Thursday, November 7, 2013

ফোনে আড়ি পাতা ওয়াশিংটন স্টাইল

মার্কিন আস্থাভঙ্গে হতাশ জার্মানি
বার্লিন শহরের কেন্দ্রে বার্লিন গেটসংলগ্ন বিশাল অট্টালিকায় মার্কিন দূতাবাস। সেই ভবনের ছাদেই ছিল ফোনে আড়িপাতার যন্ত্রটি। লোকের দৃষ্টি এড়াতে একটি নকল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখান থেকেই ৮০০ মিটার দূরে অবস্থিত চ্যান্সেলর ভবনে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনে দীর্ঘদিন ধরে আড়ি পেতেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।
টেলিফোন ও ইন্টারনেটে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারি দেশ-বিদেশে ঝড় তুলেছে। কিন্তু ইউরোপে এর প্রতিক্রিয়ার ধরনটা অন্য রকম। সেখানে শীর্ষ নেতাদের ফোনে আড়িপাতা নিয়ে মার্কিন জ্ঞাতি ভাইদেরসঙ্গে সম্পর্কের ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিনিদের বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো বরাবরের সহচর। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্যের পতনের পর তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। এর মধ্যে জার্মানির ব্যাপারটা একটু আলাদা। বিশ্বযুদ্ধের দায়ভার ঘাড়ে থাকায় তারা সংযমী হয়ে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখে চলার নীতি অনুসরণ করে আসছে। জার্মানরা অবাক হয়ে দেখছে, তারা এ রকম শিষ্টাচার মেনে চলার পরও মার্কিনিরা গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ভদ্রতা ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। করেনি শত্রুমিত্রের ভেদাভেদ। এ রকম আচরণ করা কাউকে আর যা-ই বলা যাক, ভালো বন্ধু বলা যায় না। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনে মার্কিন নজরদারির ঘটনা ফাঁসের পর জার্মান রাজনীতিক ও জনগণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা ঠিক এ রকম।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা কাগজপত্র ঘেঁটে বহুল প্রচারিত জার্মান সাময়িকী ডের স্পিগেল -এর দুই সাংবাদিক মার্শেল রোসেনবাক ও হোলগার স্টার্ক গত জুলাই মাসে এনএসএর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নম্বরসহ টেলিফোন নজরদারির একটি তালিকা পান। এই নিয়ে জুলাই মাসেই মার্কিনিদের টেলিফোনে আড়িপাতা নিয়ে ডের স্পিগেল একটি প্রচ্ছদ কাহিনি করে। পরে আরও তদন্তে দেখা যায়, সেখানে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মুঠোফোনের নম্বরটিও আছে। এর সত্যতা যাচাই করতে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগের নিকোলাস বলমে ও ইয়র্গ শিন্ডলার ১৭ অক্টোবর জার্মান চ্যান্সেলরের প্রেস সচিব স্টেফান সাইবার্ডকে চ্যান্সেলরের নম্বরে আড়িপাতার কাগজপত্রগুলো দেন।
ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের পরই ২৪ অক্টোবর ক্ষুব্ধ, স্তম্ভিত আঙ্গেলা ম্যার্কেল সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ফোন করেন। স্বল্পভাষী হিসেবে পরিচিত এ নেতা পর্যন্ত বলে ফেলেন, মিত্রদের ওপর এ ধরনের নজরদারি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এর পরের দিনই বার্লিনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন এমারসনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। একই ঘটনার কারণে আগের সপ্তাহেই প্যারিসে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বার্লিনের পর ২৮ অক্টোবর স্পেনের মাদ্রিদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্টদূতের কপালে একই ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে এখন ইউরোপ-মার্কিন বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কথা উঠছে।
মনে করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ৬৮ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জার্মানির (একটা অধ্যায় ধরে পশ্চিম জার্মানির) নতজানুপররাষ্ট্রনীতি, একধরনের যুদ্ধের দায়ভার শোধ। জার্মানির রাজনীতিকদের মধ্য একটি প্রথা চালু আছে, সেটা হলো, উঁচু গলায় যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের সমালোচনা না করা। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর লাখ লাখ ইহুদি নিধনের কারণে অপরাধবোধ এবং নাৎসিবাদের কবলমুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা এই নীতির কারণ। এই প্রথার অর্গল ভাঙতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস। গ্রাস ২০১১ সালে তাঁর এক আলোচিত কবিতায় ইসরায়েলকে আগ্রাসী দেশ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিশ্বের অনেক স্থানেই তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসিত হলেও জার্মানিতে তিনি একঘরে হয়েছিলেন।
বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্র বাহিনীর চার শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সেনারা দীর্ঘ দিন ধরে বিভক্ত দুই জার্মানি জুড়ে অবস্থান করে। দুই জার্মানি এক হওয়ার পর সবাই জার্মানি ত্যাগ করে। কিন্তু মার্কিন সেনা দল ও তাদের সামরিক বিমানঘাঁটি এখনো জার্মানিতে বহাল তবিয়তে রয়েছে।
সাবেক পশ্চিম জার্মানিকে মার্কিনিদের নানা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হয়েছে জার্মানি। সন্ত্রাসবাদবিরোধী জোটে একসঙ্গে কাজ করেছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে ধকল পোহানো জার্মান জনগণ এখন প্রচণ্ড যুদ্ধবিরোধী হলেও দেশটির অতীতের সরকারগুলো মার্কিনিদের নানা আগ্রাসীযুদ্ধের সঙ্গী হয়েছে।
কিন্তু সময় দ্রুত পাল্টাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর তৃতীয় প্রজন্মের জার্মান তথা ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা মার্কিনিদের বিশ্ব পুলিশেরভূমিকা বা সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনের নামে সব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সহযোগী আর হতে চাইছেন না। আর এই মনোভাবের মধ্যে জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের মুঠোফোনে নজরদারির ঘটনা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো ঘটনা। মার্কিনিদের ব্যাপারে জার্মানির রাজনীতিকদের উঁচু গলায় সমালোচনা না করার ঐতিহ্যও ভেঙে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ঐক্য ক্রমশ দৃঢ় হওয়ার ফলে ইউরোপীয় রাজনীতিকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরশীলতা ক্রমে কমছে। নানা বন্ধু দেশেও আড়িপাতার ঘটনায় আটলান্টিকের অন্য পাশের এই শক্তিশালী মিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে।
আড়িপাতার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে জার্মানির সব রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করছে। আগামী ১৮ নভেম্বর জার্মানির পার্লামেন্টে এই ঘটনার জন্য আলোচনার দিন ঠিক করা হয়েছে।
স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অধিবেশনেও ইউরোপ তথা বিশ্বজুড়ে মার্কিন নজরদারির ঘটনার নিন্দা হয়েছে। ইতিমধ্যে সন্ত্রাসবাদী দমনে ১৯৯৮ সালে করা সেফ হারবার প্যাক্টচুক্তি বাতিল বা পরিবর্তনের প্রস্তাব উঠেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনার পর ভোটাভুটিতে পরিবর্তনের পক্ষে ২৮০ এবং বিপক্ষে ২৫৪টি ভোট পড়ে।
ইউরোপের সাধারণ মানুষ মহাদেশজুড়ে আড়িপাতার এ ঘটনাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। ইউরোপের অনেক শহরেই আড়িপাতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে ভবিষ্যতে ওবামা সরকার বিশ্বজুড়ে তাদের গোয়েন্দাগিরির নখর সংযত করার কথা বলতে বাধ্য হয়েছে।
         
ফোনে আড়ি পাতা ওয়াশিংটন স্টাইল
ইন্টারনেট ও ফোনে ওয়াশিংটনের গোপন গোয়েন্দা নজরদারির কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন এডওয়ার্ড স্নোডেন। সাবেক এই মার্কিন গোয়েন্দা কর্মী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, সারাবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর অতি সন্তর্পনে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ)। 'প্রিজম' নামের ওই গোয়েন্দা কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ পড়ছে না নিজ দেশ এমনকি মিত্র দেশের নাগরিকরাও। সংশি¬ষ্ট দেশের সাধারণ মানুষ ওই তত্পরতার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠার পর এবার একযোগে প্রতিবাদ জানালো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিশেষ করে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের ফোনে নজরদারির নতুন তথ্য ফাঁস হওয়ায় নড়েচড়ে বসেন ইউরোপের ক্ষমতাসীনরা।
স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যের সূত্র ধরেই গত কয়েকদিন ধরে নতুন করে প্রচার পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অতিগোপনীয় 'প্রিজম' কর্মসূচির কথা। একে একে এ সব তথ্য প্রকাশ করছে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা ও জার্মানির দের স্পাইজেল ম্যাগজিনসহ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম। এ সব তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবৃত্তির বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। শুক্রবার ব্রাসেলসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে নেতারা এ বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এতে তারা বলেন, 'যে সন্দেহ বা অবিশ্বাসে ভর করে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশে গুপ্তচরবৃত্তিতে নেমেছে, তা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইকে বাধাগ্রস্ত করবে'। এর আগে একের পর এক গোয়েন্দা নজরদারির তথ্য প্রচার হওয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর ব্যাখ্যা চায় জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে এ যাবত্কালের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ফাটল দেখা দিয়েছে মনে করছেন অনেকে।
সমপ্রতি গার্ডিয়ান জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ এরই মধ্যে মার্কেলের অসংখ্য ফোনকল রেকর্ড করেছে। সেই সাথে জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেনের লাখ লাখ নাগরিকের টেলিফোনেও আড়ি পেতেছে সংস্থাটি। এ সংক্রান্ত গোপন প্রমাণাদি হাতে আসার কথা দাবি করেছে গার্ডিয়ান। সংবাদপত্রটি জানায়, শুধু আঞ্জেলা মার্কেল নয়, ৩৫ জন বিশ্বনেতার ফোনে আড়ি পাতে এনএসএ। তবে সর্বশেষ জার্মানির দের স্পাইজেল ম্যাগাজিন জানায় আরো ভয়াবহ তথ্য। চ্যান্সেলর হবার আগে থেকেই নাকি অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের মোবাইলে নজরদারি করছে ওয়াশিংটন। ম্যাগাজিনের দাবি, এনএসএ'র ফাঁস হওয়া ২০০২ সালের গোপন তালিকায় মার্কেলের মোবাইল নম্বর রয়েছে। ২০১৩ সালের তালিকাতেও ঐ নম্বর তালিকাভুক্ত রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কিভাবে, কখন, কতটুকু নজরদারি করা হয়েছে বা নজরদারির ধরন কী, তা ঐ তালিকা থেকে জানা যায়নি। তবে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে কোন মোবাইলের কথাবার্তা রেকর্ড করা বা তার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারীদের তালিকা পাওয়া বর্তমান প্রযুক্তিতে সম্ভব বলে জানিয়েছে দের স্পাইজেল। জার্মান ম্যাগাজিনের দাবি, ইন্টারনেটে গুপ্তচরবৃত্তি বা ফোনে আড়ি পেতে তথ্য সংগ্রহের কাজটি করছে বার্লিনের খোদ মার্কিন দূতাবাস। ঐ ভবনের ভেতরের আছে 'স্পেশাল কালেকশন সার্ভিসেস' নামের একটি বিশেষ ইউনিট। যার কাজ হলো- আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বার্লিনের সরকারি আবাসিক এলাকার তথ্য সংগ্রহ করা। ফাঁস হওয়া নথিপত্রে বলা হয়েছে, সারাবিশ্বের প্রায় ৮০টি স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের এমন বিশেষ ইউনিট কাজ করছে। এর মধ্যে ১৯টিরই অবস্থান ইউরোপের বিভিন্ন নগরীতে।
ব্রাসেলসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে বিবিসিকে অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জানান, আমেরিকান বন্ধুদের আচরণে ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুবই মর্মাহত। শীর্ষ সম্মেলনে জানানো হয়, জার্মান চ্যান্সেলরের ফোনে নজরদারির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এবং এটা বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিতে এ সপ্তাহেই ওয়াশিংটন যাচ্ছেন জার্মানির গোয়েন্দা প্রধানরা (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক)। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা নজরদারির ইস্যুটি ইউরোপের সাধারণ জনগণের মধ্যে তৈরি করেছে গভীর উদ্বেগ। তাই জার্মানি ও ফ্রান্স উভয়েই বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খোলামেলা আলোচনা চাইছে। যেখানে নতুন করে বোঝাপড়া তৈরি হবে। এর জন্য কোন কালক্ষেপন নয়, বরং চলতি বছরের শেষ নাগাদই আলোচনার দাবি জানিয়েছে তারা। আর এমন দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। আলোচনা প্রক্রিয়ায় ইউরোপের অন্যান্য দেশও অংশ নিতে পারবে বলে জানানো হয়েছে। বিবৃতির বাইরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের বক্তব্য ছিলো বেশ স্পষ্ট। তিনি বলেন, 'যে অতীত জেনে আলোচনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক বা কর্মপরিকল্পনা নেয়া হবে। যার লক্ষ্য হবে গোয়েন্দা নজরদারির সব ম্যাকানিজম বন্ধ করা'
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র কেইটলিন হেডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের ফোনে কখনো আড়ি পাতা হয়েছিলো কি-না। তিনি জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগের কোন মাধ্যমেই অতীতে নজরদারি করা হয়নি, বর্তমানে করা হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে কোনকালেই তা করবে না ওয়াশিংটন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্য এবং বৈদেশিক সম্পর্কে এর প্রভাব খতিয়ে দেখছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজেই। এ কাজে তিনি নিয়োজিত করেছেন নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞের বাইরে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের। তথ্য ফাঁস হবার পর কিভাবে আস্থা সমুন্নত রাখা যায় সে ব্যাপারটিও পর্যালোচনা করছেন তারা।
এ সব গেলো রাষ্ট্রের বাহ্যিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা। বিশে¬ষকদের মতে, আসলে ইউরোপীয় নেতারা যেটা চাইছেন, তা হলো নতুন গোয়েন্দা সহযোগিতা চুক্তি। যেটা হবে 'ফাইভ আইজ' চুক্তির সংস্করণ। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ১৯৪৬ সালে একটি টপ সিক্রেট গোয়েন্দা সহযোগিতা চুক্তি সই করে। পরে বিভিন্ন নথিপত্রে ঐ চুক্তির নাম 'ইউকেইউএসএ এগ্রিমেন্ট' হিসেবে উলে¬খ পাওয়া যায়। ঐ চুক্তিতে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে গোয়েন্দা সহযোগিতার মৌলিক বিষয় উলে¬খ ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঐ চুক্তিতে যোগ দেয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। পাঁচটি দেশের অংশগ্রহণ থাকায় চুক্তিটি পরে 'ফাইভ আইজ' বা 'পঞ্চ চোখ' নামে অভিহিত হয়। বিশে¬ষকরা বলছেন, ফ্রান্স ও জার্মানি চাইছে ঐ চুক্তির আদলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন চুক্তি। প্রাথমিকভাবে এর নাম হতে পারে 'নো স্পাইং প্যাক্ট'

মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রত্যাহারের আহবান চীনের
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) গোয়েন্দা নজরদারির ঘটনায় জাকার্তায় নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে ইন্দোনেশিয়া সরকার। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দূতাবাসের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হওয়ায় ইন্দোনেশিয়া এ পদক্ষেপ নেয়। তারা বলেছে, এ আচরণ শুধু নিরাপত্তাই নয়, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও নৈতিকতার গুরুতর লঙ্ঘন। অপরদিকে চীন সরকারও তাদের দেশে নজরদারির ব্যাখ্যা দাবি করে দেশ থেকে মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন দেশের সরকার, সরকারপ্রধান ও নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়ে প্রথমবারের মতো সুর নরম করল যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ নজরদারি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে হয়েছে। ভবিষ্যতে আর এমনটি হবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানান।
ইন্দোনেশিয়া সরকার সে দেশে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ায় গোয়েন্দা নজরদারি চলে এমন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ডাকা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা নথির বরাত দিয়ে সম্প্রতি জার্মানির দের স্পিগেল পত্রিকা জানায়, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন গোয়েন্দা নজরদারিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসগুলো। পরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা নজদারির বিস্তারিত তুলে ধরে। এতে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা ও বালি শহরে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হয়। গতকাল শুক্রবার জাকার্তায় অস্ট্রেলীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে নজরদারির তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইন্দোনেশিয়া সরকার। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্টি নাতালেগাওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, 'জাকার্তায় মার্কিন দূতাবাসে আড়ি পাতার ব্যবস্থা স্থাপনের সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ জানায় ইন্দোনেশিয়া সরকার। এ ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। এটা শুধু নিরাপত্তা লঙ্ঘনই নয়, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও নৈতিকতার গুরুতর লঙ্ঘনও।'
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নজরদারির ব্যাখ্যা দাবি করেছে চীনা সরকারও। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে এক নিবন্ধে, চীন থেকে মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা জানায়, পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন নজরদারির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে চীন। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে মার্কিন দূতাবাস এবং সাংহাই ও চেংদু শহরে মার্কিন কনস্যুলেটের মাধ্যমে এ নজরদারি চালানো হয়। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিয়িং গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, নজরদারির খবরে 'চীন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দাবি করছি। আমরা চীনে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক মিশন ও কর্মকর্তা চাই যারা আন্তর্জাতিক আইন কঠোরভাবে মেনে চলবে। তারা চীনের স্বার্থ ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে এমন কোনো কর্মকাণ্ড চালাবে না।'
চায়না ডেইলি পত্রিকা এক নিবন্ধে চীন থেকে গোয়েন্দাদের ফিরিয়ে নিতে ওয়াশিংটনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গোয়েন্দাদের কার্যক্রমকে অবৈধ ও কূটনৈতিক সুরক্ষাবহির্ভূত বলে অভিহিত করেন।
এদিকে ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা শুরুর ১০ দিন পর গত বুধবার প্রথমবারের মতো গোয়েন্দা নজরদারির সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তবে তিনি নজরদারির পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক, পরবর্তীতে লন্ডন, মাদ্রিদসহ অন্যান্য স্থানে সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ করে জানান, যেসব সন্ত্রাসী জনগণকে হত্যা ও বিভিন্ন সরকারের ওপর হামলার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই নজরদারি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
কেরি জানান, সন্ত্রাসীদের যোগাযোগব্যবস্থায় আড়ি পাতার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা ২০০১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বহু সন্ত্রাসী হামলা এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আড়ি পাতায় বাড়াবাড়ি হয়েছে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছে তা তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি।
কেরি ভবিষ্যতে এমনটা আর হবে না বলে জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য মিত্রকে আশ্বস্ত করেছেন। ভিডিও লিংকের মাধ্যমে লন্ডনে এক সম্মেলনে কেরি বলেন, 'আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি, তথ্য সংগ্রহের একটা চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও নিরীহ লোকজন তাতে হয়রানির শিকার হবে না। আমাদের প্রেসিডেন্ট বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুনঃপর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন।' কেরি আরো জানান, ওয়াশিংটন যা করার চেষ্টা করছিল তা হচ্ছে, কোনো ধরনের হুমকি আছে কি না তা সঠিকভাবে নিরূপণ ও মোকাবিলা করা।
সূত্র : এএফপি, বিবিসি।

মানুষ আজ নগ্ন

দুনিয়ার তাবৎ মানুষ আজ নগ্ন

ডেনিয়েল এলসবার্গ, ব্রাডলি ম্যানিং ও এডওয়ার্ড স্নোডেন। ১৯৭১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নানা তথ্য ফাঁস করে দিয়ে আলোড়ন তোলা তিন নায়ক।
দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের সকল মানুষের টেলিফোন ও ইন্টারনেটের উপর গোপন নজরদারি করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অন্যায় কাজের গোপন নথি সংবাদ পত্রে প্রকাশ করে দিয়েছে এডওয়াড স্নোডেন। স্নোডেন যা ফাঁস করেছেন, তা নিছক কিছু ই-মেল বা ফোন-ট্যাপের ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় নয়। স্নোডেনের দাবিগুলি যদি সত্য হয় (যার আংশিক সত্যতা মার্কিন প্রশাসন স্বীকার করেছে), তা হলে প্রিজম হল, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নজরদারির প্রোজেক্ট, যা হেলায় টেক্কা দেবে গেস্টাপো-কেজিবি-এম আই ফাইভ-এর সম্মিলিত টিমকে। স্নোডেন এক সাক্ষাতকারে গোপন নথি ফাঁসের কারণ হিসেবে বলেন, ‘আপনি যখন দেখবেন আপনার তৈরি করা পৃথিবীকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নষ্ট করে চলেছে, তখন আপনাকে এমন কাজ করতেই হবে। যদি আপনাকে এর জন্য বিপদের ঝুকিও নিতে হয়, তবু আপনি তা করতে পিছপা হবেন না। আমিও সেই কাজটি করেছি।
তবে স্নোডেনই প্রথম না যিনি মার্কিন গোপন নথি ফাঁস করে দিয়েছেন। স্নোডেনের আগেই এমন কাজ করে শাস্তি পেতে হয়েছে ডেনিয়েল এলসবার্গ ও ব্রাডলি ম্যানিংকে। ডেনিয়েল এলসবার্গ ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্দের গোপন নথি ফাঁস করে দেন। তার এই কাজের পলরে ব্যাপক তোড়পাড় শুরু হয় মার্কিন মিডিয়া এবং প্রশাসনের মধ্যে। শাস্তি পেতে হয় তাকে। ২০১০ সালে আড়াই লক্ষ তার বার্তা উইকিলিসের কাছে ফাঁস করে দেন ব্রাডলি ম্যানিং। এই কাজের জন্য তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী কোরট মার্শালের মুখোমুখী করে। তার বিচার আজও শেষ হয়নি। একই অপরাধে উইকিলিসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গ্রেফতার এড়াতে অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাজ্যে ইকুইডরের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে আছেন দুই বছরের বেশি সময় ধরে।
মার্কিন গুপ্তচররা যে বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতে রেখেছে, তিন মাস আগেই সে খবর ফাঁস করে দিয়েছিলেন এডওয়ার্ড স্নোডেন। তা বলে পড়শি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও যে রেহাই পাননি, তা আন্দাজ করেননি কেউই। ব্রাজিল ও মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টদের ই-মেল, ফোন এমনকী মেসেজের উপরও মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা (এনএসএ) আড়ি পেতেছিল বলে দাবি করে হইচই ফেলে দিয়েছেন স্নোডেন। ব্রাজিলের এক খবরের চ্যানেলে এ কথা জানান সাংবাদিক গ্রিনওয়াল্ডএনএসএ-র গোপন কীর্তির যে নথি স্নোডেনের হাতে আছে, তার উপর ভিত্তি করে এক ব্রিটিশ দৈনিকে এত দিন ধরে একের পর এক খবর লিখেছেন এই গ্লেন গ্রিনওয়াল্ডই। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রোসেফ ও মেক্সিকোর এনরিকে পেনিয়া নিয়েতোর উপর নজরদারি চালানোর কথা জানাজানি হওয়ায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দুই দেশই। আন্তর্জাতির নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে দেশের সার্বভৌমত্বর উপর আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্রাজিলের বিদেশমন্ত্রী। ব্রাজিলের মার্কিন দূত টমাস শাননকে ডেকে পাঠিয়ে লিখিত জবাবও তলব করেছে রোসেফ প্রশাসন। গত বছর মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এনরিকে। ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই তাঁর উপর নজর ছিল এনএসএ-র। ২০১২ সালের জুন মাস থেকে এনরিকের উপর নজর রাখার যে নথি স্নোডেন ফাঁস করেছেন, তাতে তাঁর মন্ত্রিসভায় কারা কারা থাকতে পারেন সেই সংক্রান্ত মেসেজ আদানপ্রদানের বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
মেক্সিকোর বিদেশ মন্ত্রকের দাবি, পুরো ঘটনার তদন্ত করুক আমেরিকা।
জার্মানির ডার স্পাইগেল বা ফ্রান্সের ল্য মঁদ কিংবা স্পেনের এল মুন্দো সংবাদপত্র বলছে, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের ব্যক্তিগত ফোনে প্রায় ১০ বছর ধরে আড়ি পেতেছিলেন মার্কিন গোয়েন্দারা মিত্র হওয়া সত্ত্বেও চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সেলফোনে আড়ি পাতায় ক্ষুব্ধ জার্মানি। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা বা বিশ্বের অন্য যে কোন স্থানের চেয়ে ওয়াশিংটনের কাছে এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মসূচির বিরুদ্ধে চীনের পাশাপাশি একযোগে ক্ষোভ আর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর এমন ক্ষোভের কারণ অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানির দু'টি পত্রিকার প্রতিবেদন। এ অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ খবরটি প্রকাশ করে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড ও দার স্পাইজেল ম্যাগাজিন। ঐ দু'টি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, 'প্রিজম' গোয়েন্দা কর্মসূচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একার নয়। বরং এর সাথে যুক্ত অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড। তাদের এই গোয়েন্দা সহযোগিতা চুক্তির নাম 'ফাইভ আইজ'সিডনি মর্নিং হেরাল্ড জানায়, দক্ষিণ-পূর্ণ এশিয়ার রাজধানীগুলোতে ফোনে আড়ি পাতাসহ অন্যান্য গোয়েন্দা তথ্য সহযোগিতার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাসকে ব্যবহার করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় আশিটি দূতাবাস ও কনস্যুলেট কার্যালয় থেকে আধুনিক প্রযুক্তি ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে গোপনে ব্যাপকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
দূতাবাসের ঐ নির্দিষ্ট কক্ষের কোড নেইম বা সাংকেতিক নাম 'স্টেটরুম'ইউরোপে এমন ঊনিশটি দূতাবাসে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্টেটরুম স্থাপন করা হয়েছেএশিয়ার কোন্ কোন্ নগরী থেকে যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে, তারও একটা তালিকা প্রকাশ করেছে পত্রিকা দু'টি। এগুলো হলো- জাকার্তা, ব্যাংকক, হ্যানয়, বেইজিং, পূর্ব তিমুরের দিলি, কুয়ালালামপুর এবং পাপুয়া নিউগিনির মোর্সবি। এসব নগরীতে অবস্থিত বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার দূতাবাস মার্কিন গোয়েন্দা কর্মসূচিতে ব্যবহূত হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। এর প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর কড়া সমালোচনা করে জাকার্তা।
ব্যক্তিস্বাধীনতার সমস্ত রক্ষাকবচ হারিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের রক্তচক্ষুর সামনে দুনিয়ার তাবৎ মানুষ আজ নগ্ন। যে নজরদারির জাল বোনা হয়েছে দুনিয়া জুড়ে, সেটাই ফাঁস করে দিয়েছেন এডওয়ার্ড স্নোডেন।
মার্কিন গোয়েন্দাকর্তা জেমস ক্ল্যাপার অবশ্য সমালোচনা সত্ত্বেও বৈদ্যুতিন আড়িপাতার পক্ষেই সওয়াল করেছেন৷ তাঁর দাবি , যে ভাবে সন্ত্রাসবাদ বাড়ছে তাতে আমেরিকাকে বাঁচাতে এ ছাড়া রাস্তা নেই৷ তাই আক্রান্ত হওয়ার আগেই আক্রমণ প্রতিহত যদি করতে হয় তা হলে নজর রাখতেই হবে৷ এনএসএ কর্তা জেনারেল কিথ আলেকজান্ডারের দাবি, একা নয় আমেরিকা , ইউরোপের একাধিক দেশের নাগরিকদের ওপর যে বৈদ্যুতিন নজরদারি চালিয়েছেন মার্কিন গোয়েন্দারা , তাতে শরিক সেই দেশের গোয়েন্দাসংস্থাও৷ মার্কিনদের সঙ্গে সবাই মিলেই ভাগ করে নিয়েছে নজরদারির ফল৷ জার্মানির ডার স্পাইগেল বা ফ্রান্সের ল্য মঁদ কিংবা স্পেনের এল মুন্দো সংবাদপত্র যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তা সত্য নয়৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন কিংবা ই -মেল অ্যাকাউন্টে দীর্ঘদিন ধরে যে নজরদারি চলে এসেছে তা একেবারে গোপনে নয়৷ আমেরিকার হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটি ’-র কাছে জেনারেল আলেকজান্ডার জানিয়েছেন , ‘আক্রান্ত দেশগুলির রাজনীতিকরা যতই বিরক্তি প্রকাশ করুন না কেন , কিছুই তাঁদের অজান্তে হয়নি৷ সন্দেহভাজনদের তথ্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দেশের গোয়েন্দারা৷ অভিযোগ তুলেছে ইন্টারনেট জগতের অন্যতম সংস্থা গুগলও৷
অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর৷ সংস্থার আইনজ্ঞ ডেভিড ড্রামন্ড দাবি করেছেন , মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে কোনও তথ্যই দেয়নি গুগল , ওঁরা যা পেয়েছেন তার সবটাই চুরি করানজরদারি চালাতে গিয়ে গুগলের ডেটাবেস হ্যাক করেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা৷ বাষিক ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি মূল্যের ব্যবসা করে মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা গুগল৷ শেয়ার বাজারের নিরিখে আমেরিকার সেরা একশোটি সংস্থার মধ্যে অনায়াসে জায়গা পায় গুগল৷ এমন শক্তিশালী একটি সংস্থার তথ্যভাণ্ডারে চুরি ? আমেরিকার মাটিতে বসে কেউ রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত করছে কিনা তা জানার অধিকার রয়েছে মার্কিন প্রশাসনের৷ সেই মতো সরকারকে সাহায্যও করে গুগল ও ইয়াহু -র মতো বড় সংস্থারা৷ নজরদারির জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ ) তৈরি করেছিল প্রিজম নামে একটি শক্তিশালী সফটওয়্যার৷ কিন্ত্ত মার্কিন ভূখণ্ডের বাইরে এমন নজরদারি একেবারেই আইনবিরুদ্ধ বলে জানিয়েছেন গুগলের কর্তারা৷ পুরো ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য ওয়াশিংটন পোস্ট কাগজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে৷ মার্কিন কম্পিউটার বি‌শেষজ্ঞ এডওয়ার্ড স্নোডেনই নাকি মার্কিন ওই সংবাদপত্রকে জানিয়েছেন খোদ ইন্টারনেট দৈত্য গুগলের -ই ডেটাবেস হ্যাক করে ফেলেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা৷
এমনিতে আমেরিকায় ব্যক্তির উপর নজরদারি এবং তার ডকুমেন্টেশন কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে তার চরিত্রে একাধিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। তথ্য হয়ে উঠেছে আকার ও ক্ষমতায় দৈত্যাকৃতি। প্রথমত, প্রযুক্তির কারণে তথ্যের পরিমাণ অকল্পনীয় রকম বেড়ে গেছে। প্রয়োজন থাক বা না থাক, প্রতিনিয়ত রেকর্ড করা হচ্ছে মানুষের স্বভাব’, ‘চরিত্র’, ‘স্বাস্থ্যইত্যাদির হিসেবনিকেশ। ক্রেডিট হিস্ট্রিঅর্থাৎ ধার নেওয়ার ইতিহাস দিয়ে মেপে রাখা হচ্ছে ব্যয়ের অভ্যেস ও তার প্যাটার্ন। এর পর আছে ড্রাইভিং রেকর্ড, ক্রিমিনাল রেকর্ড, মেডিক্যাল হিস্ট্রি। এবং তা ছাড়াও জমিয়ে রাখা হচ্ছে আরও অজস্র আপাতদৃষ্টিতে অদরকারি তথ্যসমূহকে। যা হয়েছে ইয়াহু-গুগলের ক্ষেত্রে।
কী ভাবে চলছে গুগলের মতো বহুজাতিক সংস্থার ডেটা সেন্টারে হ্যাকিংয়ের কাজ ? সার্ভার হ্যাকিংয়ের পথে হাঁটেননি মার্কিন গোয়েন্দারা৷ স্নোডেন জানিয়েছেন , ওই পথে কাজ সারা খুব সহজ কাজ নয়৷ কারণ , গুগল বা ইয়াহু -র মতো সংস্থাগুলি তাদের সার্ভারকে এমন শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে উপযুক্ত ব্যবস্থাও নেয়৷ কিন্ত্ত ফাইবার অপ্টিকের মধ্যে দিয়ে যখন অজস্র তথ্য আদান -প্রদান করা হয় , তখনই সেই তথ্য চুরি করে নেয় এনএসএ৷ বহু ক্ষেত্রেই গুগলের সার্ভারে তথ্য পৌঁছানোর আগেই ডেটা সেন্টার থেকেই তথ্য তুলে নেয় এনএসএ৷ কতটা পরিমাণ তথ্য এমন ভাবে সরানো হয় নিয়মিত ? প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে প্রতিদিন সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ রেকর্ড এমন বেআইনি পদ্ধতিতে হাতিয়ে নেওয়া হয়৷ প্রতিদিন অডিও , ভিডিও , টেক্সট সবই আছে তালিকায়কেবলমাত্র মার্কিনরাই নন , এই চুরিতে তাঁদের দোসরের ভূমিকা নিয়েছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারাও৷ গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশন হেডকোয়ার্টার্স (জিসিএইচকিউ ) গোয়েন্দাদের কাছে চুরির পর যাবতীয় তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাস্কিউলার নামে এক কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সাহায্যে৷ মাস্কিউলার নিয়ন্ত্রণ করে প্রধানত ব্রিটিশ গোয়েন্দাসংস্থা জি সি এইচ কিউএরপর সেই বিপুল পরিমাণ তথ্যের শ্রেণিবিভাগ করে তা বিভিন্ন বিভাগের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিশ্লেষণের জন্য৷ গুগলের পক্ষ থেকে সংস্থার আইনজ্ঞ ডেভিড ড্রামন্ড জানিয়েছেন , এমন যে হতে পারে তা তাঁরা আগেই আন্দাজ করেছিলেন৷ এখানেই শেষ নয়। হ্যাকার হামলার মুখে বিখ্যাত সফটওয়্যার নির্মাতা অ্যাডোব-ও৷ শুরুতে আশঙ্কা করা হয়েছিল প্রায় ২৯ লক্ষ অ্যাডোব অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছে৷ কিন্ত্ত কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন , সংখ্যাটা অন্তত ৩ কোটি ৮০ লক্ষ৷ চুরি হয়েছে অ্যাডোবের নামকরা ফটোশপ সফটওয়্যারের সোর্সকোডও৷

স্নোডেন যা দাবি করেছেন (যেটা আংশিক ভাবে মার্কিন সরকার স্বীকারও করেছে, যদিও পুরোটা নয়), সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, দুনিয়াজোড়া বিপুল তথ্য চালাচালির বৃহদংশই মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থার হাতের নাগালে। যে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত তথ্যগুলিকে এত দিন স্রেফ মার্কেটিং বা ওই জাতীয় কোনও নির্দোষ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেই তথ্যকে ইচ্ছে করলেই একটি নিরাপত্তা সংস্থা ব্যবহার করতে পারে। আর গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্য হল ব্যক্তি’, সুতরাং ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যক্তিস্বাধীনতার সমস্ত রক্ষাকবচ হারিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের রক্তচক্ষুর সামনে দুনিয়ার তাবৎ মানুষ আজ নগ্ন।

পরিবারতান্ত্রিকতা...

পরিবারতান্ত্রিকতা...
একশত পঁচিশ বছরেরও বেশি দীর্ঘ সময়কাল। কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তো তা অতি-দীর্ঘকাল। কেননা, ভারতের রাজনীতি এই একশত পঁচিশ বছরে যে ক্রমাগত উত্থান পতন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বয়েছে, তাতে এই গোটা সময়কাল জুড়ে কোনও রাজনৈতিক দলের টিঁকে থাকাই এক হিমালয়সমান কৃতিত্ব। আর কংগ্রেস তো কেবল টিঁকেই থাকে নি, দেশের অন্যতম প্রধান একক রাজনৈতিক দল হিসাবেই বিরাজ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ দেশের বহু প্রদেশে কংগ্রেস কোনও বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিই নয়, এমনকী গুরুত্বহীনএরজন্য দায়ী, দলের পরিবারতান্ত্রিকতা।
স্বাধীনতার আগেও কংগ্রেস মুক্ত গণতান্ত্রিক উপায়ে চালিত হত না কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তা একটি বিশেষ পরিবারের সম্পূর্ণ মুখাপেক্ষী হইয়া দাঁড়ায়। দলনেতারা যথারীতি প্রবল উৎসাহে নেহরু-গান্ধী পরিবারের নায়কত্ব বরণ করে নিয়েছেন বিবাদী স্বর সম্পূর্ণ অশ্রুত, অন্তত প্রকাশ্যে। পরিবারতন্ত্রের জন্যই অন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন কম অনুভূত হয়েছে, আবার অন্য নেতৃত্ব তৈরি হয় নি বলে পরিবারতান্ত্রিকতা আরও গেড়ে বসেছে। সম্প্রতি রাহুল গান্ধী যে ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে সফর করে সংগঠনের কাজে মন দিয়েছেন, তাতেও স্পষ্ট, এখনও রাজ্য-স্তরে দলের রাশ ধরতে দিল্লি থেকে দশ নম্বর জনপথের নির্বিকল্প নেতাকেই যেতে হয়। সেই দলে আজও নেহরু-গান্ধী পরিবারই প্রথম ও শেষ কথা।
সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী একবার কংগ্রেসের মুখপত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির উদ্দেশে বলেছিলেন, কারও মনে যদি কালেক্রমে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা থাকে, তার তো কখনও কংগ্রেসে যোগ দেওয়া উচিত নয়। আপনাদের দলে তো ওই আসনটার মালিক ঠিক হয়ে আছে। প্রশ্ন শুনে অভিষেক বলেন, তাতে কী? কেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছাড়া আর কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে নেই নাকি? আমাদের দলের শীর্ষ আসন দুটি সোনিয়াজি আর রাহুলজির জন্য নির্দিষ্ট, এবং আমরা তাতেই খুশি।
ষাটের দশকে কংগ্রেস ইন্দিরা গান্ধীকে যখন বরণ করে নিল, তখন কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না ইতিহাসের ধারা কোন খাতে বইবে।
তাঁর জমানার প্রথম পর্বে প্রশাসনে ঈষৎ অনভিজ্ঞ ইন্দিরা বেশ কয়েকটি বছর হাবুডুবু খেয়েছেন। আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাসে স্থিত হয়েছেন। ধীরে ধীরে কূটকৌশল ও দৃঢ়চিত্ততার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর দলে এবং দলের বাইরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবৃন্দ ক্রমশ কুপোকাত হয়েছেনভাগ্য ইন্দিরার উপর সদয় থেকেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে সুযোগ এনে দেয়, তার সুচারুতম ব্যবহার তিনি করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে ঘোল খাইয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে সৈন্য-সাহায্য করে বিশ্ব জুড়ে তারিফ কুড়িয়েছেন। এমনকী দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতা পর্যন্ত তাঁকে সাক্ষাৎ মা ভগবতী বলে বন্দনাও করেছেন। তবে ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর আচরণে-বিচরণে অন্য এক প্রবণতার লক্ষণ। অহংকার, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, পরমত-অসহিষ্ণুতা, এঁকে ওঁকে তাঁকে অবিশ্বাস, সর্বদা স্তাবকদের ঘেরাটোপে থাকা, অথচ জাত চাটুকারেরাও বুঝে উঠতে পারেন না, কবে তিনি সহসা কুপিত হয়ে তাঁদের দূরে ছুড়ে ফেলবেন। এর পর অতি দ্রুত ঘটনাবলির পরম্পরা: দেশ জুড়ে মূল্যবৃদ্ধি, জমে ওঠা জনরোষের সংগঠিত ব্যাপ্তি, এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের রায়, জরুরি অবস্থা ঘোষণাসেই সূত্র ধরে পরিবারতন্ত্রের নিটোল আত্মপ্রকাশ। ওই উথালপাথাল বছরগুলিতেই ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন নিজের সন্তানদের ছাড়া আর কারও উপর আস্থা স্থাপন করা যায় না। নির্ভরতার একমাত্র পাত্র, সঙ্কটে একমাত্র ভরসা আত্মজ-আত্মজারা।
ইন্দিরা গান্ধী নিধনের পর তাঁর জ্যেষ্ঠ তনয় প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নিধনের পর বিবিধ ঝড়ঝাপটা সামলে কংগ্রেস ফের রাষ্ট্রশাসনের চূড়ান্ত দায়িত্বে। এই মুহূর্তে দল থেকে যদিও এক জনকে প্রধানমন্ত্রীর বকলমা দেওয়া হয়েছে। আদতে সমস্ত প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দলের সভানেত্রী ইন্দিরা-পুত্রবধূর এক্তিয়ারে এবং দলের ভিতরে অন্তত সবাই মেনে নিয়েছেন। সেই পথ ধরেই রাহুল গান্ধী আজ দলের যুবরাজ। সম্প্রতি জয়পুরের চিন্তন শিবির তাঁর কপালে পাকাপাকি টিকা পরিয়ে দিল। তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মনমোহন সিংহ, যিনি দীর্ঘ আট বছর রামচন্দ্র্রের খড়মকে সিংহাসনে বসিয়ে অপেক্ষায় আছেন। তাঁর বুঝি ছুটি হল এই বার। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে কংগ্রেসের প্রার্থী কে হবেন, কোনও ঘোষণা ছাড়াই বুঝে নেওয়া সম্ভব এখন।
ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে ট্র্যাজিক চরিত্র সম্ভবত পামুলাপর্তি বেঙ্কট নরসিংহ রাও।
নরসিংহ রাওয়ের প্রতি ইতিহাস সদয় হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বেই দেশে দুর্নীতি চরমসীমায় পৌঁছেছিল। হর্ষদ মেটা সুটকেসে এক কোটি টাকা ভরে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী রাওয়ের বাসভবনে। তাঁর আমলেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী উন্মাদের দল। এবং, তারও বহু আগে, ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর যখন শিখনিধন পর্ব চলছিল, তখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরসিংহ রাও নিষ্ক্রিয় বসেছিলেন। ইতিহাসের দায় তাঁকে নিতে হবে বইকী। কিন্তু, সেই দায় যদি তাঁর কৃতিত্বকেও কেড়ে নেয়, সেটা অবিচার। এবং, এটা গোটা ব্যবস্থার ব্যর্থতার দায় শুধুমাত্র এক জনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াও অবিচারই বটে। মনমোহন সিংহ ভারতের উদার অর্থনীতির জনকবলেছিলেন, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদম্বরম আখ্যা দিয়েছিলেন ভারতের দেং জিয়াওপিংসেই মানুষটি আর্থিক সংস্কারের দুই দশক পূর্তির পরেও উপেক্ষিত কংগ্রেসের ১২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তাঁর ভাষণে সনিয়া গান্ধী যখন সব কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করেন, তখনও তিনি সন্তর্পণে নরসিংহ রাওয়ের নামটি এড়িয়ে যান। বলেন, ১৯৯১ সালে যে আর্থিক সংস্কারের কাজ আরম্ভ হয়েছিল, তা আসলে রাজীব গান্ধীর পরিকল্পনা। এটা ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা। এখানেই নরসিংহ রাওয়ের ট্র্যাজেডি। পরিবারতন্ত্রের জয়!
বাবর বাদশার পর হুমায়ুনই দিল্লির তখত-তে বসবেন, তা যেমন নিশ্চিত ছিল ষোড়শ শতকের রাজধানীতে। একুশ শতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে এমন নির্লজ্জ পরিবারতন্ত্র চোখে লাগে
তিনি যে যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়েছেন, কংগ্রেস নেহাত ধেড়িয়েছে। আট বছরে তাঁর কোনও উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা মনে করতে পারছি না। তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য কী, অভিজ্ঞান কী, গোটা দেশে কেউ জানে না। তাঁর একমাত্র কৃতিত্ব, তিনি ভারতের রাজপরিবারের কুলতিলক- পরিবারের যে অংশটি ক্ষমতার সমীকরণের ঠিক দিকে ছিল, রাহুল সেই দিকের একমাত্র পুরুষ সন্তান।
 ভাবী ইতিহাস কী বলবে, ভাবী ইতিহাসই জানে। কিন্তু গুরুবাদী দেশ আমাদের। কেন্দ্রে যে পরিবারতন্ত্র, তা এখন রাজ্যে রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কোন রাজ্য ছেড়ে কোন রাজ্যের নাম করব। পঞ্জাবে প্রবেশ করুন, কিংবা উত্তরপ্রদেশে অথবা ওড়িশায়, নয়তো ও দিকে অন্ধ্রপ্রদেশে বা তামিলনাড়ুতে বা কর্নাটকে বা মহারাষ্ট্রে, এবং অবশ্যই রাজস্থানে। যে দল ক্ষমতায় আসীন বা যারা প্রতিপক্ষ, সর্বত্রই পরিবারতন্ত্রের একচ্ছত্র বিস্তার। জীবনানন্দের একটি কবিতায় এই পঙ্ক্তিটি বিরাজ করছে আমাদের সন্তানেরা জ্যেষ্ঠ হয়ে যাবে স্বতঃসিদ্ধতার মতো জীবনের ভিতরে দাঁড়াবেতার প্রাঞ্জল ব্যাখ্যার যেন মুখোমুখি হচ্ছি আমরা।
তবে যে গতিতে বাঙালিরা আপাতত জাতীয়তার চেতনাসম্পন্ন তথা বিশ্বায়িত হচ্ছেন, কে জানে, পরিবারতন্ত্রের অভ্যুদয়ও আর খুব বেশি দিন হয়তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অন্তত ব্যক্তিতন্ত্র।
জওহরলাল নেহরুর পিতৃদেব হইতেই পরিবারের রাজনৈতিক বংশতালিকা গণনা বিধেয় মোতিলাল নেহরু ১৯১৯ সালে প্রথম বার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হইয়াছিলেন। রাহুল গান্ধী ২০১৯-এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হইবেন কি না, তাহা ভোটদেবী জানেন, কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্টের ভাইসটুকু খসিয়া পড়িতে তত দিন অপেক্ষা করিতে হইবে, এমন আশঙ্কা তাঁহার মনে নিশ্চয়ই নাই। কংগ্রেস নামক দলটির এই দুর্মর পরিবারতন্ত্রকে সরাসরি অগণতান্ত্রিক বলিলে অন্যায় হইবে। বস্তুত, গত কয়েক বছরে দল এই উত্তরাধিকারের জন্যই সর্বতোভাবে প্রস্তুত হইয়াছে, বিকল্প নেতৃত্বের কোনও কথাও ওঠে নাই, পরিবারতন্ত্রের জোগান প্রস্তুত হইবার আগেই তাহার চাহিদা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়াছে। সেই দিক দিয়া দেখিলে, পরিবারের শাসনকে স্বাভাবিককরিয়া লইবার কাজটিতে সনিয়া গান্ধীর সাফল্য অতুলনীয় এবং নিরঙ্কুশ। নিরন্তর নেতৃত্বের সঙ্কটে জর্জরিত ভারতীয় জনতা পার্টির বহু কর্মী ও নেতা নিশ্চয়ই মনের ঈর্ষা মনে লুকাইয়া ভাবিতেছেন, উত্তরাধিকার নির্ধারণে তাঁহাদের পরিবার’-এর তন্ত্রটি যদি এমন কার্যকর হইত!
বিভিন্ন রাজ্যে মুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেতারা উঠিয়া আসিবেন এবং তাঁহারা আবার মুক্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সর্বভারতীয় স্তরে দল পরিচালনা করিবেন, ইহাই ছিল দেশের প্রাচীনতম দলটির নিকট গণতান্ত্রিক ভারতের দাবি। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী জমানা হইতে অর্ধ শতাব্দী যাবৎ দল তাহার বিপরীতে হাঁটিয়াছে, নেতৃত্বের বহুমাত্রিকতাকে গণতান্ত্রিক স্ফূর্তি দিবার পরিবর্তে হাই কমান্ড’-এর শাসন নিরঙ্কুশ করিবার কাজে ব্যবহার করা হইয়াছে দ্বিতীয় সারির বিভিন্ন নেতা পরস্পরের শক্তি খর্ব করিতে পারিলে পরিবারের সুবিধা বাড়ে, সকলেই তখন সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া বলে, ‘হাই কমান্ড স্বর্গ, হাই কমান্ড ধর্মএই প্রণিপাতের পিঠে চড়িয়াই রাহুল গান্ধীর উত্তরণ।