Thursday, August 29, 2013

syria war


সিরিয়ায় যুদ্ধের দামামা

সিরিয়ায় বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা সিরিয়ায় সামরিক হামলার ছক কষে ফেলেছে। আজ বৃহস্পতিবারই সিরিয়ায় হামলা চালানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন এক মার্কিন কর্মকর্তা। তবে পশ্চিমাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে রাশিয়া বলেছে, সিরিয়ায় হামলা হলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সতর্ক করে ইরান বলেছে, সিরিয়া আক্রান্ত হলে ইসরায়েলও অক্ষত থাকবে না। আগুন জ্বলবে ইসরায়েলেও। এ হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও সিরিয়ায় হামলার অনুমতি চেয়ে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে যুক্তরাজ্য। গতকালই 
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের অনুমতি চেয়ে একটি প্রস্তাব তুলেছে যুক্তরাজ্য। সর্বশেষ খবর পর্যন্ত প্রস্তাবটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা চলছিল। ওদিকে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েলও। সীমান্তের বাসিন্দাদের জরুরি গ্যাস-মাস্ক সরবরাহ শুরু করেছে তারা। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা হামলার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ওয়ায়েল আল হালকি গতকাল বলেছেন, সামরিক হস্তক্ষেপে আগ্রাসী শক্তির কবর রচনা হবে। এদিকে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শক দল বলছে, সিরিয়ার সরকারি বাহিনী যে দামেস্কের উপকণ্ঠে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে তারা তার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আরেকবার তদন্ত চালানো হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, তদন্তকাজ শেষ করতে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শকদের আরও চারদিন সময় লাগবে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত লাখদার ব্রাহিমি বলেছেন, সিরিয়ায় হামলা চালাতে হলে অবশ্যই জাতিসংঘের অনুমতি নিতে হবে। রাশিয়া বলেছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই সিরিয়ায় হামলার অনুমতি দেওয়ার আগে অস্ত্র পরিদর্শকদের তদন্তকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সিরিয়ায় সামরিক হামলা চালাতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। আজই হামলা চালানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন ওবামা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। গতকাল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসি নিউজকে ওই কর্মকর্তা বলেন, সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে সম্ভাব্য হামলা বৃহস্পতিবারই শুরু হতে পারে। এ অভিযান হতে পারে সীমিত আকারে। স্থায়ী হবে এক বা দু'দিন। হামলার টার্গেট হবে প্রধানত সিরিয়ার সামরিক বাহিনী ও সামরিক স্থাপনাগুলো। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে হামলা চালাবে না। মিত্রদের সঙ্গে নিয়েই এগোবে। এর আগে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল ঘোষণা দিয়েছেন, যে কোনো সময়ে সিরিয়ায় সামরিক হামলা চালাতে প্রস্তুত মার্কিন বাহিনী। অপেক্ষা শুধু প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্দেশের। 

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা নিশ্চিত দামেস্কের কাছে বিদ্রোহীদের ওপর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীই রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, জঘন্য রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের জন্য বাশার আল আসাদের সরকারই দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো বলেছে, সিরিয়া সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিকে বিনা জবাবে ছেড়ে দেওয়া হবে না।
এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের অন্যতম রাশিয়া পশ্চিমাদের সিরিয়া আক্রমণ প্রস্তুতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তাতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনী দামেস্কের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র হামলার জন্য দায়ী বলে মনে করে না রাশিয়া। রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদিমির টিটোভ বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে সিরিয়া ইস্যুতে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্যই অস্ত্র পরিদর্শক দলের বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে যে কোনো পরিস্থিতির আশঙ্কায় সিরিয়া থেকে তার জনগণ ও কর্মকর্তাদের বিশেষ বিমান পাঠিয়ে ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে রাশিয়া। অন্যদিকে সিরিয়ার মিত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ইরান হুমকি দিয়ে বলেছে, সিরিয়া আক্রান্ত হলে পশ্চিমাদের মিত্র ইসরায়েলেও হামলা চালানো হবে। ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আব্বাস আরকি এ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সিরিয়ায় হামলা হলে তা সীমান্তে আটকে থাকবে না। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবেতারা চান মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংস বয়ে আনবে। 

এদিকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেশ কিউবা হুঁশিয়ার করে বলেছে, সিরিয়ায় হামলা ইতিমধ্যে অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে। তাছাড়া এটা হবে জাতিসংঘ সনদের পরিষ্কার লঙ্ঘন।

পশ্চিমীদের যুদ্ধের প্রস্তুতি
ক্রজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় চারটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি সাবমেরিন সিরিয়ার দিকে তাক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া তুরস্ক ও জর্ডানে থাকা দুটি বিমানঘাঁটি থেকে বিমান হামলা চালাতে পারে দেশটি। এ ছাড়া এ অঞ্চলে থাকা দুটি বিমানবাহী রণতরী ব্যবহার করবে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোকে এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য জিব্রাল্টার প্রণালিতে থাকা তাদের একটি সাবমেরিন থেকে ত্রুক্রজ হামলা চালাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাইপ্রাসে থাকা ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বিমানঘাঁটি থেকে হামলা চালানো হতে পারে। এই মুহূর্তে পশ্চিম ভূ-মধ্যসাগরে রয়েছে ফ্রান্সের বিমানবাহী রণতরী চার্লস দ্য গল। সিরিয়ায় যুদ্ধে এটি ব্যবহার করা হবে। অন্যদিকে আকাশপথে হামলায় অংশ নিতে পারে রাফায়েল অ্যান্ড মিরেজ যুদ্ধবিমান। ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে আরব আমিরাত। হামলা চালানো হবে শুধু প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ নিয়ন্ত্রিত সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোতে। যেসব ঘাঁটি থেকে সরকারি সেনারা হামলা করে থাকে সেসব স্থানে এবং অস্ত্র ঘাঁটিগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হবে। তবে রাসায়নিক অস্ত্র আছে সন্দেহভাজন এমন স্থানে হামলা চালানো হবে না। বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ আরও বাড়ানো হবে। এ ছাড়া সিরিয়া সরকার যাতে তার বিমানবাহিনীকে ব্যবহার না করতে পারে এ জন্য নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা করা হবে। বাশার সরকারের কাছে রাশিয়ার নির্মিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এসব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা করা হতে পারে। বছরখানেক ধরে নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনা করে আসছে পশ্চিমারা। এ ছাড়া বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে। খবর বিবিসির।
সিরিয়া যুদ্ধ কি বৈধ হবে?
সিরিয়ায় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে সিরিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপ বৈধ হবে কি-না। অর্থাৎ এটি আন্তর্জাতিক আইন মেনে করা হবে কি-না। একটি যুদ্ধ তখনই পুরোপুরি বৈধ হবে যখন সব রাষ্ট্র বিশেষত জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর সম্মতিক্রমে অভিযান চালানো হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এটি প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
জাতিসংঘের রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট (আর২পি) সনদ অনুযায়ী, কোনো দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে যেসব মানদণ্ড মেনে চলতে হবে সেগুলো হচ্ছে_
প্রথমত, কোনো রাষ্ট্রকে তার জনগণকে গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্র যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তবে ওই রাষ্ট্রে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কোনো ক্ষেত্রে যদি এমন অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় যা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিবেচনায় আনা যাবে।
তৃতীয়ত, যদি উপরোক্ত সবগুলো প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয় তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে। সামরিক এই হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে অবশ্যই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে দেশটির পাশে রাশিয়া ও চীন থাকায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নেওয়া সম্ভব হবে না, তা একরকম নিশ্চিত প্রায়। তা হলে সিরিয়ায় হামলা কীভাবে বৈধ হবে?
আর২পি সনদে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থাও রয়েছে। তা হচ্ছে আঞ্চলিক জোট। একটি কোয়ালিশন তৈরি করে সামরিক হস্তক্ষেপ পরিচালনা করা যেতে পারে। তা করার জন্যও তিনটি শর্ত রয়েছে। এগুলো হলো_ সংশ্লিষ্ট দেশে মারাত্মক হত্যাযজ্ঞের শক্তিশালী প্রমাণ থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনীতিক আলোচনা ও নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করতে হবে। তাতে কাজ না হলে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে। তবে প্রত্যেকটি হামলা করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নৃশংতা থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করার লক্ষ্যে। সিরিয়ায় হামলার ক্ষেত্রে এই দিকটি সামনে রেখেই এগোতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।

রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার কী ইঙ্গিত দিচ্ছে
সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহীরা দাবি করছে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে। সম্প্রতি সারি করে শুইয়ে রাখা মৃত শিশুদের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, সিরীয় বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগে ওইদিন শিশুসহ অন্তত এক হাজার ৩০০ জন নিহত হয়েছে। এ অভিযোগে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আবার ঘটনা ও পারিপাশর্ি্বক অবস্থা তলিয়ে দেখলে কিছু প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয়।
প্রশ্নটি হতে পারে_ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী, এটি কিসেরই বা প্রতিধ্বনি করছে? যদি এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ সত্য হয়, তবে তা দেশটির সরকার ও বিরোধীদের সংঘাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড় হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কেনই বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হুঁশিয়ারির পরও এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেবেন? তাছাড়া রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের অতীতের একটি অভিযোগ তদন্তে সিরিয়ায় যখন জাতিসংঘের একটি দল অবস্থান করছে, তখনই কেন তিনি এত বড় মাত্রায় এ ধরনের হামলা করতে যাবেন? ওই হামলা ও হতাহতের জন্য সরকার ও বিদ্রোহী উভয়েই পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
বিগত কয়েক সপ্তাহের সিরীয় পরিস্থিতি বিচার করলে এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক, এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট বাশারের সেনাবাহিনীর এ ধরনের হামলার কোনো আবশ্যকতা নেই। যখন এমনিতেই বিদ্রোহীদের ওপর ভারি অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে যথেষ্ট চাপের মুখে আছেন প্রেসিডেন্ট বাশার। অন্যদিকে, এ ধরনের হামলা সিরীয় বাহিনীর রণকৌশলেরই একটি অংশ হতে পারে। রাসায়নিক বা অন্য কোনো হামলা_ যার মাধ্যমে ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে নেওয়া যেতে পারে। রাসায়নিক অস্ত্রের সামরিক ও মনস্তাত্তি্বক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এর মাধ্যমে হত্যা করা যায়। আবার জনতাকে ভীত করেও তোলা যায়।
রাসায়নিক অস্ত্র কেবল বেপরোয়া মনোভাব থেকেই ব্যবহার করা হয় না। বেশ আড়ম্বর দেখাতেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমনটি করেছিলেন ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। ১৯৮৮ সালে উত্তর ইরাকের হালাবজা গ্রামে কুর্দিদের ওপর শেষোক্ত কারণে এটি ব্যবহার করেছিলেন। সিরীয় প্রেসিডেন্ট নিজেকে লৌহমানব হিসেবে দেখাতে চান। আর জয়ী হতে গিয়ে যদি বদনাম কুড়াতে হয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। এজন্য হয়তো 'খুচরো' হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে পাইকারি হত্যা চালিয়ে বিরোধীদের অবশ করে দিতে চাইছে সরকারি বাহিনী। যুক্তির খাতিরে এটাও ধরে নেওয়া যায়, সিরিয়া হয়তো ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের দেখাতে চায়, প্রত্যুত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। ওই হামলা পশ্চিমাদের বিব্রত করেছে। বিরোধীদের শক্তিহীন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
আরেকটি প্রশ্ন হতে পারে_ সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পশ্চিমা বিশ্বের অপরাগতার ব্যাখ্যা কী? গত অর্ধ শতাব্দী ধরে এ ধরনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলের পদক্ষেপ নির্ভর করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ও ক্ষমতার ওপর। সিরিয়া ইস্যুতে অনেক আগেই ওবামা প্রশাসন পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, তারা সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চায় না। হোয়াইট হাউস এখন নিজেদের ঘরোয়া এজেন্ডা বাস্তবায়নেই হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া আফগানিস্তান ও ইরাকে দুটি অজনপ্রিয় যুদ্ধের কলঙ্ক তো রয়েছেই। তাছাড়া সিরীয় ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্বার্থই হুমকির মুখে পড়ছে না। বিপরীতে এটাও বলা যায়, স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে বলেই এখন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল ও মার্কিন শত্রু সিরিয়া যদি অভ্যন্তরীণ সংঘাতে দুর্বলতর হয়ে যায়, ইরান ও হিজবুল্লাহ প্রেসিডেন্ট বাশারের পক্ষ নিয়ে অপদস্থ ও আরব বিশ্বে সমর্থন হারায় তাতে ক্ষতি কি? এ অবস্থায় সাইড লাইনে বসে সিরীয় পরিস্থিতি দেখার মধ্যে কোনো ক্ষতি নেই। তাছাড়া হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক হলে বা বিদ্রোহীদের সহায়তা করলে_ উভয় ক্ষেত্রেই 'উগ্র জিহাদিদের' লাভবান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিপরীতে আজকের অবস্থানে ওয়াশিংটনের মুখরক্ষার সব কৌশলই কার্যকর থাকছে।
শেষ প্রশ্নটি হতে পারে_ চূড়ান্ত সীমা অতিক্রান্ত হলে ওয়াশিংটন কি করবে? যদি প্রমাণিত হয় সিরীয় সরকারি বাহিনী রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে তাহলে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে তা ব্যাপক চ্যালেঞ্জ জুড়ে দেবে। চান বা না চান তাকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। কেননা তিনি আগেই এ ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন।
সূত্র : আলজাজিরা অনলাইন।

শিশুরা যুদ্ধের বলি
লেবাননের বালবেকের শরণার্থী শিবির। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মারসি করপোরেশনের সদস্যদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে কয়েকজন শিশু। তাদের সবাই সিরীয় শরণার্থী। হঠাৎ চোখ যায় একটু দূরে একটি ছেলের দিকে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছোট সেই ছেলেটিকে দেখলে মনে হবে হঠাৎ করেই অনেক বুড়িয়ে গেছে সে। চুলে পাক ধরেছে, চোখ ভাষাহীন।
১২ বছরের এই শিশুটির নাম মোস্তফা। বাড়ি সিরিয়ার আলেপ্পোয়। সেখানে ৬ ভাইবোন নিয়ে একটি বড় বাড়িতে থাকত সে। স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি ভেড়া চরিয়েই তার দিন কাটত। আসাদ সরকার নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র তৈরির কারখানার পাশে বাড়ি হলেও সহিংসতা শুরুর দেড়-দুই বছরের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব টের পায়নি মোস্তফার পরিবার। কাজেই দেশ ছাড়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাদের। কিন্তু ৬ মাস আগে অস্ত্র তৈরির কারখানা দখলে নিতে আলেপ্পোয় হামলা চালায় বিদ্রোহীদের জোট ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই রাজনৈতিক এই পট পরিবর্তনের যুদ্ধের মাঝে পড়ে যায় মোস্তফার পরিবার। মোস্তফার বোন ফাতেমা জানান, বাবা-মা ও ভাইবোনের সঙ্গে দেশ ছাড়ার সময় বারবারই নিজের ভেড়াগুলোর কাছে ছুটে যেতে চেয়েছে মোস্তফা।
সহিংসতায় বিধ্বস্ত গ্রাম পেছনে ফেলে লেবাননের শরণার্থী শিবিরে পেঁৗছতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মোস্তফা ও তার পরিবারকে। গোটা রাস্তাতেই গাদাগাদি করে ঠাসা বাসটি বারবার পড়েছে চেক পোস্টের মুখে। এর মধ্যে অনেকই সরকারি বাহিনীর, কিছু আবার বিদ্রোহীদের। একেকটি চেক পোস্টে কিছু কিছু যাত্রী রেখে এগিয়েছে বাসটি। এরপর লেবাননের বালবেকে পেঁৗছে আত্মীয়-পরিজন ছাড়া অপরিচিত জায়গায় রীতিমতো আরেক মানবেতর পরিস্থিতি।
যুদ্ধ মানেই সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে সে দেশের নারী ও শিশুরা। আড়াই বছরের যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। একের পর এক শহর নিজেদের দখলে নিতে হামলা-পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে আসাদ বাহিনী ও বিরোধীরা। চলমান যুদ্ধপরিস্থিতিতে স্বাভাবিক শৈশব হারিয়ে ফেলছে সিরীয় শিশুরা। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের রেশ বেশ ভালোই টের পাচ্ছে দেশটির লাখ লাখ মানুষ। লেবাননের মতো লাখ লাখ সিরীয় আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ জর্ডান, তুরস্ক, ইরাক ও মিসরের শরণার্থী শিবিরে। সিরিয়ার আড়াই বছরের সহিংসতায় শরণার্থীদের তালিকায় শুধু শিশুদের সংখ্যাই ১০ লাখে পেঁৗছেছে। এই ঘটনাকে দুঃখজনক মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটির দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, লেবানন, জর্ডান, তুরস্ক, ইরাক এবং মিসরের মোট সিরীয় শরণার্থীর অর্ধেকই শিশু। এদের সাড়ে ৭ লাখ শিশুর বয়সই ১১ বছরের নিচে। ৪ বছরের কম বয়স এমন শিশুর সংখ্যাই এক লাখ। সিরিয়া পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার কারণ হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
দেশের রাজনীতি বোঝার ক্ষমতা না থাকলেও সেই রাজনীতির বলি হচ্ছে তারা। মোস্তফার মতো অনেকেই আছে, যারা বেঁচে আছে, কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া। সিরিয়ার বিভিন্ন শহরের প্রতিটি অলি-গলিতে আর্টিলারির ক্ষতচিহ্ন প্রত্যক্ষ হলেও শিশুদের মনের ক্ষতের প্রভাব সুদূরপ্রসারি। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালালেও পিছু ছাড়েনি যুদ্ধের ভয়াবহতা। চোখের সামনে প্রিয়জনকে হত্যার দৃশ্য বা সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। এমন পরিস্থিতিতে তথাকথিত এই গণতন্ত্র অর্জনের চেষ্টার লড়াইয়ে যে পক্ষেরই জয় হোক না কেন, দীর্ঘ এই গৃহযুদ্ধে ক্ষতির পরিমাণ অপরিমাপযোগ্য। যুদ্ধ শেষে নিজ দেশে ফিরলেও ফিরবে না শিশুদের সেই সারল্য। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ গিয়ে পড়বে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক প্রজন্মের হাতে।

No comments:

Post a Comment