Sunday, July 14, 2013

egypt crisis

মিশর কি ঐক্য খুঁজে পাবে?
টমাস ফ্রিডম্যান

যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন, মধ্যপ্রাচ্য এমন এক অঞ্চল, যেখানে চরমপন্থীরা খুব তৎপর, আর মধ্যপন্থীরা গা বাঁচিয়ে চলতে চায়। কিন্তু ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তি আলোচনা, ২০০৬ সালের আল-কায়েদার বিরুদ্ধে ইরাকি সুন্নিদের আনবার অভ্যুত্থান, ২০০৫ সালে লেবাননে সিরিয়া ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সেডার বিপ্লবএ ঘটনাগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যপন্থীরা কখনো কখনো উঠে দাঁড়ায় এবং একটা অবস্থান নেয়। যখন তারা তা করে, তখন তাদের পক্ষে আমেরিকার সমর্থন প্রয়োজন হয়। গোষ্ঠীতান্ত্রিক বিভেদে বিষাক্ত, অতীতমুখিনতায় ভবিষ্যৎকে চাপা দিয়ে রাখতে অভ্যস্ত এই অঞ্চলের ইতিবাচক পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার সমর্থনই একমাত্র আশার দিক। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান বা সামরিক অভ্যুত্থানকে আমি এভাবেই দেখতে চাই।
কিন্তু আমি যে খুব সহজে এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, তা নয়। অনেক বেশি ভালো হতো যদি মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি তিন বছরের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হতেন নির্বাচনের মাধ্যমে। তাহলে দলটি নিজের অযোগ্যতা ও জনগণের প্রত্যাখ্যানকে মোকাবিলা করতে বাধ্য হতো। ভালো হতো যদি মিসরীয় সেনাবাহিনী এর সঙ্গে না জড়াত। কিন্তু মিশরে এখন আর সবকিছু ভালোমতো হওয়া সম্ভব নয়। পারফেক্টআর মিশরের মেন্যুতে নেই। এমনকি গরিবদের খাদ্যতালিকায় হয়তো খাদ্যও এখন নেই। মিশরের বিপুলসংখ্যক মানুষের মনে হয়েছে, মুরসিকে ভোটের মাধ্যমে তাড়ানোর জন্য তিন বছর অপেক্ষা করলে দেশটা খাদের কিনারে চলে যাবে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এমন যে জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না, সবখানে গ্যাস-সংকট আর বিদ্যুৎ-সংকট। এটা পরিষ্কার হয়েছিল যে দেশ পরিচালনার দিকে মুরসির মনোযোগ ছিল না, দেশ পরিচালনার জন্য যে দক্ষ লোকবল দরকার হয়, তা নিয়োগের দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল না। তাঁর সব মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল নিজের ও নিজের দলের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার দিকে। ফলে, নির্বাচনের সময় আসতে আসতে মিশর হয়ে উঠত পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ দেশগুলোর একটা, যেখানকার সরকার হতো অপ্রতিরোধ্য, তাকে হারানোর সাধ্য কারোর থাকত না, আর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের থাকত না কোনো প্রতিকার।
ব্রাদারহুডের অগ্রাধিকারগুলো কেমন ছিল, সে সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে একটি ঘটনা থেকে। খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত উপার্জনের সবচেয়ে ভালো উপায় পর্যটনশিল্প পুনরুজ্জীবিত করা। দেশটির অর্থনীতির ১০ শতাংশই পর্যটন খাতের অন্তর্ভুক্ত। ১৬ জুন মুরসি ১৭ জন নতুন গভর্নর নিয়োগ করেন। মিসরীয় পর্যটনশিল্পের প্রাণকেন্দ্র লাক্সরের গভর্নর হিসেবে তিনি নিয়োগ করেন আদেল আল-খায়াতকে, যিনি ইসলামি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী গামা আল ইসলামিয়ার সদস্য। এ গোষ্ঠী হোসনি মোবারকের সরকারের ওপর আঘাত হানতে এবং সুনির্দিষ্টভাবে মিশরের পর্যটনশিল্পকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৭ সালে লাক্সরে এক সন্ত্রাসী হামলায় ৫৮ জন পর্যটককে হত্যা করেছিল বলে তারা নিজেরাই স্বীকার করে। এক দশক হয়ে গেল গামা ইসলামিয়া সহিংসতা পরিহার করেছে বটে, কিন্তু কখনো বলেনি যে লাক্সরের ওই সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে তারা ঠিক করেনি। এই গোষ্ঠীর নেতা আদেল আল-খায়াতকে লাক্সরের গভর্নর নিয়োগ দেওয়ার প্রতিবাদে মুরসি সরকারের পর্যটনমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত আদেল আল-খায়াতও বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এসব ঘটনা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়, মিশরে কী ঘটছিল।
চূড়ান্ত খারাপ অবস্থায় পৌঁছে যাওয়ার আগে মিশরের গতিমুখ পরিবর্তনে সে দেশের জনগণের এ রকম বেপরোয়া হয়ে ওঠার জন্য তাদের শাস্তি না দিয়ে আমেরিকার উচিত এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সহযোগিতা করা, মিসরীয় সেনাবাহিনীর ওপর আমেরিকার যে প্রভাব রয়েছে তা কাজে লাগানো। এটা শুরু হতে পারে ব্রাদারহুডের নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে এবং দলটি ও তার প্রচারমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ করতে চাপ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। পরবর্তী পার্লামেন্ট নির্বাচনে ও সংবিধান প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। যে-ই মিশরকে এককভাবে শাসন করতে চাইবে, সে-ই ব্যর্থ হবে। মোবারক ব্যর্থ হয়েছেন; সেনাবাহিনী, মুসলিম ব্রাদাররা, কিংবা উদার গণতন্ত্রীরাকেউ-ই একা মিশর শাসন করতে পারবে না। মিশর এক সাংঘাতিক গভীর গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে, সেখান থেকে উঠে আসার একমাত্র উপায় একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা, যারা কঠোর সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারে, দরকারি কঠিন কাজগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারবে।
অবশ্য কে মিশর শাসন করবেএটাই একমাত্র বড় প্রশ্ন নয়; বরং এটাও একটা বড় প্রশ্ন যে শাসনটা কীভাবে করা যাবে। এ রকম গভীর অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও দুঃখ-দুর্দশায় কোনো ভঙ্গুর নয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি অগ্রসর হতে পারে? আমি সদ্য মিশর থেকে ফিরলাম। দেশটি ভেঙে পড়ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে আমি কায়রোর এক চায়ের দোকানে বসে মুহাম্মদ মেদানির সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। মেদানি মিশরের কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের গবেষক এবং দেশটির শীর্ষ পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের একজন। ৫৫ বছর বয়সী মেদানি স্মরণ করছিলেন, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে যখন তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তখন তাঁরা একটা গান গাইতেন। সে গানের কথাগুলো ছিল এমন, গোটা পৃথিবী কীভাবে দুই কোটি মিসরীয়র সঙ্গে কথা বলছে। ১৯৮২ সালে মোবারক যখন ক্ষমতা নিলেন তখন আমরা ছিলাম তিন কোটি ৩৩ লাখ বা ৪০ লাখ। আজ আমরা আট কোটি ছাড়িয়ে গেছি।তিনি আরও বলেন, নীল অববাহিকায় ক্রমাগত পলি জমা, তার সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমে বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। নীল নদ আমাদের প্রাণের নাড়ি, আর এই বদ্বীপ আমাদের রুটির ঝুড়ি,’ মেদানি বলেন, ‘যদি এ দুটো কেড়ে নাও, তাহলে মিশরের অস্তিত্বই থাকবে না।
মিশরের জনসাধারণ প্রচণ্ড মানসিক চাপের শিকার এবং তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা আন্দোলিত হচ্ছে। এমন একটি জনগোষ্ঠী, তার কর্মসংস্থানের সংকট, পানির সংকট, তার নিরক্ষরতা ও জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনএ সবকিছু মিলিয়েই সম্ভবত মিশরের অবস্থা শাসনের অযোগ্য হয়ে উঠছে। আমি জানি, ব্রাদারহুডকে বিচ্ছিন্ন করে সেক্যুলার বা সামরিক সরকার আর অপর পক্ষকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রাদারহুডের সরকারএ দুয়ের মাঝখানে মিশরের দোদুল্যমানতা অব্যাহতভাবে চলতে পারে না।
দারন আসেমগলু হোয়াই নেশনস ফেইল শীর্ষক বইয়ের দুই লেখকের একজন। এ বইয়ের সরল বক্তব্য হচ্ছে, কোনো জাতি উন্নতি করে তখনই, যখন তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো হয় গ্রহণবাদী বা ইনক্লুসিভ। আর কোনো জাতি ব্যর্থ হয় যখন তার এ প্রতিষ্ঠানগুলো হয় বর্জনবাদী বা এক্সট্র্যাকটিভ, ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধা কুক্ষিগত হয় স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে। দারন আসেমগলুর মতে, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রশক্তিসম্পন্ন মিশর বর্জনবাদী সমাজের একটা ভালো দৃষ্টান্ত। মিশরের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন একজন নেতার, যিনি সব পক্ষকে একত্র করার গ্রহণবাদী চেতনার সঙ্গে কঠোর সততা যুক্ত করে জনগণকে বলতে পারবেন, বহু সময় তাঁরা নষ্ট করেছেন, এখন সত্যিই কাজ শুরু করা জরুরি: শিক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা, রাষ্ট্রের আকার সংকুচিত করা, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক উদ্যোগকে উৎসাহিত করা, নারীদের ক্ষমতায়ন ঘটানো এবং পুলিশ ও বিচার বিভাগের সংস্কার সাধন।
মুরসি এসব করার দিকে অগ্রসর হতেনএমন কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। যদি নতুন করে নির্বাচন হয়, একটা নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা যায়, যদি ইসলামপন্থীদেরসহ একটা ব্যাপক অংশগ্রহণভিত্তিক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়, তাহলে মিশর সেসব সমস্যার সমাধান করার সুযোগ পাবে, যেগুলো এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ আর নেই। এভাবেই মিশর ভবিষ্যতে আরও অনেক গভীর ও জটিল সমস্যা সৃষ্টি হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে।
কিন্তু এটি একটি সুযোগ মাত্র। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার কর্তব্য হচ্ছে এ রকম একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের জন্য সব পক্ষকে উদ্বুদ্ধ করা।

ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন থেকে নেওয়া।

টমাস ফ্রিডম্যান: আমেরিকান সাংবাদিক।

Wednesday, July 10, 2013

manhatan project

ম্যানহাটন প্রকল্প
পারমাণবিক যুগ শুরু

১৯৩৯-র জানুয়ারির কথা।
ইউরেনিয়ামের কেন্দ্রীন বিভাজন সম্ভব জানতে পেরে ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণাগারে আগের পরীক্ষাগুলোর পুণরাবৃত্তি করতে শুরু করেন। এর মাত্র ১ বছরের মধ্যে কেন্দ্রীন বিভাজন বিষয়ে শতাধিক গবেষণাপত্রের উদ্ভব হয়। মার্কিন প্রবাসী হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানী লিও জিলার্দ ইউরেনিয়াম বিভাজনের খবর শুনে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, "পৃথিবী দুঃখের দিকে এগিয়ে চলেছে"। ১৯৩৯ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীদের একটি ছোট দল নিশ্চিত ছিলেন যে, এই প্রক্রিয়ায় অনন্য সাধারণ শক্তির এক অস্ত্র নির্মাণ সম্ভব, অন্তত তত্ত্ব তা-ই বলছিল।
১৯৩৯ সালের প্রথম থেকেই অভিবাসী বিজ্ঞানীরা মার্কিন পরমাণু গবেষণা ত্বরাণ্বিত করার জন্য সরকারকে রাজি করাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ওই বছরের জুলাইয়ে মার্কিন প্রবাসী হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার, লিও জিলার্দ এবং এডওয়ার্ড টেলার মার্কিন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাটি কাজে লাগায়। তারা আলবার্ট আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে এ বিষয় জানিয়ে চিঠি লেখার জন্য। ২ আগস্ট আইনস্টাইন রুজভেল্টকে একটি নতুন ধরণের বোমার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেন। এর মাত্র ৬ বছরের মাথায়ই যে জাপানে অপরিমেয় শক্তির বোমা বিস্ফোরিত হতে পরে, আইনস্টাইন তখন তা ভাবতেও পারেননি। রুজভেল্ট বিজ্ঞান সম্বন্ধে বেশ কমই জানতেন। তাই চিঠিটি পড়ে অবিলম্বে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে ইউরেনিয়াম সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে তথ্য জোগাড়ের নির্দেশ দেন। ১৯৪১ সালের ২৮ জুন রুজভেল্টের নির্দেশে সাইন্টিফিক রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট দফতরের মাধ্যমে "ন্যাশনাল ডিফেন্স রিসার্চ কমিটি" গঠিত হয়। অবশ্য মার্কিনীরা পারমানবিক বোমা তৈরিতে তখনও খুব একটি তাড়া বোধ করছিল না। কিন্তু ৭ ডিসেম্বর জাপানের পার্ল পোতাশ্রয় আক্রমণ তাদের টনক নড়িয়ে দেয়। এই আক্রমণের পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান ও জার্মানির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পারমারবিক বোমা নিয়ে যত তত্ত্বকথা চলছিল তা তৎক্ষণাৎ ব্যবহারিক প্রয়োগের মুখ দেখে।
পার্ল পোতাশ্রয় হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি কর্পস অব ইঞ্জিনিয়ার্সের সহযোগিতায় পারমানবিক বোমা নির্মাণ প্রক্রিয়াকে সরকারীভাবে সুসংগঠিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পরিচালনায় সাধারণ গবেষণা প্রকল্প থেকে এই প্রচেষ্টা একটি সুবৃহৎ জাতীয় নির্মাণ প্রকল্পে রূপ নেয় যার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইঞ্জিনিয়ার্স কর্পসের "ম্যানহাটন ইঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্ট"-কে। এখান থেকেই ম্যানহাটন প্রকল্প নামটি এসেছে। প্রকল্পের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লেজলি রিচার্ড গ্রোভ্‌স। এই সুদক্ষ সামরিক প্রকৌশলী এর আগে পেন্টাগন নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন। গ্রোভ্‌স পারমানবিক গবেষণা সংক্রান্ত সকল প্রচেষ্টাকে একক উদ্দেশ্যে সুসংহত করেন। ফলশ্রুতিতে বড় আকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বিমান, জাহাজ বা ডুবোজাহাজের জন্য শক্তির উৎস নির্মাণ সংক্রান্ত সকল পরিকল্পনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন থেকে এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল কেবল একটি, পারমানবিক বোমা তৈরি করে সম্ভাব্য ন্যুনতম সময়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানো।
গ্রোভ্‌স প্রথমেই ক্রিসলার, জেনারেল ইলেকট্রিক, ইস্টম্যান কোডাক, ওয়েস্টিংহাউস এবং ডুপন্ট-এর মত মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা কাজে লাগান। এছাড়া উচ্চতর নিউক্লীয় গবেষণার জন্য অনেকগুলো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়কেও এ কাজে যুক্ত করেন যার মধ্যে ছিলপ্যাসাডেনার ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, নিউ ইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজেরম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং নিউ ইয়র্কের রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়। পরিশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ভিন্ন স্থানে তিনটি সুবৃহৎ ফেডারেল স্থাপনা নির্মাণ করেন। এই স্থানগুলি ছিল টেনেসির ওক রিজ, ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ড এবং নিউ মেক্সিকোর লস আলামস। ১৯৪২ সালে গ্রোভ্‌স এই প্রকল্পের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ততদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরে অক্ষ শক্তির সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। মার্কিন বিজয়ের সংবাদ সেদেশের সংবাদপত্রগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হতো। কিন্তু ম্যানহাটন প্রকল্পের সকল ধরণের তথ্য একেবারে গোপন করে যান গ্রোভ্‌স। চূড়ান্ত সফলতার আগে এর পারমানবিক বোমা তৈরির খবর কেউই জানতো না। এমনকি প্রকল্পের কর্মীদেরকেও জ্ঞানের শ্রেণীবিভক্তিকরণের মাধ্যমে অজ্ঞ করে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ কর্মীরা তাদের নিজস্ব কাজটি করার জন্য যতটুকু না জানলেই নয় ততটুকুই জানতো। সর্বস্তরের কর্মীরা এতে বেশ হতাশ বোধ করলেও গোপনীয়তা ঠিক বজায় ছিল। ১৯৪৫ সালের মূল্যমানে এই প্রকল্পের জন্য খরচ হয়েছিল প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এতে মোট ১৭৫,০০০ লোক কাজ করেছিল।
গোপনেই বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা পুরোদমে চালিয়ে গেলেন। এনরিকো ফের্মি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার গবেষণার স্থান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাতুবিজ্ঞান গবেষণাগারে নিয়ে আসলেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে অব্যবহৃত ফুটবল স্টেডিয়ামের নিচে একটি স্কোয়াশ কোর্ট কিছুদিনের জন্য ব্যবহার করতে দিল। সেখানে ফের্মি তার ক্রুদের সাহায্যে বিশাল বিশাল ইউরেনিয়াম দণ্ড ও গ্রাফাইট খণ্ড জড়ো করলেন যেগুলো প্রায় কোর্টের ছাদ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এভাবে ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর ফের্মি পৃথিবীর প্রথম নিয়ন্ত্রিত নিউক্লীয় শক্তি বিমুক্তিকরণ প্রক্রিয়া নির্মাণ করলেন। এর প্রায় ৪ বছর আগে বোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিভাজন বিক্রিয়ার খবর এনেছিলেন। ফের্মি কেবল একটি বাতি জ্বালানোর মত শক্তি উৎপাদনে সমর্থ হয়েছিলেন। তথাপি তা ছিল সব ধরণের নিউক্লীয় শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার আদি পুরুষ। ফের্মির উদ্ভাবনের পর বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হলেন এই ভেবে যে তারা সঠিক পথে রয়েছেন।
ম্যানহাটন প্রকল্প পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা ঘটায় যাকে বলা হয় "পারমাণবিক যুগ"। পারমাণবিক বোমা কতটা ভয়ানক এবং বিধ্বংসী হতে পারে, আর এর প্রতিক্রিয়াই বা কি হতে পারে, প্রকল্পের মাধ্যমে তা পরিষ্কার হয়েছে। পারমাণবিক বোমা তৈরির পর একটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার উদ্ভব ঘটেছে। এর ফলে বর্তমানে এতো পরিমাণ পারমাণবিক বোমা উৎপাদিত হয়েছে যার মাধ্যমে মানব সভ্যতা এবং পৃথিবীর অধিকাংশ জীবকূল মুহুর্তেই ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব।
নিউ মেক্সিকোর লস আলামসের বৈজ্ঞানিক পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। একটি স্কুল ভবনকে করা হয় কেন্দ্রীয় গবেষণাগার এবং সরকারিভাবে সাইট ওয়াইহিসেবে নামকরণ করা হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে ছোট্ট এই শহরে নিভৃতে চলত বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা বানানোর তোড়জোড়। সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও কয়েকজন বিজ্ঞানীর কর্মব্যস্ততায় গভীর রাত অবধি জেগে থাকত শহরটি। বিংশ শতাব্দীর একদল সেরা বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ লস আলামসে ওপেনহাইমারের অধীনে কাজ করেছিলেন। প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের মধ্যে রয়েছেন ফিলিপ এইচ আবেলসন, হান্স বেটে, নিল্‌স বোর, জেমস চ্যাডউইক, এনরিকো ফের্মি, রিচার্ড ফাইনম্যান, অটো ফ্রিশ্‌চ, জর্জ কিস্তিয়াকোভ্‌স্কি, আর্নেস্ট লরেন্স, ফিলিপ মরিসন, সেথ নেডারমেয়ার, জন ফন নিউমান, রুডলফ্ পিয়ার্লস, ইসিদোর ইজাক রাবি, লিও জিলার্দ,এডওয়ার্ড টেলার, স্তানিসল' উলাম, হ্যারল্ড উরে এবং ভিক্টর ওয়েইজকফ। প্রকল্পে কাজ শুরু করার আগেই এদের মধ্যে ৫ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং যুদ্ধের পর এখান থেকে আরও ৩ জন নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
ম্যানহাটন প্রকল্প ৪টি পারমাণবিক বোমা বানিয়েছিল। এর মধ্যে ট্রিনিটি নামক প্রথম বোমাটি নিউ মেক্সিকোর আলামোগোর্ডোর নিকটে পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরিত করা হয়। প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে যে ফিশন বোমাটি তৈরি করা হয় তার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল ২০,০০০ টন টিএনটি-এর সমান। আর প্রথম যে হাইড্রোজেন বোমাটি তৈরি করা হয় তা ছিল ১০,০০০,০০০ টন টিএনটি ক্ষমতাসম্পন্ন। অন্য দুটি বোমা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট এবং ৯ আগস্ট তারিখে যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত হয়। শেষ বোমাটি আগস্টের শেষ দিকে জাপানের উপর নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই দুটি বোমার মধ্য দিয়েই বিশ্ব প্রথম পারমাণবিক বোমা সম্পর্কে জানতে পারে এবং অজানা শহর লস আলামসের রহস্যের পর্দাও উন্মোচিত হয়ে পড়ে।

সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী পরমাণু পরীক্ষা
তারিখ
পরিমাণ
পরীক্ষণের ধরণ
দেশ
এলাকা
৩০ অক্টোবর, ১৯৬১
৫০ মেগাটন
আকাশ থেকে নিক্ষেপণ
সোভিয়েত ইউনিয়ন
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৬২
২৪.২ মেগাটন
আকাশ থেকে নিক্ষেপণ
সোভিয়েত ইউনিয়ন
৫ আগস্ট, ১৯৬১
২১.১ মেগাটন
আকাশ থেকে নিক্ষেপণ
সোভিয়েত ইউনিয়ন
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২
১৯.১ মেগাটন
আকাশ থেকে নিক্ষেপণ
সোভিয়েত ইউনিয়ন
২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪
১৫ মেগাটন
ভূমিতে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
৫ মে, ১৯৫৪
১৩.৫ মেগাটন
সমুদ্রের উপরিভাগ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
২৩ অক্টোবর, ১৯৬১
১২.৫ মেগাটন
আকাশ থেকে নিক্ষেপণ
সোভিয়েত ইউনিয়ন
২৬ মার্চ, ১৯৫৪
১১ মেগাটন
সমুদ্রের উপরিভাগ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
১ নভেম্বর, ১৯৫২
১০.৪ মেগাটন
ভূমিতে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২
১০ মেগাটন
আকাশ থেকে নিক্ষেপণ
সোভিয়েত ইউনিয়ন


পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ
তারিখ
সাঙ্কেতিক নাম
দেশ
গুরুত্ব
১৯৪৫
আমেরিকা
প্রথম পরমাণু বিভাজিত যন্ত্রের পরীক্ষা
১৯৪৫
আমেরিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপণ
১৯৪৫
আমেরিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ সর্বশেষ আণবিক বোমা নিক্ষেপণ
১৯৪৯
রাশিয়া
প্রথম পরমাণু বিভাজিত আণবিক পরীক্ষা
১৯৫২
ব্রিটেন
যুক্তরাজ্যের প্রথম পরমাণু বিভাজিত আণবিক পরীক্ষা
১৯৫২
আমেরিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম তাপজাত পারমাণবিক অস্ত্র
১৯৫৩
রাশিয়া
সোভিয়েত ইউনিয়নের মিশ্রণযুক্ত আণবিক অস্ত্র পরীক্ষা
১৯৫৪
আমেরিকা
অত্যন্ত বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বিকিরণে দূর্ঘটনায় নিমজ্জিত হয় প্রথম শুষ্ক মিশ্রণযুক্ত আণবিক অস্ত্র পরীক্ষা
১৯৫৫
রাশিয়া
প্রথম প্রদর্শণীকৃত ও তাপজাত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা (বিস্তীর্ণ আকারের)
১৯৫৭
ব্রিটেন
যুক্তরাজ্যের প্রথম (সফলতম) প্রদর্শণীকৃত ও তাপজাত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা
১৯৬০
ফ্রান্স
ফ্রান্সের প্রথম পরমাণু বিভাজিত পরীক্ষা
১৯৬১
রাশিয়া
সর্ববৃহৎ তাপজাত পরমাণু পরীক্ষা
১৯৬৪
চীন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কর্তৃক প্রথম পরমাণু বিভাজিত অস্ত্র পরীক্ষা
১৯৬৭
চীন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কর্তৃক প্রথম প্রদর্শণীকৃত ও তাপজাত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা
১৯৬৮
ফ্রান্স
ফ্রান্সের প্রথম প্রদর্শণীকৃত ও তাপজাত পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা
১৯৭৪
ভারত
ভারতের প্রথম পরমাণু বিভাজিত অস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ
১৯৯৮
ভারত
ভারতের প্রথম পরমাণু বিভাজিত অস্ত্রের বিস্তীর্ণ বিস্ফোরণ
১৯৯৮
পাকিস্তান
পাকিস্তানের প্রথম পরমাণু বিভাজিত অস্ত্র পরীক্ষা
২০০৬
উত্তর কোরিয়া
উত্তর কোরিয়ার প্রথম পরমাণু বিভাজিত প্লুটোনিয়ামভিত্তিক ফিজল আণবিক পরীক্ষা
২০০৯
উত্তর কোরিয়া
উত্তর কোরিয়ার প্রথম পরমাণু বিভাজিত অস্ত্রের সফলতম পরীক্ষণ