পরিবারতান্ত্রিকতা...
একশত পঁচিশ বছরেরও বেশি
দীর্ঘ সময়কাল। কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তো তা
অতি-দীর্ঘকাল। কেননা, ভারতের রাজনীতি এই একশত পঁচিশ বছরে যে ক্রমাগত উত্থান
পতন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বয়েছে, তাতে এই গোটা সময়কাল জুড়ে
কোনও রাজনৈতিক দলের টিঁকে থাকাই এক হিমালয়সমান কৃতিত্ব। আর কংগ্রেস তো কেবল টিঁকেই
থাকে নি, দেশের অন্যতম প্রধান একক রাজনৈতিক দল হিসাবেই বিরাজ
করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ দেশের বহু প্রদেশে কংগ্রেস কোনও বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিই
নয়, এমনকী গুরুত্বহীন।
এরজন্য
দায়ী, দলের পরিবারতান্ত্রিকতা।
স্বাধীনতার আগেও কংগ্রেস মুক্ত
গণতান্ত্রিক উপায়ে চালিত হত না। কিন্তু
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তা একটি বিশেষ পরিবারের সম্পূর্ণ মুখাপেক্ষী হইয়া দাঁড়ায়। দলনেতারা
যথারীতি প্রবল উৎসাহে নেহরু-গান্ধী পরিবারের নায়কত্ব বরণ করে নিয়েছেন।
বিবাদী
স্বর সম্পূর্ণ অশ্রুত, অন্তত প্রকাশ্যে। পরিবারতন্ত্রের জন্যই অন্য নেতৃত্বের
প্রয়োজন কম অনুভূত হয়েছে, আবার অন্য নেতৃত্ব তৈরি হয় নি বলে
পরিবারতান্ত্রিকতা আরও গেড়ে বসেছে। সম্প্রতি রাহুল গান্ধী যে ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে
সফর করে সংগঠনের কাজে মন দিয়েছেন, তাতেও স্পষ্ট, এখনও রাজ্য-স্তরে দলের রাশ ধরতে দিল্লি থেকে দশ নম্বর জনপথের নির্বিকল্প
নেতাকেই যেতে হয়। সেই দলে আজও নেহরু-গান্ধী পরিবারই প্রথম ও শেষ কথা।
সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী একবার কংগ্রেসের
মুখপত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির উদ্দেশে বলেছিলেন, কারও মনে যদি কালেক্রমে প্রধানমন্ত্রী
হওয়ার বাসনা থাকে, তার তো কখনও কংগ্রেসে যোগ দেওয়া উচিত নয়।
আপনাদের দলে তো ওই আসনটার মালিক ঠিক হয়ে আছে। প্রশ্ন শুনে অভিষেক বলেন, তাতে কী? কেন, প্রধানমন্ত্রী
হওয়া ছাড়া আর কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে নেই নাকি? আমাদের
দলের শীর্ষ আসন দুটি সোনিয়াজি আর রাহুলজির জন্য নির্দিষ্ট, এবং
আমরা তাতেই খুশি।
ষাটের দশকে কংগ্রেস ইন্দিরা গান্ধীকে যখন
বরণ করে নিল,
তখন কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না ইতিহাসের ধারা কোন খাতে বইবে।
তাঁর জমানার প্রথম পর্বে প্রশাসনে ঈষৎ অনভিজ্ঞ ইন্দিরা বেশ কয়েকটি বছর
হাবুডুবু খেয়েছেন। আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাসে স্থিত হয়েছেন। ধীরে ধীরে কূটকৌশল ও
দৃঢ়চিত্ততার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর দলে এবং দলের বাইরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবৃন্দ
ক্রমশ কুপোকাত হয়েছেন। ভাগ্য ইন্দিরার
উপর সদয় থেকেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে সুযোগ এনে দেয়, তার
সুচারুতম ব্যবহার তিনি করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে ঘোল খাইয়ে
বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে সৈন্য-সাহায্য করে বিশ্ব জুড়ে তারিফ কুড়িয়েছেন। এমনকী
দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতা পর্যন্ত তাঁকে সাক্ষাৎ মা ভগবতী বলে বন্দনাও করেছেন। তবে ঠিক
এই মুহূর্ত থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর আচরণে-বিচরণে অন্য এক প্রবণতার লক্ষণ। অহংকার, প্রতিহিংসাপরায়ণতা,
পরমত-অসহিষ্ণুতা, এঁকে ওঁকে তাঁকে অবিশ্বাস,
সর্বদা স্তাবকদের ঘেরাটোপে থাকা, অথচ জাত
চাটুকারেরাও বুঝে উঠতে পারেন না, কবে তিনি সহসা কুপিত হয়ে
তাঁদের দূরে ছুড়ে ফেলবেন। এর পর অতি দ্রুত ঘটনাবলির পরম্পরা: দেশ জুড়ে
মূল্যবৃদ্ধি, জমে ওঠা জনরোষের সংগঠিত ব্যাপ্তি, এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের রায়, জরুরি অবস্থা ঘোষণা। সেই
সূত্র ধরে পরিবারতন্ত্রের নিটোল আত্মপ্রকাশ। ওই উথালপাথাল বছরগুলিতেই ইন্দিরা গান্ধী
সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন নিজের সন্তানদের ছাড়া আর কারও উপর আস্থা স্থাপন করা যায়
না। নির্ভরতার একমাত্র পাত্র, সঙ্কটে একমাত্র ভরসা আত্মজ-আত্মজারা।
ইন্দিরা গান্ধী নিধনের পর তাঁর জ্যেষ্ঠ
তনয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নিধনের পর বিবিধ ঝড়ঝাপটা সামলে কংগ্রেস ফের
রাষ্ট্রশাসনের চূড়ান্ত দায়িত্বে। এই মুহূর্তে দল থেকে যদিও এক জনকে
প্রধানমন্ত্রীর বকলমা দেওয়া হয়েছে। আদতে সমস্ত প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত
দলের সভানেত্রী ইন্দিরা-পুত্রবধূর এক্তিয়ারে এবং দলের ভিতরে অন্তত সবাই মেনে
নিয়েছেন। সেই পথ ধরেই রাহুল গান্ধী আজ দলের যুবরাজ। সম্প্রতি জয়পুরের চিন্তন
শিবির তাঁর কপালে পাকাপাকি টিকা পরিয়ে দিল। তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মনমোহন সিংহ,
যিনি দীর্ঘ আট বছর রামচন্দ্র্রের খড়মকে সিংহাসনে বসিয়ে অপেক্ষায়
আছেন। তাঁর বুঝি ছুটি হল এই বার। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে কংগ্রেসের প্রার্থী
কে হবেন, কোনও ঘোষণা ছাড়াই বুঝে নেওয়া সম্ভব এখন।
ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে ট্র্যাজিক
চরিত্র সম্ভবত পামুলাপর্তি বেঙ্কট নরসিংহ রাও।
নরসিংহ রাওয়ের প্রতি ইতিহাস সদয় হয়নি।
হওয়ার কথাও নয়। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বেই দেশে দুর্নীতি চরমসীমায় পৌঁছেছিল।
হর্ষদ মেটা সুটকেসে এক কোটি টাকা ভরে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাওয়ের
বাসভবনে। তাঁর আমলেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী উন্মাদের দল।
এবং, তারও বহু আগে, ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর
যখন শিখনিধন পর্ব চলছিল, তখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরসিংহ
রাও নিষ্ক্রিয় বসেছিলেন। ইতিহাসের দায় তাঁকে নিতে হবে বইকী। কিন্তু, সেই দায় যদি তাঁর কৃতিত্বকেও কেড়ে নেয়, সেটা
অবিচার। এবং, এটা গোটা ব্যবস্থার ব্যর্থতার দায় শুধুমাত্র
এক জনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াও অবিচারই বটে। মনমোহন সিংহ ‘ভারতের
উদার অর্থনীতির জনক’ বলেছিলেন, প্রাক্তন
অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদম্বরম আখ্যা দিয়েছিলেন ‘ভারতের
দেং জিয়াওপিং’। সেই মানুষটি আর্থিক সংস্কারের দুই দশক পূর্তির
পরেও উপেক্ষিত। কংগ্রেসের ১২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তাঁর ভাষণে
সনিয়া গান্ধী যখন সব কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেন, তখনও
তিনি সন্তর্পণে নরসিংহ রাওয়ের নামটি এড়িয়ে যান। বলেন, ১৯৯১
সালে যে আর্থিক সংস্কারের কাজ আরম্ভ হয়েছিল, তা আসলে রাজীব গান্ধীর
পরিকল্পনা। এটা ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা। এখানেই নরসিংহ রাওয়ের
ট্র্যাজেডি। পরিবারতন্ত্রের জয়!
বাবর বাদশার পর হুমায়ুনই দিল্লির তখত-তে
বসবেন, তা যেমন নিশ্চিত ছিল ষোড়শ শতকের রাজধানীতে। একুশ শতকে বিশ্বের বৃহত্তম
গণতন্ত্রে এমন নির্লজ্জ পরিবারতন্ত্র চোখে লাগে।
তিনি যে যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের
প্রচারে গিয়েছেন,
কংগ্রেস নেহাত ধেড়িয়েছে। আট বছরে তাঁর কোনও উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা
মনে করতে পারছি না। তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য কী, অভিজ্ঞান কী,
গোটা দেশে কেউ জানে না। তাঁর একমাত্র কৃতিত্ব, তিনি ভারতের রাজপরিবারের কুলতিলক- পরিবারের যে অংশটি ক্ষমতার সমীকরণের ঠিক
দিকে ছিল, রাহুল সেই দিকের একমাত্র পুরুষ সন্তান।
ভাবী ইতিহাস কী বলবে, ভাবী
ইতিহাসই জানে। কিন্তু গুরুবাদী দেশ আমাদের। কেন্দ্রে যে পরিবারতন্ত্র, তা এখন রাজ্যে রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কোন রাজ্য ছেড়ে কোন রাজ্যের নাম
করব। পঞ্জাবে প্রবেশ করুন, কিংবা উত্তরপ্রদেশে অথবা ওড়িশায়,
নয়তো ও দিকে অন্ধ্রপ্রদেশে বা তামিলনাড়ুতে বা কর্নাটকে বা
মহারাষ্ট্রে, এবং অবশ্যই রাজস্থানে। যে দল ক্ষমতায় আসীন বা
যারা প্রতিপক্ষ, সর্বত্রই পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র বিস্তার।
জীবনানন্দের একটি কবিতায় এই পঙ্ক্তিটি বিরাজ করছে ‘আমাদের
সন্তানেরা জ্যেষ্ঠ হয়ে যাবে স্বতঃসিদ্ধতার মতো জীবনের ভিতরে দাঁড়াবে’ তার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যার যেন মুখোমুখি হচ্ছি আমরা।
তবে যে গতিতে বাঙালিরা আপাতত জাতীয়তার
চেতনাসম্পন্ন তথা বিশ্বায়িত হচ্ছেন, কে জানে, পরিবারতন্ত্রের
অভ্যুদয়ও আর খুব বেশি দিন হয়তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অন্তত ব্যক্তিতন্ত্র।
জওহরলাল নেহরুর পিতৃদেব হইতেই পরিবারের
রাজনৈতিক বংশতালিকা গণনা বিধেয় মোতিলাল নেহরু ১৯১৯ সালে প্রথম বার জাতীয়
কংগ্রেসের সভাপতি হইয়াছিলেন। রাহুল গান্ধী ২০১৯-এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী
হইবেন কি না,
তাহা ভোটদেবী জানেন, কিন্তু ভাইস
প্রেসিডেন্টের ‘ভাইস’টুকু খসিয়া
পড়িতে তত দিন অপেক্ষা করিতে হইবে, এমন আশঙ্কা তাঁহার মনে
নিশ্চয়ই নাই। কংগ্রেস নামক দলটির এই দুর্মর পরিবারতন্ত্রকে সরাসরি অগণতান্ত্রিক
বলিলে অন্যায় হইবে। বস্তুত, গত কয়েক বছরে দল এই
উত্তরাধিকারের জন্যই সর্বতোভাবে প্রস্তুত হইয়াছে, বিকল্প
নেতৃত্বের কোনও কথাও ওঠে নাই, পরিবারতন্ত্রের জোগান প্রস্তুত
হইবার আগেই তাহার চাহিদা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়াছে। সেই দিক দিয়া দেখিলে,
পরিবারের শাসনকে ‘স্বাভাবিক’ করিয়া লইবার কাজটিতে সনিয়া গান্ধীর সাফল্য অতুলনীয় এবং নিরঙ্কুশ।
নিরন্তর নেতৃত্বের সঙ্কটে জর্জরিত ভারতীয় জনতা পার্টির বহু কর্মী ও নেতা নিশ্চয়ই
মনের ঈর্ষা মনে লুকাইয়া ভাবিতেছেন, উত্তরাধিকার নির্ধারণে
তাঁহাদের ‘পরিবার’-এর তন্ত্রটি যদি এমন
কার্যকর হইত!
বিভিন্ন রাজ্যে মুক্ত গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতারা উঠিয়া আসিবেন এবং তাঁহারা আবার মুক্ত গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ায় সর্বভারতীয় স্তরে দল পরিচালনা করিবেন, ইহাই ছিল দেশের
প্রাচীনতম দলটির নিকট গণতান্ত্রিক ভারতের দাবি। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী জমানা হইতে
অর্ধ শতাব্দী যাবৎ দল তাহার বিপরীতে হাঁটিয়াছে, নেতৃত্বের
বহুমাত্রিকতাকে গণতান্ত্রিক স্ফূর্তি দিবার পরিবর্তে ‘হাই
কমান্ড’-এর শাসন নিরঙ্কুশ করিবার কাজে ব্যবহার করা হইয়াছে
দ্বিতীয় সারির বিভিন্ন নেতা পরস্পরের শক্তি খর্ব করিতে পারিলে পরিবারের সুবিধা
বাড়ে, সকলেই তখন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া বলে, ‘হাই কমান্ড স্বর্গ, হাই কমান্ড ধর্ম’। এই
প্রণিপাতের পিঠে চড়িয়াই রাহুল গান্ধীর উত্তরণ।
No comments:
Post a Comment