Thursday, March 9, 2023


পাকিস্তান আজ ফুটো কলসি

কানাডার বিখ্যাত কফি ব্র্যান্ড টিম হর্টন্স বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে লাহোরে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি। টিম হর্টন্সের সেই দোকানে এখন নাকি পা ফেলারও জায়গা নেই। পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকা জানাচ্ছে, কানাডার এই ব্র্যান্ড ৬১ বছরের ইতিহাসে প্রথম দিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রির রেকর্ড গড়েছে লাহোরেই। দামি কফি ও পেস্ট্রি কেনার জন্য ভিড়ে ঠাসা সেই দোকান দেখলে কে বলবে, গোটা দেশ ‘দেউলিয়া’ ঘোষণার অপেক্ষায়!

গত কয়েক মাস ধরেই আর্থিক সঙ্কটে ন্যুব্জ একটা দেশ। জ্বালানির চড়া দাম, বিদ্যুতের চড়া বিল, ভর্তুকি কমে আসা এবং সর্বোপরি ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতিসব কিছু একযোগে সে দেশের জীবনযাত্রার মানের অবনমন ঘটিয়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। তার সঙ্গে প্রতিদিনই অন্তত ৩০-৪০ টাকা করে লাফ দিয়ে বাড়ছে খাবারের দাম। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পাকিস্তানিরা সবাই এখন লাইনে দাঁড়িয়ে। হতদরিদ্র মানুষ সশস্ত্র প্রহরায় স্বল্প মূল্যের আটার জন্য লাইনে, আর উচ্চবিত্তদের বিশাল লাইন টিম হর্টন্সে। এটাই পাকিস্তানের দুই মুখ। আটা এবং কফির লাইন। খোলাবাজারে আটার দাম যখন প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৬০ পাকিস্তানি টাকা, একশ্রেণির মানুষ তখন ৩৫০ টাকা দিয়ে ছোট্ট এক কাপ কফি গিলছে দেদার। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযোগ উঠেছে, দেশের অর্থনীতির এই হাল আকাশপাতাল বিভাজনের জন্যই। দেশের সম্পদ একটি অংশের কুক্ষিগত। তারা ধনী হয়েই চলেছে। অন্য অংশ পরিস্থিতির পাকে দুর্ভোগ সহ্য করে চলেছে। টিম হর্টন্স চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানে বৈষম্য কতটা উৎকট!

পাকিস্তানে যারা ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গঠনের পক্ষে, তারা এ কথা বিশ্বাস করে যে জিন্না ইসলামকে একটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। ইসলাম যদি এই রাষ্ট্রের প্রধান খুঁটি হয়, তো ভারত-বিরোধিতা তার দুই নম্বর খুঁটি। প্রথম খুঁটিকে পোক্ত করার জন্যই প্রয়োজন দ্বিতীয় খুঁটিটির। যে যত ভারতবিরোধী, মুসলিম হিসেবে তার ক্রেডেনশিয়াল তত পাক্কা। এই যুক্তি মাথায় রেখে পাকিস্তানের সব রাজনীতিক কে কার চেয়ে বেশি ভারতবিরোধী, সেই প্রতিযোগিতা চালিয়ে গিয়েছেন। ইসলাম বিপন্ন, এই স্লোগান পাকিস্তানি রাজনীতিকরা আগাগোড়াই দিয়ে এসেছেন। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারত, সে যেকোনও সময় আক্রমণে প্রস্তুত। অতএব, ইসলামকে বাঁচাতে হলে ভারতকে রুখতে হবে। দেশের ভিতর যে এই যুক্তির বিরোধিতা করবে, তার কপালে তকমা জুটবে ভারতপন্থী। অতএব সে ইসলামবিরোধী এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরোধী। গোড়ার দিকে পাকিস্তানি রাজনীতিকরা ধরে নিয়েছিলেন, এই ফর্মুলায় তাঁদের পক্ষে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা কঠিন হবে না। কিন্তু সমস্যা হল বহির্গত বিপদযদি রাজনৈতিক পাশা খেলায় প্রধান ঘুঁটি হয়, তাহলে যাঁরা সেই হুমকি মোকাবিলায় জান বাজি রাখছেন, সেই সেনাকর্তারা রাজা-উজির না হয়ে রাজা-উজির হবেন কি না অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত রাজনীতিক? পাক অভিজাতরাও মনে করেন, সামরিক বাহিনী তাঁদের একমাত্র ভরসা।

সম্প্রতি পাকিস্তানের আর্থিক সংকট বিষয়ে এক ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল দ্য ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন। সেখানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাক বংশোদ্ভূত অধ্যাপক আতিফ মিয়া বলেছেন, পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের মূল কারণ সেনা পরিচালিত পারিবারিক শাসন। পারিবারিক শাসনে ক্ষমতাসীনরা তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও স্তাবকদের দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত করে। ফলে এই শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতির বিস্তার ঘটে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য কায়েমি স্বার্থ তোষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ পরিবারের শাসন চলছে। পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে সেনাবাহিনী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেক্সিকোকে খেয়ে ফেলেছে ড্রাগ কার্টেল, ইতালিকে মাফিয়া আর পাকিস্তানকে মিলিটারি। পাকিস্তানে আজ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ সামরিক ব্যয়ের বিপুল বোঝা। সাড়ে পাঁচ লাখের সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক যুক্তিতে কোনওভাবেই এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে নানা সময়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের হাতের মুঠোয় চলে গিয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭১-২০২৩ পর্বেও পাকিস্তানের শাসকের ভূমিকা থেকে সামরিক বাহিনীকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। কিছুদিন পরপর সামরিক একনায়করা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছে। শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছে তারা। আর অনামে, বেনামে বা ভিন্ন নামে সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে প্রতিটি সরকার তাদের ভাগ্যনিয়ন্তাকে তুষ্ট করে রাখে, যাতে গলা ধাক্কা খেয়ে মসনদ থেকে নেমে যেতে না হয়। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা থেকে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পিছনেও সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কলকাঠিই তার প্রমাণ।

পাকিস্তানে সর্বগ্রাসী দৈত্যের মতো শুধু সামরিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর কোনও প্রতিষ্ঠানকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে দেয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিচার বিভাগকে ক্রমাগত কোণঠাসা করা হয়েছে। মৌলবাদী গোষ্ঠীকে হাতে রাখতে গিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে শ্বাসরুদ্ধ। শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মান্ধতাকে চাপিয়ে দিয়ে তাকে করা হয়েছে অদক্ষ ও উৎপাদনবিমুখ। সব দেশ নিজের গুণে সম্পদ গড়ে। বিশ্বের একমাত্র দেশ পাকিস্তান সম্পদের ভাগ্য গড়েছে প্রতিবেশীকে ব্যবহার করে।

১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েতের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকার কাছ থেকে মোটা কমিশন পেয়েছে পাকিস্তান। তার কাজ ছিল তালিবান ও সন্ত্রাসবাদীদের লালনপালন করে রুশ বাহিনীর উপর আক্রমণ করা। তাই গোটা আশির দশক মার্কিন সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল রমরমা। ওই দশকে পাকিস্তানের গড় জিডিপি ছিল ৭ শতাংশের কাছাকাছি। সামরিক প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের নেতাদের বুঝিয়েছিল, যে কোনও যুদ্ধ প্রতিবেশীর সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে পারলে তা পাকিস্তানের জন্য স্বাস্থ্যকর। আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে দিল। গোটা নব্বইয়ের দশকে বড় কোনও যুদ্ধ আশপাশে না থাকায় পাকিস্তান ভারতকে টেক্কা দেওয়ার জন্য পারমাণবিক বোমায় মনোযোগ দিল। কাশ্মীর নিয়ে বিক্ষিপ্ত লড়াইয়েও খুব একটা উপকার হয়নি। ওই দশকে পাকিস্তানের গড় জিডিপি ৭ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নেমে আসে। ভাগ্যচক্রে পাকিস্তানের আবার সুদিন নিয়ে আসে ২০০১ সালের নাইনইলেভেন। আফগানিস্তানে ছিল আলকায়েদার আস্তানা ও তালিবানের চারণভূমি। তা ভাঙতে মার্কিন সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানি সেনাশাসক যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ফের পাকিস্তানের অর্থনীতি হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু ততদিনে ব্যাপক সামরিকীকরণ ক্যানসারের মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কোনও না কোনও ভাবে পাকিস্তান দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় থাকা দেশ হয়ে থাকার মধ্যে যেন মোক্ষের দিশা দেখতে পেয়েছিল।

১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩০ বছরে ভারতে মোট সরকারি ব্যয়ের প্রায় ১০ শতাংশ দেওয়া হয়েছে সামরিক খাতে। যুদ্ধপ্রেমী পাকিস্তানে তা প্রায় ২১ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা এই খরচের সিংহভাগকে অনুৎপাদনশীল খাতের খরচ বলে ধরে থাকেন। ওদের এই ২১ শতাংশও নাকি কম দেখানো। আসলে তা ৩০ শতাংশের উপরে বলে দাবি। একটা রাষ্ট্রের মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যদি এই যুদ্ধবাহিনী পুষতেই চলে যায় তাহলে সে দেশের উন্নয়ন খাতে আর থাকে কী। তাই দু’হাত তুলে আইএমএফকে ডাকাডাকি। আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জিও পলিটিক জানিয়েছে, পাকিস্তান এখনও পর্যন্ত আইএমএফ থেকে ১৪টি ঋণ নিয়েছে। তার একটিও পরিশোধ করতে পারেনি। অর্থনৈতিক দৈনতা মোকাবিলায় তারা গত ৭৫ বছরে ২৩ বার আইএমএফের বেল আউট প্যাকেজের সাহায্য নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর মুর্তজা সইদ বলেছেন, ‘আমরাই আইএমএফের নিয়মিত গ্রাহক। একইসঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন করা ভারত মাত্র সাতবার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। ১৯৯১ সালে মনমোহন সিংয়ের যুগান্তকারী সংস্কারের পর তারা একবারও আইএমএফের কাছে যায়নি।’ আরও একধাপ এগিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ‘আমরা এক দেউলিয়া দেশের বাসিন্দা।’ শুনলে অবাক হবেন, পাকিস্তানে আয়কর দেন দেশের মাত্র ০.৬ শতাংশ নাগরিক। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নীচে নেমে যাচ্ছে। ২০২২ সালে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গিয়েছে ১৪৭ নম্বরে।

যেকোনও দেশের নেতারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অনেক প্রতিষ্ঠানের অদল-বদল ঘটায়। এটাই নিয়ম। কিন্তু এই নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তান। সেখানে একটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র চালায়। তারাই নেতৃত্বের রাশিফল ঠিক করে দেয়। যার ফলে ৭৫ বছরে পাকিস্তান ফেল্ড স্টেট-এ পরিণত হয়েছে।

গোটা দুনিয়া বলছে, পারমানবিক বোমা, এফ-সিক্সটিন আর সামরিক দাপটের পাকিস্তান যেন আজ ফুটো কলসি!

No comments:

Post a Comment