ডলারের
আধিপত্যে থাবা
ডলারের
আগে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিল ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের। ১৯২০ সাল পর্যন্ত দুনিয়ায় রাজত্ব
করেছে এই মুদ্রাই।
ডলারের আত্মপ্রকাশের আগে ৫০০ বছর ধরে যেসব মুদ্রা রাজত্ব করেছে তার মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মুদ্রা। বিশ্বের নানা প্রান্তে এসব দেশের কলোনি থাকায় তাদের মুদ্রাও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু গোটা পরিস্থিতি বদলে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৮) শুরুর পর থেকে।
এই লড়াইয়ে
আমেরিকা যোগ দিয়েছিল যুদ্ধ শুরুর আড়াই বছর পরে। সেই অর্থে যুদ্ধের আঁচড় আমেরিকার গায়ে
লাগেনি। যদিও আমেরিকা তার মিত্র দেশগুলির কাছে প্রচুর অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রি করা
শুরু করে। বিক্রি করা রসদের মূল্য পরিশোধ করা হয় সোনার মাধ্যমে। এভাবেই দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ আসতে আসতে বিশ্বের মোট মজুত সোনার একটি বড় অংশই আমেরিকার কোষাগারে জমা
হয়। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও আমেরিকা শেষ মুহূর্তে যোগ দেয়। ওই সময়ও মিত্রদের কাছে
প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে নিজেদের কোষাগারে বিপুল স্বর্ণমুদ্রা মজুত করে ফেলে
আমেরিকা। ইউরোপ তখন বিধ্বস্ত। মানুষের হাতে অর্থ নেই। খাবার নেই। কাজ নেই। সর্বত্র
হাহাকার।
এই অবস্থায় ১৯৪৪ সালে ৪৪টি দেশ আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে মিলিত হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই ৪৪টি দেশের মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হবে মার্কিন মুদ্রা ডলারের উপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হবে সোনার উপর ভিত্তি করে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুত সোনার ৭০ শতাংশ আমেরিকার হাতে। এই বিপুল সোনা মজুত ও ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় সেসব দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়। মূলত ডলারের আধিপত্য সেই থেকেই শুরু।
শুনলে অবাক হবেন, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, সেই সময় আক্ষরিক অর্থেই ভারতের ১ টাকা আমেরিকার ১ ডলারের সমতুল্য ছিল। কালক্রমে ডলারের চেয়ে দুর্বল হয়েছে ভারতীয় টাকা। স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫২ সালে। তারপর অনেক নির্বাচন এসেছে। রাজনৈতিক নেতারা বার বার আশ্বাস দিয়েছেন, টাকার দাম আরও বাড়িয়ে তোলাই তাঁদের লক্ষ্য। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। ১ ডলার = ১ টাকা তো দূরের কথা, দিন দিন বরং আরও দুর্বল হয়েছে ভারতীয় মুদ্রা।
১৯৫০ ও
৬০-এর দশকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি এবং জাপানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
তারা ডলার দিয়ে আমেরিকার কাছ থেকে বিপুল সোনা কিনতে থাকে। ক্রমশ ফাঁকা হতে শুরু
করে মার্কিন কোষাগার। সেই সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের খরচ মেটানোর চাপে ওয়াশিংটন বিপুল
পরিমাণ কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। কঠিন হয়ে পড়ে ডলারের সঙ্গে সোনার সংযোগ বজায়
রাখা। ১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করেন, সোনার উপর
ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। যা ‘নিক্সন শক’
নামে পরিচিত। এই সিদ্ধান্তে ডলার হয়ে যায় ‘ফিয়াট
মানি’ (কোনও সরকারের জারি করা একটি মুদ্রা)। তারপরও ডলারের
গুরুত্ব কমেনি। বিশ্বজুড়ে ডলারের আধিপত্য ধরে রাখতে ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের তীব্র
উত্তেজনার মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি করে আমেরিকা। তাতে বলা হয়,
সৌদি আরব থেকে বিশ্বের যেসব দেশ জ্বালানি তেল আমদানি করবে, তাদের
মূল্য পরিশোধ করতে হবে মার্কিন ডলারে। বিনিময়ে সৌদি আরবকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে
রক্ষা করবে আমেরিকা। এর দু’বছর পর ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির জোট ‘ওপেক’ সৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ তেল
বিক্রির সব অর্থ পরিশোধ করা হবে শুধু ডলারে। শুরু হয় বিশ্বব্যাপী ডলারের আধিপত্য বিস্তার।
বিশ্ব
রাজনীতিতে মার্কিনিদের একক আধিপত্যের বড় অস্ত্র— ইউএস ডলার। মারণাস্ত্রের মতোই যা ক্ষমতাসম্পন্ন।
ওয়াশিংটন জানে, নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে চাইলে, ডলারের আধিপত্যও বজায় রাখতে হবে। আমেরিকার
ইরাক, লিবিয়া এবং অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা
চালানোর গুরুত্বপূর্ণ কারণ একটাই— পেট্রোডলার ব্যবস্থা এবং প্রধান বাণিজ্য মুদ্রা
হিসেবে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখা। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব
রাজনীতি-অর্থনীতির অনেক হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক
জ্বালানি বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য ক্ষয় হতে শুরু করেছে। দুনিয়াজুড়ে প্রশ্ন
উঠছে, ডলারের আধিপত্য কি এবার মুখ থুবড়ে পড়বে?
রাশিয়াকে
ভাতে মারার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। তাই রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত
তেল কেনায় তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে রুশ কোম্পানিগুলির জন্য ডলার ‘বিষাক্ত সম্পদ’
হয়ে দাঁড়ায়। পাল্টা জবাবে রুশ প্রশাসনও একটি ‘অবন্ধু’ দেশের তালিকা
প্রকাশ করে। তারা ঘোষণা করে, রাশিয়ার কাছ থেকে যে সব দেশ তেল-গ্যাস
কিনবে তাদের রুবলে (রাশিয়ার মুদ্রা) অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তাদের এই ঘোষণা আমেরিকা
ও ইউরোপের দেশগুলির জন্য ছিল কল্পনাতীত। কারণ, এর অর্থ, ডলারের একচেটিয়ার আধিপত্যে
রুবলের ভাগ বসানো। পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার শুরুতে রুবলের মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে
গেলেও, রাশিয়ার এই সিদ্ধান্তের ফলে রুবলের মান আগের অবস্থায় চলে আসে। ফলে রুবল
ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং বর্তমানে তা উর্দ্ধমুখী। আজ এক ডলার সমান ৭৫.৫৫ রুবেল।
ইতিমধ্যে রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ
বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। বুলগেরিয়ার ৯০ এবং পোল্যান্ডের ৫৩ শতাংশ গ্যাস যেত রাশিয়া
থেকেই। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার জ্বালানি আমদানির নিষেধাজ্ঞা নিয়ে স্পষ্টত
দ্বিধাবিভক্ত।
আমেরিকার
আপত্তিতে অনেক দেশই রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিলেও ভারত সে পথে হাঁটেনি।
তারা পশ্চিমের ভ্রুকুটি উড়িয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা জারি রেখেছে। রাশিয়া
থেকে সস্তায় তেল কিনে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েছে ভারত। তারপর বিদেশেও তা রপ্তানি
শুরু করেছে। এমনকি,
ভারত থেকে রাশিয়ার তেল পৌঁছেছে আমেরিকাতেও। জানুয়ারিতেই প্রায় ৮৯
হাজার ব্যারেল ডিজেল ভারত থেকে নিউ ইয়র্কে পাঠানো হয়েছে। দেখা গিয়েছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনার ফলে গত এক বছরে ভারতের লাভের অঙ্ক বেড়েছে অনেকখানি।
৪০০ কোটি ডলার অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩৩ হাজার কোটি
টাকা লাভ করেছে নয়াদিল্লি।
ডলারের আত্মপ্রকাশের আগে ৫০০ বছর ধরে যেসব মুদ্রা রাজত্ব করেছে তার মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মুদ্রা। বিশ্বের নানা প্রান্তে এসব দেশের কলোনি থাকায় তাদের মুদ্রাও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু গোটা পরিস্থিতি বদলে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৮) শুরুর পর থেকে।
এই অবস্থায় ১৯৪৪ সালে ৪৪টি দেশ আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে মিলিত হয়। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই ৪৪টি দেশের মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হবে মার্কিন মুদ্রা ডলারের উপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হবে সোনার উপর ভিত্তি করে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুত সোনার ৭০ শতাংশ আমেরিকার হাতে। এই বিপুল সোনা মজুত ও ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় সেসব দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়। মূলত ডলারের আধিপত্য সেই থেকেই শুরু।
শুনলে অবাক হবেন, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, সেই সময় আক্ষরিক অর্থেই ভারতের ১ টাকা আমেরিকার ১ ডলারের সমতুল্য ছিল। কালক্রমে ডলারের চেয়ে দুর্বল হয়েছে ভারতীয় টাকা। স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫২ সালে। তারপর অনেক নির্বাচন এসেছে। রাজনৈতিক নেতারা বার বার আশ্বাস দিয়েছেন, টাকার দাম আরও বাড়িয়ে তোলাই তাঁদের লক্ষ্য। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। ১ ডলার = ১ টাকা তো দূরের কথা, দিন দিন বরং আরও দুর্বল হয়েছে ভারতীয় মুদ্রা।
No comments:
Post a Comment