আদানি
সাম্রাজ্যের নেপথ্য কারিগর!
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘মাল্টি-বিলিয়ন ডলার
জালিয়াতির মূল খেলোয়াড়’ গৌতম
আদানি নন, বরং
তার বড় ভাই বিনোদ আদানি। গৌতমকে সামনের সারিতে রেখে পর্দার আড়ালে মূল কাজ করার
অভিযোগ এই সাইপ্রাসের পাসপোর্টধারী ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ মার্কিন বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসেরও...
মুম্বইয়ে পাওয়ার লুম দিয়ে ব্যবসা শুরু। সালটা ১৯৭৬।
এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের ছাপ ফেলতে সিঙ্গাপুরে একটি অফিস খুলেছিলেন। সেখানেই
বসবাস শুরু করেন। যদিও পরবর্তীতে চলে যান দুবাই। সেখানে জ্বালানি এবং নির্মাণ
ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। চিনি, তেল, অ্যালুমিনিয়াম, তামা এবং লোহার স্ক্র্যাপের
ব্যবসার সঙ্গেও যোগ রয়েছে। এই ধনীতম অনাবাসী ভারতীয়ের সম্পদের পরিমাণ ১,৬৯,০০০ কোটি টাকা। হিসেব বলছে, প্রতিদিন
গড়ে ১০২ কোটি টাকা আয় করেন। গত পাঁচ বছরে সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ গুণ।
এটাই তাঁর সব পরিচয় নয়। আসলে পরিচয়, তিনি গৌতম আদানির দাদা— বিনোদ আদানি।
১৯৮০-এর দশকে ১ হাজার ডলারের বিনিময়ে একটি ছোট প্লাস্টিক
প্যাকেজিং কারখানা কিনেছিলেন বিনোদ। সেটিও নিজের বহুদিনের টাকা জমিয়ে এবং ব্যাঙ্ক থেকে
লোন নিয়ে। এরপর সেটি চালানোর ভার দিয়ে দেন ছোট ভাই গৌতমের হাতে। দু’জন একেবারে শূন্য
থেকে শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই বিনোদ আদানি ২০১৮ সালে ভারতের ধনীতম ব্যক্তিদের
তালিকায় ৪৯তম স্থানে। আর গত চার বছরের মধ্যে এক লাফে উঠে এসেছেন ষষ্ঠ স্থানে। কীভাবে
এই উল্লম্ফন? প্রশ্নটা তুলেছে মার্কিন শর্ট সেলার কোম্পানি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ।
তারা মনে করছে, আদানি সাম্রাজ্যের নেপথ্য কারিগর আসলে গৌতম নন, এই বিনোদ আদানি। জানুয়ারি
মাসের শেষে প্রকাশিত হওয়া প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির নাম উঠেছে
৫৪ বার। অন্যদিকে, বিনোদের
নাম উল্লেখ করা হয়েছে ১৫১ বার। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে অভিযোগ, বিদেশে
আদানি গোষ্ঠীর যাবতীয় লেনদেন সামলাতেন আড়ালে থাকতে পছন্দ করা বিনোদই। তাঁর সংস্থার
হাত ধরেই শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি-র নিয়ম এড়িয়ে ভুয়ো লেনদেনের মাধ্যমে টাকা
ঢুকেছে আগানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থায়। শুধু তাই-ই নয়, আদানির বিভিন্ন শেয়ারে
লগ্নির বদলে গোপনে রাশিয়ার ব্যাঙ্কের থেকে প্রায় ২৪ কোটি ডলারের বেশি (প্রায় ১৯৮০
কোটি টাকা) ঋণ নিয়েছেন বিনোদ। আদানিরা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্য একটি রিপোর্ট বলছে, হোলসিমের ভারতীয় ব্যবসা কেনার ক্ষেত্রে সরাসরি
ভূমিকা রয়েছে বিনোদের সংস্থার। এ ছাড়াও আদানিদের বেশ কয়েকটি সংস্থার ক্ষেত্রে
ঘুরপথে টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা করেছেন বিনোদ। যার হাত ধরে বাধ্যতামূলকভাবে ২৫ শতাংশ
শেয়ার প্রোমোটারদের বাইরের লগ্নিকারীদের হাতে থাকার নিয়ম এড়াতে পেরেছে আদানিরা।
এমনকি অস্ট্রেলিয়ায় তাদের কয়লা খনি প্রকল্প নিয়ে আলোচনার সময়ে বিনোদই ছিলেন বিদেশে
লেনদেনের মূল মাথা।
সম্প্রতি মার্কিন বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসের সাংবাদিক জন
হায়াট ও জিয়াকোমো তোগনিনি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, বিনোদ অনেকগুলি
অফশোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সেগুলির সাহায্যে এক গোলকধাঁধা তৈরি করেছেন। যার সাহায্যে ভারতে
থাকা আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলি থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সরানো হয়েছে। আর এর বেশিরভাগ লেনদেনই
হয়েছে গোপনে। এর ফলে আদানি গ্রুপ ভারতীয় আইনকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই আইন
অনুযায়ী, কোনও
পাবলিক-ট্রেডিং স্টকে থাকা কোম্পানির কমপক্ষে ২৫ শতাংশ শেয়ার ওই কোম্পানির মালিকের
সঙ্গে জড়িত কারও অধীনে থাকতে পারবে না। তবে আদানি গ্রুপ তাদের চেয়ারম্যানের ভাইয়ের
সঙ্গে মালিকানার সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার
পাঁচ দিন পর এর পাল্টা প্রত্যুত্তরে লেখা ৪১৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপ দাবি
করে, বিনোদ
আদানি পাবলিক লিস্টে থাকা আদানি গ্রুপের কোনও প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার পদে নেই, এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত
কাজকর্মেও তাঁর কোনও অংশগ্রহণ নেই। তবে ফোর্বস এর আগেও বিনোদ আদানির সঙ্গে
সম্পর্কযুক্ত ভুয়ো কোম্পানির সঙ্গে আদানি গ্রুপের অপ্রকাশিত লেনদেনের খবর পেয়েছে। যেগুলিকে আদানি গ্রুপের
লাভের জন্যই তৈরি করা হয়েছে বলে মনে হয়। এই চুক্তিগুলি হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনে
থাকা গোপন লিভারেজ এবং অ্যাকাউন্টিংয়ে অনিয়মের অভিযোগকেও আরও শক্ত ভিত দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট এনার্জি
ফাইন্যান্সের কর্তা টিম বাকলির কথায়,
‘আমি তো সবসময়েই ভেবেছি এটা একটা যৌথ উদ্যোগ। গৌতম
বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ ব্যক্তিত্ব যিনি সবার সামনে নিজেকে প্রকাশ করেন। অন্যদিকে
বিনোদ এর সবকিছুর পিছনে থাকা ব্যক্তি। ট্যাক্স হেভেনের মাস্টারমাইন্ড। আসল পাপেট মাস্টার।’
ফোর্বসের অনুরোধ সত্ত্বেও আদানি গ্রুপ এবং বিনোদ আদানি কোনও প্রত্যুত্তর দেননি। যদিও
বিনোদের ইমেল ঠিকানা আদানি গ্লোবাল ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, যে নামে দুবাইয়ে বেশ কিছু
সম্পত্তি রয়েছে।
ফোর্বসের সাংবাদিক জন হায়াট ও জিয়াকোমো লিখছেন, আদানি
গ্রুপের সঙ্গে বিনোদের যে লেনদেন রয়েছে তা সাধারণ চোখেই ধরা পড়েছে। গত বছরেই
বিনোদের এনডেভার ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড কোম্পানিটি আদানি গ্রুপের
সিমেন্ট ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। ভারতীয় দুই সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানির
সুইস প্রতিষ্ঠান হোলসিমের মালিকানা ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয়
আদানি গ্রুপ, যা
তাদের পরিণত করে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারী গ্রুপ হিসেবে। সেই সময়
সংস্থার তরফে এবং তাদের ব্যাঙ্কগুলি লেনদেনের নথি প্রকাশ্যে আনে। ওই নথিতে উঠে
আসে, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ভার্জিন, মরিশাস
এবং দুবাইয়ের সাতটি সংস্থার নাম। যারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার মধ্যে
একটি ফার্ম সিমেন্ট কোম্পানির শেয়ার খোলা বাজার থেকে কিনবে বলে ঠিক হয়। নথিতে
উল্লেখ করা হয়, এর
ফলে গৌতম আদানি লাভবান হবেন না। বরং দাদা বিনোদ এবং তাঁর স্ত্রী রঞ্জনবেনকে ‘বেনিফিশারি’ হিসেবে দেখানো হয়। এভাবেই
আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন লেনদেনে ভূমিকা নিয়েছিলেন বিনোদ। যেখানে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে।
আরও কিছু লেনদেন রয়েছে, যেগুলি বেশ অস্পষ্ট। যেমন— সিঙ্গাপুরের পিনাকল
ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পিটিই কোম্পানি পরোক্ষভাবে বিনোদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত
হয়। ২০২০ সালে কোম্পানিটি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভিটিবি ব্যাঙ্কের সঙ্গে
একটি ঋণ চুক্তি করে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে পিনাকল কোম্পানি ব্যাঙ্কটি থেকে ২৬৩
মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে আরেকটি নামহীন সংশ্লিষ্ট পক্ষকে ২৫৮ মিলিয়ন ডলার ধার দেয়।
সিঙ্গাপুরের ডকুমেন্ট অনুযায়ী, ওই
বছরের শেষের দিকে পিনাকল তাদের ঋণ নেওয়ার গ্যারান্টর হিসেবে দু’টি ফান্ড কোম্পানির
নাম লিপিবদ্ধ করে। আফ্রো এশিয়া ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড এবং ওয়ার্ল্ডওয়াইড
ইমার্জিং মার্কেট হোল্ডিং লিমিটেড। তবে ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জের ফাইল অনুযায়ী, বিনোদ মরিশাস-ভিত্তিক
অ্যাক্রোপলিস ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের চূড়ান্ত সুবিধাভোগী মালিক। যে কোম্পানিটি আবার ওয়ার্ল্ডওয়াইড
ইমার্জিং মার্কেট হোল্ডিং লিমিটেড নিয়ন্ত্রণ করে।
এদিকে আফ্রো এশিয়া ট্রেড এবং ওয়ার্ল্ডওয়াইড উভয়ই আদানি
গ্রুপের বড় শেয়ারহোল্ডার। এই দু’টি তহবিল একত্রে আদানি এন্টারপ্রাইজ, আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি পোর্টস এবং আদানি পাওয়ারের
৪ বিলিয়ন ডলার স্টকের মালিক।
বিনিয়োগ ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ট্রেন্ডলাইনের মতে আফ্রো এশিয়া
ট্রেড এবং ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কাছে অন্য কোনও সিকিউরিটিজ নেই। এর অর্থ পিনাকলের ঋণ
মূলত আদানি কোম্পানির শেয়ারের উপর নির্ভর করছে! একইসঙ্গে এই দু’টি ফান্ডের কোনওটিই
ভারতীয় স্টক এক্সচেঞ্জের ফাইলে আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলিতে তাদের শেয়ারের কথা
প্রকাশ করেনি।
সাংবাদিক জন হায়াট ও জিয়াকোমো লিখছেন, আদানি সাম্রাজ্যের
পাবলিক ফেস হলেন গৌতম আদানি, অন্যদিকে
বিনোদ আদানি কাজ করেন পর্দার আড়ালে। তার খুব কম ছবিই ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
সাইপ্রাসের পাসপোর্টধারী এবং সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা বিনোদের বেশ কিছু নাম
রয়েছে। যার
মধ্যে একটি হল বিনোদ শান্তিলাল শাহ। যদিও তাঁর জন্ম সাল কবে তা এখনও রহস্য। ফোর্বসের
হিসেব অনুযায়ী, বিনোদের
সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে ১.৩ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাব করা হয়েছে মূলত ওয়ার্ল্ডওয়াইড
ইমার্জিং মার্কেট হোল্ডিং লিমিটেড এবং এনডেভার ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট
লিমিটেডের উপর তাঁর মালিকানাকে ভিত্তি করে। এই দু’টি কোম্পানিই দুই সিমেন্ট
কোম্পানিসহ বেশ কিছু আদানি গ্রুপ কোম্পানির শেয়ারেরও মালিক।
তবে গৌতমের ব্যবসার সঙ্গে বিনোদ কতটুকু জড়িয়ে আছেন তা এখন
পুরোপুরি জানা যায়নি, যে
কারণে ধারণা করা হচ্ছে, বিনোদের
সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি। ওয়াশিংটন ডিসির প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড
ডিফেন্স স্টাডিজের রিয়েল এস্টেট সম্পর্কিত ডেটা অনুযায়ী, দুবাইয়ে বিনোদের ১০টি সম্পত্তি
রয়েছে। তাছাড়া সিঙ্গাপুরে তাঁর অ্যপার্টমেন্টের দামও প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার। ফোর্বস
তদন্ত করে বের করেছে, বিনোদ অন্তত ৬০টি ভুয়ো কোম্পানির সঙ্গে জড়িত, যেগুলি ছড়িয়ে আছে বাহামাস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, কেইম্যান আইল্যান্ড, সাইপ্রাস, মরিশাস, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট থেকে প্রকাশিত পানামা
পেপার্স অনুযায়ী, বিনোদ
১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে বাহামাসে একটি কোম্পানি তৈরি করেন। দুই মাস পরে তিনি
কোম্পানিটির ডকুমেন্টে তার নাম বিনোদ শান্তিলাল আদানি থেকে পরিবর্তন করে বিনোদ
শান্তিলাল শাহ করার অনুরোধ করেন। বিনোদের ব্যবসা যখন দুবাইতে বেড়ে চলছিল, ওই সময়ে গৌতমও তাঁর ব্যবসা
শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৪ সালে একে পাবলিক কোম্পানি
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি অন্তত ২০১১ সাল পর্যন্ত
আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলির বিভিন্ন উচ্চ পদে ছিলেন। বিনোদের ৪৪ বছরের ছেলে প্রণব
এখনও আদানি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
২০১৪ সালের একটি কেলেঙ্কারিতে বিনোদ জড়িত থাকার অভিযোগ
রয়েছে। সেই বছর আদানি গ্রুপ পাওয়ার প্ল্যান্টের সরঞ্জাম কেনার জন্য অতিরিক্ত
ওভার-ইনভয়েসিং করে সেটিকে ৮০০ মিলিয়ন ডলারে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করে ভারতের
ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স। তাদের অভিযোগ, বিনোদ বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের জন্য আদানি
গ্রুপের কর্মীদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। মামলাটি প্রাথমিকভাবে বাতিল
করা হলেও সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে এবং এখনও ভারতের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের
হাতে বিচারাধীন রয়েছে। আদানি গ্রুপ অবশ্য সমস্ত অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছে।
২০১২ সালে আরেকটি ধারাবাহিক লেনদেনের সময়, সাইপ্রাসে থাকা ভাকোডার ইনভেস্টমেন্টস
নামে বিনোদ আদানির আরও একটি কোম্পানি দুবাইয়ের একটি ভুয়ো ফার্মের কাছ থেকে ২৩২
মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। ভাকোডার এরপর ডিবেঞ্চার কেনার জন্য ২২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে
আদানি এস্টেটস এবং আদানি ল্যান্ড ডেভেলপারস নামে দু’টি প্রতিষ্ঠানে। যেগুলি আদানি
ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্সের অন্তর্ভুক্ত। এই ডিবেঞ্চারগুলির মেয়াদ পরে
২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
যার অর্থ বিনোদ এখনও এগুলির মালিক।
২০১২ সাল পর্যন্ত,
আদানি ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্স আদানি
এন্টারপ্রাইজের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে হওয়া এই লেনদেনের সময়
আদানি এন্টারপ্রাইজ আদানি ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্স প্রতিষ্ঠানকে
বিক্রি করে দেয়। আদানি এন্টারপ্রাইজের ২০১৩ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী ৮১.৫
মিলিয়ন ডলার লাভ করে তারা। চার বছর পর কোম্পানিটি আদানি এন্টারপ্রাইজের বার্ষিক
প্রতিবেদনে পুনরায় আবির্ভূত হয়, এবার
একটি ‘রিলেটেড এন্টারপ্রাইজ’
হিসেবে। এই প্রসঙ্গে নিউ সাউথ ওয়েলস বিজনেস স্কুলের
সহকারী অধ্যাপক মার্ক হামফ্রে-জেনার বলেন,
‘আদানি এন্টারপ্রাইজের ব্যালান্স শিটে আদানি
ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্সের এই পুনরায় আবির্ভূত হওয়ার ফলে বেশ কিছু প্রশ্ন
রয়ে যায়। কোম্পানিটি কি আদৌ বিক্রি হয়েছিল?
যারা আদানি গ্রুপে বিনিয়োগ করেছেন তাদের জন্য চিন্তার
বিষয় যে, কোম্পানিটি
আদৌ লাভ করেছে নাকি তাদের চোখে লাভ দেখানোর ধুলো দেওয়া হয়েছে।’
২০১২ সালের তথাকথিত ‘বিক্রি’র পরও ফোর্বস খুঁজে পেয়েছে যে
২০১৭ সালেও আদানি পরিবার তাদের আরও একটি কোম্পানি আদানি প্রপার্টিজের মাধ্যমে
আদানি ইনফ্রাস্টাকচার অ্যান্ড ডেভেলপার্সের মালিকানা ধরে রেখেছে। এই আদানি
প্রপার্টিজের শেয়ারহোল্ডার আবার তিনটি। আদানি ফ্যামিলি ট্রাস্ট, আদানি এন্টারপ্রাইজের অধীনে
থাকা আদানি কমোডিটিজ এলএলপি এবং গৌতম আদানির ছেলে করণ আদানি। হোয়ার্টন স্কুলের
অ্যকাউন্টিংয়ের অধ্যাপক ড্যান টেইলর জানান,
‘এটা দেখে মনে হচ্ছে আয় বাড়িয়ে দেখানোর জন্য অথবা ঋণ
কমানোর জন্য এই (ভুয়া বিক্রি) করা হয়েছে। আর তাই প্রশ্ন চলেই আসে, এই লেনদেনের সঙ্গে বাস্তব
ব্যবসায়িক কারণ কী ছিল?’
এই লেনদেনের আরও একটি কারণ থাকতে পারে, আর তা হল পারিবারিক রাজনীতি।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট যেভাবে বিনোদকে ‘মাল্টি-বিলিয়ন ডলার জালিয়াতির মূল খেলোয়াড়’ হিসেবে তুলে ধরেছে, তাতে বিনোদ নিঃসন্দেহেই
অপমানিত বোধ করবেন। কারণ, তিনি বা তাঁর কোনও পরামর্শদাতা ২০১৬ সালে একটি পত্রিকায়
স্পনসর্ড সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিলেন,
যেখানে লেখা হয়েছিল: ‘মিথ্যা ও দুর্নীতিতে ছেয়ে
থাকা এই সময়ে এমন লোকের সংখ্যা বিরল। যারা তাদের কথা অনুযায়ী চলাফেরা করে এবং
স্বার্থপরতার মাধ্যমে লাভ করার চেয়ে সততা এবং আনুগত্যকে বেছে নেয়। বিনোদ শান্তিলাল
আদানি এমনই মূল্যবোধ সমৃদ্ধ একজন মানুষ। যা তিনি তাঁর পরিবার থেকে পেয়েছেন এবং নিজেও
অনুশীলন করেছেন।’
এরকম একের পর এক ভয়ঙ্কর তথ্য ফাঁস হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠা
স্বাভাবিক, এই
আদানি সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক কী? তাঁর আশীর্বাদে আদানিরা কী কী সুবিধা পেয়েছে? এত বড় কেলেঙ্কারির অভিযোগ, শেয়ার বাজারে আদানির প্রবল
পতনের পরেও কেন তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না? কিন্তু এইসব বিতর্কের উত্তর দেওয়ার মতো
গণতান্ত্রিক সৌজন্যবোধ ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে আর নেই। অতএব, প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে
গোটা বক্তৃতায় আদানির নাম নিলেন না, শুধু
বললেন যে মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে,
মানুষের জন্য তিনি কাজ করেছেন। বিরোধীরা আর কোনও ইস্যু
খুঁজে না পেয়ে তাঁর চরিত্রহনন করতে চাইছে...
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদে দাঁড়িয়ে বুক ঠুকে
বললেন, “আমি
একাই লড়ছি সবার বিরুদ্ধে। দেশের কাজ করার জন্য বেরিয়েছি। রাজনীতির কারবারিদের তাই
আমাকে পছন্দ হচ্ছে না”।
শুনে ভক্তদের চোখে জল, মুখে
স্লোগান, নেট
সরগরম, মিডিয়া
আপ্লুত। আহা! প্রধানমন্ত্রীর বাচনভঙ্গি,
তাঁর আক্রমণাত্মক বক্তব্যের কোনও জুড়ি নেই। দেশের
প্রধানমন্ত্রীর মতই বলেছেন মোদিজি। মোদি হ্যায়, তো মুমকিন হ্যায়।
এর অর্থ একটাই—
মোদির বন্ধু হলে আপনার কোনও চিন্তা নেই। গভীর এবং গুরুতর
অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে থাকলেও ইডি-সিবিআই কেন, পাড়ার হাবিলদারও আপনাকে কোনও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে
না। কারণ ইডি, ইনকাম
ট্যাক্স, সিবিআই
ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলি আর মানুষের স্বার্থে কাজ করে
না। তারা কাজ করে মোদির স্বার্থে এবং মোদি বিরোধীদের বিরুদ্ধে। ভারতে থাকলে মোদির
পক্ষে থাকতে হবে। বিপক্ষে থাকলে গব্বর সিংহের মতন ইডি-সিবিআই-আয়কর আপনাকে ভয়
দেখাতে আসবেই।
আপনাকে বলা হবে,
মোদির নেতৃত্বে দেশজুড়ে উন্নয়ন চলছে। আদানি সেই উন্নয়নেরই
অংশ। তাই আদানিও বলে রেখেছেন, তাঁর
বিরুদ্ধে কথা বলা মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা। তাদের বক্তব্য মার্কিন সংস্থার এই
রিপোর্টটি আদতে ভারতের বিরুদ্ধে বানানো। একদিকে সরকার নিশ্চুপ, অন্যদিকে আদানি বলছেন তাকে
প্রশ্ন করা মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা। যদি মেনে নিতে হয় যে আদানিকে প্রশ্ন করা
মানে ভারতকে প্রশ্ন করা তাহলে জাতীয়তাবাদের নামে আমাদের মেনে নিতে হবে যে আদানিদের
মতন ব্যক্তিরা শেয়ারবাজারে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ালেও চুপ করে থাকাই শ্রেয়।
শিল্পপতি এবং দেশ যদি সমার্থক হয়ে যায়,
তাহলে বুঝতে হবে যে দেশে ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হচ্ছে।
বেনিতো মুসোলিনি বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে কর্পোরেট এবং
রাষ্ট্রব্যবস্থা একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। আমাদের দেশে আদানির প্রতি সরকারের
পক্ষপাত এবং দেশের সঙ্গে সংস্থার তুলনা মুসোলিনির ধারণাকেই যেন মান্যতা দেয়।
এই আদানির ভারতে আপনাকে স্বাগত!
https://www.forbes.com/sites/johnhyatt/2023/02/17/gautam-adanis-older-brother-vinod-adani-controls-offshore-empire-with-links-to-adani-group/?sh=6ba865d364cd