Thursday, November 7, 2013

ফোনে আড়ি পাতা ওয়াশিংটন স্টাইল

মার্কিন আস্থাভঙ্গে হতাশ জার্মানি
বার্লিন শহরের কেন্দ্রে বার্লিন গেটসংলগ্ন বিশাল অট্টালিকায় মার্কিন দূতাবাস। সেই ভবনের ছাদেই ছিল ফোনে আড়িপাতার যন্ত্রটি। লোকের দৃষ্টি এড়াতে একটি নকল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখান থেকেই ৮০০ মিটার দূরে অবস্থিত চ্যান্সেলর ভবনে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনে দীর্ঘদিন ধরে আড়ি পেতেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
টেলিফোন ও ইন্টারনেটে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারি দেশ-বিদেশে ঝড় তুলেছে। কিন্তু ইউরোপে এর প্রতিক্রিয়ার ধরনটা অন্য রকম। সেখানে শীর্ষ নেতাদের ফোনে আড়িপাতা নিয়ে মার্কিন জ্ঞাতি ভাইদেরসঙ্গে সম্পর্কের ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিনিদের বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো বরাবরের সহচর। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্যের পতনের পর তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। এর মধ্যে জার্মানির ব্যাপারটা একটু আলাদা। বিশ্বযুদ্ধের দায়ভার ঘাড়ে থাকায় তারা সংযমী হয়ে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখে চলার নীতি অনুসরণ করে আসছে। জার্মানরা অবাক হয়ে দেখছে, তারা এ রকম শিষ্টাচার মেনে চলার পরও মার্কিনিরা গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ভদ্রতা ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। করেনি শত্রুমিত্রের ভেদাভেদ। এ রকম আচরণ করা কাউকে আর যা-ই বলা যাক, ভালো বন্ধু বলা যায় না। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনে মার্কিন নজরদারির ঘটনা ফাঁসের পর জার্মান রাজনীতিক ও জনগণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা ঠিক এ রকম।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা কাগজপত্র ঘেঁটে বহুল প্রচারিত জার্মান সাময়িকী ডের স্পিগেল -এর দুই সাংবাদিক মার্শেল রোসেনবাক ও হোলগার স্টার্ক গত জুলাই মাসে এনএসএর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নম্বরসহ টেলিফোন নজরদারির একটি তালিকা পান। এই নিয়ে জুলাই মাসেই মার্কিনিদের টেলিফোনে আড়িপাতা নিয়ে ডের স্পিগেল একটি প্রচ্ছদ কাহিনি করে। পরে আরও তদন্তে দেখা যায়, সেখানে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনের নম্বরটিও আছে। এর সত্যতা যাচাই করতে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগের নিকোলাস বলমে ও ইয়র্গ শিন্ডলার ১৭ অক্টোবর জার্মান চ্যান্সেলরের প্রেস সচিব স্টেফান সাইবার্ডকে চ্যান্সেলরের নম্বরে আড়িপাতার কাগজপত্রগুলো দেন।
ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের পরই ২৪ অক্টোবর ক্ষুব্ধ, স্তম্ভিত আঙ্গেলা ম্যার্কেল সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ফোন করেন। স্বল্পভাষী হিসেবে পরিচিত এ নেতা পর্যন্ত বলে ফেলেন, মিত্রদের ওপর এ ধরনের নজরদারি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এর পরের দিনই বার্লিনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন এমারসনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। একই ঘটনার কারণে আগের সপ্তাহেই প্যারিসে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বার্লিনের পর ২৮ অক্টোবর স্পেনের মাদ্রিদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্টদূতের কপালে একই ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে এখন ইউরোপ-মার্কিন বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কথা উঠছে।
মনে করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ৬৮ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জার্মানির (একটা অধ্যায় ধরে পশ্চিম জার্মানির) নতজানুপররাষ্ট্রনীতি, একধরনের যুদ্ধের দায়ভার শোধ। জার্মানির রাজনীতিকদের মধ্য একটি প্রথা চালু আছে, সেটা হলো, উঁচু গলায় যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের সমালোচনা না করা। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর লাখ লাখ ইহুদি নিধনের কারণে অপরাধবোধ এবং নাৎসিবাদের কবলমুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা এই নীতির কারণ। এই প্রথার অর্গল ভাঙতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস। গ্রাস ২০১১ সালে তাঁর এক আলোচিত কবিতায় ইসরায়েলকে আগ্রাসী দেশ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিশ্বের অনেক স্থানেই তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসিত হলেও জার্মানিতে তিনি একঘরে হয়েছিলেন।
বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্র বাহিনীর চার শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সেনারা দীর্ঘ দিন ধরে বিভক্ত দুই জার্মানি জুড়ে অবস্থান করে। দুই জার্মানি এক হওয়ার পর সবাই জার্মানি ত্যাগ করে। কিন্তু মার্কিন সেনা দল ও তাদের সামরিক বিমানঘাঁটি এখনো জার্মানিতে বহাল তবিয়তে রয়েছে।
সাবেক পশ্চিম জার্মানিকে মার্কিনিদের নানা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হয়েছে জার্মানি। সন্ত্রাসবাদবিরোধী জোটে একসঙ্গে কাজ করেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে ধকল পোহানো জার্মান জনগণ এখন প্রচণ্ড যুদ্ধবিরোধী হলেও দেশটির অতীতের সরকারগুলো মার্কিনিদের নানা আগ্রাসীযুদ্ধের সঙ্গী হয়েছে।
কিন্তু সময় দ্রুত পাল্টাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর তৃতীয় প্রজন্মের জার্মান তথা ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা মার্কিনিদের বিশ্ব পুলিশেরভূমিকা বা সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনের নামে সব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সহযোগী আর হতে চাইছেন না। আর এই মনোভাবের মধ্যে জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের মুঠোফোনে নজরদারির ঘটনা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো ঘটনা। মার্কিনিদের ব্যাপারে জার্মানির রাজনীতিকদের উঁচু গলায় সমালোচনা না করার ঐতিহ্যও ভেঙে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ঐক্য ক্রমশ দৃঢ় হওয়ার ফলে ইউরোপীয় রাজনীতিকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীলতা ক্রমে কমছে। নানা বন্ধু দেশেও আড়িপাতার ঘটনায় আটলান্টিকের অন্য পাশের এই শক্তিশালী মিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে।
আড়িপাতার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে জার্মানির সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করছে। আগামী ১৮ নভেম্বর জার্মানির পার্লামেন্টে এই ঘটনার জন্য আলোচনার দিন ঠিক করা হয়েছে।
স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অধিবেশনেও ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে মার্কিন নজরদারির ঘটনার নিন্দা হয়েছে। ইতিমধ্যে সন্ত্রাসবাদী দমনে ১৯৯৮ সালে করা সেফ হারবার প্যাক্টচুক্তি বাতিল বা পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনার পর ভোটাভুটিতে পরিবর্তনের পক্ষে ২৮০ এবং বিপক্ষে ২৫৪টি ভোট পড়ে।
ইউরোপের সাধারণ মানুষ মহাদেশজুড়ে আড়িপাতার এ ঘটনাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। ইউরোপের অনেক শহরেই আড়িপাতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে ভবিষ্যতে ওবামা সরকার বিশ্বজুড়ে তাদের গোয়েন্দাগিরির নখর সংযত করার কথা বলতে বাধ্য হয়েছে।
         
ফোনে আড়ি পাতা ওয়াশিংটন স্টাইল
ইন্টারনেট ও ফোনে ওয়াশিংটনের গোপন গোয়েন্দা নজরদারির কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন এডওয়ার্ড স্নোডেন। সাবেক এই মার্কিন গোয়েন্দা কর্মী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সারাবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর অতি সন্তর্পনে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ)। 'প্রিজম' নামের ওই গোয়েন্দা কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ পড়ছে না নিজ দেশ এমনকি মিত্র দেশের নাগরিকরাও। সংশি¬ষ্ট দেশের সাধারণ মানুষ ওই তত্পরতার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠার পর এবার একযোগে প্রতিবাদ জানালো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিশেষ করে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের ফোনে নজরদারির নতুন তথ্য ফাঁস হওয়ায় নড়েচড়ে বসেন ইউরোপের ক্ষমতাসীনরা।
স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যের সূত্র ধরেই গত কয়েকদিন ধরে নতুন করে প্রচার পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অতিগোপনীয় 'প্রিজম' কর্মসূচির কথা। একে একে এ সব তথ্য প্রকাশ করছে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা ও জার্মানির দের স্পাইজেল ম্যাগজিনসহ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম। এ সব তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবৃত্তির বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শুক্রবার ব্রাসেলসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে নেতারা এ বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এতে তারা বলেন, 'যে সন্দেহ বা অবিশ্বাসে ভর করে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশে গুপ্তচরবৃত্তিতে নেমেছে, তা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইকে বাধাগ্রস্ত করবে'। এর আগে একের পর এক গোয়েন্দা নজরদারির তথ্য প্রচার হওয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর ব্যাখ্যা চায় জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে এ যাবত্কালের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ফাটল দেখা দিয়েছে মনে করছেন অনেকে।
সমপ্রতি গার্ডিয়ান জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ এরই মধ্যে মার্কেলের অসংখ্য ফোনকল রেকর্ড করেছে। সেই সাথে জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেনের লাখ লাখ নাগরিকের টেলিফোনেও আড়ি পেতেছে সংস্থাটি। এ সংক্রান্ত গোপন প্রমাণাদি হাতে আসার কথা দাবি করেছে গার্ডিয়ান। সংবাদপত্রটি জানায়, শুধু আঞ্জেলা মার্কেল নয়, ৩৫ জন বিশ্বনেতার ফোনে আড়ি পাতে এনএসএ। তবে সর্বশেষ জার্মানির দের স্পাইজেল ম্যাগাজিন জানায় আরো ভয়াবহ তথ্য। চ্যান্সেলর হবার আগে থেকেই নাকি অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের মোবাইলে নজরদারি করছে ওয়াশিংটন। ম্যাগাজিনের দাবি, এনএসএ'র ফাঁস হওয়া ২০০২ সালের গোপন তালিকায় মার্কেলের মোবাইল নম্বর রয়েছে। ২০১৩ সালের তালিকাতেও ঐ নম্বর তালিকাভুক্ত রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কিভাবে, কখন, কতটুকু নজরদারি করা হয়েছে বা নজরদারির ধরন কী, তা ঐ তালিকা থেকে জানা যায়নি। তবে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে কোন মোবাইলের কথাবার্তা রেকর্ড করা বা তার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারীদের তালিকা পাওয়া বর্তমান প্রযুক্তিতে সম্ভব বলে জানিয়েছে দের স্পাইজেল। জার্মান ম্যাগাজিনের দাবি, ইন্টারনেটে গুপ্তচরবৃত্তি বা ফোনে আড়ি পেতে তথ্য সংগ্রহের কাজটি করছে বার্লিনের খোদ মার্কিন দূতাবাস। ঐ ভবনের ভেতরের আছে 'স্পেশাল কালেকশন সার্ভিসেস' নামের একটি বিশেষ ইউনিট। যার কাজ হলো- আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বার্লিনের সরকারি আবাসিক এলাকার তথ্য সংগ্রহ করা। ফাঁস হওয়া নথিপত্রে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বের প্রায় ৮০টি স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের এমন বিশেষ ইউনিট কাজ করছে। এর মধ্যে ১৯টিরই অবস্থান ইউরোপের বিভিন্ন নগরীতে।
ব্রাসেলসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে বিবিসিকে অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জানান, আমেরিকান বন্ধুদের আচরণে ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুবই মর্মাহত। শীর্ষ সম্মেলনে জানানো হয়, জার্মান চ্যান্সেলরের ফোনে নজরদারির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এবং এটা বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিতে এ সপ্তাহেই ওয়াশিংটন যাচ্ছেন জার্মানির গোয়েন্দা প্রধানরা (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক)। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা নজরদারির ইস্যুটি ইউরোপের সাধারণ জনগণের মধ্যে তৈরি করেছে গভীর উদ্বেগ। তাই জার্মানি ও ফ্রান্স উভয়েই বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খোলামেলা আলোচনা চাইছে। যেখানে নতুন করে বোঝাপড়া তৈরি হবে। এর জন্য কোন কালক্ষেপন নয়, বরং চলতি বছরের শেষ নাগাদই আলোচনার দাবি জানিয়েছে তারা। আর এমন দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। আলোচনা প্রক্রিয়ায় ইউরোপের অন্যান্য দেশও অংশ নিতে পারবে বলে জানানো হয়েছে। বিবৃতির বাইরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের বক্তব্য ছিলো বেশ স্পষ্ট। তিনি বলেন, 'যে অতীত জেনে আলোচনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক বা কর্মপরিকল্পনা নেয়া হবে। যার লক্ষ্য হবে গোয়েন্দা নজরদারির সব ম্যাকানিজম বন্ধ করা'
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র কেইটলিন হেডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের ফোনে কখনো আড়ি পাতা হয়েছিলো কি-না। তিনি জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগের কোন মাধ্যমেই অতীতে নজরদারি করা হয়নি, বর্তমানে করা হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে কোনকালেই তা করবে না ওয়াশিংটন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্য এবং বৈদেশিক সম্পর্কে এর প্রভাব খতিয়ে দেখছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজেই। এ কাজে তিনি নিয়োজিত করেছেন নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞের বাইরে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের। তথ্য ফাঁস হবার পর কিভাবে আস্থা সমুন্নত রাখা যায় সে ব্যাপারটিও পর্যালোচনা করছেন তারা।
এ সব গেলো রাষ্ট্রের বাহ্যিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা। বিশে¬ষকদের মতে, আসলে ইউরোপীয় নেতারা যেটা চাইছেন, তা হলো নতুন গোয়েন্দা সহযোগিতা চুক্তি। যেটা হবে 'ফাইভ আইজ' চুক্তির সংস্করণ। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ১৯৪৬ সালে একটি টপ সিক্রেট গোয়েন্দা সহযোগিতা চুক্তি সই করে। পরে বিভিন্ন নথিপত্রে ঐ চুক্তির নাম 'ইউকেইউএসএ এগ্রিমেন্ট' হিসেবে উলে¬খ পাওয়া যায়। ঐ চুক্তিতে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে গোয়েন্দা সহযোগিতার মৌলিক বিষয় উলে¬খ ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঐ চুক্তিতে যোগ দেয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। পাঁচটি দেশের অংশগ্রহণ থাকায় চুক্তিটি পরে 'ফাইভ আইজ' বা 'পঞ্চ চোখ' নামে অভিহিত হয়। বিশে¬ষকরা বলছেন, ফ্রান্স ও জার্মানি চাইছে ঐ চুক্তির আদলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন চুক্তি। প্রাথমিকভাবে এর নাম হতে পারে 'নো স্পাইং প্যাক্ট'

মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রত্যাহারের আহবান চীনের
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) গোয়েন্দা নজরদারির ঘটনায় জাকার্তায় নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ইন্দোনেশিয়া সরকার। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দূতাবাসের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হওয়ায় ইন্দোনেশিয়া এ পদক্ষেপ নেয়। তারা বলেছে, এ আচরণ শুধু নিরাপত্তাই নয়, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও নৈতিকতার গুরুতর লঙ্ঘন। অপরদিকে চীন সরকারও তাদের দেশে নজরদারির ব্যাখ্যা দাবি করে দেশ থেকে মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন দেশের সরকার, সরকারপ্রধান ও নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়ে প্রথমবারের মতো সুর নরম করল যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ নজরদারি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে হয়েছে। ভবিষ্যতে আর এমনটি হবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানান।
ইন্দোনেশিয়া সরকার সে দেশে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় গোয়েন্দা নজরদারি চলে এমন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ডাকা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা নথির বরাত দিয়ে সম্প্রতি জার্মানির দের স্পিগেল পত্রিকা জানায়, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন গোয়েন্দা নজরদারিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসগুলো। পরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা নজদারির বিস্তারিত তুলে ধরে। এতে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা ও বালি শহরে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হয়। গতকাল শুক্রবার জাকার্তায় অস্ট্রেলীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে নজরদারির তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইন্দোনেশিয়া সরকার। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্টি নাতালেগাওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, 'জাকার্তায় মার্কিন দূতাবাসে আড়ি পাতার ব্যবস্থা স্থাপনের সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইন্দোনেশিয়া সরকার। এ ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। এটা শুধু নিরাপত্তা লঙ্ঘনই নয়, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও নৈতিকতার গুরুতর লঙ্ঘনও।'
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নজরদারির ব্যাখ্যা দাবি করেছে চীনা সরকারও। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে এক নিবন্ধে, চীন থেকে মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা জানায়, পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন নজরদারির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে চীন। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে মার্কিন দূতাবাস এবং সাংহাই ও চেংদু শহরে মার্কিন কনস্যুলেটের মাধ্যমে এ নজরদারি চালানো হয়। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিয়িং গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, নজরদারির খবরে 'চীন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দাবি করছি। আমরা চীনে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক মিশন ও কর্মকর্তা চাই যারা আন্তর্জাতিক আইন কঠোরভাবে মেনে চলবে। তারা চীনের স্বার্থ ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে এমন কোনো কর্মকাণ্ড চালাবে না।'
চায়না ডেইলি পত্রিকা এক নিবন্ধে চীন থেকে গোয়েন্দাদের ফিরিয়ে নিতে ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গোয়েন্দাদের কার্যক্রমকে অবৈধ ও কূটনৈতিক সুরক্ষাবহির্ভূত বলে অভিহিত করেন।
এদিকে ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা শুরুর ১০ দিন পর গত বুধবার প্রথমবারের মতো গোয়েন্দা নজরদারির সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তবে তিনি নজরদারির পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক, পরবর্তীতে লন্ডন, মাদ্রিদসহ অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ করে জানান, যেসব সন্ত্রাসী জনগণকে হত্যা ও বিভিন্ন সরকারের ওপর হামলার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই নজরদারি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
কেরি জানান, সন্ত্রাসীদের যোগাযোগব্যবস্থায় আড়ি পাতার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা ২০০১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বহু সন্ত্রাসী হামলা এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আড়ি পাতায় বাড়াবাড়ি হয়েছে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছে তা তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি।
কেরি ভবিষ্যতে এমনটা আর হবে না বলে জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য মিত্রকে আশ্বস্ত করেছেন। ভিডিও লিংকের মাধ্যমে লন্ডনে এক সম্মেলনে কেরি বলেন, 'আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি, তথ্য সংগ্রহের একটা চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও নিরীহ লোকজন তাতে হয়রানির শিকার হবে না। আমাদের প্রেসিডেন্ট বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুনঃপর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন।' কেরি আরো জানান, ওয়াশিংটন যা করার চেষ্টা করছিল তা হচ্ছে, কোনো ধরনের হুমকি আছে কি না তা সঠিকভাবে নিরূপণ ও মোকাবিলা করা।
সূত্র : এএফপি, বিবিসি।

No comments:

Post a Comment