Tuesday, July 2, 2024

 


বদলে যাওয়া ক্রিকেট

একসময় ব্যাট আর লাল বলের মায়ায় আটকে গিয়েছিলেন অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। হয়ে উঠেছিলেন বাংলার নেভিল কার্ডাস

তাঁর ক্রিকেট সমগ্রবইয়ে কাব্যময় রোমান্টিক ভাষায় খেলার ছবি এঁকে গিয়েছেন। গোটা বইজুড়ে গত ষাটের দশকের ক্রিকেট উপভোগের রমণীয় প্রতিবেদন। যে বই পড়তে গিয়ে মনে হতে পারে, ক্রিকেট কেবল এ দেশে সবার খেলা হয়ে ওঠেনি, ক্রমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত আর ইন্ডিয়ার একযোগে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অস্ত্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যখন কপিল দেবের হাতে ক্রিকেট-বিশ্বকাপ ওঠার পর এই খেলাকে ঘিরে গণ-হিস্টিরিয়া, নব্বই-পরবর্তী পর্বে ক্রিকেট বিনোদনে পুঁজির মারকাটারি অনুপ্রবেশ। তবুও সেই সময় ক্রিকেটের সঙ্গে এখনকার বাণিজ্যকণ্টকিত বিনোদনের দূরত্ব ছিল কয়েক আলোকবর্ষ।

কথাসাহিত্যিক শঙ্করের মতো বাঙালিরা শুরুতে মনে করতেন: ক্রিকেটটা কোনও খেলা নয়, কলোনিয়াল কালচারের একটি বর্বর প্রকাশ মাত্র। ফলে দুজন লোক লাঠি হাতে সারাদিন খাটায় একাদশ নির্দোষ মানুষকে।তবুও একদিকে বাঙালিরা ইংরেজ খেদাও আন্দোলন করেছে, অন্যদিকে মজেছে ক্রিকেট রসে। ধীরে-ধীরে বাঙালিরা আত্মস্থ করে নিয়েছেন ক্রিকেট-কালচারকে। বিশ্বায়নের হাওয়ায় আজ বাঙালির জীবনচর্চার সঙ্গে বদলে গিয়েছে সেই ক্রিকেটও।

‘হোয়াট ডু দে নো অব ক্রিকেট হু ওনলি ক্রিকেট নো!’ তারা ক্রিকেটের কী বোঝে, যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে! ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত বই বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি-তে লিখেছিলেন সিএলআর জেমস। যিনি একাধারে ইতিহাসবিদ, ক্যারিবিয়ান ফেডারেশনের প্রবক্তা এবং ক্রিকেট-সাংবাদিক। ১৯৬০ সালে যখন ত্রিনিদাদ ও জামাইকার শত্রুতার কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাজনৈতিক মিলন ভাঙতে শুরু করেছে, জেমস তাঁর শত্রুদেশ জামাইকার ক্রিকেটার ফ্রাঙ্ক ওরেলকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন করার জন্য অক্লান্ত লেখালিখি শুরু করলেন। এর আগে শুধুমাত্র সাদা মানুষ ক্যাপ্টেন হতেন, কিন্তু জেমসের একক চেষ্টায় ওরেল প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন হলেন। তারপরে অস্ট্রেলিয়া সফরে চূড়ান্ত সাফল্য। দুবছর পরে, যখন ফেডারেশন অতীতমাত্র, ত্রিনিদাদের জেমস লিখলেন, জামাইকার ওরেলের জন্যই তাঁর দেশ বিশ্ব-দরবারে স্থান পেয়েছে। জেমসের এই কথায়, রাজনৈতিক হিংসার ছক গুলিয়ে যায়। কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিতে তৈরি বন্ধুত্বের সেতু সহজে ভাঙে না। একসময় এটাই ছিল ক্রিকেটের পবিত্রতা।

আজ প্রশ্ন ওঠে, যে ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার সাদা-শ্বেতশুভ্র পবিত্র ক্রীড়া হিসেবে ক্রিকেটের প্রচলন, তা কি আর পবিত্র আছে? ক্রিকেট যে তার কথিত ভদ্র চরিত্র হারিয়ে নষ্টহতে চলেছে, সেই ভবিষ্যৎবাণী ২০০৭ সালেই করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন বিশ্বকাপজয়ী কোচ জন মার্শাল বুকানন তাঁর দ্য ফিউচার অব ক্রিকেট: রাইজ অব টি-টোয়েন্টিতে লিখেছেন, ‘হোয়েন মানি টকস, ক্রিকেট লিসেন্স। হাউ বিগ মানি, অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস অ্যান্ড প্লেয়ারস আর পাওয়ারিং আ নিউ ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড।’ সত্যিই আজ ক্রিকেট শুধু ২২ গজের খেলা নয়। এই খেলার ভয়াবহ প্রতীকী অর্থ খাড়া হয়ে গিয়েছে। ক্রিকেট এখন জাতীয় মর্যাদার প্রতীক। ক্রিকেট এখন জাতির পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার। ক্রিকেট পুঁজিবাদের সবচেয়ে রমরমা ব্যবসা। ক্রিকেট আজ অক্ষম আত্মতৃপ্তিতে ভোগা হুজুগে জনতার স্বল্পায়ু গৌরব! তাই ক্রিকেটকে ঘিরে দেখি পুঁজিতান্ত্রিক ছকের রাজনীতি। আর রাজনীতির মাঠে শুনি খেলার ময়দানের মতো হুঙ্কার: খেলা হবে’!

১৭৮৭ সালে মেরিলবোন ক্রিকেট ক্লাব থেকে যাত্রা শুরু করে আজকে ২০২৩ সালের ক্রিকেটে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। চারদিকে তাক করা ক্যামেরাগুলি এখন ব্যাটসম্যানের ভাগ্য নির্ধারণ করে। টিভি থাকে আম্পায়ারের ভূমিকায়। সংবাদমাধ্যম খেলার প্রতিটি মুহূর্ত পৌঁছে দেয় মানুষের চোখ-কানের চাহিদা মতো। খেলার প্রতিটি মুহূর্তে এখন দর্শকরা যেন ক্রিকেটারের হেলমেটের ঠিক চারদিকে জড়ো হয়ে বসে থাকেন। এখন পিচের চারদিকে অন্তত ৩০টি ক্যামেরায় দর্শকের চোখ। স্টাম্পের গায়েও বসানো মিনিয়েচার ক্যামেরা। ব্লাইন্ড স্পট বলে একচুল জায়গাও নেই। ১৯৯২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতের মধ্যে টেস্ট সিরিজে রানআউট নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রথম টেলিভিশনকে থার্ড আম্পায়ার করা হয়েছিল। এখন স্টাম্পিং, এলবিডব্লু, ক্যাচ বা ওয়াইড সবকিছুরই রায় দেয় প্রযুক্তি। দর্শক এখন ব্যাট হাতে স্ট্যাম্প আড়াল করে নিজেই যেন ব্যাটসম্যানের জায়গায় দাঁড়িয়ে। সামনে বিশ্বসেরা বোলার, তাঁকে মোকাবিলা করবেন এবার দর্শক নিজেই! টেলিভিশনের সামনে বসে তো বটেই, চাইলে হাতের মুঠোয় ফোনে ক্রিকেটের অ্যাপে। সোজা কথায়, ক্রিকেট আগে ছিল ওয়ান ডাইমেনশনালবা একমাত্রিক। আর এখন তা মাল্টিডাইমেনশনাল। অর্থাৎ ক্রিকেট এখন বহুমাত্রিকতা নিয়ে উপস্থিত।

ক্রিকেট একসময় ছিল ধৈর্যশীল ও তারিয়ে তারিয়ে আনন্দ উপভোগের খেলা। গোটা একটা দিন শেষে উত্তেজনাকর কিছু মুহূর্তের স্মৃতি নিয়ে তৃপ্ত হতেন দর্শক। প্রিয় দল জিতে যাওয়ার বা হারার আনন্দ-বেদনা দীর্ঘদিন তাঁর মনে উঁকি দিত। কিন্তু এখন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে দর্শকের শরীরে এন্ডোরফিন হরমোন তৈরি করে, যা তাঁকে উত্তেজিত করে। আনন্দ-বেদনায় ভাসিয়ে তাঁকে ঘণ্টা খানেকের জন্য তৃপ্ত করার প্রক্রিয়া সফলভাবে চালু হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেটপ্রেমীদের বুঁদ হয়ে থাকা সিরিজ আর ওয়ানডে ফরম্যাটের জায়গায় এখন টি-টোয়েন্টির পতাকা উড়ছে। যদিও বিশ্বকাপের আয়োজনের খাতিরে ওয়ানডে ফরম্যাটকেই এখনও ধরে রাখা হয়েছে, কিন্তু দর্শকের মনে আশঙ্কা জাগতেই পারে, এই ওয়ানডে ফরম্যাটের স্থায়িত্ব আর কতদিন?

ক্রিকেটে এই পরিবর্তন এসেছে কি কেবল দর্শকের কথা ভেবে? দর্শক আর প্রযুক্তি হয়তো অনুঘটকের কাজ করে, তবে মূলে আছে অর্থের লেনদেন। লক্ষ্য করবেন, প্রযুক্তি যখন উৎকর্ষের দিকে, ঠিক তখনই ভারতের আইপিএল আর অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ (বিবিএল) টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে শুরু হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম ক্রিকেট খেলাকে তখন গাড়ির রেস ‘ফর্মুলা ওয়ান’-এর মতো করে প্রচার শুরু করেছিল। দ্রুত ফক্স স্পোর্টস আর চ্যানেল নাইন মনোযোগ বাড়াল ওই খেলার দিকে। শুরু হল ক্রিকেটে মনোমুগ্ধকর উপস্থাপন, শত ক্যামেরার ফ্লুইড ফ্রেমিং, ঝকমকে গ্রাফিক্স, হাই ইনটেনসিটি, র‌্যাপিড কাটস আর হাইপারবোলিক ধারাবিবরণী। ক্রিকেটের চেহারায় যে চাকচিক্য এসে লাগল আর দিনের পর দিন আনকোরা প্রযুক্তিনির্ভর চোখ ঝলসানো পরিবর্তনের আঁচড় সেখানে পড়তে লাগল, তাতে ক্রিকেট এখন কেবল সুস্থিরভাবে মাপজোখ করে বল-ব্যাট করার খেলা নয়। বরং অকশন, টাকার লেনদেন আর গ্ল্যামারের আখড়া।

আপনি বলবেন, একসময় যে দর্শক চার-পাঁচ দিন ধরে টেস্ট ম্যাচ দেখতেন, ওয়ানডে ম্যাচ দেখবেন বলে আটঘাট বেঁধে বসতেন, তাঁর এখন ততটা সময় কোথায়! অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, হাজার অনিশ্চয়তা আর সামাজিক চাপে সবার উপরে ওঠার প্রতিযোগিতা রয়েছে, সেখানে ক্রিকেটের জন্য এতটা সময় দেওয়া অসম্ভব। এখন মানুষ খোঁজে শর্টকাট রাস্তা। তাতে ক্রিকেটার আর আয়োজকদের লাভও অনেক বেশি। তাই অকশন আর সংবাদমাধ্যমে প্রচারের জন্য বিক্রিসহ টাকার ছড়াছড়ি অনেক বেশি। ইউনিক টেলিভিশনের তথ্যানুযায়ী, প্রথম আইপিএল দেখেছিলেন ১০২ মিলিয়ন মানুষ, সেখানে দশম আয়োজন দেখেন ৪০০ মিলিয়ন। আর ১৩তম বারের প্রথম এক সপ্তাহেই দেখেছিলেন ২৬৮ মিলিয়ন দর্শক, যা ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার চার গুণ।

তবু শুরুর দিকে বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন, এ এক হঠাৎ ফ্যাশন, যাকে বলে ফ্যাড’, এ রকম জিনিস হুট করেই আসে আবার হুট করেই চলে যায়। কিংবদন্তি বোলার মাইকেল হোল্ডিং বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, এটা আবার ক্রিকেট নাকি! এ তো মনে হয় চিরাচরিত ক্রিকেট আর নতুন প্রজন্মের চাহিদার মাঝামাঝি ভারসাম্য বজায় রাখার এক কায়দা। অনেকেই বলেছিলেন, ওয়ানডে আর টেস্ট খেলার সময়ে ক্রিকেটারদের মনে জেগে ওঠে দেশপ্রেমের গর্ব, টি-টোয়েন্টিতে একমাত্র থাকে টাকা আয়ের লক্ষ্য। ক্রিকেটাররা এই ফরম্যাটে খেলতে খেলতে খেলাই ভুলে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, আইসিসি কোন ফরম্যাট চায়। সাম্প্রতিক হিসেবটা বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তারা টি-টোয়েন্টির আয়োজন করেছে ৮৬৮টি, টেস্ট ১২১ আর ওয়ানডে ২৪৬। যার অর্থ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্তু তাতে ওয়ানডে বা টেস্টে নাটকীয়তা কিংবা শেষ মুহূর্তে পট আমূল বদলে যাওয়ার সেইসব গল্পের স্বাদ কি মেলে?

শেষ বিশ্বকাপের ফাইনালের কথাই ধরুন। ট্রেন্ট বোল্ট ক্যাচ ফেলে দিলেন, বেন স্টোকস যখন স্ট্যাম্পের জন্য ক্রিজে হুড়মুড় করে বল ছুড়লেন, ব্যাটে লেগে হল চার। সুপার ওভারের শেষ বলেও রানের নিষ্পত্তি হল না। গাপটিলের রানআউটের পর বাটলারের উদ্দাম ছুট। আর তারপর বাউন্ডারির উপর ভিত্তি করে ইংল্যান্ডের হাতে ট্রফি ওঠা। সেই উত্তেজনা কী সহজে ভোলা যায়?

স্কোরবোর্ডকে গাধা বলেছিলেন ‘ক্রিকেট সাহিত্যিক’ নেভিল কার্ডাস। বলেছিলেন, ‘লোকে মোটেই স্কোর আর ফলাফল মনে রাখে না, মনে রাখে মানুষগুলিকে।’ আপনিই বলুন, প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা ক’জনের মনে আছে?

সাচিকোর যন্ত্রণা!

আগস্টের ৬ তারিখটি ছিল অন্য আর আট-দশটা উষ্ণ, আর্দ্র গ্রীষ্মের দিনের মতোই। দরদর করে ঘামছিল মেয়েটি। তার পরনের কাপড়গুলোও ঘামে ভিজে একাকার। জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সাচিকো।

সাকামোতো ইন্টারন্যাশনাল সিমেট্রি পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করল। এগতে থাকল স্যানো শিন্তো মঠের সংকীর্ণ রাস্তা ধরে, কর্পূর গাছগুলোর দিকে। গাছের নীচটা কিছুটা ঠান্ডাই হবে। সূর্যের উত্তাপ ঝলসে দিচ্ছিল সাচিকোকে। সাকামোতো সিমেট্রি, স্যানো শিন্তো মঠ এবং পুরনো কর্পূর গাছগুলোকেও। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছিল উরাকামি উপত্যকার কাঠের বাড়িগুলোর ছাদের ধূসর-রঙা টাইলসগুলোর উপর। নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজেও একই অবস্থা। পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে জাপানকে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার পথিকৃৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই কলেজটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। উত্তপ্ত হচ্ছিল এশিয়ার সর্ববৃহৎ চার্চ হিসেবে খ্যাত উরাকামি ক্যাথেড্রাল এবং ছোট্ট দেজিমা দ্বীপটি। যেখানে একসময় পা দিয়েছিল পর্তুগিজ বণিকরা। যখন জাপানের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তখনও নাগাসাকির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল পাশ্চাত্য দুনিয়ার। এই নাগাসাকিতেই প্রাচ্যের সঙ্গে মিলন ঘটেছিল পাশ্চাত্যের।

যুদ্ধের ফলে নাগাসাকিরও তখন জাপানের অন্য আর আট-দশটা শহরের মতো দুঃসহ অবস্থা। খেলার মাঠ এবং পার্কগুলোতেও মিষ্টি আলু ও কুমড়োর মতো বিভিন্ন ধরনের সব্জির চাষ করা হয়েছিল। আশপাশের পাহাড়গুলোতে বিমান হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছিল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। বোমা হামলার ফলে উৎপন্ন আগুনের হাত থেকে বাঁচতে তৈরি করা হয়েছিল জলের ট্যাঙ্ক। মার্কিন আক্রমণ প্রতিরোধে একদিকে জাপানি সেনারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অন্যদিকে আত্মরক্ষার স্বার্থে দেশের স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল বাঁশের তৈরি বর্শা দিয়ে।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন স্যানো মঠের কাছাকাছিই চলে এসেছিল সাচিকো। কর্পূর গাছগুলোর ছিল আর একটু দূরেই। গাছগুলোর প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। এই গাছগুলোর পিছনেই স্যানো মঠের বৃহদাকার, পাথুরে গেটটি। আধ্যাত্মিকতার চাদরে মোড়া এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাচিকো মনে মনে প্রার্থনা করল। আবার যেন ও প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে!

গত এপ্রিলের কথা। চারদিকের পরিবেশ তখন চেরি ফুলের গন্ধে সুশোভিত। জাপানের স্কুলগুলোর নতুন শিক্ষাবর্ষ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। বাবা সাচিকোকে নিয়ে জেনজা প্রাইমারি স্কুলে গিয়েছিলেন। বাবা তাকে বলেছিলেন, স্যার-ম্যাডামদের কথা মেনে চলো সাচিকো। তারা তোমাকে সঠিক পথের নির্দেশ দেবেন।কিন্তু বাবা আর সাচিকো যখন স্কুল-প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলেন, শিক্ষকদের চোখ-মুখ জুড়ে তখন আতঙ্কের ছাপ। মার্কিন বিমান হামলার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। বিমান হামলার সাইরেনের জন্য সেদিন সকালেও স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সাচিকো শুধুমাত্র তার নতুন শিক্ষকের সামনে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে পেরেছিল। এরপরই প্রিন্সিপ্যাল স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করেন। সাচিকোর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির স্বপ্ন সেখানেই মিলিয়ে যায়। পড়াশোনা শেখার বদলে সে শিখেছিল আঙুল দিয়ে কান এবং চোখগুলো ঢেকে রাখতে। সেই সঙ্গে শিখেছিল বাইরে থাকাকালে টেকি’ (শত্রুপক্ষের বিমান) শব্দটি শুনলে সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে শুয়ে পড়ার বিদ্যা!

যুদ্ধের রাতগুলো ছিল এক একটা দুঃস্বপ্ন।

সাচিকোর মনে আছে, বিমান হামলার সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা পরিবারকে ঘুম থেকে তুলে বাবা পাহাড়ের বুকে তৈরি গুহাগুলোর দিকে ছুটত। সাকামোতো সিমেট্রির কাছেই ছিল সেগুলো। ইচিরোর হাত ধরে সাচিকো ভেজা ঘাসের মধ্য দিয়ে ছুটত। তার গলায় ঝোলানো ব্যাগে রাখা বিস্কুটগুলো বারবার বুকে এসে আঘাত করত। গুহার প্রবেশপথে এসে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে যেত সাচিকো, গিয়েই উবু হয়ে বসে পড়ত। ভেজা খড়কুটো বিছানো মেঝের শীতল পরশ তাকে শিহরিত করে তুলত। আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো গুহার উপর দিয়ে গর্জন করে উড়ে যেত। ওদিকে গুহার ভিতরে সাচিকোর মাথার উপর তখন ভনভন করে উড়ত অজস্র মশা।

বোমারু বিমানগুলোর গর্জন আর থামত না। দূরে কিছু মানুষের ছায়া নড়াচড়া দেখলেই সাচিকো দাঁতে দাঁত চেপে থাকত। আকির সামনে বসে মিসা ফুঁপিয়ে কাঁদত। মায়ের কোলে তোশি জোরে জোরে শ্বাস নিত। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে মিসা আর তোশির দিকে এগিয়ে দিত সাচিকো। একটা সময় বি-২৯ বোমারু বিমানগুলোর ভয়ঙ্কর আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেত। শহরের লাউড স্পিকারগুলো থেকে একটি সাইরেন বেজে উঠত। বিপদ কেটে গিয়েছে! আকি বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত। সাচিকো ইচিরোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিত। আপাতত বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ।

কী ভয়ঙ্কর সেই জীবন!

কারেন স্টেলসনের লেখা সাচিকো, আ নাগাসাকি বোম্ব সারভাইভার্স স্টোরি’— এক হিবাকুশার গল্প। পারমাণবিক বোমা হামলার পর হিরোশিমা ও নাগাসাকির যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের বলা হয় হিবাকুশা। তবে তারা কেউই হিবাকুশা হতে চাননি, চেয়েছিলেন আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই সুন্দর একটা জীবন কাটাতে। কিন্তু ফ্যাট ম্যান ও লিটল বয় নামে দুটি অভিশাপ তছনছ করে দিয়েছিল তাদের সাজানো সংসার, সাজানো স্বপ্নসহ সবকিছুই। তেমনই একজন হিবাকুশা সাচিকো ইয়াসুই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছিল যার সর্বস্ব।

১৯৪৫-র ৬ আগস্ট।

রাত দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বি-২৯ বোমারু বিমান এনোলা গের ককপিটে বসেছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল টিবেটস। গত প্রায় এক বছর ধরে টিবেটসসহ আরও বেশ কয়েকজন পাইলট জাপানের উপর পারমাণবিক বোমাটি নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।

এনোলা গের সঙ্গে আরও দুটি প্লেনের থাকার কথা। সেগুলো আরও আগেই রওনা হয়ে গিয়েছিল। তাদের একটির কাজ ছিল বিষ্ফোরণের ছবি তোলা এবং অপরটির কাজ ছিল বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। কাঙ্ক্ষিত সঙ্কেত পাওয়ার পরই এনোলা গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট্ট দ্বীপ টিনিয়ানের বুক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত হিরোশিমার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মাঝখানে ছিল প্রায় ২,৫২২ কিলোমিটার দূরত্ব। সঙ্গে ৪.৪ মেট্রিক টন ওজনের ইউরেনিয়াম দিয়ে তৈরি পারমাণবিক বোমা। যার সাঙ্কেতিক নাম লিটল বয়

সকাল ৮টা ১৪ মিনিট। ওটা নদীর উপরে আইওয়া ব্রিজের দিকে নজর গেল এনোলা গের পাইলটের। অটোমেটিক কন্ট্রোল সুইচে চাপ দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে লিটল বয়’-র পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। হিরোশিমার দিকে তুমুল বেগে ধেয়ে এসেছিল লিটল বয়। আনুমানিক ১,৯০০ ফুট উপরে বোমার ভিতরে থাকা গান মেকানিজম ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গেই নিউক্লিয়ার চেন রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। যা থামানোর কোনও উপায় ছিল না। ১৫,০০০ টন টিএনটির (ট্রাইনাইট্রোটলুইন) সমতুল্য ক্ষমতা নিয়ে বিষ্ফোরিত হল লিটল বয়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ভয়াবহ বিকিরণ। শক ওয়েভ ছড়িয়ে গেল সবদিকে। ৬ আগস্ট সকালের বোমা হামলায় হিরোশিমা নগরীর ৯২ শতাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যায় প্রায় সত্তর হাজারের মতো নাগরিক। আঘাত, দহন এবং বিকিরণজনিত অসুস্থতায় পরবর্তীতে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়।

বিষ্ফোরণের কথা টোকিওতে গিয়ে পৌঁছয়। জাপানের সম্রাট হিরোহিতো বুঝতে পারলেন না ঠিক কী করা উচিত। ওই একই দিনে মার্কিন জনগণের কাছে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের কথা জানিয়ে বললেন, (জাপানের নেতারা) যদি এখনও আমাদের শর্ত মেনে না নেয়, তাহলে তাদের উপর আকাশ থেকে ধ্বংসের (বোমার) বৃষ্টি নেমে আসবে, পৃথিবীর ইতিহাসে যা আগে কোনওদিনই দেখা যায়নি।

তিনদিন পর। ৯ আগস্ট সকাল। বি-২৯ বোমারু বিমান বক্সকার’-র ককপিটে বসে ছিলেন মেজর চার্লস সোয়েনি। প্লেনটিতে ছিল প্লুটোনিয়ামের তৈরি ফ্যাট ম্যাননামে একটি পারমাণবিক বোমা। যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল ২১,০০০ টন টিএনটির সমতুল্য। সোয়েনির প্রধান লক্ষ্য ছিল শিল্পনগরী কোকুরা। যদি কোনও কারণে কোকুরার মিশনটি ব্যর্থ হয়, তাহলে তালিকায় পরের নামটিই ছিল নাগাসাকি। জাপানের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে উড়ে গেল বক্সকার। আর ওদিকে স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ চালাল জাপান-নিয়ন্ত্রিত মাঞ্চুরিয়ায়। নাগাসাকি কিংবা আমেরিকাকোনও অংশের মানুষই জানত না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে।

১৯৪৫-র ৯ আগস্ট।

সকালে সবে মাত্র বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে চোখটা ভালোমতো রগড়ে নিল সাচিকো। জানালার বাইরে ঘুরঘুরে পোকাগুলো শব্দ করছিল। অসুস্থ এক বন্ধুর খোঁজ নিতে বাবা তাড়াতাড়িই বের হয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। মা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। হাতের তালুতে গমের বল বানাচ্ছিলেন। মাকে কেমন যেন আতঙ্কিত লাগছিল। কিছুক্ষণ পর মা ডাক দিলেন, বাচ্চারা, এস, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।

সকাল ৭টা ৫০ মিনিট। হঠাৎ করে বিকট কোনও একটি শব্দ ঘুরঘুরে পোকাগুলোর কম্পনের আওয়াজকে ম্লান করে দিল। মা মাথা তুলে চাইলেন।

বাচ্চারা, তাড়াতাড়ি’, এটুকু বলেই মা তোশিকে কোলে তুলে নিলেন। সাচিকো তার হুডটা খুঁজতে দৌড় দিল। আকি মিসাকে তার হুড খুঁজে দিল। সাচিকোর হাতটা ধরল ইচিরো। থেমে থেমে বাজতে থাকল সাইরেন।

সাচিকোর পরিবার আবারও ছুট লাগাল পাহাড়ের বুকে তৈরি সেই গুহাগুলোর দিকে। মাথা নিচু করে গুহার ভিতর ঢুকে স্যাঁতস্যাঁতে মাদুরের উপর বসে রইল সাচিকো। দূরের ছায়াগুলোর মধ্যে সে শুধু তাদের বাড়ির আশেপাশে থাকা চারটি বাচ্চাকে চিনতে পারল। তিনটি মেয়ে এবং একটি ছেলে।

সকাল ৮টা বেজে ৩০ মিনিট। বিমান হামলার সাইরেন থেমে গেল। পরিচিত আরেকটি সাইরেন বেজে সবাইকে বুঝিয়ে দিল, বিপদ কেটে গিয়েছে।

গুহা থেকে বেরিয়ে এল সবাই। তোশির হাত ধরে রেখেছিলেন মা। ফের মুরগির ডিম খুঁজতে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। এক বন্ধুর সঙ্গে ঘুরঘুরে পোকা ধরতে চলে গেল ইচিরো। সেদিন সকালে আকাশে সূর্যের দেখা মিলেছিল কিছুটা দেরি করেই। ঘুরঘুরে পোকাগুলো ফের শব্দ করতে লাগল। মেঘগুলোও বয়ে যেতে লাগল। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা বেজে ৪৫ মিনিট।

বি-২৯ বোমারু বিমান বক্সকারকে নিয়ে কোকুরা শহরের উপর দিয়ে নিরাপদেই উড়ে গেলেন ক্যাপ্টেন সোয়েনি। সঙ্গে পারমাণবিক বোমা ফ্যাট ম্যান। হিরোশিমার পর পারমাণবিক বোমা হামলার টার্গেট নগরীর তালিকায় ছিল কোকুরার নাম। বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। শুরু হল ঘন মেঘের চলাচলও। সেই মেঘরাশি সোয়েনির চোখ আবছা করে দিল। সোয়েনি কোকুরার উপর দিয়ে দ্বিতীয়বার চক্কর দিলেন। জাপানি অ্যান্টিএয়ারক্রাফট গানগুলো থেকে ততক্ষণে গোলাগুলি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সোয়েনি তৃতীয়বার চক্কর দিলেন। বিমানের ক্রুরা শঙ্কিত হয়ে পড়ল। সকালে উড্ডয়নের সময় ফুয়েল পাম্পটা ঠিকমতো কাজ করছিল না, প্রয়োজনের তুলনায় কম তেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সময়ও ফুরিয়ে আসছিল বেশ দ্রুত।

দ্রুততার সঙ্গে অবশিষ্ট জ্বালানী নিয়ে একটা হিসাব কষে ফেললেন সোয়েনি। তালিকায় থাকা পরবর্তী নগরী নাগাসাকিতে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি তখনও ছিল। সোয়েনি প্লেন ঘুরিয়ে নাগাসাকির পথ ধরলেন। সকাল ১১টা বাজার কয়েক সেকেন্ড পরই বক্সকার নীচের দিকে নামতে শুরু করল। উপর থেকে নাগাসাকিকেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ নগরীটি ঢেকে রেখেছিল।

বক্সকারের টার্গেট ছিল পোতাশ্রয়ে থাকা মিতসুবিশি শিপইয়ার্ড। কিন্তু উপর থেকে সেটা তারা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ করেই একখণ্ড মেঘ সরে গেল। ফলে নাগাসাকির ঘনবসতিপূর্ণ উরাকামি উপত্যকা বক্সকারের ক্রুদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। যা ছিলো টার্গেট থেকে প্রায় ১ মাইল দূরে। চিৎকার করে উঠলেন সোয়েনি, আমি খুঁজে পেয়েছি, আমি খুঁজে পেয়েছি। এটুকু বলেই নিশানা ঠিক করে সুইচে চাপ দিলেন তিনি।

নাগাসাকির উদ্দেশ্যে ধেয়ে গেল ফ্যাট ম্যান।

সকাল ১১টা বেজে ১ মিনিট। দশ বছর বয়সি মেয়েটি হঠাৎ করেই ভয়ে পাথরের মতো জমে গেল। টেকি (শত্রুপক্ষের বিমান)বলে চিৎকার করে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গেই মাদুরের উপর উপুর হয়ে গেল সাচিকো। কানগুলো ঢেকে এবং চোখগুলো বুজে রইল। সকাল ১১টা বেজে ২ মিনিট। ফ্যাট ম্যান বিষ্ফোরণের অত্যুজ্জ্বল আলোতে, প্রচণ্ড শব্দে, ভয়াবহ বিষ্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে উঠল গোটা নাগাসাকি নগরী। অদ্ভুত, চোখধাঁধানো এক আলো জ্বলে উঠেছিল আকাশজুড়ে। লাল, নীল, সবুজ- হরেক রকমের রঙ। প্রচণ্ড উত্তপ্ত, কানে তালা লাগিয়ে দেওয়া, ঘূর্ণিঝড়ের মতো শক্তিশালী বাতাস ধেয়ে এসেছিল। বিষ্ফোরণে মাটি কেঁপে উঠেছিল। সাচিকোকে কে যেন শূন্যে ছুঁড়ে দিয়েছিল। পরক্ষণেই আবার সজোরে ভূমিতে আছড়ে পড়েছিল সে।

পাথরের টুকরো, ভাঙা টাইলস, গাছের শাখা-প্রশাখা, পাতাসবকিছু তার উপর একে একে পড়তে লাগল। ক্রমশ এগুলোর নিচে চাপা পড়তে লাগল সে। নাকে-মুখে ধুলোবালি ঢুকে গিয়েছিল তার। বিষ্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র ৯০০ মিটার দূরে মাটিতে পড়ে কাঁপতে লাগল মেয়েটি।

বাতাসের তোড়ে বৈদ্যুতিক তারগুলো ছিড়ে গিয়েছিল। দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল রাস্তায় থাকা গাড়িগুলো। কাচ ভেঙে গিয়েছিল জানালার। কব্জা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল অনেক দরজা। উল্টে পড়েছিল অনেক ঘরবাড়ি। ভাঙা কাচের টুকরাগুলো বাতাসে বুলেটের মতোই এদিক ওদিকে ছুটে যাচ্ছিল। নাগাসাকি মেডিক্যাল কলেজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভেঙে পড়েছিল উরাকামি ক্যাথেড্রাল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল স্যানো মঠও। কর্পূর গাছগুলোর বাকল উঠে গিয়েছিল। অনেক গাছই উপড়ে গিয়েছিল। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া গাছগুলোর দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছিল, কী ভয়াবহ ঝড়টাই না বয়ে গিয়েছে তাদের উপর দিয়ে। স্যানো মঠের পাথুরে গেটটি ভারসাম্যহীনভাবে, পুড়ে যাওয়া একটি পা নিয়েই দাঁড়িয়েছিল। গান গাইতে থাকা ঘুরঘুরে পোকাগুলোও যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল মুহূর্তে।

ওদিকে নাগাসাকির আকাশে, প্রায় ৩.২ কিলোমিটার উপরে, ধীরে ধীরে জমাট বাধল একটি পারমাণবিক মেঘ। যা দেখতে ছিল অনেকটাই বৃহদাকায় মাশরুমের মতোই। খানিক বাদেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছাদের টাইলসগুলো পুড়ে গেল। ল্যাম্পপোস্টগুলো গলে নুয়ে পড়ল। রাস্তাগুলো ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকল। একসময় সেই মেঘ পুরো আকাশটাকেই ছেয়ে ফেলল। ধূসররঙা, মোটা কম্বলের মতো ঢেকে দিল সূর্যটাকে। নাগাসাকির বুকে ভরদুপুরে নেমে এল রাতের অন্ধকার। পাক খেতে খেতে সেই আগুনে মেঘটি আরও উপরের দিকে উঠতে লাগল। যেন এটা জীবন্ত কোনও এক সত্ত্বা। মাত্র ০.৭ গ্রাম ইউরেনিয়ামের কারণেই সবচেয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় বলে জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এক ডলারের নোটের চেয়েও হালকা একটা পদার্থের কারণে এক ধাক্কায় প্রাণ হারান ৮০ হাজার মানুষ।

এরপর তছনছ হয়ে যাওয়া জীবন নিয়ে সাচিকোর কেটে গিয়েছে কয়েক দশক। বদলে গিয়েছে গোটা দুনিয়া।

১৯৯৫ সালের ৯ আগস্টের সন্ধ্যা। নাগাসাকি পিস পার্কে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে। একটি হোটেলের লবিতে একদল শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সামনে দাঁড়িয়ে সাচিকো ইয়াসুই। সামনে ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে আকি, ইচিরো, মিসা, তোশি এবং সেই সঙ্গে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল সাচিকোর। সেদিন ডিমের গল্পটা দিয়েই শুরু হয়েছিল পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি।

আমার বয়স তখন ছবছর। আমার অন্য চার ভাই-বোন আকি, ইচিরো, মিসা আর তোশি। ছোট্ট তোশি প্রতিদিনই ডিম খেত। কিন্তু আমাদের মুরগিটা সেদিন কোনও ডিম পাড়েনি। মা আর তোশি মিলে অনেকক্ষণ ডিম খুঁজেছিলেন। পাননি। আমরা খোলা আকাশের নিচে কাদামাটির দিয়ে খেলছিলাম। হঠাৎ করেই উপরে বি-২৯ বিমানের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। মেঘগুলো সরে গেল। পিকাডন! (জাপানি এই শব্দটি দিয়ে মূলত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণকেই বোঝানো হয়ে থাকে। পিকা অর্থ অত্যুজ্জ্বল আলো এবং ডন অর্থ বিস্ফোরণ।) অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তোশি, আকি, ইচিরোওরা সবাই চলে গিয়েছে। সেই সঙ্গে চলে গিয়েছে মিসাও। আমার বাবা। আমার মা। আমিও প্রায় মরেই গিয়েছিলাম।এটুকু বলে থেমে গিয়েছিলেন সাচিকো। শেষে শুধু বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তা যেন তোমাদের সঙ্গে কোনওদিন না হয়।

ঘুরঘুরে পোকারা মাটির নিচে অনেকদিন সময় কাটায়। মাটির নিচে সুরক্ষিত অবস্থায় গাছের শিকড়ের শীর্ষভাগ থেকে পুষ্টিকর দ্রব্য শুষে নেয় তারা। কালচক্রে মাটির নীচে থেকে উঠে এসে গাছের ডালে জায়গা করে নেয় তারা। সূর্যের আলোতে পাতলা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে তারা। ডানাটাকে শুকিয়ে নেয় আর এরপরই শুরু হয়ে যায় তাদের গ্রীষ্মের গান। পারমাণবিক বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি, নিজের ভিতরে চেপে রাখা কষ্ট। এই সবকিছু নিয়েই সাচিকো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঘুরঘুরে পোকার মতো সে-ও পুষ্টিদ্রব্য শোষণ করতো বাবার জ্ঞানের শিকড় থেকে। হেলেন কেলারের সাহস থেকে। এবং ভালোবাসা, অহিংসা ও ন্যায়বিচারের প্রতি গান্ধীজি ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বিশ্বাস থেকে। ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্টের পর থেকে সাচিকো ইয়াসুই জাপান ছুটে বেড়িয়েছেন। গিয়েছেন কানাডা এবং আমেরিকাতেও। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাথে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তিনি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছেন, বিভিন্ন রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে দিয়েছেন সাক্ষাৎকার। সাচিকোর জীবনটা যেন ওলিয়েন্ডার’-এর মতো।

আপনি জানেন তো, পরমাণু হামলার পর হিরোশিমায় প্রথম ফুটেছিল ওলিয়েন্ডার (করবী) ফুল। গত শতাব্দীর কলঙ্ক ঢেকে দিয়েছিল যে ফুল!

 https://lernerbooks.blog/2021/11/in-memoriam-sachiko-yasui-1938-2022.html

https://www.publishersweekly.com/9781467789035