Wednesday, March 22, 2023


খাকিমভের মৃত্যু

একটা যুদ্ধের সমাপ্তি

তালিবান শাসনে আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাত এখন ভুতুড়ে নগরী!

শহরের চারদিকে এখন শুধুই তালিবানের পতাকা। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রাস্তায় সশস্ত্র প্রহরা। নয়া ফতোয়ায় তালিবান জানিয়ে দিয়েছে, হিজাবে চলবে না। জনসমক্ষে পরতে হবে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা বোরখা (চাদরি)। নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, মহিলাদের গাড়ি চালানোর উপরও। এই বদ্ধভূমি হেরাত থেকেই শেখ আবদুল্লার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছেছে সুদূর মস্কোতে। রুশদের কাছে খানিকটা স্বস্তির খবরও বটে। আসলে রুশদের কাছে আবদুল্লার জীবন ছিল ইতিহাসের দীর্ঘতম বিব্রতকর প্রতীক। গত ২৭ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু আফগানিস্তানে রাশিয়ার ভয়াবহ আগ্রাসনের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। কে এই শেখ আবদুল্লা?

আসল নাম খাকিমভ বাখেরোদিন। বাবা ছিলেন সোভিয়েত রেড আর্মির বড় অফিসার। জাতিতে উজবেক। মা ছিলেন ইউক্রেনের। খাকিমভের এক ভাই রেড আর্মির গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন। বোনও ছিলেন এই বাহিনীর একজন উপদেষ্টা। রাশিয়া তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ভূমি। রুশ সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে খাকিমভ আফগানিস্তানে পা রেখেছিলেন ১৯৮০ সালের দিকে। বয়স তখন ২১। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গিয়েছে, খাকিমভ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার ছিলেন। তবে সরাসরি যুদ্ধের পোশাক পরা ছবিও পাওয়া যায় তাঁর।

১৯৮৩-৮৪ সালের কোনও একসময় হেরাতের সিন্দাদে স্থানীয় মুজাহিদিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে খাকিমভ মাথায় আঘাত পান। হাজি সৈয়দ আবদুলবাহাব কাতালির নেতৃত্বে মুজাহিদিনের স্থানীয় একটা উপদলের হাতেই খাকিমভ আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। কিন্তু খাকিমভকে জঙ্গি মুজাহিদিন গোষ্ঠী মেরে ফেলেনি। তার কারণ আজও রহস্য। ১০ বছর যুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালে রুশরা যখন আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়, খাকিমভ আর দেশে ফিরে যাননি। রুশদের বিদায়ের পর ইসলামে দীক্ষা নেন। নাম পাল্টে হেরাতেই থেকে যান। আফগানিস্তানজুড়ে এই রকম পক্ষত্যাগীরুশ যোদ্ধা কম ছিলেন না। রাশিয়ার হিসেবে সংখ্যাটা প্রায় আড়াইশো। রুশ প্রতিরক্ষা বিভাগ এঁদের চিহ্নিত করে নিখোঁজ সেনা হিসেবেই। খাকিমভ ছিলেন এই তালিকার জীবিত শেষ ব্যক্তি। আফগানিস্তানের তরফে অন্তত সেই রকমই দাবি করা হয়। রাশিয়ার গোয়েন্দারা অবশ্য মনে করেন, এই রকম আরও কিছু প্রাক্তন রুশ সেনা এখনও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। তাঁরা দেশে ফিরলে কোনও আইন-কানুনের মুখোমুখি হতে হবে না, এমন আশ্বাস দেওয়া হলেও নিখোঁজ সেনারাফিরতে আগ্রহী হননি। কেউ ভয়ে, কেউ অনিচ্ছায়।

বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সুস্থ হওয়ার পর ১৯৮৯ সালের আগে যুদ্ধের বাকি সময়টা খাকিমভ মুজাহিদিন গোষ্ঠীকে সাহায্য করেছিলেন। ইসলামে দীক্ষা নিয়েছিলেন আফগান মুজাহিদিন গোষ্ঠীর কাছেই। তারা তাঁকে জীবিকায় সাহায্য করে। বিয়েও দিয়ে দেয়। আফগান মাটিতে এক কন্যাসন্তানেরও পিতা হন তিনি। একসময় নাকি দ্বিতীয় বিয়েও করেছিলেন। নিত্যদিনের পোশাক-আশাক হিসেবে স্থানীয় রক্ষণশীল স্টাইল রপ্ত করে নিয়েছিলেন। দ্রুত স্থানীয় ভাষাও শিখে ফেলেছিলেন। শেষজীবনে হেরাতে সোভিয়েতবিরোধী প্রতিরোধযুদ্ধের সরঞ্জাম দিয়ে একটা জাদুঘর গড়ার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ থেকে তালিবান নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বরাদরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন বলেও জানা যায়। তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ডান হাত ছিলেন বরাদর। মাঝেমাঝে উজবেকিস্তানে বাস করা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তাও বলতেন। হয়তো এসব নানা খবরের পর রুশরা যুদ্ধের পর তাঁকে আর ফিরিয়ে নেয়নি। তিনিও আগ্রহী ছিলেন না।

খাকিমভ আফগানদের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি দিনই বেঁচেছেন। এরপরও তাঁর মৃত্যুসংবাদ হেরাতের অনেককে বিস্মিত করেছে। কারণ, ষাটোর্ধ্ব বয়সেও শারীরিকভাবে অনেক সবল ছিলেন। মারা গিয়েছেন হিটার থেকে নির্গত বিষাক্ত এক গ্যাস দুর্ঘটনায়। এভাবে আচমকা মারা না গেলে আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসনের জীবন্ত এই সাক্ষীকে বিশ্ববাসী আরও অনেকদিন দেখতে পেতেন। যে আগ্রাসনে ২০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। প্রাণ হারিয়েছিল ১৫ হাজার সোভিয়েত সেনাও। আফগানিস্তান অভিযানের ব্যর্থতা ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনেও ভূমিকা রেখেছিল। আবার সোভিয়েত আগ্রাসনের অজুহাত দেখিয়ে প্রতিরোধের নামে আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পথ তৈরি হয়েছিল। সেই ধ্বংসলীলার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আফগানিস্তান ফের তালিবানের খপ্পরে।

যুদ্ধবিদ্যায় বলা হয়, শেষ সেনা ঘরে ফিরে না আসা কিংবা মারা না যাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলছে বলে ধরে নিতে হয়। খাকিমভের মৃত্যু হয়তো সেই অর্থে আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েত যুদ্ধের প্রকৃতই সমাপ্তি ঘটাল।

তবে এই যুদ্ধ এবং আগ্রাসনের পুরো রেশ এখনও বন্ধ হয়েছে বলা যায় না। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে ২০২১ সালের আগস্টে ন্যাটোর ফিরে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছরের আফগান ট্র্যাজেডির প্রাথমিক জন্মদাতা যে মস্কোর নীতিনির্ধারকরা, খাকিমভ বাখেরোদিন ওরফে শেখ আবদুল্লার জীবনের গল্প তার নিখুঁত প্রমাণ!


 https://www.dawn.com/news/1164633


No comments:

Post a Comment