Friday, July 5, 2013

mandela...

পরিশুদ্ধ বাতাসে আমি ম্যান্ডেলাকেই দেখব...
তুমি মঞ্চে উঠে এলে 
অনতি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশ্বরের মতো, বটবৃক্ষের মতো 

দু'হাতা বাড়ালে
আমরা প্রচণ্ড আবেগে গর্জে উঠে
শ্রদ্ধা জানালাম প্রিয়তম নেতাকে। 


দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাজীবন শেষে মুক্ত হওয়ার পর এই কবিতা লিখেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় কবি ও গায়ক ক্রিসম্যান। আফ্রিকার এই মহামানবকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান ও নাটক। 

নেলসন ম্যান্ডেলার ৮৮তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে হালালা মাদিবাকে স্বাগত নামে একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এটা শুধু একজন ব্যক্তি সম্পর্কে কবিতার সংকলন নয়, এটা কবিতার মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষের দৃষ্টিতে আফ্রিকার মুক্তির সংগ্রামের অনবদ্য গান। এতে স্থান পায় ১২ বছর বয়সের এক শিশু থেকে শুরু করে রেগে ও র‌্যাপ গায়ক, সাবেক রাষ্ট্রনায়ক পর্যন্ত অনেকের কবিতা। বইটির সব কবিতাই তার জীবন ও মানবতার জন্য তার মুক্তি সংগ্রামকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। 

দক্ষিণ আফ্রিকার কবি জন মাশিকিজা ১৯৭৪ সালে লিখেছেন। ওই সময় ম্যান্ডেলা কারাবন্দি ছিলেন।
এই মানুষটি নেতৃত্বের জন্য তার দু'বাহু প্রসারিত করেছেন। 

তার শক্তিশালী মুক্তির বার্তা ভেসেছিল আফ্রিকার বাতাসে
তার দৃষ্টিসীমা পৌছেছিল সুদূর আকাশে 

বাতাসকে পরিশুদ্ধ করতে এই মানুষটি নিজেকে জ্বালিয়েছিলেন 

তোমরা তাকে হত্যা করলেও 

এই পরিশুদ্ধ বাতাসে আমি নেলসন ম্যান্ডেলাকেই দেখব। 

জোহানেসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যান্ডেলকে নিয়ে রচিত কবিতার ওপর রচিত হয়েছে অভিসন্দর্ভ। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার ঝোসা ভাষায় যেসব কবিতা লেখা হয় তা নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণা হয়। 


৪৬৬৬৪
ম্যান্ডেলাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গান। এর মধ্যে ২০০৩ সালের ২৯ নভেম্বর বিখ্যাত ইউ ২ ব্যান্ডের বোনোর কণ্ঠে ৪৬৬৬৪ গানটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বর্ণবাদবিরোধী এই কিংবদন্তিকে নেতাকে নিয়ে গাওয়া বেশকিছু গান বিল বোর্ডের টপচার্টে স্থান করে নেয়।
ইউটুর গাওয়া গানটি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে গ্রিন পয়েন্ট স্টেডিয়ামে প্রথম গাওয়া হয়। ৪৬৬৬৪ হচ্ছে রোবেন দ্বীপের কারাগারে বন্দি ম্যান্ডেলার কয়েদি নম্বর। ১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলা এই কারাগারে ৪৬৬ নম্বর বন্দি ছিলেন। এই ৪৬৬ ও সাল ৬৪ নিয়ে তার কয়েদি নম্বর হয় ৪৬৬৬৪। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালে 'ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা অর্গল ভেঙে দাও' গান দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রিটেনে টপচার্টে অবস্থান করে নেয়। এসব গানে বিশ্বের অন্যতম প্রতিবাদী গান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা গান সম্পর্কে এর গায়ক ও গীতিকার কবি ডামার্স বলেন গানটি যে বিশ্বব্যাপী এত প্রভাব ফলেবে ভাবতেও পারিনি। পরে এটি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রসে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়।
এত গেলে তাকে নিয়ে রচনা করা কবিতা গান কিংবা নাটকের কথা। কিন্তু এসব দিয়ে তো তাকে বিবেচনা করা যায় না। সমগ্র জীবনে যিনি নিজেই রচনা করেছে মানবতার জয়গান। 

১৯৬৪ সালের ১২ জুন আদালতে দাঁড়িয়ে এক জবানবন্দি দিয়েছিলেন দক্ষিণ ম্যান্ডেলা। ওই অকপট স্বীকারোক্তির পর দীর্ঘ ২৭ বছর কাটাতে হয়েছিল নির্বাসনে। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের আলো দেখানো শপথ নিয়েছিলেন তিনি। 

ওই স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেছিলেন 'অন্তর্ঘাতের ষড়যন্ত্রে এবং সহিংসতার অভিযোগের প্রথম আসামি আমি। হ্যাঁ এটা আমি করেছি। আমি অজ্ঞ এ কারণে তা করিনি। আমি সহিংসতা ভালোবাসি না। কিন্তু বছরের পর বছর আমার গোত্রের জনগণকে স্বৈরশাসন, নির্যাতন ও শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য আমি তা করেছি। আফ্রিকার মানুষদের মুক্তি দিতে এ সহিংসতা অপরিহার্য ছিল। সাদাদের শাসন ও শোষণ শেষ করতে আমাদের সামনে এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আমরা আইনের বিরুদ্ধতা করেছি। সহিংসতার জবাব দিতে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছি। দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু সাদাদের নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা হবে সব মানুষের ... আমি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে লড়েছি। একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছি। এটা এমন এক আদর্শ, যেটির আশায় আমি বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু যদি দরকার হয়, এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।'

ম্যান্ডেলার বাবা গাদলা হেনরি মপাকানইসা মভেজো গ্রামের মোড়ল ছিলেন। তবে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরাগভাজন হওয়ার পরে তারা ম্যান্ডেলার পিতাকে পদচ্যুত করে। তিনি তখন তার পরিবারসহ কুনু গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই ম্যান্ডেলার শৈশব কাটে। 

স্কুল থেকে পাস করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস কোর্সে ভর্তি হন। এখানেই অলিভার টাম্বোর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের শেষে ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িত হন। ফলে তাকে ফোর্ট হেয়ার থেকে চলে যেতে বলা হয়। জীবনের পরবর্তী সময়ে কারাগারে বন্দি থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। 

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে আফ্রিকানদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। এই দলটি বর্ণবাদে বিশ্বাসী ছিল। ন্যাশনাল পার্টি ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালের জনগণের সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই সম্মেলনে মুক্তি সনদ প্রণয়ন করা হয়, যা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল সনদ। ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে তিনি মহাত্মা গান্ধীর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় আটক করে। এই মামলাটি সুদীর্ঘ ৫ বছর ধরে (১৯৫৬-১৯৬১) চলে, কিন্তু মামলার শেষে সব আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হন। ১৯৬১ সালে ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গ সংগঠন উমখোন্তো উই সিযওয়ের (দেশের বল্লম) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বর্ণবাদী সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা করেন। ১৯৬৪ সালের ১১ জুন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে এএনসির সশস্ত্র সংগ্রাম ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়া হয়। 

পরবর্তীতে ৮০-এর দশকে এমকে বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এতে অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হন। ম্যান্ডেলা পরে অকপটে স্বীকার করেন এ সংগ্রাম চালাতে গিয়ে এএনসি অনেক সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। বর্ণবাদ অবসানের পরে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের রিপোর্ট থেকে এএনসির অনেক নেতা এই বিষয়ের তথ্য অপসারণ করতে চেয়েছিল_ ম্যান্ডেলার তীব্র সমালোচনা করে সত্য প্রকাশ করেন।
ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রোবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রোবন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলস?মুর কারাগারে নেওয়া হয়। 

১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা এখানেই বন্দি ছিলেন। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন। মুক্তির দিন কারাগারের সামনে দেওয়া বক্তৃতায় ম্যান্ডেলা তার সমর্থকদের স্মরণ করিয়ে দেন, 'এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন তিনি, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারবে।' ম্যান্ডেলা অতীতের তিক্ততার প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে তার সাবেক শ্বেতাঙ্গ নিপীড়কদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন। শুরু হলো এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পথচলা। অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশকে জাগ্রত করে আফ্রিকার এই সূর্যসন্তান নিজে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
কিংবদন্তি এই নেতা জীবন সায়াহ্নে একটি কবিতা লিখেছিলেন নাইজেরিয়ার কবি কেজু ইকেমস। 'হোয়েন ম্যান্ডেলা গোজ' শিরোনামের কবিতাটিতে তিনি লিখেছিলেন, 

তুমি যখন স্বপ্নের এই যুদ্ধ শেষে চিরবিদায় নেবে 

আমাদের অশ্রু তোমার যাওয়ার পথকে মেঘাচ্ছান্ন করবে না 

তুমি যখন চলে যাবে হে পিতা 

উত্তরাধিকার সূত্রে তোমার মহত্ত্ব আমাদের ওপর বর্তাবে 

যেই আফ্রিকার মাটিকে তুমি ভালোবাসতে 

এই মাটি তোমাকে ভালোবেসে যাবে 

তোমার দীর্ঘ মহিমান্বিত পথেই হাটবো আমরা 

আমাদের পথ দেখাবে তোমার সাহসী পদচারণ 

তুমি যখন স্বপ্নের এই যুদ্ধ শেষে চিরবিদায় নেবে 

কথা দিলাম আমাদের অশ্রু 

তোমার যাওয়ার পথকে মেঘাচ্ছান্ন করবে না।

No comments:

Post a Comment