বদলে
যাওয়া ক্রিকেট
একসময় ব্যাট
আর লাল বলের মায়ায় আটকে গিয়েছিলেন অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ‘নেভিল কার্ডাস’।
তাঁর ‘ক্রিকেট সমগ্র’ বইয়ে কাব্যময় রোমান্টিক ভাষায় খেলার
ছবি এঁকে গিয়েছেন। গোটা বইজুড়ে গত ষাটের দশকের ক্রিকেট উপভোগের রমণীয় প্রতিবেদন। যে
বই পড়তে গিয়ে মনে হতে পারে, ক্রিকেট কেবল এ দেশে সবার খেলা হয়ে ওঠেনি, ক্রমে
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত আর ইন্ডিয়ার একযোগে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অস্ত্র হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে যখন কপিল দেবের হাতে ক্রিকেট-বিশ্বকাপ ওঠার পর এই খেলাকে ঘিরে
গণ-হিস্টিরিয়া, নব্বই-পরবর্তী পর্বে ক্রিকেট বিনোদনে পুঁজির
মারকাটারি অনুপ্রবেশ। তবুও সেই সময় ক্রিকেটের সঙ্গে এখনকার বাণিজ্যকণ্টকিত
বিনোদনের দূরত্ব ছিল কয়েক আলোকবর্ষ।
কথাসাহিত্যিক শঙ্করের মতো বাঙালিরা শুরুতে মনে করতেন: ‘ক্রিকেটটা কোনও
খেলা নয়, কলোনিয়াল কালচারের একটি বর্বর প্রকাশ মাত্র। ফলে দু’জন লোক লাঠি হাতে সারাদিন খাটায় একাদশ নির্দোষ মানুষকে।’ তবুও একদিকে বাঙালিরা ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছে, অন্যদিকে
মজেছে ক্রিকেট রসে। ধীরে-ধীরে বাঙালিরা আত্মস্থ করে নিয়েছেন ‘ক্রিকেট-কালচার’কে। বিশ্বায়নের হাওয়ায় আজ বাঙালির
জীবনচর্চার সঙ্গে বদলে গিয়েছে সেই ক্রিকেটও।
‘হোয়াট ডু দে নো অব ক্রিকেট হু ওনলি ক্রিকেট নো!’ তারা ক্রিকেটের কী
বোঝে, যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে! ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত বই ‘বিয়ন্ড
দ্য বাউন্ডারি’-তে লিখেছিলেন সিএলআর জেমস। যিনি একাধারে
ইতিহাসবিদ, ক্যারিবিয়ান ফেডারেশনের প্রবক্তা এবং ক্রিকেট-সাংবাদিক।
১৯৬০ সালে যখন ত্রিনিদাদ ও জামাইকার শত্রুতার কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাজনৈতিক মিলন
ভাঙতে শুরু করেছে, জেমস তাঁর ‘শত্রু’ দেশ
জামাইকার ক্রিকেটার ফ্রাঙ্ক ওরেলকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন করার
জন্য অক্লান্ত লেখালিখি শুরু করলেন। এর আগে শুধুমাত্র সাদা মানুষ ক্যাপ্টেন হতেন,
কিন্তু জেমসের একক চেষ্টায় ওরেল প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন
হলেন। তারপরে অস্ট্রেলিয়া সফরে চূড়ান্ত সাফল্য। দু’বছর পরে,
যখন ফেডারেশন অতীতমাত্র, ত্রিনিদাদের জেমস লিখলেন, জামাইকার ওরেলের জন্যই তাঁর দেশ বিশ্ব-দরবারে স্থান পেয়েছে। জেমসের এই কথায়,
রাজনৈতিক হিংসার ছক গুলিয়ে যায়। কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিতে তৈরি বন্ধুত্বের
সেতু সহজে ভাঙে না। একসময় এটাই ছিল ক্রিকেটের পবিত্রতা।
আজ প্রশ্ন ওঠে, যে ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার সাদা-শ্বেতশুভ্র পবিত্র
ক্রীড়া হিসেবে ক্রিকেটের প্রচলন, তা কি আর পবিত্র আছে? ক্রিকেট
যে তার কথিত ভদ্র চরিত্র হারিয়ে ‘নষ্ট’ হতে চলেছে, সেই ভবিষ্যৎবাণী ২০০৭ সালেই করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার
প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী কোচ জন মার্শাল বুকানন তাঁর ‘দ্য
ফিউচার অব ক্রিকেট: রাইজ অব টি-টোয়েন্টি’তে লিখেছেন, ‘হোয়েন
মানি টকস, ক্রিকেট লিসেন্স। হাউ বিগ মানি, অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস অ্যান্ড প্লেয়ারস আর পাওয়ারিং আ নিউ ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড।’
সত্যিই আজ ক্রিকেট শুধু ২২ গজের খেলা নয়। এই খেলার ভয়াবহ প্রতীকী অর্থ খাড়া হয়ে গিয়েছে।
ক্রিকেট এখন জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। ক্রিকেট এখন জাতির পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার।
ক্রিকেট পুঁজিবাদের সবচেয়ে রমরমা ব্যবসা। ক্রিকেট আজ অক্ষম আত্মতৃপ্তিতে ভোগা
হুজুগে জনতার স্বল্পায়ু গৌরব! তাই ক্রিকেটকে ঘিরে দেখি পুঁজিতান্ত্রিক ছকের
রাজনীতি। আর রাজনীতির মাঠে শুনি খেলার ময়দানের মতো হুঙ্কার: ‘খেলা হবে’!
১৭৮৭ সালে মেরিলবোন ক্রিকেট ক্লাব থেকে যাত্রা শুরু করে আজকে ২০২৩
সালের ক্রিকেটে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। চারদিকে তাক করা ক্যামেরাগুলি এখন ব্যাটসম্যানের
ভাগ্য নির্ধারণ করে। টিভি থাকে আম্পায়ারের ভূমিকায়। সংবাদমাধ্যম খেলার প্রতিটি
মুহূর্ত পৌঁছে দেয় মানুষের চোখ-কানের চাহিদা মতো। খেলার প্রতিটি মুহূর্তে এখন
দর্শকরা যেন ক্রিকেটারের হেলমেটের ঠিক চারদিকে জড়ো হয়ে বসে থাকেন। এখন পিচের
চারদিকে অন্তত ৩০টি ক্যামেরায় দর্শকের চোখ। স্টাম্পের গায়েও বসানো মিনিয়েচার
ক্যামেরা। ব্লাইন্ড স্পট বলে একচুল জায়গাও নেই। ১৯৯২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আর
ভারতের মধ্যে টেস্ট সিরিজে রানআউট নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রথম টেলিভিশনকে থার্ড
আম্পায়ার করা হয়েছিল। এখন স্টাম্পিং, এলবিডব্লু, ক্যাচ
বা ওয়াইড— সবকিছুরই রায় দেয় প্রযুক্তি। দর্শক এখন ব্যাট হাতে
স্ট্যাম্প আড়াল করে নিজেই যেন ব্যাটসম্যানের জায়গায় দাঁড়িয়ে। সামনে বিশ্বসেরা বোলার,
তাঁকে মোকাবিলা করবেন এবার দর্শক নিজেই! টেলিভিশনের সামনে বসে তো
বটেই, চাইলে হাতের মুঠোয় ফোনে ক্রিকেটের অ্যাপে। সোজা কথায়,
ক্রিকেট আগে ছিল ‘ওয়ান ডাইমেনশনাল’ বা একমাত্রিক। আর এখন তা ‘মাল্টিডাইমেনশনাল’। অর্থাৎ ক্রিকেট এখন বহুমাত্রিকতা নিয়ে উপস্থিত।
ক্রিকেট একসময় ছিল ধৈর্যশীল ও তারিয়ে তারিয়ে আনন্দ উপভোগের খেলা। গোটা
একটা দিন শেষে উত্তেজনাকর কিছু মুহূর্তের স্মৃতি নিয়ে তৃপ্ত হতেন দর্শক। প্রিয় দল
জিতে যাওয়ার বা হারার আনন্দ-বেদনা দীর্ঘদিন তাঁর মনে উঁকি দিত। কিন্তু এখন ঘণ্টা
তিনেকের মধ্যে দর্শকের শরীরে এন্ডোরফিন হরমোন তৈরি করে, যা তাঁকে উত্তেজিত করে। আনন্দ-বেদনায়
ভাসিয়ে তাঁকে ঘণ্টা খানেকের জন্য তৃপ্ত করার প্রক্রিয়া সফলভাবে চালু হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন
ধরে ক্রিকেটপ্রেমীদের বুঁদ হয়ে থাকা সিরিজ আর ওয়ানডে ফরম্যাটের জায়গায় এখন
টি-টোয়েন্টির পতাকা উড়ছে। যদিও বিশ্বকাপের আয়োজনের খাতিরে ওয়ানডে ফরম্যাটকেই এখনও
ধরে রাখা হয়েছে, কিন্তু দর্শকের মনে আশঙ্কা জাগতেই পারে, এই ওয়ানডে
ফরম্যাটের স্থায়িত্ব আর কতদিন?
ক্রিকেটে এই পরিবর্তন এসেছে কি কেবল দর্শকের কথা ভেবে? দর্শক আর
প্রযুক্তি হয়তো অনুঘটকের কাজ করে, তবে মূলে আছে অর্থের
লেনদেন। লক্ষ্য করবেন, প্রযুক্তি যখন উৎকর্ষের দিকে, ঠিক
তখনই ভারতের আইপিএল আর অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ (বিবিএল) টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে
শুরু হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম ক্রিকেট খেলাকে তখন গাড়ির রেস ‘ফর্মুলা
ওয়ান’-এর মতো করে প্রচার শুরু করেছিল। দ্রুত ফক্স স্পোর্টস আর চ্যানেল নাইন মনোযোগ
বাড়াল ওই খেলার দিকে। শুরু হল ক্রিকেটে মনোমুগ্ধকর উপস্থাপন, শত ক্যামেরার ফ্লুইড ফ্রেমিং, ঝকমকে গ্রাফিক্স,
হাই ইনটেনসিটি, র্যাপিড কাটস আর হাইপারবোলিক
ধারাবিবরণী। ক্রিকেটের চেহারায় যে চাকচিক্য এসে লাগল আর দিনের পর দিন আনকোরা
প্রযুক্তিনির্ভর চোখ ঝলসানো পরিবর্তনের আঁচড় সেখানে পড়তে লাগল, তাতে ক্রিকেট এখন কেবল সুস্থিরভাবে মাপজোখ করে বল-ব্যাট করার খেলা নয়। বরং
অকশন, টাকার লেনদেন আর গ্ল্যামারের আখড়া।
আপনি বলবেন, একসময় যে দর্শক চার-পাঁচ দিন ধরে টেস্ট ম্যাচ দেখতেন, ওয়ানডে ম্যাচ
দেখবেন বলে আটঘাট বেঁধে বসতেন, তাঁর এখন ততটা সময় কোথায়!
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, হাজার অনিশ্চয়তা আর সামাজিক চাপে সবার উপরে ওঠার প্রতিযোগিতা
রয়েছে, সেখানে ক্রিকেটের জন্য এতটা সময় দেওয়া অসম্ভব। এখন
মানুষ খোঁজে শর্টকাট রাস্তা। তাতে ক্রিকেটার আর আয়োজকদের লাভও অনেক বেশি। তাই
অকশন আর সংবাদমাধ্যমে প্রচারের জন্য বিক্রিসহ টাকার ছড়াছড়ি অনেক বেশি। ইউনিক
টেলিভিশনের তথ্যানুযায়ী, প্রথম আইপিএল দেখেছিলেন ১০২ মিলিয়ন
মানুষ, সেখানে দশম আয়োজন দেখেন ৪০০ মিলিয়ন। আর ১৩তম বারের
প্রথম এক সপ্তাহেই দেখেছিলেন ২৬৮ মিলিয়ন দর্শক, যা ক্রিকেটের
জন্মস্থান ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার চার গুণ।
তবু শুরুর দিকে বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন, এ এক হঠাৎ ফ্যাশন, যাকে বলে ‘ফ্যাড’, এ রকম জিনিস
হুট করেই আসে আবার হুট করেই চলে যায়। কিংবদন্তি বোলার মাইকেল হোল্ডিং বিস্ময়
প্রকাশ করেছিলেন, এটা আবার ক্রিকেট নাকি! এ তো মনে হয়
চিরাচরিত ক্রিকেট আর নতুন প্রজন্মের চাহিদার মাঝামাঝি ভারসাম্য বজায় রাখার এক
কায়দা। অনেকেই বলেছিলেন, ওয়ানডে আর টেস্ট খেলার সময়ে
ক্রিকেটারদের মনে জেগে ওঠে দেশপ্রেমের গর্ব, টি-টোয়েন্টিতে
একমাত্র থাকে টাকা আয়ের লক্ষ্য। ক্রিকেটাররা এই ফরম্যাটে খেলতে খেলতে খেলাই ভুলে
যাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, আইসিসি কোন ফরম্যাট চায়। সাম্প্রতিক হিসেবটা বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তারা টি-টোয়েন্টির আয়োজন করেছে ৮৬৮টি, টেস্ট ১২১ আর ওয়ানডে ২৪৬। যার অর্থ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উজ্জ্বল
ভবিষ্যৎ। কিন্তু তাতে ওয়ানডে বা টেস্টে নাটকীয়তা কিংবা শেষ মুহূর্তে পট আমূল বদলে
যাওয়ার সেইসব গল্পের স্বাদ কি মেলে?
শেষ বিশ্বকাপের ফাইনালের কথাই ধরুন। ট্রেন্ট বোল্ট ক্যাচ ফেলে দিলেন, বেন স্টোকস যখন
স্ট্যাম্পের জন্য ক্রিজে হুড়মুড় করে বল ছুড়লেন, ব্যাটে লেগে
হল চার। সুপার ওভারের শেষ বলেও রানের নিষ্পত্তি হল না। গাপটিলের রানআউটের পর
বাটলারের উদ্দাম ছুট। আর তারপর বাউন্ডারির উপর ভিত্তি করে ইংল্যান্ডের হাতে ট্রফি
ওঠা। সেই উত্তেজনা কী সহজে ভোলা যায়?
স্কোরবোর্ডকে গাধা বলেছিলেন ‘ক্রিকেট সাহিত্যিক’ নেভিল কার্ডাস। বলেছিলেন, ‘লোকে মোটেই
স্কোর আর ফলাফল মনে রাখে না, মনে রাখে মানুষগুলিকে।’ আপনিই বলুন,
প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা ক’জনের মনে আছে?