Friday, May 12, 2023

মৌলবাদীদের কাছে ডারউইনের বিপদ

মোদি সরকারের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং বলেছিলেন, তিনি চার্লস ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্ব মানেন না। কারণ, বাঁদর থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টির কথা আসলে মিথ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেউ বাঁদরকে মানুষে পরিণত হতে দেখেননি। তাই ওই তত্ত্ব স্কুল-কলেজে পড়ানো উচিত নয়। সালটা ২০১৮।

সেদিন দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি-নিউ দিল্লি, ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-বেঙ্গালুরু এবং ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-প্রয়াগরাজ) এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিল: মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। বিবর্তনের তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই। এটি এমন একটি তত্ত্ব, যার ভিত্তিতে এমন বহু অনুমান করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলো পরবর্তী কালে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্যকে অনেকে ব্যক্তিগত অজ্ঞতার বিষয় বলেও ভেবেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা যে তা ছিল না, মন্ত্রী যে কেন্দ্রে শাসন পরিচালনায় নিযুক্ত একটি গোষ্ঠীর মতকেই প্রতিধ্বনিত করেছিলেন, তা সিবিএসইর ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছে নবম দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে। কী ভয়ঙ্কর ভাবুন, একাদশ-দ্বাদশে যে সব পড়ুয়া জীববিজ্ঞান পড়বে না, তাদের আর স্কুলজীবনে ডারউইনের নামই শোনা হবে না!

কিন্তু কেন এই পদক্ষেপ? এর মূল কারণ, যে সময়ে বাইবেলের বিরোধিতা আর দেশদ্রোহিতা সমার্থক, সেইসময় দাঁড়িয়ে চার্লস রবার্ট ডারউইন যত দেখেছেন, তত লিখেছেন। তাঁর কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে, পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি ও বিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়ম। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, এক প্রজাতি থেকে আর এক প্রজাতির সৃষ্টি একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। সৃষ্টির পিছনে কোনও এক অজানা-অচেনা, শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার ভূমিকাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়েছে বিবর্তনবাদ। তিনি এ কথাও খুব স্পষ্ট করেই বুঝেছিলেন, বাইবেলে বর্ণিত নোয়ার নৌকায় যাদের ঠাঁই মিলেছিল শুধু তারাই পৃথিবীতে টিকে গিয়েছে, ব্যাপারটা ঠিক তেমনটা নয়। বরং কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে যারা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে, প্রকৃতি শুধু তাদেরই দিয়েছে বেঁচে থাকার ছাড়পত্র। এর অর্থ একটাই, বসুন্ধরা বীরভোগ্যা। এই ধরিত্রীর বুকে টিকে থাকা সহজসাধ্য নয়। এর জন্য লড়াই করতে হয়, নচেৎ অবলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। ডারউইন-প্রবর্তিত প্রাকৃতিক নির্বাচনের এটাই মূল কথা।

ফলে ধর্মতাত্ত্বিকরা ভীষণ বিপদে পড়ে যান। মজার কথা, গোঁড়া খ্রিস্টানের মতো গোঁড়া মুসলিমরাও বিবর্তনের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন, মানুষের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বা আল্লা। গেরুয়া শিবির যেমন মনে করে, মানুষের সৃষ্টি সরাসরি মুনি-ঋষিদের ঔরস থেকে। কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের পরে ধর্মতাত্ত্বিকদের আশ্রয় ছিল জীবজগৎ, বিশেষ করে মানুষের সৃষ্টি। কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা ছাড়া এটা সম্ভব নয়এই বিশ্বাসই ছিল তাঁদের শক্তির শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদ জীবজগৎ সৃষ্টির পিছনে প্রাকৃতিক নিয়মের কথা প্রমাণ করে দেওয়ায় তা ধর্মতাত্ত্বিকদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছিল। তাই ডারউইনের জীবদ্দশাতেই তীব্র আক্রমণ শুরু হয়েছিল, এখনও যা অব্যাহত। ডারউইন তাঁর জীবদ্দশায় ‘থমাস হেনরি হাক্সলি’র মতো সমর্থক পেয়েছিলেন। লন্ডনের এক বিতর্কসভায় বিশপ উইলবারফোর্স বিদ্রুপ করে হাক্সলিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি কোন দিক থেকে নিজেকে বানরের উত্তরাধিকারী মনে করছেন, বাবার দিক থেকে নাকি মায়ের দিক থেকে? শোনা যায়, হাক্সলির সপাট উত্তর ছিল, নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে সত্য আড়াল করার কাজে ব্যবহার করেন, এমন কোনও ব্যক্তির চেয়ে একটা বানর তাঁর কাছে পূর্বপুরুষ হিসেবে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধ অবশ্য নতুন কিছু নয়। ডারউইনের জন্মেরও বহু বছর আগে আমরা দেখেছিলাম, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এই পরম সত্যটি উচ্চারণ করায় গ্যালিলিওকে চার্চ ও শাসকের কী ভয়ানক কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। নিউটনের তত্ত্ব ঘিরেও এককালে কম বিতর্ক হয়নি। স্কুলে ডারউইনবাদ পড়ানোর অপরাধে এক শতাব্দী আগে আমেরিকায় বিজ্ঞান শিক্ষক টমাস স্কোপসকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের অমোঘ প্রমাণের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে ধর্মকে। তবুও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর বলেছিলেন, ‘এখন নাকি বিজ্ঞানের যুগ। তাই প্রায়ই যুক্তি দেওয়া হয়, বিজ্ঞানের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধর্মেও পরিবর্তন আনতে হবে। আমি ঠিক উল্টো কথা বলি। যদি বিজ্ঞানের প্রতিটি গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মে পরিবর্তন করতে হয়, তা হলে ধর্ম আর ধর্ম থাকবে না।’ ঠিক বলেছিলেন ‘গুরুজি’! আসলে ভাবার ক্ষমতা, যুক্তিবোধ ধ্বংস করার প্রয়োজন যখনই পড়ে, তখনই বিজ্ঞানের উপর আক্রমণ হয়। দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে যতই বিরোধিতা থাকুক, বিজ্ঞানকে আক্রমণের প্রশ্নে, অন্ধ বিশ্বাসে মদত দেওয়ার প্রশ্নে তাদের আশ্চর্য মিল। লেবানন, তিউনিশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্ডন সমেত বেশ কিছু ইসলামিক রাষ্ট্রে ডারউইন পড়ানো নিষিদ্ধ অথবা রাষ্ট্রের দ্বারা সমালোচিত। ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে সিলেবাস থেকে ডারউইনের থিওরি খারিজ করা হয়েছে বহুকাল আগেই। পাশ্চাত্যের গির্জাতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে ডারউইনের বিরোধ তো সেই গোড়া থেকেই। হিন্দু, ইসলাম বা খ্রিস্টানযে কোনও ধর্মের গোঁড়ামিই বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখতে শেখায়। সেই ধর্মীয় গোঁড়ামি পুরাণকে ইতিহাস বলে, আর বিবর্তনের তত্ত্ব খারিজ করে দেয়।

আর তাই অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি নাগেশ্বর রাওয়ের মতো কিছু অধ্যাপক দাবি করে বসেন, উনিশ শতকে বিবর্তন তত্ত্ব ব্যাখ্যার বহু আগেই হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতায় উল্লিখিত দশাবতারে প্রাণিজগতের বিবর্তন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিষ্ণুর দশাবতারে বলা সেই বিবর্তন তত্ত্ব, ডারউইনের তত্ত্বের থেকে অনেকে বেশি উন্নতমানের। ১০৬তম বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাও বলেছিলেন, দশাবতার শুরু হচ্ছে মৎস্য অবতারদিয়ে, জলজ প্রাণী। তারপর কূর্ম অবতার’, অর্থাৎ কি না উভচর। যে জলেও বাঁচে, ডাঙাতেও। চতুর্থ অবতার নরসিংহ। অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক সিংহ। পঞ্চম অবতার বামন। আকারে ছোট মানুষ। ...শেষে এলেন রাম। একজন সম্পূর্ণ মানুষ। তারপর কৃষ্ণ। আরও জ্ঞানী, বিচারক্ষমতা, কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন। শুধু বিবর্তন তত্ত্বেই থামেননি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। রামায়ণ-মহাভারত সম্পর্কেও নানা দাবি করেছিলেন তিনি। যেমন কৌরবদের জন্ম স্টেম সেল থেকে, টেস্টটিউব প্রযুক্তির মাধ্যমে। হাজার হাজার বছর আগেই ভারতের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। বিষ্ণুর হাতের সুদর্শন চক্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে আবার তাঁর হাতে ফিরে আসত। শুধু পুষ্পক-রথ নয়, রাবণের অন্তত ২৪ ধরনের বিভিন্ন মাপের, বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন বিমান ছিল...

এইভাবে একদিকে যেমন কাল্পনিক বিষয় এবং প্রাচীন সাহিত্যে উল্লিখিত বিষয়কে সত্যবলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা হচ্ছে। গত কয়েক বছর এই অতীতের বিজ্ঞান গৌরবগাথার জয়গান যে খুব বেশি শোনা যাচ্ছে তার পিছনের কারণটা বোঝা সহজ। এই বিজ্ঞানহল বিশুদ্ধ হিন্দুবিজ্ঞান যা রামায়ণ-মহাভারত-গীতা-পুরাণে বিস্তৃত। সব কিছুর মূলে হিন্দুত্ববাদ।হিন্দু সভ্যতাহিসেবেই যে ভারত এক সময় বিশ্বে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, সে কথা প্রমাণ করার মরিয়া প্রয়াস। বিপদটা এখানেই। বিপদটা অপবিজ্ঞানে। বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে যুক্তিহীন বিষয় পরিবেশনের চেষ্টা।

আমাদের পৌরাণিক গল্পগাথাগুলি বেশির ভাগই রূপকাশ্রিত। তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে, ইতিহাস আছে। সেটা ক্ষতিকর নয় যতক্ষণ না তাকে বাস্তব বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু পুষ্পক রথকে বিমান বা গণেশের মাথাকে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ ইত্যাদি বলে উপস্থাপন করার অর্থ, কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই কাল্পনিক ঘটনাকে বিজ্ঞানাশ্রিত বলে বিশ্বাস করানো। বিজ্ঞানের মূল কথাই হল, কার্যকারণ সম্পর্কের অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা। যেকোনও তত্ত্বকে প্রশ্ন করাই প্রকৃত অনুসন্ধিৎসুর কাজ, এবং চাক্ষুষ প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছুকে বিশ্বাস না করাও বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গির আবশ্যিক অঙ্গ। তাই এই ধরনের ধারণা ছড়ানো মানে বিজ্ঞানচেতনার গোড়ায় আঘাত করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপি, বিশেষত আরএসএস আসলে তাদের ভাবধারা, হিন্দুত্বের তত্ত্বে বিশ্বাসী একটি পাকাপাকি ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে চাইছে। তাদের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ককে আরও মজবুত করতে চাইছে। এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করতে চাইছে, যারা তাদের ভাবধারাতেই বড় হয়ে উঠবে। তাই পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়েছে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব।

কেউ কি ভেবে দেখেছেন, এদেশে মোদিরাজও হঠাৎ একদিনে তৈরি হয়নিএই সরকারও বিবর্তিতই হয়েছে প্রায় এক দশক ধরে। সেই বিবর্তনে অন্যতম অনুঘটক গরিষ্ঠ সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের নীরবতা!


Wednesday, March 22, 2023


খাকিমভের মৃত্যু

একটা যুদ্ধের সমাপ্তি

তালিবান শাসনে আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাত এখন ভুতুড়ে নগরী!

শহরের চারদিকে এখন শুধুই তালিবানের পতাকা। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রাস্তায় সশস্ত্র প্রহরা। নয়া ফতোয়ায় তালিবান জানিয়ে দিয়েছে, হিজাবে চলবে না। জনসমক্ষে পরতে হবে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা বোরখা (চাদরি)। নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, মহিলাদের গাড়ি চালানোর উপরও। এই বদ্ধভূমি হেরাত থেকেই শেখ আবদুল্লার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছেছে সুদূর মস্কোতে। রুশদের কাছে খানিকটা স্বস্তির খবরও বটে। আসলে রুশদের কাছে আবদুল্লার জীবন ছিল ইতিহাসের দীর্ঘতম বিব্রতকর প্রতীক। গত ২৭ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু আফগানিস্তানে রাশিয়ার ভয়াবহ আগ্রাসনের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। কে এই শেখ আবদুল্লা?

আসল নাম খাকিমভ বাখেরোদিন। বাবা ছিলেন সোভিয়েত রেড আর্মির বড় অফিসার। জাতিতে উজবেক। মা ছিলেন ইউক্রেনের। খাকিমভের এক ভাই রেড আর্মির গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন। বোনও ছিলেন এই বাহিনীর একজন উপদেষ্টা। রাশিয়া তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ভূমি। রুশ সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে খাকিমভ আফগানিস্তানে পা রেখেছিলেন ১৯৮০ সালের দিকে। বয়স তখন ২১। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গিয়েছে, খাকিমভ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার ছিলেন। তবে সরাসরি যুদ্ধের পোশাক পরা ছবিও পাওয়া যায় তাঁর।

১৯৮৩-৮৪ সালের কোনও একসময় হেরাতের সিন্দাদে স্থানীয় মুজাহিদিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে খাকিমভ মাথায় আঘাত পান। হাজি সৈয়দ আবদুলবাহাব কাতালির নেতৃত্বে মুজাহিদিনের স্থানীয় একটা উপদলের হাতেই খাকিমভ আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। কিন্তু খাকিমভকে জঙ্গি মুজাহিদিন গোষ্ঠী মেরে ফেলেনি। তার কারণ আজও রহস্য। ১০ বছর যুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালে রুশরা যখন আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়, খাকিমভ আর দেশে ফিরে যাননি। রুশদের বিদায়ের পর ইসলামে দীক্ষা নেন। নাম পাল্টে হেরাতেই থেকে যান। আফগানিস্তানজুড়ে এই রকম পক্ষত্যাগীরুশ যোদ্ধা কম ছিলেন না। রাশিয়ার হিসেবে সংখ্যাটা প্রায় আড়াইশো। রুশ প্রতিরক্ষা বিভাগ এঁদের চিহ্নিত করে নিখোঁজ সেনা হিসেবেই। খাকিমভ ছিলেন এই তালিকার জীবিত শেষ ব্যক্তি। আফগানিস্তানের তরফে অন্তত সেই রকমই দাবি করা হয়। রাশিয়ার গোয়েন্দারা অবশ্য মনে করেন, এই রকম আরও কিছু প্রাক্তন রুশ সেনা এখনও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। তাঁরা দেশে ফিরলে কোনও আইন-কানুনের মুখোমুখি হতে হবে না, এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও নিখোঁজ সেনারাফিরতে আগ্রহী হননি। কেউ ভয়ে, কেউ অনিচ্ছায়।

বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সুস্থ হওয়ার পর ১৯৮৯ সালের আগে যুদ্ধের বাকি সময়টা খাকিমভ মুজাহিদিন গোষ্ঠীকে সাহায্য করেছিলেন। ইসলামে দীক্ষা নিয়েছিলেন আফগান মুজাহিদিন গোষ্ঠীর কাছেই। তারা তাঁকে জীবিকায় সাহায্য করে। বিয়েও দিয়ে দেয়। আফগান মাটিতে এক কন্যাসন্তানেরও পিতা হন তিনি। একসময় নাকি দ্বিতীয় বিয়েও করেছিলেন। নিত্যদিনের পোশাক-আশাক হিসেবে স্থানীয় রক্ষণশীল স্টাইল রপ্ত করে নিয়েছিলেন। দ্রুত স্থানীয় ভাষাও শিখে ফেলেছিলেন। শেষজীবনে হেরাতে সোভিয়েতবিরোধী প্রতিরোধযুদ্ধের সরঞ্জাম দিয়ে একটা জাদুঘর গড়ার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ থেকে তালিবান নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বরাদরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন বলেও জানা যায়। তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ডান হাত ছিলেন বরাদর। মাঝেমাঝে উজবেকিস্তানে বাস করা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তাও বলতেন। হয়তো এসব নানা খবরের পর রুশরা যুদ্ধের পর তাঁকে আর ফিরিয়ে নেয়নি। তিনিও আগ্রহী ছিলেন না।

খাকিমভ আফগানদের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি দিনই বেঁচেছেন। এরপরও তাঁর মৃত্যুসংবাদ হেরাতের অনেককে বিস্মিত করেছে। কারণ, ষাটোর্ধ্ব বয়সেও শারীরিকভাবে অনেক সবল ছিলেন। মারা গিয়েছেন হিটার থেকে নির্গত বিষাক্ত এক গ্যাস দুর্ঘটনায়। এভাবে আচমকা মারা না গেলে আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসনের জীবন্ত এই সাক্ষীকে বিশ্ববাসী আরও অনেকদিন দেখতে পেতেন। যে আগ্রাসনে ২০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। প্রাণ হারিয়েছিল ১৫ হাজার সোভিয়েত সেনাও। আফগানিস্তান অভিযানের ব্যর্থতা ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনেও ভূমিকা রেখেছিল। আবার সোভিয়েত আগ্রাসনের অজুহাত দেখিয়ে প্রতিরোধের নামে আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পথ তৈরি হয়েছিল। সেই ধ্বংসলীলার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আফগানিস্তান ফের তালিবানের খপ্পরে।

যুদ্ধবিদ্যায় বলা হয়, শেষ সেনা ঘরে ফিরে না আসা কিংবা মারা না যাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলছে বলে ধরে নিতে হয়। খাকিমভের মৃত্যু হয়তো সেই অর্থে আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েত যুদ্ধের প্রকৃতই সমাপ্তি ঘটাল।

তবে এই যুদ্ধ এবং আগ্রাসনের পুরো রেশ এখনও বন্ধ হয়েছে বলা যায় না। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে ২০২১ সালের আগস্টে ন্যাটোর ফিরে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছরের আফগান ট্র্যাজেডির প্রাথমিক জন্মদাতা যে মস্কোর নীতিনির্ধারকরা, খাকিমভ বাখেরোদিন ওরফে শেখ আবদুল্লার জীবনের গল্প তার নিখুঁত প্রমাণ!


 https://www.dawn.com/news/1164633


Friday, March 17, 2023

ডলারের আধিপত্যে থাবা: রাশিয়া-ভারতের তেল বাণিজ্য

ডলারের আধিপত্যে থাবা

ডলারের আগে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিল ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের। ১৯২০ সাল পর্যন্ত দুনিয়ায় রাজত্ব করেছে এই মুদ্রাই।
ডলারের আত্মপ্রকাশের আগে ৫০০ বছর ধরে যেসব মুদ্রা রাজত্ব করেছে তার মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মুদ্রা। বিশ্বের নানা প্রান্তে এসব দেশের কলোনি থাকায় তাদের মুদ্রাও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু গোটা পরিস্থিতি বদলে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪১৮) শুরুর পর থেকে।
এই লড়াইয়ে আমেরিকা যোগ দিয়েছিল যুদ্ধ শুরুর আড়াই বছর পরে। সেই অর্থে যুদ্ধের আঁচড় আমেরিকার গায়ে লাগেনি। যদিও আমেরিকা তার মিত্র দেশগুলির কাছে প্রচুর অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রি করা শুরু করে। বিক্রি করা রসদের মূল্য পরিশোধ করা হয় সোনার মাধ্যমে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসতে আসতে বিশ্বের মোট মজুত সোনার একটি বড় অংশই আমেরিকার কোষাগারে জমা হয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও আমেরিকা শেষ মুহূর্তে যোগ দেয়। ওই সময়ও মিত্রদের কাছে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে নিজেদের কোষাগারে বিপুল স্বর্ণমুদ্রা মজুত করে ফেলে আমেরিকা। ইউরোপ তখন বিধ্বস্ত। মানুষের হাতে অর্থ নেই। খাবার নেই। কাজ নেই। সর্বত্র হাহাকার।
এই অবস্থায় ১৯৪৪ সালে ৪৪টি দেশ আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে মিলিত হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই ৪৪টি দেশের মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হবে মার্কিন মুদ্রা ডলারের উপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হবে সোনার উপর ভিত্তি করে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুত সোনার ৭০ শতাংশ আমেরিকার হাতে। এই বিপুল সোনা মজুত ও ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় সেসব দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়। মূলত ডলারের আধিপত্য সেই থেকেই শুরু।
শুনলে অবাক হবেন, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, সেই সময় আক্ষরিক অর্থেই ভারতের ১ টাকা আমেরিকার ১ ডলারের সমতুল্য ছিল। কালক্রমে ডলারের চেয়ে দুর্বল হয়েছে ভারতীয় টাকা। স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫২ সালে। তারপর অনেক নির্বাচন এসেছে। রাজনৈতিক নেতারা বার বার আশ্বাস দিয়েছেন, টাকার দাম আরও বাড়িয়ে তোলাই তাঁদের লক্ষ্য। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। ১ ডলার = ১ টাকা তো দূরের কথা, দিন দিন বরং আরও দুর্বল হয়েছে ভারতীয় মুদ্রা।
১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি এবং জাপানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তারা ডলার দিয়ে আমেরিকার কাছ থেকে বিপুল সোনা কিনতে থাকে। ক্রমশ ফাঁকা হতে শুরু করে মার্কিন কোষাগার। সেই সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের খরচ মেটানোর চাপে ওয়াশিংটন বিপুল পরিমাণ কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। কঠিন হয়ে পড়ে ডলারের সঙ্গে সোনার সংযোগ বজায় রাখা। ১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করেন, সোনার উপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। যা নিক্সন শকনামে পরিচিত। এই সিদ্ধান্তে ডলার হয়ে যায় ফিয়াট মানি’ (কোনও সরকারের জারি করা একটি মুদ্রা)। তারপরও ডলারের গুরুত্ব কমেনি। বিশ্বজুড়ে ডলারের আধিপত্য ধরে রাখতে ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের তীব্র উত্তেজনার মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি করে আমেরিকা। তাতে বলা হয়, সৌদি আরব থেকে বিশ্বের যেসব দেশ জ্বালানি তেল আমদানি করবে, তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে মার্কিন ডলারে। বিনিময়ে সৌদি আরবকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে আমেরিকা। এর দু’বছর পর ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির জোট ওপেকসৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ তেল বিক্রির সব অর্থ পরিশোধ করা হবে শুধু ডলারে। শুরু হয় বিশ্বব্যাপী ডলারের আধিপত্য বিস্তার।
বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনিদের একক আধিপত্যের বড় অস্ত্র— ইউএস ডলার। মারণাস্ত্রের মতোই যা ক্ষমতাসম্পন্ন। ওয়াশিংটন জানে, নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চাইলে, ডলারের আধিপত্যও বজায় রাখতে হবে। আমেরিকার ইরাক, লিবিয়া এবং অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর গুরুত্বপূর্ণ কারণ একটাই— পেট্রোডলার ব্যবস্থা এবং প্রধান বাণিজ্য মুদ্রা হিসেবে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখা। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতির অনেক হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য ক্ষয় হতে শুরু করেছে। দুনিয়াজুড়ে প্রশ্ন উঠছে, ডলারের আধিপত্য কি এবার মুখ থুবড়ে পড়বে?
রাশিয়াকে ভাতে মারার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। তাই রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনায় তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে রুশ কোম্পানিগুলির জন্য ডলার বিষাক্ত সম্পদহয়ে দাঁড়ায়। পাল্টা জবাবে রুশ প্রশাসনও একটি ‘অবন্ধু’ দেশের তালিকা প্রকাশ করে। তারা ঘোষণা করে, রাশিয়ার কাছ থেকে যে সব দেশ তেল-গ্যাস কিনবে তাদের রুবলে (রাশিয়ার মুদ্রা) অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তাদের এই ঘোষণা আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির জন্য ছিল কল্পনাতীত। কারণ, এর অর্থ, ডলারের একচেটিয়ার আধিপত্যে রুবলের ভাগ বসানো। পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার শুরুতে রুবলের মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে গেলেও, রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের ফলে রুবলের মান আগের অবস্থায় চলে আসে। ফলে রুবল ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং বর্তমানে তা উর্দ্ধমুখী। আজ এক ডলার সমান ৭৫.৫৫ রুবেল। ইতিমধ্যে রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। বুলগেরিয়ার ৯০ এবং পোল্যান্ডের ৫৩ শতাংশ গ্যাস যেত রাশিয়া থেকেই। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার জ্বালানি আমদানির নিষেধাজ্ঞা নিয়ে স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত।
আমেরিকার আপত্তিতে অনেক দেশই রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিলেও ভারত সে পথে হাঁটেনি। তারা পশ্চিমের ভ্রুকুটি উড়িয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা জারি রেখেছে। রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েছে ভারত। তারপর বিদেশেও তা রপ্তানি শুরু করেছে। এমনকি, ভারত থেকে রাশিয়ার তেল পৌঁছেছে আমেরিকাতেও। জানুয়ারিতেই প্রায় ৮৯ হাজার ব্যারেল ডিজেল ভারত থেকে নিউ ইয়র্কে পাঠানো হয়েছে। দেখা গিয়েছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনার ফলে গত এক বছরে ভারতের লাভের অঙ্ক বেড়েছে অনেকখানি। ৪০০ কোটি ডলার অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে নয়াদিল্লি।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে রাশিয়া-ভারত জ্বালানি বাণিজ্যের কারণেই। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের দাবি, সমুদ্রপথে রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির অধিকাংশ চুক্তি নিষ্পত্তি অন্যান্য মুদ্রায় করছে নয়াদিল্লি ও মস্কো। মার্কিন ডলারের পরিবর্তে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মুদ্রা দিরহাম দিয়ে ভারত আমদানি দায় মিটিয়েছে। এই তথ্য হাতে পাওয়ার পর আমেরিকা ও ব্রিটেন মস্কো ও আবুধাবির রুশ ব্যাঙ্ক এমটিএসকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যোগ করেছে। এমটিএস ভারতে কয়েকটি ডলারবিহীন লেনদেনে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ। লেনদেনের বিকল্প পথ হিসেবে সম্প্রতি ভারতীয় সংস্থাগুলি রাশিয়ান রুবলকে বেছে নিয়েছে। গত তিন মাসে এভাবে কয়েকশো মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের আমদানির দাম অন্যান্য মুদ্রায় নিষ্পত্তি হয়েছে। জ্বালানি বাণিজ্যের ব্যাপক এই পরিবর্তন এর আগে কোনওদিন হয়নি।
সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মস্কো নিজের অর্থনীতিকে ডলারের প্রভাবমুক্ত করতে চাইছে। যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, ভারতের তিনটি ব্যাঙ্ক অন্যান্য মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের কিছু লেনদেনে সাহায্য করছে। ভারতীয় সংস্থাগুলি অধিকাংশক্ষেত্রেই অপরিশোধিত তেল কিনছে মস্কোর সুবিধামতো মুদ্রায়। বেশিরভাগ ক্রয়ই হয়েছে রাশিয়ার তেলে পশ্চিমের দেশগুলি যে মূল্যসীমা বেঁধে দিয়েছে তার চেয়ে কম দরে। তবে এই বাণিজ্যে যাতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন না হয় সেবিষয়ে সতর্ক ভারতীয় ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। মূল্য পরিশোধের প্রক্রিয়ায় আংশিক সাহায্য করেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ‘নস্ট্রো’ অ্যাকাউন্ট। এই লেনদেনের বেশিরভাগই হয় রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রম ও রসনেফট থেকে। অন্যদিকে, দিরহামে মূল্য পরিশোধের বেশিরভাগ লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে ব্যাঙ্ক অব বরোদা এবং অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। ব্যাঙ্কিং সূত্রগুলি জানিয়েছে, রুবলে লেনদেনে আরও নিষেধাজ্ঞা চাপানো হলে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি টাকায় বাণিজ্যিক লেনদেন করতেও প্রস্তুত।
একসময় মার্কিন অর্থসচিব জন কনালি গোটা দুনিয়াকে বলেছিলেন, ‘ডলার আমাদের মুদ্রা, তোমাদের সমস্যা।আর আজ আইএমএফ-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলছেন, ‘রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা যত দীর্ঘ হবে ডলারের প্রভাব তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ডলার প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে থাকলেও কিছু দেশ অন্যান্য মুদ্রাও ব্যবহার করবে। তারা ডলারে তাদের রিজার্ভও কমিয়ে আনতে পারে।’ যা ওয়াশিংটনের জন্য মোটেই সুখবর নয়!

Saturday, March 11, 2023

আমেরিকার অস্ত্র গণতন্ত্র, ইরানের ড্রোন সন্ত্রাস?


আমেরিকার অস্ত্র গণতন্ত্র, ইরানের ড্রোন সন্ত্রাস

এতদিনে আসল কথাটি লিখেছেন টরন্টোর গুয়েলফ-হাম্বার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিষয়ের শিক্ষক গ্রেগরি শুপাক। সম্প্রতি তিনি লিখেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের ড্রোন ব্যবহার করায় আমেরিকার সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো খুব খেপেছে। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানগুলোই নিয়মিতভাবে আমেরিকার অস্ত্র রপ্তানিকে মহৎ কাজ হিসেবে দেখিয়ে যাচ্ছে।
ফোর্বস ম্যাগাজিনে সাংবাদিক পল ইডোন তো ইরানকে রাশিয়ার আগ্রাসী লালসার সহচরহিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফরেন পলিসি সাময়িকীতে এলি জেরানমায়ে ও সিনজিয়া বিয়ানকো লিখেছেন, ‘ইউক্রেনে ইরানের অস্ত্র যাওয়া ঠেকানো এবং ইরানের অভ্যন্তরের নাগরিকদের দৈনন্দিন খরচ বৃদ্ধি কীভাবে করা যায়, তার উপায় আমেরিকা ও ইউরোপের খুঁজে বের করা উচিত। ওই একই সাময়িকীতে জন হার্ডি ও বেনহাম বেন ট্যালেবলু লিখেছেন, ইরানের শাহেদ-১৩৬ ড্রোন ইউক্রেনে রাশিয়ার সন্ত্রাসের বিস্তারেসাহায্য করছে এবং এই ধরনের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি পশ্চিমীদের বিরুদ্ধে ইরানের আক্রমণের শামিল। এই বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের সম্পাদকীয়তে বলেছে, এই ড্রোন রপ্তানি করে ইরান সমস্যা সৃষ্টি করছেএবং রাশিয়ার ইউক্রেন ধ্বংসে সাহায্য করছে’।
অন্যদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো গত সপ্তাহেও আমেরিকার অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। সাংবাদিক পিটার বারজেন সিএনএন টেলিভিশনে সম্প্রতি বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে এবং ইউক্রেনকে হিমার্স মিসাইল ও এমওয়ান ট্যাংকসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করে সত্যিকারের নেতৃত্বেরপরিচয় দিয়েছেন।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি ডি স্যাক্স বলেছেন, গত মার্চে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে যাচ্ছিল এবং এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার দখল করা ভূখণ্ড হাতছাড়া করতে রাজি হয়েই কিয়েভ যুদ্ধ সমাপ্তির দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন সেই শান্তি উদ্যোগে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছেন এবং ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিল থেকে উঠে যেতে প্ররোচিত করেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ব্রেট স্টিফেন লিখেছেন, ‘এফ-১৬ যুদ্ধ বিমানসহ সব ধরনের সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর এটিই মোক্ষম সময়। তবে এর মধ্যে দ্য বুলেটিন অব দ্য অ্যাটোমিক সায়েন্সেস-এর অবস্থান উল্টো। তারা বলেছে, আমেরিকার আলোচনার দ্বার খোলা রাখা উচিত। আমেরিকা, ন্যাটো জোট ও অন্যান্য মিত্ররা যদি সামরিক সংঘাতকেই সমাধানের একমাত্র রাস্তা হিসেবে বেছে নেয়, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
ওয়ার রিজার্ভ স্টক পাইল অ্যামিউনিশন-ইজরায়েল (ডব্লিউআরএসএ-১) নামে ইজরায়েলে আমেরিকার যে অস্ত্রের ভাণ্ডার রয়েছে, তা তাদের ভাষায় গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নিবেদিত। মধ্যপ্রাচ্যে কোনও ধরনের যুদ্ধ লাগলে যাতে দ্রুত এই অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নিয়ে ব্যবহার করা যায়, সে জন্য এই মজুত গড়ে তোলা হয়েছে। মিখাইল মাকোভস্কি ও ব্লেইজ মিজতাল লিখেছেন, ইজরায়েলের ভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। মিখাইল মাকোভস্কি ও ব্লেইজ মিজতাল মনে করেন, এই যুদ্ধ মূলত রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো তথা আমেরিকার প্রক্সি যুদ্ধ। পশ্চিমীরা শুধু ইউক্রেনে গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এই যুদ্ধে জড়ায়নি, বরং রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর দড়িটানাটানির ধারাবাহিকতা হিসেবেও তারা এই লড়াইয়ে নেমেছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় মিখাইল মাকোভস্কি ও ব্লেইজ মিজতাল একটি উপসম্পাদকীয়তে লিখেছেন, বাইডেন প্রশাসন যখন ইউক্রেনে কামানের গোলা পাঠিয়েছে, ঠিক তখন ইজরায়েলে আমেরিকার অস্ত্রভাণ্ডার ‘গণতন্ত্রের ডিপো’ হিসেবে কাজ করছে। তবে সবাই বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও ইজরায়েলের অস্ত্র ব্যবহারকে গণতন্ত্রবলে চালানো কতটা অযৌক্তিক। কারণ, ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবহার গোটা অঞ্চলে যে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা আজ অসম্ভব।
কিন্তু মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো একপেশেভাবে ইরানের ড্রোন সরবরাহকে সন্ত্রাসবাদী কাজে সাহায্যহিসেবে দেখাচ্ছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহারকে গণতন্ত্রচর্চা বলে ন্যায্যতা দিচ্ছে।
আজ পশ্চিমের গণমাধ্যমের এই দ্বিমুখী নীতি নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে!



Thursday, March 9, 2023


পাকিস্তান আজ ফুটো কলসি

কানাডার বিখ্যাত কফি ব্র্যান্ড টিম হর্টন্স বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে লাহোরে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি। টিম হর্টন্সের সেই দোকানে এখন নাকি পা ফেলারও জায়গা নেই। পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকা জানাচ্ছে, কানাডার এই ব্র্যান্ড ৬১ বছরের ইতিহাসে প্রথম দিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রির রেকর্ড গড়েছে লাহোরেই। দামি কফি ও পেস্ট্রি কেনার জন্য ভিড়ে ঠাসা সেই দোকান দেখলে কে বলবে, গোটা দেশ ‘দেউলিয়া’ ঘোষণার অপেক্ষায়!

গত কয়েক মাস ধরেই আর্থিক সঙ্কটে ন্যুব্জ একটা দেশ। জ্বালানির চড়া দাম, বিদ্যুতের চড়া বিল, ভর্তুকি কমে আসা এবং সর্বোপরি ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতিসব কিছু একযোগে সে দেশের জীবনযাত্রার মানের অবনমন ঘটিয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। তার সঙ্গে প্রতিদিনই অন্তত ৩০-৪০ টাকা করে লাফ দিয়ে বাড়ছে খাবারের দাম। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পাকিস্তানিরা সবাই এখন লাইনে দাঁড়িয়ে। হতদরিদ্র মানুষ সশস্ত্র প্রহরায় স্বল্প মূল্যের আটার জন্য লাইনে, আর উচ্চবিত্তদের বিশাল লাইন টিম হর্টন্সে। এটাই পাকিস্তানের দুই মুখ। আটা এবং কফির লাইন। খোলাবাজারে আটার দাম যখন প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ পাকিস্তানি টাকা, একশ্রেণির মানুষ তখন ৩৫০ টাকা দিয়ে ছোট্ট এক কাপ কফি গিলছে দেদার। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ উঠেছে, দেশের অর্থনীতির এই হাল আকাশপাতাল বিভাজনের জন্যই। দেশের সম্পদ একটি অংশের কুক্ষিগত। তারা ধনী হয়েই চলেছে। অন্য অংশ পরিস্থিতির পাকে দুর্ভোগ সহ্য করে চলেছে। টিম হর্টন্স চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানে বৈষম্য কতটা উৎকট!

পাকিস্তানে যারা ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গঠনের পক্ষে, তারা এ কথা বিশ্বাস করে যে জিন্না ইসলামকে একটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। ইসলাম যদি এই রাষ্ট্রের প্রধান খুঁটি হয়, তো ভারত-বিরোধিতা তার দুই নম্বর খুঁটি। প্রথম খুঁটিকে পোক্ত করার জন্যই প্রয়োজন দ্বিতীয় খুঁটিটির। যে যত ভারতবিরোধী, মুসলিম হিসেবে তার ক্রেডেনশিয়াল তত পাক্কা। এই যুক্তি মাথায় রেখে পাকিস্তানের সব রাজনীতিক কে কার চেয়ে বেশি ভারতবিরোধী, সেই প্রতিযোগিতা চালিয়ে গিয়েছেন। ইসলাম বিপন্ন, এই স্লোগান পাকিস্তানি রাজনীতিকরা আগাগোড়াই দিয়ে এসেছেন। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারত, সে যেকোনও সময় আক্রমণে প্রস্তুত। অতএব, ইসলামকে বাঁচাতে হলে ভারতকে রুখতে হবে। দেশের ভিতর যে এই যুক্তির বিরোধিতা করবে, তার কপালে তকমা জুটবে ভারতপন্থী। অতএব সে ইসলামবিরোধী এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরোধী। গোড়ার দিকে পাকিস্তানি রাজনীতিকরা ধরে নিয়েছিলেন, এই ফর্মুলায় তাঁদের পক্ষে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা কঠিন হবে না। কিন্তু সমস্যা হল বহির্গত বিপদযদি রাজনৈতিক পাশা খেলায় প্রধান ঘুঁটি হয়, তাহলে যাঁরা সেই হুমকি মোকাবিলায় জান বাজি রাখছেন, সেই সেনাকর্তারা রাজা-উজির না হয়ে রাজা-উজির হবেন কি না অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত রাজনীতিক? পাক অভিজাতরাও মনে করেন, সামরিক বাহিনী তাঁদের একমাত্র ভরসা।

সম্প্রতি পাকিস্তানের আর্থিক সংকট বিষয়ে এক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল দ্য ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন। সেখানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাক বংশোদ্ভূত অধ্যাপক আতিফ মিয়া বলেছেন, পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের মূল কারণ সেনা পরিচালিত পারিবারিক শাসন। পারিবারিক শাসনে ক্ষমতাসীনরা তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও স্তাবকদের দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত করে। ফলে এই শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য কায়েমি স্বার্থ তোষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ পরিবারের শাসন চলছে। পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে সেনাবাহিনী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেক্সিকোকে খেয়ে ফেলেছে ড্রাগ কার্টেল, ইতালিকে মাফিয়া আর পাকিস্তানকে মিলিটারি। পাকিস্তানে আজ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ সামরিক ব্যয়ের বিপুল বোঝা। সাড়ে পাঁচ লাখের সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক যুক্তিতে কোনওভাবেই এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে নানা সময়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭১-২০২৩ পর্বেও পাকিস্তানের শাসকের ভূমিকা থেকে সামরিক বাহিনীকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। কিছুদিন পরপর সামরিক একনায়করা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে। শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছে তারা। আর অনামে, বেনামে বা ভিন্ন নামে সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে প্রতিটি সরকার তাদের ভাগ্যনিয়ন্তাকে তুষ্ট করে রাখে, যাতে গলা ধাক্কা খেয়ে মসনদ থেকে নেমে যেতে না হয়। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা থেকে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পিছনেও সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কলকাঠিই তার প্রমাণ।

পাকিস্তানে সর্বগ্রাসী দৈত্যের মতো শুধু সামরিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর কোনও প্রতিষ্ঠানকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে দেয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিচার বিভাগকে ক্রমাগত কোণঠাসা করা হয়েছে। মৌলবাদী গোষ্ঠীকে হাতে রাখতে গিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে শ্বাসরুদ্ধ। শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মান্ধতাকে চাপিয়ে দিয়ে তাকে করা হয়েছে অদক্ষ ও উৎপাদনবিমুখ। সব দেশ নিজের গুণে সম্পদ গড়ে। বিশ্বের একমাত্র দেশ পাকিস্তান সম্পদের ভাগ্য গড়েছে প্রতিবেশীকে ব্যবহার করে।

১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েতের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকার কাছ থেকে মোটা কমিশন পেয়েছে পাকিস্তান। তার কাজ ছিল তালিবান ও সন্ত্রাসবাদীদের লালনপালন করে রুশ বাহিনীর উপর আক্রমণ করা। তাই গোটা আশির দশক মার্কিন সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল রমরমা। ওই দশকে পাকিস্তানের গড় জিডিপি ছিল ৭ শতাংশের কাছাকাছি। সামরিক প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের নেতাদের বুঝিয়েছিল, যে কোনও যুদ্ধ প্রতিবেশীর সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে পারলে তা পাকিস্তানের জন্য স্বাস্থ্যকর। আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে দিল। গোটা নব্বইয়ের দশকে বড় কোনও যুদ্ধ আশপাশে না থাকায় পাকিস্তান ভারতকে টেক্কা দেওয়ার জন্য পারমাণবিক বোমায় মনোযোগ দিল। কাশ্মীর নিয়ে বিক্ষিপ্ত লড়াইয়েও খুব একটা উপকার হয়নি। ওই দশকে পাকিস্তানের গড় জিডিপি ৭ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নেমে আসে। ভাগ্যচক্রে পাকিস্তানের আবার সুদিন নিয়ে আসে ২০০১ সালের নাইনইলেভেন। আফগানিস্তানে ছিল আলকায়েদার আস্তানা ও তালিবানের চারণভূমি। তা ভাঙতে মার্কিন সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানি সেনাশাসক যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ফের পাকিস্তানের অর্থনীতি হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু ততদিনে ব্যাপক সামরিকীকরণ ক্যানসারের মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কোনও না কোনও ভাবে পাকিস্তান দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় থাকা দেশ হয়ে থাকার মধ্যে যেন মোক্ষের দিশা দেখতে পেয়েছিল।

১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩০ বছরে ভারতে মোট সরকারি ব্যয়ের প্রায় ১০ শতাংশ দেওয়া হয়েছে সামরিক খাতে। যুদ্ধপ্রেমী পাকিস্তানে তা প্রায় ২১ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা এই খরচের সিংহভাগকে অনুৎপাদনশীল খাতের খরচ বলে ধরে থাকেন। ওদের এই ২১ শতাংশও নাকি কম দেখানো। আসলে তা ৩০ শতাংশের উপরে বলে দাবি। একটা রাষ্ট্রের মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যদি এই যুদ্ধবাহিনী পুষতেই চলে যায় তাহলে সে দেশের উন্নয়ন খাতে আর থাকে কী। তাই দু’হাত তুলে আইএমএফকে ডাকাডাকি। আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জিও পলিটিক জানিয়েছে, পাকিস্তান এখনও পর্যন্ত আইএমএফ থেকে ১৪টি ঋণ নিয়েছে। তার একটিও পরিশোধ করতে পারেনি। অর্থনৈতিক দৈনতা মোকাবিলায় তারা গত ৭৫ বছরে ২৩ বার আইএমএফের বেল আউট প্যাকেজের সাহায্য নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর মুর্তজা সইদ বলেছেন, ‘আমরাই আইএমএফের নিয়মিত গ্রাহক। একইসঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন করা ভারত মাত্র সাতবার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। ১৯৯১ সালে মনমোহন সিংয়ের যুগান্তকারী সংস্কারের পর তারা একবারও আইএমএফের কাছে যায়নি।’ আরও একধাপ এগিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ‘আমরা এক দেউলিয়া দেশের বাসিন্দা।’ শুনলে অবাক হবেন, পাকিস্তানে আয়কর দেন দেশের মাত্র ০.৬ শতাংশ নাগরিক। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নীচে নেমে যাচ্ছে। ২০২২ সালে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গিয়েছে ১৪৭ নম্বরে।

যেকোনও দেশের নেতারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অনেক প্রতিষ্ঠানের অদল-বদল ঘটায়। এটাই নিয়ম। কিন্তু এই নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তান। সেখানে একটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র চালায়। তারাই নেতৃত্বের রাশিফল ঠিক করে দেয়। যার ফলে ৭৫ বছরে পাকিস্তান ফেল্ড স্টেট-এ পরিণত হয়েছে।

গোটা দুনিয়া বলছে, পারমানবিক বোমা, এফ-সিক্সটিন আর সামরিক দাপটের পাকিস্তান যেন আজ ফুটো কলসি!

Thursday, March 2, 2023

 

আদানি সাম্রাজ্যের নেপথ্য কারিগর!

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘মাল্টি-বিলিয়ন ডলার জালিয়াতির মূল খেলোয়াড়গৌতম আদানি নন, বরং তার বড় ভাই বিনোদ আদানি। গৌতমকে সামনের সারিতে রেখে পর্দার আড়ালে মূল কাজ করার অভিযোগ এই সাইপ্রাসের পাসপোর্টধারী ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দার বিরুদ্ধে। অভিযোগ মার্কিন বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসেরও...

মুম্বইয়ে পাওয়ার লুম দিয়ে ব্যবসা শুরু। সালটা ১৯৭৬। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের ছাপ ফেলতে সিঙ্গাপুরে একটি অফিস খুলেছিলেন। সেখানেই বসবাস শুরু করেন। যদিও পরবর্তীতে চলে যান দুবাই। সেখানে জ্বালানি এবং নির্মাণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চিনি, তেল, অ্যালুমিনিয়াম, তামা এবং লোহার স্ক্র্যাপের ব্যবসার সঙ্গেও যোগ রয়েছে। এই ধনীতম অনাবাসী ভারতীয়ের সম্পদের পরিমাণ ১,৬৯,০০০ কোটি টাকা। হিসেব বলছে, প্রতিদিন গড়ে ১০২ কোটি টাকা আয় করেন। গত পাঁচ বছরে সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ গুণ। এটাই তাঁর সব পরিচয় নয়। আসলে পরিচয়, তিনি গৌতম আদানির দাদা— বিনোদ আদানি।

১৯৮০-এর দশকে ১ হাজার ডলারের বিনিময়ে একটি ছোট প্লাস্টিক প্যাকেজিং কারখানা কিনেছিলেন বিনোদ। সেটিও নিজের বহুদিনের টাকা জমিয়ে এবং ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে। এরপর সেটি চালানোর ভার দিয়ে দেন ছোট ভাই গৌতমের হাতে। দু’জন একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই বিনোদ আদানি ২০১৮ সালে ভারতের ধনীতম ব্যক্তিদের তালিকায় ৪৯তম স্থানে। আর গত চার বছরের মধ্যে এক লাফে উঠে এসেছেন ষষ্ঠ স্থানে। কীভাবে এই উল্লম্ফন? প্রশ্নটা তুলেছে মার্কিন শর্ট সেলার কোম্পানি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। তারা মনে করছে, আদানি সাম্রাজ্যের নেপথ্য কারিগর আসলে গৌতম নন, এই বিনোদ আদানি। জানুয়ারি মাসের শেষে প্রকাশিত হওয়া প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির নাম উঠেছে ৫৪ বার। অন্যদিকে, বিনোদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে ১৫১ বার। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে অভিযোগ, বিদেশে আদানি গোষ্ঠীর যাবতীয় লেনদেন সামলাতেন আড়ালে থাকতে পছন্দ করা বিনোদই। তাঁর সংস্থার হাত ধরেই শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি-র নিয়ম এড়িয়ে ভুয়ো লেনদেনের মাধ্যমে টাকা ঢুকেছে আগানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থায়। শুধু তাই-ই নয়, আদানির বিভিন্ন শেয়ারে লগ্নির বদলে গোপনে রাশিয়ার ব্যাঙ্কের থেকে প্রায় ২৪ কোটি ডলারের বেশি (প্রায় ১৯৮০ কোটি টাকা) ঋণ নিয়েছেন বিনোদ। আদানিরা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

অন্য একটি রিপোর্ট বলছে, হোলসিমের ভারতীয় ব্যবসা কেনার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রয়েছে বিনোদের সংস্থার। এ ছাড়াও আদানিদের বেশ কয়েকটি সংস্থার ক্ষেত্রে ঘুরপথে টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা করেছেন বিনোদ। যার হাত ধরে বাধ্যতামূলকভাবে ২৫ শতাংশ শেয়ার প্রোমোটারদের বাইরের লগ্নিকারীদের হাতে থাকার নিয়ম এড়াতে পেরেছে আদানিরা। এমনকি অস্ট্রেলিয়ায় তাদের কয়লা খনি প্রকল্প নিয়ে আলোচনার সময়ে বিনোদই ছিলেন বিদেশে লেনদেনের মূল মাথা।

সম্প্রতি মার্কিন বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের সাংবাদিক জন হায়াট ও জিয়াকোমো তোগনিনি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, বিনোদ অনেকগুলি অফশোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সেগুলির সাহায্যে এক গোলকধাঁধা তৈরি করেছেন। যার সাহায্যে ভারতে থাকা আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলি থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সরানো হয়েছে। আর এর বেশিরভাগ লেনদেনই হয়েছে গোপনে। এর ফলে আদানি গ্রুপ ভারতীয় আইনকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, কোনও পাবলিক-ট্রেডিং স্টকে থাকা কোম্পানির কমপক্ষে ২৫ শতাংশ শেয়ার ওই কোম্পানির মালিকের সঙ্গে জড়িত কারও অধীনে থাকতে পারবে না। তবে আদানি গ্রুপ তাদের চেয়ারম্যানের ভাইয়ের সঙ্গে মালিকানার সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ দিন পর এর পাল্টা প্রত্যুত্তরে লেখা ৪১৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপ দাবি করে, বিনোদ আদানি পাবলিক লিস্টে থাকা আদানি গ্রুপের কোনও প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার পদে নেই, এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কাজকর্মেও তাঁর কোনও অংশগ্রহণ নেই। তবে ফোর্বস এর আগেও বিনোদ আদানির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ভুয়ো কোম্পানির সঙ্গে আদানি গ্রুপের অপ্রকাশিত লেনদেনের খবর পেয়েছে। যেগুলিকে আদানি গ্রুপের লাভের জন্যই তৈরি করা হয়েছে বলে মনে হয়। এই চুক্তিগুলি হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনে থাকা গোপন লিভারেজ এবং অ্যাকাউন্টিংয়ে অনিয়মের অভিযোগকেও আরও শক্ত ভিত দিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি ফাইন্যান্সের কর্তা টিম বাকলির কথায়, ‘আমি তো সবসময়েই ভেবেছি এটা একটা যৌথ উদ্যোগ। গৌতম বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ ব্যক্তিত্ব যিনি সবার সামনে নিজেকে প্রকাশ করেন। অন্যদিকে বিনোদ এর সবকিছুর পিছনে থাকা ব্যক্তি। ট্যাক্স হেভেনের মাস্টারমাইন্ড। আসল পাপেট মাস্টার।’ ফোর্বসের অনুরোধ সত্ত্বেও আদানি গ্রুপ এবং বিনোদ আদানি কোনও প্রত্যুত্তর দেননি। যদিও বিনোদের ইমেল ঠিকানা আদানি গ্লোবাল ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, যে নামে দুবাইয়ে বেশ কিছু সম্পত্তি রয়েছে।

ফোর্বসের সাংবাদিক জন হায়াট ও জিয়াকোমো লিখছেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিনোদের যে লেনদেন রয়েছে তা সাধারণ চোখেই ধরা পড়েছে। গত বছরেই বিনোদের এনডেভার ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড কোম্পানিটি আদানি গ্রুপের সিমেন্ট ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। ভারতীয় দুই সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানির সুইস প্রতিষ্ঠান হোলসিমের মালিকানা ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় আদানি গ্রুপ, যা তাদের পরিণত করে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারী গ্রুপ হিসেবে। সেই সময় সংস্থার তরফে এবং তাদের ব্যাঙ্কগুলি লেনদেনের নথি প্রকাশ্যে আনে। ওই নথিতে উঠে আসে, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ভার্জিন, মরিশাস এবং দুবাইয়ের সাতটি সংস্থার নাম। যারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার মধ্যে একটি ফার্ম সিমেন্ট কোম্পানির শেয়ার খোলা বাজার থেকে কিনবে বলে ঠিক হয়। নথিতে উল্লেখ করা হয়, এর ফলে গৌতম আদানি লাভবান হবেন না। বরং দাদা বিনোদ এবং তাঁর স্ত্রী রঞ্জনবেনকে বেনিফিশারিহিসেবে দেখানো হয়। এভাবেই আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন লেনদেনে ভূমিকা নিয়েছিলেন বিনোদ। যেখানে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। 

আরও কিছু লেনদেন রয়েছে, যেগুলি বেশ অস্পষ্ট। যেমন— সিঙ্গাপুরের পিনাকল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পিটিই কোম্পানি পরোক্ষভাবে বিনোদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০২০ সালে কোম্পানিটি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভিটিবি ব্যাঙ্কের সঙ্গে একটি ঋণ চুক্তি করে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে পিনাকল কোম্পানি ব্যাঙ্কটি থেকে ২৬৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে আরেকটি নামহীন সংশ্লিষ্ট পক্ষকে ২৫৮ মিলিয়ন ডলার ধার দেয়। সিঙ্গাপুরের ডকুমেন্ট অনুযায়ী, ওই বছরের শেষের দিকে পিনাকল তাদের ঋণ নেওয়ার গ্যারান্টর হিসেবে দু’টি ফান্ড কোম্পানির নাম লিপিবদ্ধ করে। আফ্রো এশিয়া ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড এবং ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইমার্জিং মার্কেট হোল্ডিং লিমিটেড। তবে ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জের ফাইল অনুযায়ী, বিনোদ মরিশাস-ভিত্তিক অ্যাক্রোপলিস ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের চূড়ান্ত সুবিধাভোগী মালিক। যে কোম্পানিটি আবার ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইমার্জিং মার্কেট হোল্ডিং লিমিটেড নিয়ন্ত্রণ করে।

এদিকে আফ্রো এশিয়া ট্রেড এবং ওয়ার্ল্ডওয়াইড উভয়ই আদানি গ্রুপের বড় শেয়ারহোল্ডার। এই দু’টি তহবিল একত্রে আদানি এন্টারপ্রাইজ, আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি পোর্টস এবং আদানি পাওয়ারের ৪ বিলিয়ন ডলার স্টকের মালিক। 

বিনিয়োগ ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ট্রেন্ডলাইনের মতে আফ্রো এশিয়া ট্রেড এবং ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কাছে অন্য কোনও সিকিউরিটিজ নেই। এর অর্থ পিনাকলের ঋণ মূলত আদানি কোম্পানির শেয়ারের উপর নির্ভর করছে! একইসঙ্গে এই দু’টি ফান্ডের কোনওটিই ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জের ফাইলে আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলিতে তাদের শেয়ারের কথা প্রকাশ করেনি।

সাংবাদিক জন হায়াট ও জিয়াকোমো লিখছেন, আদানি সাম্রাজ্যের পাবলিক ফেস হলেন গৌতম আদানি, অন্যদিকে বিনোদ আদানি কাজ করেন পর্দার আড়ালে। তার খুব কম ছবিই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। সাইপ্রাসের পাসপোর্টধারী এবং সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা বিনোদের বেশ কিছু নাম রয়েছে। যার মধ্যে একটি হল বিনোদ শান্তিলাল শাহ। যদিও তাঁর জন্ম সাল কবে তা এখনও রহস্য। ফোর্বসের হিসেব অনুযায়ী, বিনোদের সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ১.৩ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাব করা হয়েছে মূলত ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইমার্জিং মার্কেট হোল্ডিং লিমিটেড এবং এনডেভার ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের উপর তাঁর মালিকানাকে ভিত্তি করে। এই দু’টি কোম্পানিই দুই সিমেন্ট কোম্পানিসহ বেশ কিছু আদানি গ্রুপ কোম্পানির শেয়ারেরও মালিক।

তবে গৌতমের ব্যবসার সঙ্গে বিনোদ কতটুকু জড়িয়ে আছেন তা এখন পুরোপুরি জানা যায়নি, যে কারণে ধারণা করা হচ্ছে, বিনোদের সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি। ওয়াশিংটন ডিসির প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের রিয়েল এস্টেট সম্পর্কিত ডেটা অনুযায়ী, দুবাইয়ে বিনোদের ১০টি সম্পত্তি রয়েছে। তাছাড়া সিঙ্গাপুরে তাঁর অ্যপার্টমেন্টের দামও প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার। ফোর্বস তদন্ত করে বের করেছে, বিনোদ অন্তত ৬০টি ভুয়ো কোম্পানির সঙ্গে জড়িত, যেগুলি ছড়িয়ে আছে বাহামাস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, কেইম্যান আইল্যান্ড, সাইপ্রাস, মরিশাস, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট থেকে প্রকাশিত পানামা পেপার্স অনুযায়ী, বিনোদ ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে বাহামাসে একটি কোম্পানি তৈরি করেন। দুই মাস পরে তিনি কোম্পানিটির ডকুমেন্টে তার নাম বিনোদ শান্তিলাল আদানি থেকে পরিবর্তন করে বিনোদ শান্তিলাল শাহ করার অনুরোধ করেন। বিনোদের ব্যবসা যখন দুবাইতে বেড়ে চলছিল, ওই সময়ে গৌতমও তাঁর ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৪ সালে একে পাবলিক কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি অন্তত ২০১১ সাল পর্যন্ত আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলির বিভিন্ন উচ্চ পদে ছিলেন। বিনোদের ৪৪ বছরের ছেলে প্রণব এখনও আদানি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

২০১৪ সালের একটি কেলেঙ্কারিতে বিনোদ জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সেই বছর আদানি গ্রুপ পাওয়ার প্ল্যান্টের সরঞ্জাম কেনার জন্য অতিরিক্ত ওভার-ইনভয়েসিং করে সেটিকে ৮০০ মিলিয়ন ডলারে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করে ভারতের ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স। তাদের অভিযোগ, বিনোদ বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের জন্য আদানি গ্রুপের কর্মীদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। মামলাটি প্রাথমিকভাবে বাতিল করা হলেও সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে এবং এখনও ভারতের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের হাতে বিচারাধীন রয়েছে। আদানি গ্রুপ অবশ্য সমস্ত অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছে।

২০১২ সালে আরেকটি ধারাবাহিক লেনদেনের সময়, সাইপ্রাসে থাকা ভাকোডার ইনভেস্টমেন্টস নামে বিনোদ আদানির আরও একটি কোম্পানি দুবাইয়ের একটি ভুয়ো ফার্মের কাছ থেকে ২৩২ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। ভাকোডার এরপর ডিবেঞ্চার কেনার জন্য ২২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আদানি এস্টেটস এবং আদানি ল্যান্ড ডেভেলপারস নামে দু’টি প্রতিষ্ঠানে। যেগুলি আদানি ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্সের অন্তর্ভুক্ত। এই ডিবেঞ্চারগুলির মেয়াদ পরে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যার অর্থ বিনোদ এখনও এগুলির মালিক।

২০১২ সাল পর্যন্ত, আদানি ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্স আদানি এন্টারপ্রাইজের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে হওয়া এই লেনদেনের সময় আদানি এন্টারপ্রাইজ আদানি ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্স প্রতিষ্ঠানকে বিক্রি করে দেয়। আদানি এন্টারপ্রাইজের ২০১৩ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী ৮১.৫ মিলিয়ন ডলার লাভ করে তারা। চার বছর পর কোম্পানিটি আদানি এন্টারপ্রাইজের বার্ষিক প্রতিবেদনে পুনরায় আবির্ভূত হয়, এবার একটি ‘রিলেটেড এন্টারপ্রাইজ’ হিসেবে। এই প্রসঙ্গে নিউ সাউথ ওয়েলস বিজনেস স্কুলের সহকারী অধ্যাপক মার্ক হামফ্রে-জেনার বলেন, ‘আদানি এন্টারপ্রাইজের ব্যালান্স শিটে আদানি ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্সের এই পুনরায় আবির্ভূত হওয়ার ফলে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। কোম্পানিটি কি আদৌ বিক্রি হয়েছিল? যারা আদানি গ্রুপে বিনিয়োগ করেছেন তাদের জন্য চিন্তার বিষয় যে, কোম্পানিটি আদৌ লাভ করেছে নাকি তাদের চোখে লাভ দেখানোর ধুলো দেওয়া হয়েছে।’

২০১২ সালের তথাকথিত ‘বিক্রি’র পরও ফোর্বস খুঁজে পেয়েছে যে ২০১৭ সালেও আদানি পরিবার তাদের আরও একটি কোম্পানি আদানি প্রপার্টিজের মাধ্যমে আদানি ইনফ্রাস্টাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্সের মালিকানা ধরে রেখেছে। এই আদানি প্রপার্টিজের শেয়ারহোল্ডার আবার তিনটি। আদানি ফ্যামিলি ট্রাস্ট, আদানি এন্টারপ্রাইজের অধীনে থাকা আদানি কমোডিটিজ এলএলপি এবং গৌতম আদানির ছেলে করণ আদানি। হোয়ার্টন স্কুলের অ্যকাউন্টিংয়ের অধ্যাপক ড্যান টেইলর জানান, ‘এটা দেখে মনে হচ্ছে আয় বাড়িয়ে দেখানোর জন্য অথবা ঋণ কমানোর জন্য এই (ভুয়া বিক্রি) করা হয়েছে। আর তাই প্রশ্ন চলেই আসে, এই লেনদেনের সঙ্গে বাস্তব ব্যবসায়িক কারণ কী ছিল?

এই লেনদেনের আরও একটি কারণ থাকতে পারে, আর তা হল পারিবারিক রাজনীতি। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট যেভাবে বিনোদকে ‘মাল্টি-বিলিয়ন ডলার জালিয়াতির মূল খেলোয়াড়’ হিসেবে তুলে ধরেছে, তাতে বিনোদ নিঃসন্দেহেই অপমানিত বোধ করবেন। কারণ, তিনি বা তাঁর কোনও পরামর্শদাতা ২০১৬ সালে একটি পত্রিকায় স্পনসর্ড সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে লেখা হয়েছিল: ‘মিথ্যা ও দুর্নীতিতে ছেয়ে থাকা এই সময়ে এমন লোকের সংখ্যা বিরল। যারা তাদের কথা অনুযায়ী চলাফেরা করে এবং স্বার্থপরতার মাধ্যমে লাভ করার চেয়ে সততা এবং আনুগত্যকে বেছে নেয়। বিনোদ শান্তিলাল আদানি এমনই মূল্যবোধ সমৃদ্ধ একজন মানুষ। যা তিনি তাঁর পরিবার থেকে পেয়েছেন এবং নিজেও অনুশীলন করেছেন।’

এরকম একের পর এক ভয়ঙ্কর তথ্য ফাঁস হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই আদানি সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক কী? তাঁর আশীর্বাদে আদানিরা কী কী সুবিধা পেয়েছে? এত বড় কেলেঙ্কারির অভিযোগ, শেয়ার বাজারে আদানির প্রবল পতনের পরেও কেন তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না? কিন্তু এইসব বিতর্কের উত্তর দেওয়ার মতো গণতান্ত্রিক সৌজন্যবোধ ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে আর নেই। অতএব, প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে গোটা বক্তৃতায় আদানির নাম নিলেন না, শুধু বললেন যে মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে, মানুষের জন্য তিনি কাজ করেছেন। বিরোধীরা আর কোনও ইস্যু খুঁজে না পেয়ে তাঁর চরিত্রহনন করতে চাইছে...

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদে দাঁড়িয়ে বুক ঠুকে বললেন, আমি একাই লড়ছি সবার বিরুদ্ধে। দেশের কাজ করার জন্য বেরিয়েছি। রাজনীতির কারবারিদের তাই আমাকে পছন্দ হচ্ছে না। শুনে ভক্তদের চোখে জল, মুখে স্লোগান, নেট সরগরম, মিডিয়া আপ্লুত। আহা! প্রধানমন্ত্রীর বাচনভঙ্গি, তাঁর আক্রমণাত্মক বক্তব্যের কোনও জুড়ি নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতই বলেছেন মোদিজি। মোদি হ্যায়, তো মুমকিন হ্যায়।

এর অর্থ একটাইমোদির বন্ধু হলে আপনার কোনও চিন্তা নেই। গভীর এবং গুরুতর অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে থাকলেও ইডি-সিবিআই কেন, পাড়ার হাবিলদারও আপনাকে কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে না। কারণ ইডি, ইনকাম ট্যাক্স, সিবিআই ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলি আর মানুষের স্বার্থে কাজ করে না। তারা কাজ করে মোদির স্বার্থে এবং মোদি বিরোধীদের বিরুদ্ধে। ভারতে থাকলে মোদির পক্ষে থাকতে হবে। বিপক্ষে থাকলে গব্বর সিংহের মতন ইডি-সিবিআই-আয়কর আপনাকে ভয় দেখাতে আসবেই।

আপনাকে বলা হবে, মোদির নেতৃত্বে দেশজুড়ে উন্নয়ন চলছে। আদানি সেই উন্নয়নেরই অংশ। তাই আদানিও বলে রেখেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা। তাদের বক্তব্য মার্কিন সংস্থার এই রিপোর্টটি আদতে ভারতের বিরুদ্ধে বানানো। একদিকে সরকার নিশ্চুপ, অন্যদিকে আদানি বলছেন তাকে প্রশ্ন করা মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা। যদি মেনে নিতে হয় যে আদানিকে প্রশ্ন করা মানে ভারতকে প্রশ্ন করা তাহলে জাতীয়তাবাদের নামে আমাদের মেনে নিতে হবে যে আদানিদের মতন ব্যক্তিরা শেয়ারবাজারে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ালেও চুপ করে থাকাই শ্রেয়। শিল্পপতি এবং দেশ যদি সমার্থক হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে দেশে ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হচ্ছে। বেনিতো মুসোলিনি বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে কর্পোরেট এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। আমাদের দেশে আদানির প্রতি সরকারের পক্ষপাত এবং দেশের সঙ্গে সংস্থার তুলনা মুসোলিনির ধারণাকেই যেন মান্যতা দেয়।

এই আদানির ভারতে আপনাকে স্বাগত!

https://www.forbes.com/sites/johnhyatt/2023/02/17/gautam-adanis-older-brother-vinod-adani-controls-offshore-empire-with-links-to-adani-group/?sh=6ba865d364cd


Monday, February 27, 2023

 

প্রতারক স্যাম, কিপ্টো দুনিয়ার পতন

অশরীরী মুদ্রার খেলা দেখেছিল আমেরিকা!

গত বছর ঠিক এই সময় ন্যাশনাল ফুটবল লিগ জিতেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস র‌্যামস। ফাইনালে হেরে গিয়েছিল সিনসিনাটি বেঙ্গলস। শুধু খেলা নয়, সেই রাতে প্রায় ১০ কোটি দর্শকের চোখ আটকে গিয়েছিল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলগুলির প্রচারিত বিজ্ঞাপনে। একরাশ উত্তেজনা নিয়ে আমেরিকানরা দেখেছিলেন, খেলার ফাঁকে ফাঁকে ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সির ‘অবাক করা’ বিজ্ঞাপন। যেখানে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম ‘এফটিএক্স’র বিজ্ঞাপন। তাতে ক্রিপ্টোর নিরাপদ ও সহজ পথ হিসেবে পরিচিত করাতে আসরে নামানো হয় আমেরিকার বিখ্যাত কমেডিয়ান ল্যারি ডেভিডকে। কোকাকোলা কিংবা জেনারেল মোটরসের মতো প্রথম সারির কোম্পানিগুলিকে পিছনে ফেলে ডিজিটাল মুদ্রার এমন ‘দামী’ বিজ্ঞাপন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে যায়। তাহলে কি এতদিনে ডিজিটাল মুদ্রা সাবালক হয়ে উঠল? উত্তর পেতে বেশি সময় লাগেনি।

দুনিয়াজুড়ে এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা ক্রিপ্টোলজি ব্যবহার করে যে বৈদ্যুতিন মুদ্রা তৈরি হয়, তারই নাম ক্রিপ্টোকারেন্সি। এই মুদ্রা হাতে ছোঁয়ার উপায় নেই, এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র ভার্চুয়াল জগতে। ব্লকচেননামে এক প্রযুক্তি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে এই অশরীরী মুদ্রা। এই ব্যবস্থায় প্রতিটি লেনদেন যেভাবে ডিজিটাল ব্লকের মাধ্যমে চিহ্নিত করা থাকে, সেই ব্লকচেনভেদ করা প্রযুক্তিগত ভাবে অসম্ভব, এমনটাই দাবি। এই আর্থিক ব্যবস্থায় ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা আমেরিকার ফেডারেল ব্যাঙ্কের মতো কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। যে কোনও দুই সংস্থা বা ব্যক্তির ক্রিপটোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট থাকলে তাঁরা কোনও নগদ ছাড়াই নিজেদের মধ্যে ক্রিপটোকারেন্সি লেনদেন করতে পারেন। কোনও বিপণির ক্রিপটোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট থাকলে সেখান থেকে গ্রাহকরা ক্রিপটোকারেন্সিতেই জিনিসপত্র কিনতে পারেন। ছাপোষা মানুষের ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে প্রচলিত ধারা মেনে বিনিয়োগ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। অর্থাৎ টাকা-ডলার-পাউন্ড ভাঙিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনে আশা রাখতে হবে যে এর মূল্য দিন দিন বাড়বে। নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই আর্থিক ব্যবস্থার পক্ষে দীর্ঘদিন ধরেই সওয়াল করে আসছেন পৃথিবীর প্রযুক্তিবিদদের একাংশ।

এই মুদ্রার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, এতে লেনদেনকারীর পরিচয় গোপন থাকে। তার বদলে ব্যবহার হয় সঙ্কেতলিপি। অর্থাৎ, অন্য ডিজিটাল লেনদেনে যেমন বলা যায়, তা কার কাছ থেকে কার কাছে গিয়েছে, ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। শুধু জানা যায় এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যটিতে তার লেনদেন হয়েছে। তবে যদি এক্সচেঞ্জে এর লেনদেন (ট্রেডিং) করতে চান অথবা ক্রিপ্টোকারেন্সি ভাঙিয়ে টাকা হাতে নিতে চান, তা হলে পরিচয় গোপন রাখা শক্ত। বিনিয়োগের সুফল দ্রুত মিলবে, এমন আশ্বাসে ক্রেতা টেনেছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বেচাকেনার প্ল্যাটফর্মগুলি। তথাকথিত ক্রিপ্টো ওয়ালেটকে ব্যাঙ্কের সঞ্চয়ী হিসেবের মতো করে তৈরি করা হয়। এতে উচ্চ হারে সুদের অফারও রয়েছে। প্রচলিত মুদ্রার উপর যাঁরা আস্থা হারিয়েছেন, তাঁদের কাছে ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগের বাড়তি সুবিধা হল, লেনদেনের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী কোনও নিয়ন্ত্রক নিয়ে চিন্তা নেই।

কিন্তু অশরীরী মুদ্রার উপর মানুষের বিশ্বাস জমাট বাধার আগেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে প্রথাগত আর্থিক মডেলের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি। একের পর এক। গত বছর মে মাসে ‍দুই ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা টেরাইউএসডি ও লুনার ব্যাপক পতন হয়। প্রায় সব দর হারায় মুদ্রা দু’টি। রাতারাতি ক্রিপ্টোমার্কেট থেকে উধাও হয়ে যায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিপ্টো হেজ ফান্ড থ্রি অ্যারোজ ক্যাপিটাল। এরপরই দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার আবেদন করে ভয়েজার ডিজিটালসেলসিয়াস নেটওয়ার্ক। দু’টি প্রতিষ্ঠানই অর্থ ধার দিয়েছিল থ্রি অ্যারোজ ক্যাপিটালকে। ‘এফটিএক্স’-এর পতন হয় আরও কয়েক মাস পরে। গত নভেম্বরে। পরের মাসেই উত্তর আমেরিকার বাহামাস থেকে গ্রেপ্তার হন এফটিএক্সের প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল বেঞ্জামিন ব্যাংকম্যান-ফ্রিড। যাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় প্রতারণার অভিযোগ। আমেরিকার সিয়াটেল ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের অধ্যাপক টিম লিউংয়ের কথায়, আগামী দিনে আরও অনেক দুঃসংবাদ হাজির হবে। দুনিয়ায় ক্রিপ্টো শীতের বদলে ক্রিপ্টো বরফ যুগ আসার শঙ্কাই বেশি...

কিপ্টোকারেন্সির কিং স্যামের পতন যতটা হতাশাজনক, উত্থান তার চেয়েও অনেক নাটকীয়। ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ এফটিএক্স আত্মপ্রকাশ করে ২০১৯ সালে। এর আগে স্যাম ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার মার্কেটে শেয়ার লেনদেনকারী হিসেবে কাজ করতেন। অঙ্কে মেধাবী, ধারালো বুদ্ধির স্যাম শেয়ার ব্যবসায়ী পুরনো ব্যবসা ছেড়ে এসেছিলেন ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসায়। তাঁর সঙ্গে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন গুগলের প্রাক্তন কর্মী গ্যারি ওয়াং। তাঁদের হাত ধরেই এফটিএক্স বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রিপটোকারেন্সি এক্সচেঞ্জে পরিণত হয়েছিল। যার গ্রাহকসংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। প্রতিদিন এখানে এক হাজার কোটি ডলারের ক্রিপটোকারেন্সি লেনদেন হতো। মাত্র পাঁচ বছরে স্যাম আয় করেছিলেন ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তরুণ বিলিয়নিয়ারের তালিকায় নাম লেখান এই মার্কিন বিনিয়োগকারী। রাতারাতি ধনী হওয়ার গল্প তখন আমেরিকার ঘরে ঘরে। কী করেন, কী খান, কেমন জীবনযাপন—সব।

নিরামিষাশি স্যাম রাতে ঘুমোন মাত্র ৪ ঘণ্টা। ভিডিও গেম খেলা তাঁর নেশা। প্রিয় গেম লিগ অব লিজেন্ডস। কেন তিনি এই গেম খেলেন তার কারণ ব্যাখ্যা করে একাধিক টুইটে স্যাম বলেছিলেন, ‘এই লড়াইয়ের খেলা খেলতে খেলতেই তার মাথা থেকে কোম্পানির প্রতিদিনের কোটি কোটি ডলারের ব্যবসার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।’ ফরচুন ম্যাগাজিন একসময় স্যামকে আগামীদিনের ওয়ারেন বাফেট হিসেবেও বলা শুরু করেছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে গত নভেম্বরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেউলিয়া হন কিপ্টোকারেন্সির এই বিলিয়নিয়ার। ক্রিপ্টোকারেন্সির জগতে এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্মগুলি যখন কুখ্যাত, তখনও এফটিএক্স নিজেদের বিশ্বস্থ হিসেবে জানান দিত। রাজনীতিবিদদের তহবিলে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যোগান দিয়েছিলেন এমআইটির একসময়ের তুখোড় ছাত্র স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রিড। সবসময় দাবি করতেন, তাঁর অর্থ উপার্জনের একমাত্র কারণ ভালো কাজ করা। কিন্তু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন জানিয়েছে, ব্যক্তিগত সুবিধের জন্যই গ্রাহকদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নয়ছয় করেছেন তিনি। কমিশনের দাবি, স্যাম প্রতারণা শুরু করেছিলেন একেবারে প্রথম থেকেই।

‘দ্য উইজার্ড অব লাইজ’ গ্রন্থের লেখক ডায়না হেনরিকসের কথায়, গড়পড়তা বিনিয়োগকারীরা বিনাপ্রশ্নে স্যামকে বিশ্বাস করেছিলেন। একজন প্রতারকের সবচেয়ে অপরিহার্য গুণ, তারা এমনভাবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন যা কখনও টলে না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও নেতিবাচক তথ্য মানুষের জানা থাকলেও। এফএফটিএক্সের গ্রাহকদের কাছেও সংস্থাটিকে বিশ্বাস করার মতো পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ ছিল না। তারপরও তারা স্রেফ বিশ্বাসের উপর ভর করে বিনিয়োগে এগিয়ে গিয়েছিলেন। স্যাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা যায়, ৫০টি বড় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে এফটিএক্সের দেনার পরিমান তিনশো কোটি ডলারের বেশি। এফটিএক্স-এ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করে কারা কারা অর্থ খুইয়েছেন তার সম্পূর্ণ তালিকা এখনও জানা যায়নি। তবে এই প্ল্যাটফর্মটির ইকুইটি ইনভেস্টর ছিলেন মার্কিন ফুটবলার টম ব্যাডি ও তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী, মডেল জিজেল বুন্ডশেন প্রমুখ। এফটিএক্স’র বিজ্ঞাপনেও দেখা গিয়েছিল তাঁদের। এই কোম্পানিকে সমর্থন জানাতে দেখা গিয়েছে কমেডিয়ান ল্যারি ডেভিড, টেনিস তারকা নাওমি ওসাকা, প্রাক্তন বাস্কেটবল তারকা শাকিল ও’নিল ও মার্কিন টিভি সিরিজ শার্ক ট্যাঙ্ক তারকা কেভিন ও’লিরিকে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন পর্ষদের রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশবাসীর ক্রিপ্টো হাতে রাখার ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে ইউক্রেন (১২.৭ শতাংশ) ও রাশিয়া (১১.৯ শতাংশ)। গত ফেব্রুয়ারি থেকে যুদ্ধ চলছে যাদের মধ্যে। তার পরে যথাক্রমে ভেনেজুয়েলা (১০.৩ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৯.৪ শতাংশ), কেনিয়া (৮.৫ শতাংশ) ও আমেরিকা (৮.৩ শতাংশ)। ২০টি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান সপ্তম। আর এর মধ্যে ১৫টিই উন্নয়নশীল দেশ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এর ব্যবহার বেড়েছে মূলত দ্রুত লেনদেনের সুবিধা থাকায় এবং মুদ্রার দামের পতন ও মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি এড়ানোর মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু তা তৈরি করছে বেশ কিছু আশঙ্কাও। যেমন এতে বাড়তে পারে ক্রিপ্টোর মাধ্যমে কর ফাঁকি, বেআইনি লেনদেন। প্রথাগত মুদ্রায় কমতে পারে নিয়ন্ত্রকের দখল। ক্রিপ্টোর ব্যবহার বিপুল বাড়লে তা আঘাত করতে পারে দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্বেও। বিশেষত যে সব দেশে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে নেমেছে, তাদের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টো বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কেমন ঝুঁকি, তা টের পাচ্ছে আমেরিকা!

সেই কবে ডায়না হেনরিকস লিখেছিলেন, ‘চোখের পলকে এক সুদর্শন রাজপুত্র কুৎসিত ব্যাঙে পরিণত হয়েছে।’