সাচিকোর যন্ত্রণা!
আগস্টের ৬ তারিখটি ছিল অন্য আর আট-দশটা উষ্ণ, আর্দ্র গ্রীষ্মের দিনের মতোই। দরদর করে ঘামছিল মেয়েটি। তার পরনের কাপড়গুলোও ঘামে ভিজে একাকার। জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সাচিকো।
সাকামোতো
ইন্টারন্যাশনাল সিমেট্রি পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করল। এগতে থাকল স্যানো শিন্তো
মঠের সংকীর্ণ রাস্তা ধরে, কর্পূর গাছগুলোর দিকে। গাছের নীচটা কিছুটা ঠান্ডাই হবে। সূর্যের
উত্তাপ ঝলসে দিচ্ছিল সাচিকোকে। সাকামোতো সিমেট্রি, স্যানো শিন্তো মঠ এবং পুরনো কর্পূর গাছগুলোকেও।
উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছিল উরাকামি উপত্যকার কাঠের বাড়িগুলোর ছাদের ধূসর-রঙা টাইলসগুলোর
উপর। নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজেও একই অবস্থা। পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে
জাপানকে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার পথিকৃৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই কলেজটি ছিল
গুরুত্বপূর্ণ। উত্তপ্ত হচ্ছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ চার্চ হিসেবে খ্যাত উরাকামি
ক্যাথেড্রাল এবং ছোট্ট দেজিমা দ্বীপটি। যেখানে একসময় পা দিয়েছিল পর্তুগিজ বণিকরা।
যখন জাপানের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তখনও নাগাসাকির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল
পাশ্চাত্য দুনিয়ার। এই নাগাসাকিতেই প্রাচ্যের সঙ্গে মিলন ঘটেছিল পাশ্চাত্যের।
যুদ্ধের ফলে
নাগাসাকিরও তখন জাপানের অন্য আর আট-দশটা শহরের মতো দুঃসহ অবস্থা। খেলার মাঠ এবং
পার্কগুলোতেও মিষ্টি আলু ও কুমড়োর মতো বিভিন্ন ধরনের সব্জির চাষ করা হয়েছিল।
আশপাশের পাহাড়গুলোতে বিমান হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছিল স্কুলের
শিক্ষার্থীরা। বোমা হামলার ফলে উৎপন্ন আগুনের হাত থেকে বাঁচতে তৈরি করা হয়েছিল
জলের ট্যাঙ্ক। মার্কিন আক্রমণ প্রতিরোধে একদিকে জাপানি সেনারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অন্যদিকে আত্মরক্ষার স্বার্থে দেশের স্কুলপড়ুয়া
মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল বাঁশের তৈরি বর্শা দিয়ে।
হাঁটতে
হাঁটতে কখন যেন স্যানো মঠের কাছাকাছিই চলে এসেছিল সাচিকো। কর্পূর গাছগুলোর ছিল আর
একটু দূরেই। গাছগুলোর প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। এই গাছগুলোর পিছনেই স্যানো মঠের
বৃহদাকার, পাথুরে
গেটটি। আধ্যাত্মিকতার চাদরে মোড়া এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাচিকো মনে মনে প্রার্থনা করল।
আবার যেন ও প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে!
গত এপ্রিলের
কথা। চারদিকের পরিবেশ তখন চেরি ফুলের গন্ধে সুশোভিত। জাপানের স্কুলগুলোর নতুন
শিক্ষাবর্ষ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। বাবা সাচিকোকে নিয়ে জেনজা প্রাইমারি স্কুলে
গিয়েছিলেন। বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘স্যার-ম্যাডামদের কথা মেনে চলো সাচিকো। তারা তোমাকে সঠিক পথের নির্দেশ
দেবেন।’ কিন্তু বাবা আর সাচিকো যখন স্কুল-প্রাঙ্গনে প্রবেশ
করলেন, শিক্ষকদের চোখ-মুখ জুড়ে তখন আতঙ্কের ছাপ।
মার্কিন বিমান হামলার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। বিমান হামলার সাইরেনের জন্য সেদিন
সকালেও স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সাচিকো শুধুমাত্র তার নতুন শিক্ষকের সামনে
শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে পেরেছিল। এরপরই প্রিন্সিপ্যাল স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা
করেন। সাচিকোর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির স্বপ্ন সেখানেই মিলিয়ে যায়। পড়াশোনা শেখার
বদলে সে শিখেছিল আঙুল দিয়ে কান এবং চোখগুলো ঢেকে রাখতে। সেই সঙ্গে শিখেছিল বাইরে
থাকাকালে ‘টেকি’ (শত্রুপক্ষের বিমান)
শব্দটি শুনলে সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে শুয়ে পড়ার বিদ্যা!
যুদ্ধের
রাতগুলো ছিল এক একটা দুঃস্বপ্ন।
সাচিকোর মনে
আছে, বিমান হামলার সাইরেন বাজার
সঙ্গে সঙ্গেই গোটা পরিবারকে ঘুম থেকে তুলে বাবা পাহাড়ের বুকে তৈরি গুহাগুলোর দিকে
ছুটত। সাকামোতো সিমেট্রির কাছেই ছিল সেগুলো। ইচিরোর হাত ধরে সাচিকো ভেজা ঘাসের
মধ্য দিয়ে ছুটত। তার গলায় ঝোলানো ব্যাগে রাখা বিস্কুটগুলো বারবার বুকে এসে আঘাত
করত। গুহার প্রবেশপথে এসে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে যেত সাচিকো, গিয়েই উবু হয়ে বসে পড়ত। ভেজা খড়কুটো বিছানো মেঝের শীতল পরশ তাকে
শিহরিত করে তুলত। আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো গুহার উপর দিয়ে গর্জন করে উড়ে
যেত। ওদিকে গুহার ভিতরে সাচিকোর মাথার উপর তখন ভনভন করে উড়ত অজস্র মশা।
বোমারু
বিমানগুলোর গর্জন আর থামত না। দূরে কিছু মানুষের ছায়া নড়াচড়া দেখলেই সাচিকো দাঁতে
দাঁত চেপে থাকত। আকির সামনে বসে মিসা ফুঁপিয়ে কাঁদত। মায়ের কোলে তোশি জোরে জোরে
শ্বাস নিত। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে মিসা আর তোশির দিকে এগিয়ে দিত সাচিকো। একটা
সময় বি-২৯ বোমারু বিমানগুলোর ভয়ঙ্কর আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেত। শহরের লাউড
স্পিকারগুলো থেকে একটি সাইরেন বেজে উঠত। বিপদ কেটে গিয়েছে! আকি বাবা-মায়ের দিকে
তাকিয়ে থাকত। সাচিকো ইচিরোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিত। আপাতত বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ।
কী ভয়ঙ্কর
সেই জীবন!
কারেন
স্টেলসনের লেখা ‘সাচিকো, আ নাগাসাকি বোম্ব
সারভাইভার্স স্টোরি’— এক হিবাকুশার গল্প। পারমাণবিক বোমা
হামলার পর হিরোশিমা ও নাগাসাকির যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের বলা হয় হিবাকুশা। তবে তারা কেউই হিবাকুশা হতে চাননি, চেয়েছিলেন আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই
সুন্দর একটা জীবন কাটাতে। কিন্তু ফ্যাট ম্যান ও লিটল বয় নামে দুটি অভিশাপ তছনছ করে
দিয়েছিল তাদের সাজানো সংসার, সাজানো স্বপ্নসহ সবকিছুই। তেমনই একজন হিবাকুশা সাচিকো ইয়াসুই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছিল যার সর্বস্ব।
১৯৪৫-র ৬
আগস্ট।
রাত দুটো
বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বি-২৯ বোমারু বিমান এনোলা গে’র ককপিটে বসেছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল টিবেটস।
গত প্রায় এক বছর ধরে টিবেটসসহ আরও বেশ কয়েকজন পাইলট জাপানের উপর পারমাণবিক বোমাটি
নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।
এনোলা গে’র সঙ্গে আরও দু’টি প্লেনের
থাকার কথা। সেগুলো আরও আগেই রওনা হয়ে গিয়েছিল। তাদের একটির কাজ ছিল বিষ্ফোরণের ছবি
তোলা এবং অপরটির কাজ ছিল বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। কাঙ্ক্ষিত সঙ্কেত
পাওয়ার পরই এনোলা গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট্ট দ্বীপ টিনিয়ানের বুক থেকে
দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত হিরোশিমার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মাঝখানে ছিল প্রায় ২,৫২২ কিলোমিটার দূরত্ব। সঙ্গে ৪.৪ মেট্রিক টন ওজনের ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি
পারমাণবিক বোমা। যার সাঙ্কেতিক নাম ‘লিটল বয়’।
সকাল ৮টা ১৪
মিনিট। ওটা নদীর উপরে আইওয়া ব্রিজের দিকে নজর গেল এনোলা গে’র পাইলটের। অটোমেটিক কন্ট্রোল সুইচে চাপ দিলেন
তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ‘লিটল বয়’-র পতন
প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। হিরোশিমার দিকে তুমুল বেগে ধেয়ে এসেছিল ‘লিটল বয়’। আনুমানিক ১,৯০০ ফুট
উপরে বোমার ভিতরে থাকা গান মেকানিজম ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গেই নিউক্লিয়ার চেন
রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। যা থামানোর কোনও উপায় ছিল না। ১৫,০০০
টন টিএনটির (ট্রাইনাইট্রোটলুইন) সমতুল্য ক্ষমতা নিয়ে বিষ্ফোরিত হল লিটল বয়। বাতাসে
ছড়িয়ে পড়ল ভয়াবহ বিকিরণ। শক ওয়েভ ছড়িয়ে গেল সবদিকে। ৬ আগস্ট সকালের বোমা হামলায়
হিরোশিমা নগরীর ৯২ শতাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যায় প্রায় সত্তর হাজারের মতো
নাগরিক। আঘাত, দহন এবং বিকিরণজনিত অসুস্থতায় পরবর্তীতে মৃতের
সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়।
বিষ্ফোরণের
কথা টোকিওতে গিয়ে পৌঁছয়। জাপানের সম্রাট হিরোহিতো বুঝতে পারলেন না ঠিক কী করা
উচিত। ওই একই দিনে মার্কিন জনগণের কাছে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হিরোশিমায় পারমাণবিক
বোমা নিক্ষেপের কথা জানিয়ে বললেন, (জাপানের নেতারা) যদি এখনও আমাদের শর্ত মেনে না নেয়, তাহলে তাদের উপর আকাশ থেকে ধ্বংসের (বোমার)
বৃষ্টি নেমে আসবে, পৃথিবীর ইতিহাসে যা আগে কোনওদিনই দেখা যায়নি।
তিনদিন পর।
৯ আগস্ট সকাল। বি-২৯ বোমারু বিমান ‘বক্সকার’-র ককপিটে বসে ছিলেন মেজর চার্লস সোয়েনি।
প্লেনটিতে ছিল প্লুটোনিয়ামের তৈরি ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে একটি পারমাণবিক বোমা। যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল ২১,০০০ টন টিএনটির সমতুল্য। সোয়েনির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিল্পনগরী কোকুরা। যদি
কোনও কারণে কোকুরার মিশনটি ব্যর্থ হয়, তাহলে
তালিকায় পরের নামটিই ছিল নাগাসাকি। জাপানের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে উড়ে গেল বক্সকার।
আর ওদিকে স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ চালাল জাপান-নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুরিয়ায়।
নাগাসাকি কিংবা আমেরিকা— কোনও
অংশের মানুষই জানত না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে।
১৯৪৫-র ৯
আগস্ট।
সকালে সবে
মাত্র বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে চোখটা ভালোমতো রগড়ে নিল সাচিকো। জানালার বাইরে ঘুরঘুরে
পোকাগুলো শব্দ করছিল। অসুস্থ এক বন্ধুর খোঁজ নিতে বাবা তাড়াতাড়িই বের হয়ে
গিয়েছিলেন সেদিন। মা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। হাতের তালুতে গমের বল বানাচ্ছিলেন।
মাকে কেমন যেন আতঙ্কিত লাগছিল। কিছুক্ষণ পর মা ডাক দিলেন, ‘বাচ্চারা, এস, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’
সকাল ৭টা ৫০
মিনিট। হঠাৎ করে বিকট কোনও একটি শব্দ ঘুরঘুরে পোকাগুলোর কম্পনের আওয়াজকে ম্লান করে
দিল। মা মাথা তুলে চাইলেন।
‘বাচ্চারা, তাড়াতাড়ি’, এটুকু বলেই মা তোশিকে কোলে তুলে নিলেন। সাচিকো তার হুডটা খুঁজতে
দৌড় দিল। আকি মিসাকে তার হুড খুঁজে দিল। সাচিকোর হাতটা ধরল ইচিরো। থেমে থেমে বাজতে
থাকল সাইরেন।
সাচিকোর
পরিবার আবারও ছুট লাগাল পাহাড়ের বুকে তৈরি সেই গুহাগুলোর দিকে। মাথা নিচু করে
গুহার ভিতর ঢুকে স্যাঁতস্যাঁতে মাদুরের উপর বসে রইল সাচিকো। দূরের ছায়াগুলোর মধ্যে
সে শুধু তাদের বাড়ির আশেপাশে থাকা চারটি বাচ্চাকে চিনতে পারল। তিনটি মেয়ে এবং একটি
ছেলে।
সকাল ৮টা
বেজে ৩০ মিনিট। বিমান হামলার সাইরেন থেমে গেল। পরিচিত আরেকটি সাইরেন বেজে সবাইকে
বুঝিয়ে দিল, বিপদ কেটে গিয়েছে।
গুহা থেকে
বেরিয়ে এল সবাই। তোশির হাত ধরে রেখেছিলেন মা। ফের মুরগির ডিম খুঁজতে তিনি বেরিয়ে
পড়লেন। এক বন্ধুর সঙ্গে ঘুরঘুরে পোকা ধরতে চলে গেল ইচিরো। সেদিন সকালে আকাশে
সূর্যের দেখা মিলেছিল কিছুটা দেরি করেই। ঘুরঘুরে পোকাগুলো ফের শব্দ করতে লাগল।
মেঘগুলোও বয়ে যেতে লাগল। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা বেজে ৪৫ মিনিট।
বি-২৯
বোমারু বিমান বক্সকারকে নিয়ে কোকুরা শহরের উপর দিয়ে নিরাপদেই উড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন
সোয়েনি। সঙ্গে পারমাণবিক বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’। হিরোশিমার পর পারমাণবিক বোমা হামলার
টার্গেট নগরীর তালিকায় ছিল কোকুরার নাম। বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। শুরু হল ঘন মেঘের
চলাচলও। সেই মেঘরাশি সোয়েনির চোখ আবছা করে দিল। সোয়েনি কোকুরার উপর দিয়ে দ্বিতীয়বার
চক্কর দিলেন। জাপানি অ্যান্টিএয়ারক্রাফট গানগুলো থেকে ততক্ষণে গোলাগুলি শুরু হয়ে
গিয়েছিল। সোয়েনি তৃতীয়বার চক্কর দিলেন। বিমানের ক্রুরা শঙ্কিত হয়ে পড়ল। সকালে
উড্ডয়নের সময় ফুয়েল পাম্পটা ঠিকমতো কাজ করছিল না, প্রয়োজনের তুলনায় কম তেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সময়ও
ফুরিয়ে আসছিল বেশ দ্রুত।
দ্রুততার
সঙ্গে অবশিষ্ট জ্বালানী নিয়ে একটা হিসাব কষে ফেললেন সোয়েনি। তালিকায় থাকা পরবর্তী
নগরী নাগাসাকিতে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি তখনও ছিল। সোয়েনি প্লেন ঘুরিয়ে
নাগাসাকির পথ ধরলেন। সকাল ১১টা বাজার কয়েক সেকেন্ড পরই বক্সকার নীচের দিকে নামতে
শুরু করল। উপর থেকে নাগাসাকিকেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ নগরীটি
ঢেকে রেখেছিল।
বক্সকারের
টার্গেট ছিল পোতাশ্রয়ে থাকা মিতসুবিশি শিপইয়ার্ড। কিন্তু উপর থেকে সেটা তারা
ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ করেই একখণ্ড মেঘ সরে গেল। ফলে নাগাসাকির
ঘনবসতিপূর্ণ উরাকামি উপত্যকা বক্সকারের ক্রুদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। যা ছিলো
টার্গেট থেকে প্রায় ১ মাইল দূরে। চিৎকার করে উঠলেন সোয়েনি, ‘আমি খুঁজে পেয়েছি, আমি খুঁজে পেয়েছি’। এটুকু বলেই নিশানা ঠিক করে সুইচে চাপ দিলেন তিনি।
নাগাসাকির
উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেল ফ্যাট ম্যান।
সকাল ১১টা
বেজে ১ মিনিট। দশ বছর বয়সি মেয়েটি হঠাৎ করেই ভয়ে পাথরের মতো জমে গেল। ‘টেকি (শত্রুপক্ষের বিমান)’ বলে
চিৎকার করে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মাদুরের উপর উপুর হয়ে গেল সাচিকো। কানগুলো ঢেকে
এবং চোখগুলো বুজে রইল। সকাল ১১টা বেজে ২ মিনিট। ফ্যাট ম্যান বিষ্ফোরণের
অত্যুজ্জ্বল আলোতে, প্রচণ্ড শব্দে, ভয়াবহ বিষ্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে উঠল গোটা
নাগাসাকি নগরী। অদ্ভুত, চোখধাঁধানো এক আলো জ্বলে উঠেছিল আকাশজুড়ে। লাল, নীল, সবুজ- হরেক রকমের রঙ। প্রচণ্ড উত্তপ্ত, কানে তালা লাগিয়ে দেওয়া, ঘূর্ণিঝড়ের মতো শক্তিশালী বাতাস ধেয়ে এসেছিল।
বিষ্ফোরণে মাটি কেঁপে উঠেছিল। সাচিকোকে কে যেন শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল। পরক্ষণেই
আবার সজোরে ভূমিতে আছড়ে পড়েছিল সে।
পাথরের
টুকরো, ভাঙা টাইলস, গাছের শাখা-প্রশাখা, পাতা—
সবকিছু তার উপর একে একে পড়তে লাগল। ক্রমশ এগুলোর নিচে চাপা পড়তে
লাগল সে। নাকে-মুখে ধুলোবালি ঢুকে গিয়েছিল তার। বিষ্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র
৯০০ মিটার দূরে মাটিতে পড়ে কাঁপতে লাগল মেয়েটি।
বাতাসের
তোড়ে বৈদ্যুতিক তারগুলো ছিড়ে গিয়েছিল। দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল রাস্তায় থাকা গাড়িগুলো।
কাচ ভেঙে গিয়েছিল জানালার। কব্জা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল অনেক দরজা। উল্টে পড়েছিল অনেক
ঘরবাড়ি। ভাঙা কাচের টুকরাগুলো বাতাসে বুলেটের মতোই এদিক ওদিকে ছুটে যাচ্ছিল।
নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল উরাকামি ক্যাথেড্রাল।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল স্যানো মঠও। কর্পূর গাছগুলোর বাকল উঠে গিয়েছিল। অনেক গাছই উপড়ে
গিয়েছিল। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া গাছগুলোর দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছিল, কী ভয়াবহ ঝড়টাই না বয়ে গিয়েছে তাদের উপর দিয়ে।
স্যানো মঠের পাথুরে গেটটি ভারসাম্যহীনভাবে, পুড়ে যাওয়া একটি পা নিয়েই দাঁড়িয়েছিল। গান গাইতে থাকা ঘুরঘুরে
পোকাগুলোও যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল মুহূর্তে।
ওদিকে নাগাসাকির
আকাশে, প্রায় ৩.২
কিলোমিটার উপরে, ধীরে ধীরে জমাট বাধল একটি পারমাণবিক মেঘ। যা দেখতে ছিল অনেকটাই
বৃহদাকায় মাশরুমের মতোই। খানিক বাদেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছাদের টাইলসগুলো
পুড়ে গেল। ল্যাম্পপোস্টগুলো গলে নুয়ে পড়ল। রাস্তাগুলো ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকল।
একসময় সেই মেঘ পুরো আকাশটাকেই ছেয়ে ফেলল। ধূসররঙা, মোটা কম্বলের মতো ঢেকে দিল সূর্যটাকে। নাগাসাকির
বুকে ভরদুপুরে নেমে এল রাতের অন্ধকার। পাক খেতে খেতে সেই আগুনে মেঘটি আরও উপরের
দিকে উঠতে লাগল। যেন এটা জীবন্ত কোনও এক সত্ত্বা। মাত্র ০.৭ গ্রাম ইউরেনিয়ামের
কারণেই সবচেয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় বলে জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এক ডলারের নোটের
চেয়েও হালকা একটা পদার্থের কারণে এক ধাক্কায় প্রাণ হারান ৮০ হাজার মানুষ।
এরপর তছনছ
হয়ে যাওয়া জীবন নিয়ে সাচিকোর কেটে গিয়েছে কয়েক দশক। বদলে গিয়েছে গোটা দুনিয়া।
১৯৯৫ সালের
৯ আগস্টের সন্ধ্যা। নাগাসাকি পিস পার্কে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো ততক্ষণে শেষ হয়ে
গিয়েছে। একটি হোটেলের লবিতে একদল শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সামনে দাঁড়িয়ে
সাচিকো ইয়াসুই। সামনে ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে আকি, ইচিরো, মিসা, তোশি এবং সেই সঙ্গে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল সাচিকোর। সেদিন
ডিমের গল্পটা দিয়েই শুরু হয়েছিল পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি।
‘আমার
বয়স তখন ছ’বছর। আমার অন্য চার ভাই-বোন আকি, ইচিরো, মিসা আর তোশি। ছোট্ট তোশি প্রতিদিনই ডিম খেত। কিন্তু আমাদের
মুরগিটা সেদিন কোনও ডিম পাড়েনি। মা আর তোশি মিলে অনেকক্ষণ ডিম খুঁজেছিলেন। পাননি।
আমরা খোলা আকাশের নিচে কাদামাটির দিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ করেই উপরে বি-২৯ বিমানের
ইঞ্জিন গর্জে উঠল। মেঘগুলো সরে গেল। পিকাডন! (জাপানি এই শব্দটি দিয়ে মূলত
পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণকেই বোঝানো হয়ে থাকে। ‘পিকা’ অর্থ ‘অত্যুজ্জ্বল আলো’ এবং ‘ডন’ অর্থ ‘বিস্ফোরণ’।) অসহ্য
যন্ত্রণা নিয়ে তোশি, আকি, ইচিরো— ওরা
সবাই চলে গিয়েছে। সেই সঙ্গে চলে গিয়েছে মিসাও। আমার বাবা। আমার মা। আমিও প্রায়
মরেই গিয়েছিলাম।’ এটুকু বলে থেমে গিয়েছিলেন সাচিকো। শেষে
শুধু বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা যেন তোমাদের সঙ্গে কোনওদিন না হয়।’
ঘুরঘুরে পোকারা
মাটির নিচে অনেকদিন সময় কাটায়। মাটির নিচে সুরক্ষিত অবস্থায় গাছের শিকড়ের শীর্ষভাগ
থেকে পুষ্টিকর দ্রব্য শুষে নেয় তারা। কালচক্রে মাটির নীচে থেকে উঠে এসে গাছের ডালে
জায়গা করে নেয় তারা। সূর্যের আলোতে পাতলা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে তারা। ডানাটাকে
শুকিয়ে নেয় আর এরপরই শুরু হয়ে যায় তাদের গ্রীষ্মের গান। পারমাণবিক বোমা হামলার
দুঃসহ স্মৃতি, নিজের ভিতরে চেপে রাখা কষ্ট। এই সবকিছু নিয়েই সাচিকো কথা বলা বন্ধ
করে দিয়েছিলেন। ঘুরঘুরে পোকার মতো সে-ও পুষ্টিদ্রব্য শোষণ করতো বাবার জ্ঞানের শিকড়
থেকে। হেলেন কেলারের সাহস থেকে। এবং ভালোবাসা, অহিংসা ও ন্যায়বিচারের প্রতি গান্ধীজি ও মার্টিন লুথার কিং
জুনিয়রের বিশ্বাস থেকে। ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্টের পর থেকে সাচিকো ইয়াসুই জাপান ছুটে
বেড়িয়েছেন। গিয়েছেন কানাডা এবং আমেরিকাতেও। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাথে নিজের
অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তিনি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছেন, বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দিয়েছেন সাক্ষাৎকার।
সাচিকোর জীবনটা যেন ‘ওলিয়েন্ডার’-এর মতো।
আপনি জানেন
তো, পরমাণু হামলার পর হিরোশিমায়
প্রথম ফুটেছিল ওলিয়েন্ডার (করবী) ফুল। গত শতাব্দীর কলঙ্ক ঢেকে দিয়েছিল যে ফুল!
No comments:
Post a Comment