসাসে না টিম জর্জে।’

২০১৭ সালে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইজরায়েল সফরে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর ‘এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ান’ বিমান তেল আভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের টারম্যাক ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের বিদেশনীতিতে শুরু হয়েছিল একটি নতুন অধ্যায়। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে মর্যাদা দিতে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিজেই চলে এসেছিলেন বিমানবন্দরে। সেই ইজরায়েল সফরটির সাফল্য যে আসলে বিজেপির সাফল্য ছিল, ভারতের সাফল্য নয়— তা বুঝতে আরও তিন বছর কেটে যায়। ফাঁস হয়ে যায় মার্কিন সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর দ্য ব্যাটল ফর দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট পাওয়ারফুল সাইবারওয়েপনশীর্ষক প্রতিবেদনে। রিপোর্টে দাবি করা হয়, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে মোদির সফরের সময়ই ইজরায়েল থেকে প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা নজরদারি সরঞ্জাম কিনতে প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই হয়েছিল। ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি সেই প্রতিরক্ষা চুক্তিরতালিকায় অন্যতম ছিল ফোনে আড়ি পাতার স্পাইঅয়্যার পেগাসাস। এই পেগাসাস ব্যবহার করেই বিভিন্ন বিরোধী নেতানেত্রীদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে ২০২০ সালে। পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে যে বিতর্ক প্রবল ঝড়ে পরিণত হয়েছে, সেই বিতর্কের অবসান কিন্তু এখনও হয়নি। বরং, তা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে। এই আবহেই টিম জর্জ’-এর কারিকুরি ফাঁস। সেখানেও জড়িয়ে পড়েছে মোদির ভারত। ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান অন্তত তেমনই জানিয়েছে।

মানুন কিংবা না মানুন, মোদিজি যে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, আর যা বাস্তবে হচ্ছে— তার নাম আসলে ‘সার্ভেল্যান্স ইন্ডিয়া’!

 @saptahikbartaman

‘স্পেয়ার’ হ্যারির জীবন!

নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে ইংল্যান্ডের যুবরাজ হ্যারির আত্মজীবনী ‘স্পেয়ার’।

বিতর্ক বইটির নামেও। রাজকুমারের নিজের বয়ানে, রাজপরিবারের প্রথম সন্তান হচ্ছেন এয়ারবা উত্তরাধিকারী, যাঁর জন্য সংরক্ষিত থাকে সিংহাসন। আর বাকি সন্তানরা স্পেয়ারবা বাড়তি। অর্থাৎ উপস্থিত থাকা ছাড়া যাঁদের কোনও কাজে লাগে না। তিনি নিজেও সেই রকমই এক স্পেয়ারবা বাড়তি, লিখেছেন হ্যারি। আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছেন স্পেয়ারহওয়ার নানা সমস্যার কথা। হ্যারির এই বই নিয়ে প্রবল অস্বস্তিতে রাজপরিবার।

হবেই বা না কেন? বেলাগাম জীবনযাপনের নিরন্তর অভিযোগ থেকে স্ত্রী মেগানকে নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। তিনি ব্রিটেনের রাজপরিবারের অচলায়তন ভেঙে দেওয়া বজ্রনির্ঘোষ, কারও কাছে তিনি বেয়াদপ, যিনি মানেন না কোনও নিয়ম। নিজের বাবা রাজা তৃতীয় চার্লস, মা প্রিন্সেস ডায়ানা, ভাই উইলিয়াম, মেগানের সঙ্গে বিয়ে থেকে শুরু করে রাজপরিবারের গোপন আর চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে এই বই। যে বই জানাচ্ছে, চার্লস-ক্যামিলার বিয়ে হোক চাননি হ্যারি-উইলিয়াম। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, সৎমা হিসেবে ক্যামিলা খুব খারাপ হবেন। হ্যারি লিখেছেন, ক্যামিলাকে বিয়ে করতে বাবা চার্লসকে কাতর অনুরোধ করেছিলেন তিনি ও তাঁর বড় দাদা উইলিয়াম। এমনকি বিয়ের আগে তাঁরা ক্যামিলার সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। তবে বাবার সুখের কথা চিন্তা করে তাঁরা একসময় ক্যামিলাকে মেনে নেন।

সেই প্রিন্স হ্যারি বই লিখবেন, তাতে মা ডায়ানা জড়িয়ে থাকবে তা তো স্বাভাবিক। আত্মজীবনী স্পেয়ার জুড়ে প্রিন্স হ্যারি তাঁর জীবনে মা ডায়ানা না থাকার কষ্টের কথা বলেছেন। পাঠককে তাঁর মায়ের গাড়ি দুর্ঘটনার দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন হ্যারি। লিখেছেন, বাবা চার্লসই তাঁর কাছে মায়ের দুর্ঘটনার খবর প্রথম জানান। শুনেই ভেঙে পড়েছিলেন প্রিন্স হ্যারি। কিন্তু ওই রকম একটি কঠিন মুহূর্তে তাঁকে একবারের জন্যও জড়িয়ে ধরেননি চার্লস। মায়ের মৃত্যুর পর মাত্র একবার কেঁদেছিলেন প্রিন্স হ্যারি। দেহ সমাহিত করার সময়। কেনসিংটন প্যালেসে সেদিন ফুল ছড়ানো রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে হাঁটার সময় নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। হ্যারি বলছেন, ‘আমাদের মায়ের কাছে তখন ৫০ হাজার ফুলের তোড়া। আমরা সেখানে মানুষের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলাম...। যাঁদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলাম, তাঁদের হাত তখন ভেজা। চোখের জলে তাঁদের হাত ভিজে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম, সবাই মায়ের কত কাছের মানুষ ছিলেন।

হ্যারি লিখেছেন, ১৯৯৭ সালে প্যারিসে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত মা ডায়ানার মৃত্যুর শোক কাটানোর উপায় খুঁজতে তিনি অপার্থিব ক্ষমতা’-এর অধিকারী এক মহিলার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। হ্যারির বয়স তখন ১২। ওই অলৌকিক ক্ষমতাশালী মহিলা হ্যারিকে বলেছিলেন, তুমি এমন জীবন-যাপন করছ যেটি তিনি পারেননি। তুমি এমন জীবন-যাপন করছ যেটি তোমার মা চেয়েছিলেন।

বাবার গল্পের স্মৃতিচারণা করে হ্যারি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, চার্লস তাঁকে একবার বলেছিলেন, ‘আমি যে তোমার আসল বাবা কি না, কে জানে? সম্ভবত তোমার বাবা আসলে ব্রডমুরেই রয়েছেন! বাবার এমন কথাকে তেতো স্বাদেরকৌতুক হিসেবেই দেখেছেন হ্যারি। বাবা তো হাসি থামাতেই পারছিলেন না। যদিও সেটা মজা পাওয়ার মতো কোনও কৌতুক ছিল না। কারণ, ঠিক তখনই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল আমার প্রকৃত বাবা আমার মায়ের প্রাক্তন প্রেমিকাদের একজন। মেজর জেমস হিউইট। হিউইট ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অশ্বারোহী দলের অফিসার ছিলেন।

হ্যারি জানিয়েছেন, যখন তাঁর বয়স ১৭, তখন কেউ একজন তাঁর হাতে কোকেন তুলে দিয়েছিলেন। এরপর আরও কয়েকবার কোকেন সেবনের কথা স্বীকার করেছেন হ্যারি। যদিও এটা তাঁর ভালো লাগেনি। ইটন কলেজে পড়া অবস্থায় কলেজের বাথরুমে প্রথম গাঁজা সেবন করেছিলেন। একবার ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে ম্যাজিক মাশরুমও খেয়ে দেখেছিলেন। তার থেকেও আরও খারাপ লেগেছে ওই বয়সে তাঁর যৌনসম্পর্ক। বইয়ে সে কথা গোপন করেননি। লিখেছেন, ১৭ বছর বয়সে তাঁর চেয়ে বড় এক মহিলার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক হয়েছিলেন। কিন্তু এটা তাঁর কাছে অপমানজনকছিল। কারণ, ওই মহিলা তাঁর সঙ্গে এমন ব্যবহার করছিলেন, যেন হ্যারি তাঁর অবৈধ প্রেমিক

আত্মজীবনীতে প্রিন্স হ্যারি লিখেছেন, অভিনেত্রী মেগান মার্কেলকে বিয়ে করায় দুই ভাইয়ের সম্পর্ক ভেঙে যায়। একপর্যায়ে দু’জনের মধ্যে এই সংঘাত চরম আকার নেয়। হ্যারি লেখেন, উইলিয়াম একদিন আমার কলার চেপে ধরে, গলার চেন ছিঁড়ে ফেলে এবং ...মেঝেতে ছিটকে ফেলে দেয়। আর যাঁকে ঘিরে এত লড়াই, সেই মেগানই তাঁকে গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করেছে। অকপটে বলেছেন প্রিন্স হ্যারি। সমালোচক মহলে কান পাতলেই শোনা যায়, ব্রিটেনে রাজপরিবারের কঠোর নিয়মকানুনের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন মা ডায়ানাও। নিজের আচরণে বার বার ইঙ্গিত দিতেন দ্রোহের। ছোট ছেলে বরাবরই হেঁটেছেন সেই পথে। অভিযোগ, রাজপরিবার তো বটেই, গোটা ব্রিটেনের সম্মানই নাকি ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তবে হ্যারি মানেই তো শিরোনাম।

 

 @saptahikbartaman

যে লিগ্যাসি বইতে হবে ক্যামিলাকে

বিবিসিকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে মনে আটকে রাখা গুমোট সত্যটাকে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন প্রিন্সেস!

বলেছিলেন, ‘ওয়েল, দেয়ার ওয়াজ থ্রি অব আস ইন দিস ম্যারেজ, সো ইট ওয়াজ আ বিট ক্রাউডেড। এই বিয়েতে আসলে মানুষ আমরা তিনজন, এজন্যই একটু জনাকীর্ণ আর কী। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এমনিতে সন্তানদের ব্যক্তিগত কোনও সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারের পর আর চুপ থাকতে পারেননি। দু’জনকে আলাদা করে চিঠি পাঠিয়ে লিখেছিলেন, ‘তোমাদের সামনে শুধু একটা রাস্তাই খোলা— বিচ্ছেদ। প্রিন্সেস না হয়েও রাজপরিবারের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রিন্সেস আর কেউ নন— ডায়ানা। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ পূর্ণ রানি হতেন তিনিই। কিন্তু সেই সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল ১৯৯৫ সালেই।

ক্যামিলা পার্কার ও ব্রিটিশ সেনা অফিসার অ্যান্ড্রু পার্কারের প্রথম দেখা ১৯৬৫ সালে। ক্যামিলা তখন ১৮। দু’জনের সম্পর্ক ছিল অনেকটা অন অ্যান্ড অফ। ক্যারোলিন গ্রাহামের ক্যামিলা অ্যান্ড চার্লস: দ্য লাভ স্টোরিবইতে বলা হয়েছে, ক্যামিলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় অ্যান্ড্রু একাধিক প্রেম করেছেন। একসময় রাজকন্যা অ্যানের সঙ্গেও প্রেম শুরু করেন অ্যান্ড্রু। রাজকন্যা অ্যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একমাত্র কন্যা। এটা দেখে প্রতিশোধপরায়ণহয়ে রানির বড় ছেলে প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে প্রেম শুরু করেন ক্যামিলা। ১৯৭০ সালে ক্যামিলাকে প্রথম দেখেছিলেন চার্লস। প্রথম দেখায় আত্মবিশ্বাসী ক্যামিলার প্রেমে পড়েন চার্লস। প্রায় ১৮ মাস চলেছিল তাঁদের চুটিয়ে প্রেম।

চার্লস প্রেমিকা ক্যামিলার সঙ্গে সম্পর্কের নাম দিয়েছিলেন গভীর, শুদ্ধ বন্ধুত্ব। ডায়ানাও শুরুতে ক্যামিলাকে সেভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু উইমেনস ইন্সটিঙ্কট’–এ ধরা পড়ে যান ক্যামিলা। চার্লস আর ক্যামিলার মধ্যে কী চলছে বুঝতে সময় লাগে না ডায়ানার। তাই ১৯৮১ সালে চার্লসের সঙ্গে বিয়েতে ক্যামিলার উপস্থিতি অস্বস্তি বাড়িয়েছিল ডায়ানার। রাজকীয় বিয়ের পরও ক্যামিলাকে ভুলতে পারেননি চার্লস। এমনকি ডায়ানা আর চার্লসের দুই সন্তান হওয়ার পরও। রাজপরিবারের নানা নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে ডায়ানার জনগণের রানিহয়ে ওঠাকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও ভালোভাবে নেননি। ডায়ানার ব্যক্তিত্বের ছটায় রাজপরিবারের আর সবাই, আর সমস্ত কর্মকাণ্ড যেন ম্লান হয়ে পড়ছিল।

ডায়ানা: হার ট্রু স্টোরি ইন হার ওন ওয়ার্ডবইতে অ্যান্ড্রু মর্টন জানিয়েছেন, বিয়ের চার বছর পর ১৯৮৫ সালে একটি পার্টিতে দেখা হয় ডায়ানা ও ক্যামিলার। ক্যামিলাকে দেখেই ডায়ানা বলেছিলেন, ‘আই নো হু ইউ আর। ডোন্ট ট্রিট মি লাইক অ্যান ইডিয়ট।আপনি কে আমি জানি, আমাকে বোকা ভাববেন না। শুনে ক্যামিলা বলেছিলেন, আপনি বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মানুষটির স্ত্রী। আপনি প্রিন্সেস অব ওয়েলস। আপনার সুন্দর দু’টি বাচ্চা রয়েছে। আর কী চান?’ উত্তরে ডায়ানা বলেছিলেন, ‘আই ওয়ান্ট মাই হাজবেন্ড। আমার স্বামীকে চাই...

দ্য ডাচেস: দ্য আনটোল্ড স্টোরিবইয়ে পেনি জুনর বলেছেন, চার্লসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ডায়ানার কাছে কোনও দিন দুঃখ প্রকাশ করেননি ক্যামিলা। যখন ডায়ানা আর চার্লসের বাগদান হয়, নিজের চেয়ে ১৪ বছরের ছোট ডায়ানাকে ক্যামিলা বলেছেন, ‘আ মাউস (একটা ইঁদুর)। আর বিয়ের কয়েক বছর পর বলেছেন, ‘দ্য ম্যাড কাউ (পাগলা গোরু)। ক্যামিলা জনসম্মুখে এও বলেছেন, ‘আমি সারা জীবন একজনকেই ভালোবেসেছি। আর ডায়ানার জীবনে ছিল অসংখ্য পুরুষ।এদিকে ডায়ানাকে প্রকাশ্যে কখনও ক্যামিলা সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। তবে ডায়ানার মৃত্যুর পর তাঁর বান্ধবী সিমোন সিমোন্স ডায়ানা: দ্য লাস্ট ওয়ার্ডবইতে লিখেছেন, ক্ষুব্ধ ডায়ানা নাকি একবার ক্যামিলাকে রটওয়েলার’ (বিশেষ একপ্রকার কুকুর) বলে ফেলেছিলেন।

১৯৯৯ সালে প্রথম ক্যামিলা এবং চার্লস হাতে হাত রেখে জনসম্মুখে আসেন। এরও ছয় বছর পর ২০০৫ সালে বিয়ে করেন এই জুটি। সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন রানি এলিজাবেথ। যদিও বিয়ের পর একাধিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিল, ‘আ রয়্যাল কাপল, পিপল কুড নেভার লাভ। এক রাজকীয় দম্পতি, জনগণ যাঁদের কখনোই ভালোবাসতে পারবে না।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথই বছরের শুরুতে ঘোষণা করেন, তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী হবেন প্রিন্স চার্লস। ক্যামিলার উপাধি নিয়ে অনেক কানাঘুষা ছিল। কারণ, রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী বিচ্ছেদ হয়েছে, এমন কেউ রানি হতে পারবেন না। এলিজাবেথই ক্যামিলার উপাধি ঠিক করে দেন কুইন কনসর্ট। পুরোপুরি রানি নন, রাজার জীবনসঙ্গী।

ক্যামিলা রানি কি রানি নন, তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ, ডায়ানার অনুপস্থিতিই রাজপরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। যে লিগ্যাসি ক্যামিলাকে বইতে হবে আজীবন!

 @saptahikbartaman

অন্তরে ডায়ানাই!

কেউ তাঁকে ভোলেনি। তা-ই যেন বারবার জানান দিতে আসা।

আজও ব্রিটেনের জনপ্রিয় যুবরানিকে মনে রেখে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বহু মানুষ। রেখে যান ফুলের স্তবক, মোমের আলো। ডায়ানার মৃত্যুর ২৫ বছর পূর্তিতে এটাই ছিল কেনসিংটন প্যালেসের গেটের ছবি।

১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট প্যারিসে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল যুবরানির প্রাণ। তারপর থেকে মানুষের কাছে কেনসিংটন প্যালেস আর তার চারপাশের বাগানটাই হয়ে উঠেছে ডায়ানার স্মৃতির প্রতীক। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাম্রাজ্যেবহু প্রেম সংক্রান্ত তুমুল বিতর্ক, ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অসম্ভব টানাপড়েন সত্ত্বেও জনমানসে যুবরানি ডায়ানার ভাবমূর্তি এতটুকু টাল খায়নি। উল্টে, দিনে দিনে প্রচারের আলো থেকে অনেকটা দূরে সরে যেতে হয়েছে ডায়ানার প্রাক্তন স্বামী যুবরাজ চার্লসকে। শুধু যুবরাজ নন, ব্রিটিশ আমজনতা কখনওই ভালো চোখে দেখেনি চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলাকেও। তারা তাঁকে যুবরানি হিসেবে ভাবেওনি।

অথচ, রানির দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর নিয়ম অনুযায়ী বড় ছেলে সেই যুবরাজ চার্লসই হয়েছেন ইংল্যান্ড-সহ ১৫টি কমনওয়েলথ দেশের রাজা। কুইন কনসর্টহয়েছেন তাঁর স্ত্রী ক্যামিলা। তাঁর মাথায় আজ রানির খেতাব। ইতিহাসের কুৎসিত পরিণতি হয়তো একেই বলে!

গোটা দুনিয়া জানে, দিনের পর দিন তাঁকে কীভাবে ঠকানো হয়েছিল। বলে গিয়েছেন ডায়ানা নিজেই। ক্যামিলা আমাকে বলল ও চার্লসের সঙ্গে শিকারে যেতে চায়। আমি কিছু না বুঝেই ওদের অনুমতি দিয়েছিলাম। ক্যামিলাকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলাম। ভাবিনি পরে আমাকে ঠকতে হবে। ...একদিন একটি পার্সেল খুলে দেখি তার মধ্যে রয়েছে একটা ব্রেসলেট। শুনি চার্লস সেটা উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছিলেন ওঁর প্রেমিকা ক্যামিলা পার্কার বোলসকে। সেটা দেখেই আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। ও (চার্লস) যেন আমার মাথাটাই সেদিন কেটে ফেলেছিল। এত রেগে গিয়েছিলাম সেদিন। কতটা ঠকে গিয়েছি ভেবে ঠান্ডায় যেন জমে গিয়েছিলাম। অবশ হয়ে পড়েছিলাম।

১৯৭১-এ চার্লস ও ক্যামিলার দেখা হয়। লুসিয়া স্যান্টা ক্রুজ নামে এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁদের পরিচয়। খুব তাড়াতাড়িই তাঁরা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথার সঙ্গে মাঝে মধ্যেই তাঁরা দেখা করতেন। দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালিও হয়েছিল। দুবছর ধরে ক্যামিলার সঙ্গে গভীর প্রেম থাকা সত্ত্বেও ১৯৮১-র ২৯ জুলাই সুন্দরী ডায়ানাকেই বিয়ে করেছিলেন প্রিন্স চার্লস। অন্যদিকে, ক্যামিলাও বিয়ে করে ফেলেন তাঁর প্রাক্তন প্রেমিককে।

রয়্যাল ফ্যামিলির জীবনীকার পেনি জুনোর দ্য ডাচেস: দ্য আনটোল্ড স্টোরিবইটিতে লিখেছেন, ক্যামিলাকে বোঝানো হয়েছিল, বাকিংহাম প্যালেসের যুবরাজ তথা লর্ড মাউন্টব্যাটনের ভাইপোকে বিয়ে করার মতো অভিজাত পরিবারের মেয়ে তিনি নন। প্রশ্ন উঠতে পারে তাঁর কুমারিত্ব নিয়েও! সব মিলিয়ে প্রিন্স চার্লসকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে ফেলাই সে সময় ঠিক মনে করেছিলেন ক্যামিলা। বহু নারী সঙ্গে অভ্যস্ত মেজর অ্যান্ড্রু পার্কার বোলসকে সব জেনেশুনেও বিয়ে করে ফেলেন ক্যামিলা।

চার্লস-ডায়ানার বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন ক্যামিলাও। ক্যামিলার উপস্থিতি নাকি ডায়ানার অস্বস্তি বাড়িয়েছিল। ক্যামিলার ছায়া নাকি তাড়া করেছিল হানিমুনেও। চার্লসকে বিশ্বাস করতে পারতেন না। ১৯৯৪ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে চার্লস প্রথম ক্যামিলার সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করে নেন। এরপরেই ক্যামিলার সঙ্গে বিচ্ছেদ চেয়ে আদালতে যান তাঁর স্বামী অ্যান্ড্রু পার্কার। এক বছর পর একটি বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার দেন ডায়ানাও। জানান, জেমস হিউইটের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। ডায়ানাকে ঘোড়া চালানো শেখাতেন তিনি। সেখানে চার্লসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতির ইঙ্গিতও দেন ডায়ানা। নিজের দাম্পত্য সম্পর্কে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘এই বিয়েতে দুজন নন, তিনজন আছেন। তাই ভিড় একটু বেশিই। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে বিবাহ-বিচ্ছেদ। ডায়ানা নামের পাশ থেকে হারিয়ে যায় হার রয়্যাল হাইনেসসম্বোধন। সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর মা হিসেবে তিনি রয়ে যান শুধুই প্রিন্সেস অব ওয়েলসহয়ে। পরের বছর পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ডায়ানার। প্রাক্তন স্ত্রীর মৃত্যুর পর অবশ্য প্রাক্তন প্রেমিকা ক্যামিলার কাছেই ফিরে যান প্রিন্স চার্লস। প্রায় নবছর পর ক্যামিলা পার্কারকে বিয়ে করেন প্রিন্স অব ওয়েলস। চালর্স-ডায়ানার বিয়ের ব্যর্থতা এবং শেষমেশ ডায়ানার ওই পরিণতির জন্য আমজনতা আঙুল তোলেন যুবরাজের দিকেই।

রাজ সম্বোধন নিয়ে মোহ ছিল না ডায়ানার। শোনা যায়, রানির ইচ্ছে ছিল ডায়ানা বিচ্ছেদের পরেও হার রয়্যাল হাইনেসব্যবহার করুক। কিন্তু যুবরাজ চার্লস সেটা চাননি। প্রিন্স উইলিয়াম নাকি মাকে বলেছিলেন, তিনি যখন রাজা হবেন, হারিয়ে যাওয়া রয়্যাল হাইনেসউপাধি তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর দেননি ডায়ানা।

তবুও কেনসিংটন প্যালেসের গেটে জমে থাকা ফুলের স্তূপ যুবরানি বলতে একজনকেই জানে— লেডি ডায়ানা!

 @saptahikbartaman

সুধীন্দ্র কুলকার্নির কথাগুলি জরুরি...

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান তিনি।

সুধীন্দ্র কুলকার্নি ছিলেন একসময় অটল বিহারি বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতাও। উপপ্রধানমন্ত্রী আদবানির রাজনৈতিক কৌশলী হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ভারতীয় রাজনীতির এক বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক তো বটেই। অথচ, নরেন্দ্র মোদি জমানায় তাঁর সঙ্গে দূরত্ব আশমান-জমিন। আর তাই গেরুয়া শিবিরের চোখে সুধীন্দ্র আজ কখনও ‘নকশালদের সহমর্মী’ আবার কখনও পাক-এজেন্ট

হবেই বা না কেন? তাঁকে আজ প্রশ্ন করলে অকপটে বলেন, বাজপেয়ীর বিজেপির সঙ্গে আজকের বিজেপির কোনও মিল নেই। ফারাকটা চেখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রথমত, এখন বিজেপিতে কোনও যৌথ নেতৃত্ব নেই। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বলেও কিছু নেই। বাজপেয়ী অত্যন্ত আকর্ষণীয় নেতা ছিলেন। কিন্তু তিনি একজন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষও ছিলেন, ফলে দলটাও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলত। সেই সংস্কৃতি সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছে। আজকের বিজেপিতে কোনও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নেই। এই দল চালাচ্ছেন দুই ব্যক্তি (নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ) এবং মানুষকে দেখানোর জন্য একজন দলীয় সভাপতি (জে পি নাড্ডা) আছেন। কোনও বড় ইস্যু নিয়ে দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয় না। নেতৃত্ব যা বলে, বাকিরা তা শুনতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, বাজপেয়ী একজন জনপ্রিয় নেতা হলেও তাঁকে ঈশ্বরে পরিণত করেনি বিজেপি। কোষাগারের অর্থ খরচ করে নরেন্দ্র মোদিকে একজন অবতার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয়ত, এবং সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আদবানি তাঁদের পরের প্রজন্মের নেতাদের তৈরি করেছিলেন। সেই কারণেই তাঁরা অবসর নেওয়ার পর সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, গোবিন্দচার্য, প্রমোদ মহাজন, এমনকি নরেন্দ্র মোদির মতো নেতা উঠে এসেছেন। এখন আর সে রকমটা হচ্ছে না। বর্তমান নেতৃত্ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করেনি। নরেন্দ্র মোদির পর এক বিরাট শূন্যতা বিজেপির জন্য অপেক্ষা করছে।

ভারতে একটা নতুন হিন্দুত্ববাদ তৈরি হচ্ছে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়েতি নরসিংহানন্দের মতো সাধুরা। তাঁরা খোলাখুলি সংখ্যালঘুদের হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। এই নতুন হিন্দুত্ববাদ বিজেপিকে শক্তিশালীই করছে। তাই নয় কি? সুধীন্দ্র কুলকার্নির জবাব, এসবের কোনও সামাজিক স্বীকৃতি নেই। রাজনৈতিক অনুমোদন আছে। সাধুরা এসব কথা বলছেন, কারণ, এর একটা রাজনৈতিক স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু তা দিয়ে প্রমাণিত হয় না যে সামাজিক স্তরে মানুষ এই ধর্মান্ধতা মানছেন। আমার ধারণা, ভারতের বড় অংশের হিন্দুরা এই ধরনের কথাবার্তা সমর্থন করেন না। আবার অন্যদিকে এটা করা হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করতে। সেখানেও এটা লক্ষণীয় যে মুসলিম সম্প্রদায় কিন্তু প্ররোচিত হচ্ছে না। এটা তাদের বিরাট কৃতিত্ব।

সম্প্রতি বাংলাদেশের এক সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুধীন্দ্র বলেছেন, এতকিছুর পরও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা না কমার কারণ, বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প শক্তির অভাব। তবে মোদির সমর্থকদের একটা বড় অংশ এখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবৃদ্ধি, কর্মহীনতা এবং কোভিড নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তারা এটা প্রকাশ্যে বলছে না। কারণ, একটা বিরাট ভয় রয়েছে, যেটা ভারতে অতীতে ছিল না।

কিন্তু মোদির ভারতে বিজেপি তো হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন মানুষকে দেখাতে পেরেছে। সে ক্ষেত্রে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে কেন আপনি পরের প্রজন্মের নেতা বলবেন না? উত্তরে সুধীন্দ্র কুলকার্নি বলেছেন, মানুষ তাঁকে মানবে না। রাজনীতিতে অবশ্যই মেরুকরণের একটা জায়গা রয়েছে। সেটাকে একটা সময় পর্যন্ত কাজেও লাগানো যায়, কিন্তু তারপর মেরুকরণের রাজনীতি আর কাজ করে না। এর কারণ, একটা সময়ের পর মেরুকরণের রাজনীতি সমাজ ও রাজনীতি দুয়েরই অপরিসীম ক্ষতি করে। এটা অবশ্যই বাস্তব, মেরুকরণের রাজনীতিকে হাতিয়ার করেই নরেন্দ্র মোদি সফল হয়েছেন। কিন্তু একটা বড় তফাত আছে। তিনি একজন অত্যন্ত কৌশলী রাজনীতিবিদ, যেটা আদিত্যনাথ নন। ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি একটা সময়ের পর আর কাজ করে না।

ঘটনাটা এমন নয় যে, এক দিন সকালে বিজেপি ভাবতে শুরু করল যে এই হিন্দু সমাজকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। বরং সঙ্ঘপরিবার ধীরে ধীরে এই কাজ করে চলেছে বহু দিন ধরে। গোধরা কাণ্ডের পর সে সম্প্রসারণ দেখেছি চোখের সামনে। মোদি-অমিত শাহ আজ উন্নয়নের কথা যতই বলুন, দলের সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশল তৈরি করছেন সেই উগ্র হিন্দুয়ানার পথেই। বিজেপির সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশলে তাই দেখছি ভারতীয় ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা। এখন এক অখণ্ড হিন্দু পরিবার গড়ার চেষ্টা হচ্ছে যা ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি।

এই ভয়ঙ্কর সময়ে সুধীন্দ্র কুলকার্নির কথাগুলি জরুরি!