আফ্রিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন ঠান্ডা লড়াই
জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন
লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে ২০টি দেশ এগিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টিই আফ্রিকার। আফ্রিকান
ইউনিয়ন,
জাতিসংঘ ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশেষ করে বুর্কিনা ফাসো, মোজাম্বিক ও নামিবিয়া
অনেক উন্নতি করেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দের আটটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে
শিক্ষার প্রসার, এইডস, যক্ষ্মা ও
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের মতো চারটি শর্ত পূরণ করতে পারবে আফ্রিকা। বিশ্বের
শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচদিন
ধরে সফর করছেন সেই মহাদেশ। যাকে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো তাদের সন্তান বিবেচনা
করে। এই মহাদেশে বিনিয়োগ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। তবে এবারের ওবামার আফ্রিকা সফরের
গুরুত্ব কিংবা আলোচনা কিছুটা হলেও নেলসন ম্যান্ডেলার অসুস্থতার মধ্যে ঢাকা পড়েছে।
সফরে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন দুর্নীতি নির্মূল এবং নিরাপত্তা ইস্যুকে।
চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্য মাত্র ১৫
বছরের মধ্যে দেড়শো কোটি ডলার থেকে ছয় হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এছাড়া চীন
গতবছর দক্ষিণ আফ্রিকায় বিনিয়োগ করেছে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার। আফ্রিকা মহাদেশে
দক্ষিণ আফ্রিকাই হল চীনের বৃহত্তম বাণিজ্যিক সহযোগী। গোটা আফ্রিকার সঙ্গে চীনের
বাণিজ্যের পরিমাণ দশ হাজার কোটি ডলার। সেইসঙ্গে আছে পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ।
আফ্রিকায় চীন কিছুটা এগিয়ে থাকলেও তাদের পরেই আছে ভারত। আফ্রিকার সঙ্গে ভারতের
বাণিজ্যের পরিমাণ ৩ হাজার ৩শ' কোটি ডলার।
২০১৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে ৯ হাজার কোটি ডলার
হতে পারে। চীন আফ্রিকায় নিজ দেশের শ্রমিক-কর্মচারি নিয়োগ করে। এজন্য চীনের
সমালোচনাও হচ্ছে। চীন আফ্রিকা থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে নিয়ে দেশে তা পণ্যে
রূপান্তরিত করে এবং সেই পণ্য আবার আফ্রিকায় বিক্রয় করে। চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার
কূটনৈতিক সম্পর্ক মাত্র ১৫ বছরের। শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরকালে ওবামাকে প্রশ্ন
করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকা মহাদেশে অন্য কোনো দেশ বিশেষ
করে চীনকে হুমকি হিসেবে মনে করে কিনা। উত্তরে ওবামা সরাসরি চীনের নাম উল্লেখ না
করে বলেন, আফ্রিকার উন্নয়ন হচ্ছে এটা ভাল দিক। তবে তিনি
দক্ষিণ আফ্রিকাকে সতর্ক করে বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলো যেন
এই দেশের শ্রমিক নিয়োগ করে সেই বিষয়টির প্রতি নজর দিতে হবে। তিনি আফ্রিকার
ভবিষ্যত্ নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের এটা ভাবতে হবে
যে, হ্যাঁ আমরা পারি। গতকাল রবিবার ওবামা আফ্রিকার দেশগুলোর
বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষনা দিয়েছেন। আগামী ৫ বছর
ধরে এই অর্থ দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার হিসাবমতে, ২০৩০
সালের মধ্যে বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন হবে ৩শত বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় থেকে ২০০৫ সালে সিনেটর
নির্বাচিত হওয়ার পর কেনিয়ার রাজধানীতে এক বক্তৃতায় ওবামা বলেছিলেন, আমি
তোমাদের জানাতে চাই যে, তোমাদের মিত্র, বন্ধু এবং ভাই হিসেবে আমি সব পথেই তোমাদের সঙ্গে আছি। কিন্তু এবারের সফরে
তিনি তার সেই বক্তব্য কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন সেটাই বিবেচনা করছেন রাজনৈতিক
বিশ্লেষকরা। ওবামা আফ্রিকার দেশগুলোতে গণতন্ত্র উন্নয়ন, দুর্নীতি
দূর, নারীর ক্ষমতায়ন এবং ক্ষুধা দূর করায় বেশি জোর দিচ্ছেন।
সেনেগালে তিনি দুর্নীতি দমনের পাশাপাশি সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আহবান
জানিয়েছেন। ওয়াশিংটনের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র
ফেলো টড মসের মতে, ওবামার এটাই হয়তো শেষ সুযোগ আফ্রিকাকে
এগিয়ে নেয়ার। এর আগে ২০০৯ সালের সফর ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। অথচ সামপ্রতিক বছরগুলোতে
চীনের নেতারা আফ্রিকার দেশগুলো কয়েকবার সফর করছেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও
অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগে গুরুত্ব দিয়েছেন। চীনের নেতারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র কেবল উঠতি দেশগুলোতে চারা রোপণ করে, অনুন্নত
দেশে নয়।
ওবামার জাতীয় উপ-নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেনজামিন
জে রোডস বলেন, ওবামার এই সফরের মাধ্যমে এই বার্তা দেয়া হবে যে,
মার্কিন প্রশাসন আফ্রিকার ব্যাপারে এখন আগ্রহী এবং এই মহাদেশের
প্রতি বিশেষ নজর রয়েছে। হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জে কার্নি বলেন, আফ্রিকায় মার্কিন প্রশাসনের নীতি এশিয়ার মতোই হবে। ওবামা প্রশাসন এই
অঞ্চলে আরো বেশি বিনিয়োগের উপর জোর দিচ্ছেন। সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড
ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক স্টিফেন মরিসন বলেন, ওবামা
প্রশাসন প্রতিবছর আফ্রিকায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ করছেন। আগের প্রেসিডেন্ট
জর্জ ডব্লিউ বুশের নীতিকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
ওবামা বুশের এইডস এবং ম্যালেরিয়া রোগ
নির্মূলে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটাকে আরো কার্যক্ষম করার চেষ্টা করছেন।
সোমালিয়ায় জঙ্গি নির্মূলে অনেক অভিযান চালানো হয়। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে
আফ্রিকান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে আমেরিকা কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। নাইজারে
একটি মার্কিন ড্রোন ঘাঁটিও স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ইথিওপিয়ার সঙ্গে
জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এখানকার জঙ্গিগোষ্ঠী
বোকো হারামের বিরুদ্ধে লড়াই করছে সরকারি বাহিনী। তবে ওবামার সন্ত্রাসবিরোধী
নীতির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকায় আইনজীবী, ট্রেড ইউনিয়ন এবং ছাত্রদের
সংগঠনগুলো ওবামার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। ওবামার এই সফরে তানজানিয়াও গুরুত্ব
পাচ্ছে। কারণ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত মার্চে তানজানিয়ার বড় শহর দার এস
সালাম সফর করেন। এসময় তিনি উন্নতি প্রযুক্তি বিনিময়, বৃত্তি
প্রদান এবং ব্যাপক অর্থ সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যে নেতাই যাই বলুন না কেন আফ্রিকার উন্নতি যে আফ্রিকার মানুষদের ওপর
নির্ভর করে এটাই বড় কথা।
সেনেগালে ওবামা গুরুত্ব দিচ্ছেন বিচার
বিভাগের স্বাধীনতার উপর। ওবামার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বেন রোডস বলেছেন, প্রথমত
আপনাকে দুর্নীতি দূর করতে হবে। কারণ দুর্নীতি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সঙ্গে
মানানসই নয়। আর এটা দেশটির অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। ওবামা তানজানিয়ার দার এস
সালাম মার্কিন দূতাবাস পরিদর্শন করবেন। ১৯৯৮ সালে এখানে আল-কায়েদার বোমা হামলায়
১১ জন নিহত হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওবামার এই
সফর আরো আগেই হওয়া উচিত ছিল। কারণ চীন ইতোমধ্যে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের
আশ্বাস দিয়ে গেছে এবং কার্যক্রম শুরু করছেন। কিন্তু এরপরও মার্কিন বিনিয়োগকারীরা
আশা ছাড়েনি। ওবামার সফরে কিছু উপকার যে আফ্রিকার জন্য হবে সেটা বলা যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন আফ্রিকার সম্পদ
নিজেদের কব্জায় আনতে সংগ্রাম করছে।
ওবামার প্রথম সফরে আইভোরি কোস্ট, সোমালিয়া,
সুদান এবং দক্ষিণ সুদানে সহিংসতা বিরাজ করছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সফরেও
সেটাই গুরুত্ব পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ মালির উত্তর থেকে আল-কায়েদাকে তাড়াতে
উদ্যোগ থাকবে। সেটা সমঝোতার মাধ্যমে হলেও। ওবামা গতবছর আফ্রিকা নিয়ে নতুন
কৌশলের কথা ঘোষণা করেছিলেন। যাতে তিনি গণতন্ত্র, নিরাপত্তা
এবং উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর উন্নয়নের বাধা হিসেবে দুর্নীতিকে দায়ী করেন
তিনি। তিনি আফ্রিকার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার বিষয়টিকেও উল্লেখ করেন। তিনি বিশ্বের
নিরাপত্তার দিক থেকে আফ্রিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন।
জনশক্তির অপার ভাণ্ডার হবে আফ্রিকা
একটি দেশের জনসংখ্যা সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ
সম্পদ। এই জনসংখ্যা তখনই সম্পদে পরিণত হয়, যখন উক্ত জনসংখ্যাকে দক্ষ
জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়। একটি জাতি তখনই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় যখন সেখানে কোন নতুন
শিশু জন্ম নেয় না, ফলে নতুন কোন চিন্তা জন্ম নেয় না এবং
নতুন রাষ্ট্রও গঠন হয় না। বিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে শেষ দশক পর্যন্ত আফ্রিকা,
বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদের জন্য সারাবিশ্বে নিন্দিত ছিল।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো এখন উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে আফ্রিকা।
তথ্য-প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দিক থেকে উন্নত হচ্ছে আফ্রিকা।
জনসংখ্যার দিক দিয়ে আফ্রিকার নাইজেরিয়া পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম দেশ। বর্তমানে
পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রতি ৬ জনের ১ জন হচ্ছে আফ্রিকান। খুব শিগগিরই এই সংখ্যা হবে
প্রতি ৪ জনে ১ জন। বর্তমানে আফ্রিকার ৫৪টি দেশে প্রায় ৯০ কোটির উপরে লোক বসবাস
করছেন। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি দাবি করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনশক্তির যোগান দেবে আফ্রিকা। গত
সপ্তাহে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে জন কেরি বলেন,
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কয়েক দশক পর
বিশ্বের জনশক্তির সিংহভাগই আসবে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। এক সময় যে দেশের নাম শুনলেই
যেমন কিছু অন্তঃসারশূন্য মানুষের মুখ ভেসে উঠতো, বর্তমান
আফ্রিকা সেই অধ্যায়কে পেছনে ফেলে আজ বিশ্বের দরবারে অনেকটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে
শিখেছে।
আফ্রিকান বিজনেস ম্যাগাজিনের প্রকাশক আনভার
ভার্সির মতে, জনশক্তির উন্নয়নের ফলে আফ্রিকা আগামী ৫০ বছরের মধ্যে
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশে পরিণত হবে। জাতিসংঘের সর্বশেষ জরিপ
থেকে ভিন্ন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আফ্রিকার প্রধান জনশক্তি বা শ্রমিক বলতে ২৫-৫৯ বছর
বয়সের লোকদের বোঝানো হয়ে থাকে, যা ২০৫০ সালের মধ্যে ১
বিলিয়নে পৌঁছবে। জাতিসংঘের প্রধান জনসংখ্যা বিশ্লেষক ফ্রাঙ্কোস প্লেটিয়ারের মতে,
আগামী ৩৫ বছরে এই জনশক্তি ১২ ভাগ থেকে ২৩ ভাগে পৌঁছবে। মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির মতে, জনশক্তির উন্নয়ন করতে হলে,
শিশুদের স্কুলমুখী করতে হবে, যা দেশটির জন্য
একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের
১৮ ভাগ রয়েছে আফ্রিকায়,২০৫০ সালের মধ্যে ৩৩ ভাগে উন্নীত হবে।
সামগ্রিকভাবে চলতি শতাব্দীতে আফ্রিকার জনশক্তি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অবিশ্বাস্য মনে
হবে যা বিশ্বের অনেক দেশকে অতিক্রম করেছে।
No comments:
Post a Comment