এক অনির্বান শিখা
বিখ্যাত অনেকেই হতে পারে, তবে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ শ্রদ্ধা, সমীহ আর খ্যাতি কুড়ানোর
দাবি খুব কম মানুষই করতে পারেন। নেলসন ম্যান্ডেলা এমনই একজন। 'লিভিং লিজেন্ড' বা 'জীবন্ত
কিংবদন্তী' শব্দটাও যার স্বীকৃতির অপেক্ষায় মাথা নিচু করে
থাকে।
ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই, দক্ষিণ আফ্রিকার
কেপ প্রদেশের এমভেজো গ্রামে। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় রোলিলাহ্লা দালিভুঙ্গা
ম্যান্ডেলা। পরে 'নেলসন' নামটি রাখেন
তার এক স্কুলশিক্ষক। ম্যান্ডেলার বাবার নাম এনকোসি এমফাকানিসওয়া গাদলা ম্যান্ডেলা
আর মা ননকোয়াফি নোসেকেনি। থেমবু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলা পিতৃহারা হন
শৈশবেই। থেমবু জাতির রাজা জোঙ্গিনতাবা দালিন্দিয়েবো ছোট্ট ম্যান্ডেলার দায়িত্ব
গ্রহণ করেন।
১৯৪১ সালে পরিবার থেকে জোর করে বিয়ে করাতে চাইলে
ম্যান্ডেলা পালিয়ে জোহানেসবার্গ চলে যান। বয়স তখন তার ২৩। দু'বছর পর
উইটসওয়াটার্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন তিনি। সেখানেই কালো মানুষের
আত্ম-অধিকার আদায়ের সংগ্রামে প্রথম জড়িত হন তরুণ ম্যান্ডেলা। সে বছরই আফ্রিকান
ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন এএনসি ইয়ুথ লিগ। ১৯৪৪ সালে ইভলিন
মেইজকে বিয়ে করেন তিনি। চারটি সন্তান জন্ম নেওয়ার পর ১৯৫৮ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে
তাদের। ১৯৫২ সালে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন ম্যান্ডেলা। কিছুদিনের
মধ্যেই আইন ব্যবসায় অংশীদার অলিভার টাম্বোকে নিয়ে কালো মানুষদের ওপর ক্ষমতাসীন 'ন্যাশনাল পার্টি' তথা শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুর
নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৫৬ সালে ১৫৫ জন
সহকর্মীসহ রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। চার বছর মামলা চলার পর
নির্দোষ প্রমাণিত হন।
এ সময় 'পাস ল' নামে কয়েকটি আইন পাস হয়,
যাতে কালো মানুষদের বসবাস এবং কাজকর্মের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ
করা হয়। এর বিরুদ্ধে নতুন করে ফুঁসে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কালো মানুষ।
এরই মধ্যে ১৯৫৮ সালে উইনি মাদিকিজেলাকে বিয়ে করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৬০ সালে
নিষিদ্ধ করা হয় এএনসিকে। গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন ম্যান্ডেলা। সে বছর
শার্পভিল নামে একটি স্থানে ৬৯ জন কালো মানুষ পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রাণ
হারায়। বর্বর এই ঘটনার বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধে। এর কিছুদিন পরই
গ্রেফতার হন ম্যান্ডেলা। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিচার শুরু হয় তার।
আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর সাম্যের
পক্ষে নির্ভীক কণ্ঠে উচ্চারণ করেন তিনি_ 'আমি এমন একটি
গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখি যেখানে সব মানুষ মিলেমিশে, সমান সুযোগ নিয়ে বাস করবে। এটি এমন একটি আদর্শ যার জন্য আমি বেঁচে থাকতে
চাই এবং জীবদ্দশায় যেটি আমি অর্জন করতে চাই।' ১৯৬৪ সালে
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তাকে। প্রথম ১৮ বছর একটানা তাকে অন্তরীণ রাখা
হয় রোবেন আইল্যান্ডের এক দুর্ভেদ্য কারাগারে, পরে ১৯৮২ সালে
স্থানান্তরিত করা হয় পোলসমুর কারাগারে। সে থেকে ১৯৯০ সালে মুক্তি পর্যন্ত
কারান্তরালেই কাটাতে হয় কালো মানুষের অধিকার আদায়ের সিংহপুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলাকে।
এরই মধ্যে তার মা মারা যান। মারা যান বড় ছেলেও, কিন্তু তাদের
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়ও যোগদানের অনুমতি পাননি ম্যান্ডেলা।
ম্যান্ডেলাসহ এএনসির শত শত নেতাকে বছরের পর বছর জেলে আটকে
রেখেও শান্তিতে থাকতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা। শহরে ও গ্রামে, দক্ষিণ আফ্রিকার
আনাচে-কানাচে নেলসন ম্যান্ডেলার ছড়িয়ে দেওয়া সংগ্রামের দ্রোহী চেতনা বুকে নিয়ে
সংগ্রাম চালিয়ে যায় লাখ লাখ কালো মানুষ। তাদের দাবি ছিল একটাই_ মুক্তি চাই নেলসন ম্যান্ডেলার, মুক্তি চাই বর্ণবাদী
শাসনের দুঃসহ যাঁতাকল থেকে। ১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে লন্ডনের
ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ
টিভির পর্দায় চোখ রেখে কনসার্টে অংশগ্রহণকারী ৭২ হাজার মানুষের সঙ্গে গলা মিলিয়ে
গেয়ে ওঠেন_ 'ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা'।
অবশেষে বিশ্ববাসীর চাপে মাথা নত করে ১৯৯০ সালে দক্ষিণ
আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এফ ডবি্লউ ডি ক্লার্ক এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে
মুক্তি দেন ম্যান্ডেলাকে। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে নেলসন ম্যান্ডেলা ও ডি ক্লার্ক
যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। পাঁচ মাস পর দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে
প্রথমবারের মতো জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষ সব মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সাধারণ
নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা। ৮০
বছর বয়সে মোজাম্বিকের সাবেক ফার্স্ট লেডি গ্রাশা মিশেলকে বিয়ে করেন তিনি। এর বেশ
কয়েক বছর আগেই দ্বিতীয় স্ত্রী উইনির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট পদে
প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করার পর পূর্বপ্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই পদত্যাগ করেন তিনি।
ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ভাবশিষ্য থাবো এমবেকির হাতে।
দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ তাকে ভালোবেসে ডাকে 'টাটা' ও 'মাদিবা'। অর্থাৎ 'পিতা'। জীবদ্দশায় তার মতো সম্মান পেয়েছেন খুব কম
মানুষই। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান প্রেসিডেন্সিয়াল
মেডেল অব ফ্রিডম, সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক 'লেনিন শান্তি পুরস্কার' ও কানাডার সর্বোচ্চ সম্মান 'অর্ডার অব কানাডা'য় ভূষিত হয়েছেন তিনি। জীবিত
ব্যক্তিদের মধ্যে কানাডার সম্মানজনক নাগরিকত্ব পাওয়া প্রথম ব্যক্তিও নেলসন
ম্যান্ডেলা। ভারত থেকে পেয়েছেন 'ভারতরত্ন', পাকিস্তান থেকে 'নিশান-ই-পাকিস্তান' আর তুরস্ক থেকে আতাতুর্ক শান্তি পুরস্কার। ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয়
এলিজাবেথ তাকে ভূষিত করেছেন অর্ডার অব মেরিটে। ২০০৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ
ম্যান্ডেলার জন্মদিন ১৮ জুলাইকে ঘোষণা করে 'ম্যান্ডেলা দিবস'
হিসেবে। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ম্যান্ডেলার ৬৭ বছরের
সাধনাকে স্মরণ করে এই দিনে সবাইকে ৬৭ মিনিট অন্যের জন্য কিছু করার আহ্বান জানানো
হয়। আর আজ, এই ৯৫ বছর বয়সে রোগশয্যায় শুয়েও নেলসন ম্যান্ডেলা
পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে শোষিত আর নির্যাতিত মানুষের মনে মুক্তির শিখা জ্বালিয়ে
যান। 'নেলসন ম্যান্ডেলা' তাই কেবল একটি
নাম নয়, সূর্যের মতো এক অনির্বাণ শিখা। কোটি কোটি মানুষের
শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত এক মহান পুরুষ।
ম্যান্ডেলার মহানুভবতা
ডেভিড ফ্রস্ট নামে এক সাংবাদিক একবার নেলসন ম্যান্ডেলার
সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলাকে তার সত্যিই একজন উচ্চপর্যায়ের মানব মনে
হয়েছিল। আর তার সেই মনে হওয়াটা তিনি প্রকাশ করেছিলেন একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে।
বিশ্ববাসী তখন চোখজোড়া কপালে তুলেছিল একটি কথা ভেবে_ 'কী করে তিনি পারেন?' ভুল অজুহাতে পুরো ২৮টি বছর কেড়ে নেওয়া হলো ম্যান্ডেলার জীবন থেকে। রাখা
হলো তাকে নির্বাসনে। তারপরও তার মধ্যে যেন কোনো তিক্ততা নেই। নেই কোনো রাগের
প্রকাশ। কী করে পারেন তিনি! বিশ্ববাসীর হয়ে ডেভিড ফ্রস্ট প্রশ্নটা রেখেছিলেন
ম্যান্ডেলার সামনে। ম্যান্ডেলা প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, 'আমি
নিজেও খুব খারাপ বোধ করছি। কিন্তু এখন সময় রাগ দেখানোর নয় বরং কাজ করার।' এই হচ্ছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা।
ম্যান্ডেলা তখন রোবেন দ্বীপে নির্বাসিত। সেখানেই কৃষ্ণকায়
সচেতনতা আন্দোলনের আরেক নেতা স্টেরিনি মুডলেও
নির্বাসিত হন। মুডলেকে যখন দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ১৭ বছরের এক
ছেলে তার দরজা খুলে দেয় এবং বলে, 'শুভ সকাল'। তাকে কখনও প্রত্যুত্তর দেননি মুডলে। কিন্তু সেই ছেলেটিই ম্যান্ডেলাকে
বলে, 'শুভ সকাল, নেলসন।' শুনেই ম্যান্ডেলার কাছে ছুটে যান মুডলে। বলেন, 'কী
করে এই ছোট্ট ছেলেটি পারে আপনার নাম ধরে ডাকতে! সে হয় আপনাকে স্যার বলে ডাকবে।'
ম্যান্ডেলা তখন জবাব দিয়েছিলেন, 'বাদ দাও তো,
এসব ছোটখাটো বিষয়। আমরা এখন কারাগারে বন্দি। এই তো সময় তাদের
নিজেদের পথে নিয়ে আসার।'
'নেলসনস চিকেন ও গ্রেভি ল্যান্ড'। এখানে গেলে যা দেখবেন সবই নেলসন ম্যান্ডেলার নামে অথবা তার মতো করে গড়া।
মূলত এটি একটি রেস্টুরেন্টের নাম। নেলসন ম্যান্ডেলা মানুষের মনের চূড়াটা এতটাই
স্পর্শ করেছিলেন যে, এক লোক তার রেস্টুরেন্টের নামই দিয়ে
বসলেন ম্যান্ডেলার নামে। তখন ২০০১ সাল। নেলসন ম্যান্ডেলা নিজে ওই মালিককে নিষেধ
করলেন তার নাম ব্যবহারের জন্য। বেচারা মালিক বললেন, 'দেখুন,
আপনার নামের সঙ্গে মিল রেখে দোকানের নাম রেখেছি বলে আপনার সঙ্গে
আমাদের কোনো লেনাদেনা নেই।' তারপরও তারা নিজেদের ভুল স্বীকার
করলেন, ক্ষমা চাইলেন এবং কিছু জিনিসের পরিবর্তনে তৎপর হলেন।
তাদের নেলসনের শক্তি খাবার এবং নেলসনের শান্তি খাবার নামে দুটি খাবারের নাম ও লোগো
ছিল অনেকটা নেলসন ম্যান্ডেলার মতোই।
রিচার্ড স্টেনজেল। তিনি একজন সাংবাদিক। ভদ্রলোক
ট্রাসকেইতে থাকতেন। যেখানে থাকতেন ম্যান্ডেলাও। স্টেনজেল তখন চেষ্টা করতেন তার
সঙ্গে সকালবেলা হাঁটতে যাওয়ার। খুব ভোরে উঠে হাঁটতে বের হতেন ম্যান্ডেলা। কিন্তু
এত সকালে ওঠার অভ্যাস ছিল না স্টেনজেলের। বেচারা তাই সারারাত জেগে বসে থাকতেন এই
আশায়, যেন প্রাতঃভ্রমণে ম্যান্ডেলার সঙ্গী হতে পারেন।
১৯৯০ সালে যখন ম্যান্ডেলা জেল থেকে ছাড়া পেলেন, তখন থেকে জেসি
ডার্টে প্রায় চার বছর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। একবার তারা একসঙ্গে সাংহাই
গেলেন। ম্যান্ডেলা সবসময় তার নিজের বিছানা নিজে গোছাতেন। কিন্তু সাংহাইয়ের
হোটেলগুলোয় সবসময় একটা বিষয় থাকে, নির্দিষ্ট মানুষ ঘর
পরিষ্কার করে দেবে এবং খাবার পরিবেশন করবে। যদি কোনো অতিথি সেটা না নিতে চান তাহলে
সেটা অবহেলা হিসেবে মনে করে তারা। এমনটা শোনার পর ম্যান্ডেলা নিজে হোটেলের
ম্যানেজারকে ডাকলেন এবং তাকে বুঝিয়ে বললেন, তিনি কেন নিজের
বিছানা নিজেই ঠিক করেন। কারও অনুভূতিতে আঘাত করাটা মোটেও ম্যান্ডেলার ব্যক্তিত্বে
ছিল না।
ম্যান্ডেলার প্রেমের চিঠি
নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী
বিশ্বখ্যাত নেতা। ব্যক্তিজীবনে তিনবার বসেছেন বিয়ের পিঁড়িতে। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর
নাম উইনি মাদিকিজেলা ম্যান্ডেলা। ১৯৬৪ সালে যখন ম্যান্ডেলার বয়স ৪৬, তখন রোবেন
দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয় তাকে। সম্পর্কে টানাপড়েন থাকেই। উইনির স্বামী যখন দ্বীপে
যন্ত্রণা পোহাচ্ছেন ঠিক তখনই উইনির বাবা ট্রান্সকেই এর কৃষিমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক উস্কানিতেই শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে ম্যান্ডেলা এবং উইনির ছাড়াছাড়ি হয়ে
যায়। উইনির প্রতি ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি ছিল না ম্যান্ডেলার। আর তা স্পষ্টতই
বোঝা যায় নানান সময়ে উইনির কাছে লেখা চিঠিগুলো থেকে। প্রেমিক হিসেবে তিনি যে কারও
চেয়ে কম নন, তা বোঝা যাবে সংকলিত চারটি চিঠি থেকেও।
১৫ এপ্রিল, ১৯৭৬
আমার প্রিয়া উইনি
তোমাকে যখন চিঠিখানা লিখছি, তখনও তোমার সুন্দর ছবিটা আমার বাম
কাঁধের ঠিক দুই ফুট ওপরে রয়েছে। জানো, আমি প্রতিদিন যত্ন করে
ওটার ধুলাবালি ধুয়ে-মুছে রাখি।
আর তখন আমাদের অতীতের আদরমাখা দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে।
আমি কিন্তু তোমার নাকটাও ছুঁয়ে দিই। ছবির তোমাকে স্পর্শ করলেও মনে হয় আমার রক্তে
যেন একটা বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল।
২৬ অক্টোবর, ১৯৭৬
সেই ২২ আগস্ট তোমার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। জানি না, এখন পরিবারের
অবস্থা কী? ভাড়া, টেলিফোন বিল, বাচ্চাদের দেখাশোনা এবং খরচাদি সম্পর্কেও কিছুই জানি না। তুমি কোথায় চাকরি
নেবে তা-ও জানি না। যতক্ষণ না তোমাদের সম্পর্কে জানতে পারব, ততক্ষণ
নিজেকে মরুভূমির মতো শুকনো মনে হবে। জানো, তোমার বা পরিবারের
কারও কাছ থেকে একটা চিঠি পেলে মনে হয় প্রচণ্ড খরতাপে এক পশলা বৃষ্টি হলো বা
বসন্তের আগমন ঘটল।
আর এটুকুই তো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে এবং জীবনকে উপভোগ করতেও
শেখায়। তোমাকে লিখতে বসলেই আমি এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করি। মনে হয় সব সমস্যা দূরে
পালাল। আমি নিজেও ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠি।
২৬ জুন, ১৯৭৭
আমরা যেমনটা পরিকল্পনা করেছিলাম সেভাবে নিজেদের আশা পূরণ
করতে পারিনি। ভেবেছিলাম খারাপ সময় আসার আগেই তোমাকে একটা নিরাপদ বাড়ি বানিয়ে দেব।
হোক না খুবই ছোট, তবুও সেখানে আমরা একটু বিশ্রাম নিতে
পারতাম। কিন্তু এখন আমি একেবারে ভেঙে পড়েছি। এখন যেন আমি শূন্যে দুর্গ গড়ছি।
২২ নভেম্বর, ১৯৭৬
১৭ নভেম্বর তোমাকে সত্যিই অসাধারণ লাগছিল। ঠিক যখন তোমাকে
বিয়ে করে আনলাম, তখনকার মেয়েটি মনে হচ্ছিল। তোমার চেহারায় যেন এক ধরনের রঙ ছড়িয়ে ছিল।
যখন তুমি বেশি বেশি ডায়েটর চক্করে ছিলে, তখনকার সেই
খিটখিটে ভাবটা চোখ থেকে উড়ে গিয়ে চোখে এক ধরনের জৌলুস এসেছে। যখন ভাবছিলাম দূরে
প্লাটফর্মে একটা মেয়ে বসে আছে, তখন সাধারণ শব্দগুলোও আমার
কাছে গান মনে হচ্ছিল।
No comments:
Post a Comment