সিরিয়া সংকট
চ্যালেঞ্জের নাম রাসায়নিক অস্ত্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায়, রাসায়নিক
অস্ত্র ব্যবহার করে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ‘রেড
লাইন’ বা চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছেন। কাজেই এখন তাঁকে
শাস্তি পেতে হবে। পাশ্চাত্যের নেতারা একসুরে বলছেন, নিরীহ
জনগণের ওপর এত বড় নির্মমতা আন্তর্জাতিক বিশ্ব চুপ করে মানবে না। মার্কিন
প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল ও শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা এরই মধ্যে বলেছেন, সমরাস্ত্র নিয়ে পুরোপুরি তৈরি মার্কিন সেনারা। এখন শুধু ওবামার হুকুমের
অপেক্ষা। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সমরযন্ত্রের নিয়ন্ত্রকদের এ ঘোষণার পর থেকে
দৃশ্যত সিরিয়া অভিযান সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশেষ করে রাশিয়ার সামরিক
সহায়তাপুষ্ট সিরিয়া শক্তির বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যের মোটামুটি সমীহ জাগানো দেশ।
হামলার ভয়ে তারা কুঁকড়ে যায়নি; বরং দম্ভ প্রকাশ করেছে।
দেশটির বিদেশমন্ত্রী ওয়ালিদ মোয়াল্লাম বেশ তেজের সঙ্গেই বলেছেন, সিরিয়ার কাছে এমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে, যা গোটা
বিশ্বকে চমকে দেবে। তবে পাশ্চাত্যের অভিযানের মুখে শক্তিশালী ইরাকের পরিণতির কথা
মাথায় রাখলে বিদেশমন্ত্রীর এ কথায় সিরীয়দের ভরসা পাওয়ার বিশেষ কারণ নেই। প্রশ্ন
উঠেছে, সিরিয়ায় হামলা চালালে আমেরিকা ও তার মিত্ররা
লিবিয়ার ঘটনার মতো সহজেই জয়ী হতে পারবে কি না; নাকি
জড়িয়ে পড়বে আরেক ইরাকজাতীয় ফাঁদে। এ উদ্বেগ থেকেই আমেরিকা সিরিয়া অভিযানে
নামতে এত দিন গড়িমসি করছিল। সপ্তাহ খানেক আগে দেওয়া ভাষণেও ওবামা বলেছিলেন,
আমেরিকা বাশার বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করার অভিযোগটি
খতিয়ে দেখছে। তিনি হুট করেই আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে চান না।লিবিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার
প্রতিরক্ষা শক্তির বেশ তফাত রয়েছে। বাশার নীরবে সমরাস্ত্রের বিশাল এক মজুত গড়ে
তুলেছেন। এর উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাপক বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র। আগেও
বিভিন্ন সময় সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে ও নিজ জনগণের বিরুদ্ধে তা প্রয়োগের অভিযোগ
উঠেছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাশারবিরোধী বিদ্রোহীরাও কখনো কখনো এ কাজ
করেছে বলে অভিযোগ আছে। সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানো হলে সংগত কারণেই মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হবে বাশারের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত ধ্বংস করা।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব সতর্ক না হলে হামলার পরিণতি হবে
মারাত্মক। জাহাজ বা বিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ভুল জায়গায় পড়লে
রাসায়নিক অস্ত্র বিস্ফোরিত হয়ে যে গ্যাস ও ক্ষতিকর পদার্থ ছড়াবে, তাতে বেঘোরে মারা পড়বে হাজারো নিরীহ মানুষ। এ জন্য পেন্টাগন কর্মকর্তারা
খুব সতর্কভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করে সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা ও ঘাঁটিতে হামলা
চালানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু মুখে বললেই সুনির্দিষ্টভাবে বাশারের রাসায়নিক
অস্ত্রের মজুতে আঘাত হানা সহজ হবে না। আমেরিকা ও তার মিত্ররা কেউ হলপ করে বলতে
পারবে না, বিপজ্জনক সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাসে ভরা রাসায়নিক
অস্ত্রগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন বাশার। আর বিভিন্ন স্থানে রাখা এই মারণাস্ত্রের
মজুত এতটাই বিশাল যে যতই ধ্বংস করা হোক না কেন, কিছুটা থেকে
যাওয়ার আশঙ্কা বেশ জোরালো। তা পড়তে পারে জঙ্গিদের মতো আরও বিপজ্জনক পক্ষের
হাতেও। সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক দুঃস্বপ্ন। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু
হওয়ার আগে পশ্চিমি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা ছিল, সিরিয়ার
ভেতর ১৫টি বা তার বেশি গোপন স্থানে রাসায়নিক অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সেই
যুদ্ধের বয়স এখন দুই বছর পার হয়েছে। এত দিনে পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়ে থাকতে
পারে।ওয়াশিংটনের হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল
স্টাডিজের শিক্ষক ও সাবেক পেন্টাগন কর্মকর্তা এলিয়ট কোহেন বলেন, এত দিনে এসব রাসায়নিক অস্ত্র আরও কয়েকটি গোপন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছে
বাশারের অনুগত সেনারা। নতুন স্থানগুলোর হদিস করা এবং খুঁজে খুঁজে সেখানে হামলা
চালানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাঁর মতে, রাসায়নিক অস্ত্রের
মজুতে আঘাত হানলে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে ঘটনাটি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তা হচ্ছে আশপাশের লোকজন এর সংস্পর্শে আসা। এলিয়ট কোহেনের মতে, বরং স্থলপথে সেনা অভিযান চালিয়ে স্থাপনা অবরোধ করে অস্ত্রগুলো যদি উদ্ধার
করা যায়, তাহলে জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্থল অভিযান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। খরচের বোঝা
বাড়া ও বিপদের ঝুঁকি ছাড়াও এর মধ্যে তাদের নিজস্ব আইনি জটিলতার ব্যাপার আছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রক পেন্টাগন হিসাব করে দেখেছে, এ
ধরনের অভিয়ানে ৭৫ হাজার সেনার প্রয়োজন হতে পারে।
গত মাসে সিরিয়ায় সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়
সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান
(জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ চেয়ারম্যান) জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি। কংগ্রেসের সশস্ত্র
বাহিনীসংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান মিশিগানের ডেমোক্র্যাট সিনেটর কার্ল লেভিনের
কাছে এ বিবরণ দেন তিনি। মার্টিন ডেম্পসি বলেন, রাসায়নিক অস্ত্রের স্থানান্তর ও
সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এই মজুতের অংশবিশেষ ধ্বংস করে দেওয়া যায়। একই
সঙ্গে এসব অস্ত্র ব্যবহারের সরঞ্জামও বাজেয়াপ্ত করা যায়। কিন্তু তা করতে গেলে
অন্তত উড্ডয়ননিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আকাশ থেকে আকাশে
নিক্ষেপণযোগ্য ভারী অস্ত্র লাগবে। লাগবে আরও বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ব্যবহারে
লাগবে আবার কয়েক’শ যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ, ডুবোজাহাজ এবং এ ধরনের যান ও সরঞ্জাম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে
অভিযান চালাতে লাগবে বিশেষ ও পদাতিক বাহিনীর হাজার হাজার সেনা। কিন্তু ওবামা বা মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ কেউই চান না সিরিয়ার মাটিতে মার্কিন সেনারা যাক। এ
জন্য ওবামা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা আকাশযুদ্ধের কথাই ভেবেছেন।
বিমান হামলাও শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত হবে না মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার মতো যথেষ্ট শক্তি আছে বাশারের
বিমানবাহিনীর। এ জন্য রাশিয়া পর্যাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে সিরিয়াকে। যদিও
সিরিয়ার বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রসরঞ্জামের কতগুলো কর্মক্ষম আর যথেষ্ট হালনাগাদ, তা নিয়ে প্রশ্ন
রয়েছে।
কিছু মার্কিন কর্মকর্তা আবার দূরপাল্লার টোমাহক
ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে স্থলে আঘাত হানার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এসব
ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার পাউন্ডের বেশি যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম নয়। এই যুদ্ধাস্ত্র
মাটির এতটা গভীরে গিয়ে আঘাত হানতে সক্ষম হবে না, যেখানে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত
রয়েছে।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অ্যামি
স্মিথসন বলেন, রেটামাহক দিয়ে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করার চেষ্টা একটা বড়
ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এই ক্ষেপণাস্ত্র যদি অর্ধেক রাসায়নিক অস্ত্রও
ধ্বংস করে, এর বিপরীতে প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যাবে বহুগুণ।
ধ্বংস হওয়া রাসায়নিক অস্ত্র থেকে যে প্রাণঘাতী গ্যাস বেরোবে, তা নিকটবর্তী এলাকার মানুষের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
অ্যামি স্মিথসনের মতে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর আগে
রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত আছে—এমন এলাকার লোকজনকে আগেভাগে
সতর্ক করে দিতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে তাদের আত্মরক্ষার
ব্যবস্থা। এ জন্য তাদের গ্যাসরোধী মুখোশ দিতে হবে। এ পরামর্শ যে যুদ্ধের বাস্তব
কারণেই সম্ভব নয়, এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। তার মানে,
সিরিয়ায় হামলা চালালে নিরীহ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা
রয়েছে। অথচ কিনা সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্যই এ অভিযানের আয়োজন বলে দাবি
করছে পাশ্চাত্য। তারা এ উদ্বেগের সমাধান কীভাবে করে, সেটাই
এখন দেখার বিষয়।
সিরিয়ায় যুদ্ধের ভেতর যুদ্ধ
সিরিয়ার সরকারবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ফ্রি সিরিয়ান আর্মির
(এফএসএ) অন্যতম শীর্ষ নেতা কামাল হামামিকে সম্প্রতি হত্যা করেছে জঙ্গিরা। এই
হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে বিদ্রোহীদের অভ্যন্তরে উদারপন্থী ও
আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট ইসলামপন্থীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব।
এফএসএর একজন নেতার ভাইকে অপহরণ করেছে সিরিয়ার সবচেয়ে
বড় জঙ্গি সংগঠন নুসরা ফ্রন্ট। সেই নেতা এখন নুসরা ফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ
নিতে বদ্ধপরিকর। তিনি এখন সিরিয়ার সীমান্তের ওপারেই তুরস্কের কোথাও অবস্থান
করছেন। ভাইয়ের মুক্তিপণ হিসেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ৫০ হাজার মার্কিন ডলার গুনতে
হয়েছে তাঁকে। এফএসএর এ নেতা জানেন, নুসরা ফ্রন্ট ওই টাকা দিয়ে কেবল অস্ত্র
কিনবে। আর সেই অস্ত্র ব্যবহূত হবে এফএসএর বিরুদ্ধে।
এফএসএর ওই নেতা বলেন, তাঁর বাহিনীকে দুর্বল করে দিতে একজন
আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীকে পাঠানো হয়েছিল। ওই হামলায় ১২ জন নিহত হয়। তখন এফএসএর
অধিকাংশ যোদ্ধা কোসায়েরের লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকায় হামলাকারীরা সুযোগ নিয়েছিল।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে
লড়াইরত বিদ্রোহীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র বিরোধ চলে আসছে। উদারপন্থী ও
চরমপন্থীদের এই বিরোধ প্রায়ই রক্তাক্ত রূপ নেয়। সরকারি বাহিনীর আক্রমণে
বিদ্রোহীরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের অভ্যন্তরীণ লড়াই থামেনি। এই
লড়াইকে গৃহযুদ্ধের অভ্যন্তরে আরেকটি গৃহযুদ্ধ বলা যেতে পারে। এফএসএর শীর্ষ নেতা
কামাল হামামিকে হারানোর পর তা আরও জোরালো হয়েছে। তিনি লাতাকিয়া প্রদেশে এফএসএর
একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিগেড পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। বিদ্রোহীদের দাবি, হামামি এফএসএর
সর্বোচ্চ সামরিক পরিষদের সদস্য ছিলেন বলেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এফএসএর আরও
কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। বিদ্রোহীদের এই
অন্তর্কলহের কারণ কিছুটা স্বার্থগত ও কিছুটা আদর্শিক। এফএসএর কয়েকটি ব্রিগেডের
যোদ্ধাদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে উভয়পক্ষই ধার্মিক। তাদের
মধ্যে বিশেষ পার্থক্য হলো এফএসএর ধর্মনিরপেক্ষ অংশটি ভবিষ্যতে সিরিয়াকে একটি
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু জঙ্গিরা দেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।
সরকারবিরোধী এক মহিলা মন্তব্য করেন, জঙ্গিদের এই
আধিপত্য গোটা বিপ্লবের জন্য ‘বিপর্যয়কর’। তিনি জানান, বন্দুকধারী কট্টর ইসলামপন্থী যোদ্ধারা
মহিলাদের কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া সাংগঠনিক সভা ও
কর্মকাণ্ডে মহিলার অংশগ্রহণে বাধা দিচ্ছে তারা। ওই মহিলা বলেন, তাঁরা এমন যোদ্ধাদের চান না।
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে অনেক বিদেশি
যোদ্ধা। মূলত এরাই জঙ্গি। বলা হচ্ছে, এফএসএর অভ্যন্তরে যে দুর্নীতি ও
অন্তর্কলহ রয়েছে তারই সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা। এফএসএর লুটপাটের প্রতিবাদ করেছিলেন
একজন বিদ্রোহী। এ জন্য তাঁকে দেশ থেকেই পালাতে হয়েছে।
মোট কথা, সিরিয়ায় বাশারবিরোধী গণবিক্ষোভের প্রথম দিকে যে
আদর্শিক চেতনা কাজ করেছে, তা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। সিরীয়
জনগণের অনেকে এখন মনে করছে, শুরুর সেই গণবিপ্লব কলুষিত হয়ে
পড়েছে। বিশেষ করে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে নতুন এক ধরনের অরাজকতা তৈরি
হয়েছে। অপহরণ ও ডাকাতির মতো অপরাধের ঘটনাও সেখানে ঘটছে।
প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে সুন্নি
মুসলমানদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই বিদ্রোহীদের পক্ষ ছেড়ে
যাচ্ছে। কারণ, সব দিক বিবেচনা করে তারা সরকারপক্ষকেই ‘মন্দের ভালো’
মনে করছে।
শেষ পর্যন্ত বাশারই জিতবেন?
টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে
দেশটির অনেক এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ১৬ লাখ সাধারণ মানুষ প্রতিবেশী
দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়ে কাটাচ্ছে মানবেতর জীবন। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৮০ হাজার লোক
নিহত হয়েছে এ যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। একবার প্রেসিডেন্ট বাশার
আল-আসাদের অনুগত সেনারা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের হটিয়ে দেয় তো
আরেকবার বিদ্রোহী বাহিনী কোণঠাসা করে তোলে সরকারি সেনাদের।
তাহলে সিরিয়াযুদ্ধের পরিণতি কী?
এ প্রশ্ন এখন সবার মনে। কিন্তু এর সহজ কোনো উত্তর নেই।
তবে বিদেশি হস্তক্ষেপের হিসাব বাইরে রাখলে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অবস্থান
এখনো বিদ্রোহীদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মজবুত। প্রতিবেশী লেবাননের
কট্টরপন্থী ইসলামি শিয়াগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সম্প্রতি প্রকাশ্যে বাশারের পক্ষে
লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে। মিত্র রাশিয়া ও ইরান সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। বাশারের অনুগত
সেনাদের সবল রাখতে রাশিয়া জাহাজ ভরে অস্ত্র আর গোলাবারুদ দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের
কয়েকটি পর্যায়ে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়ল বলে মনে হলেও বাস্তবে তা
থেকে তারা অনেক দূরে। সিরিয়ায় বাশারের সরকারকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এ
মুহূর্তে সক্রিয়ভাবে সরাসরি সহযোগিতা করছে হিজবুল্লাহ ও রাশিয়া। ইরানের ভূমিকাটা
অন্য রকম। তারা মূলত সমর্থন দিচ্ছে পার্শ্বরেখা থেকে। শিয়া প্রাধান্যপুষ্ট দেশ
ইরান চায় সিরিয়ায়ও বাশারের শিয়া সরকার টিকে থাকুক। বাশারকে তারা প্রয়োজনে
অর্থসহ যেকোনো সহায়তা দিতে প্রস্তুত। আবার কট্টর শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহর বড়
পৃষ্ঠপোষক এই ইরান। সংগঠনটি চায় বাশার ক্ষমতায় থাকুন। বাশার ও হিজবুল্লাহর
অভিন্ন শত্রু ইজরায়েল।
হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সহায়তায়ই সিরীয় সেনারা সমপ্রতি
বিদ্রোহীদের দখল থেকে কুশায়ের শহর পুনরুদ্ধার করেছে। লেবানন সীমান্তের কাছের
গুরুত্বপূর্ণ শহরটি সরকারি সেনাদের পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় যুদ্ধে বাশারের
কৌশলগত অবস্থান মজবুত হয়েছে।
হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের উপস্থিতি যে বাশারের শক্তি বহুগুণ
বাড়িয়ে দিয়েছে, এ কথা বিদ্রোহীরাই এখন স্বীকার করছে। আহমেদ নামের বাশারবিরোধী এক সাবেক
যোদ্ধার ভাষ্য, ‘হিজবুল্লাহর উপস্থিতি যুদ্ধে বড় ধরনের
ব্যবধান তৈরি করেছে। কারণ, এই যোদ্ধারা সত্যিকারের সৈনিক।
তারা আমৃত্যু লড়ে।’
বাশারের সেনাদের জন্য প্রধান ভরসা রাশিয়ার সমর্থন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কার্যত একমাত্র সিরিয়াই আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর
প্রভাবমুক্ত রয়েছে। রাশিয়া চায় না, বাশার পরাজিত হয়ে এ দেশটিও পশ্চিমাদের
করতলগত হোক। এতে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে রাশিয়ার যেমন দূরত্ব সৃষ্টি হবে, তেমনি দেশটিতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার নামে ধর্মীয় উগ্রপন্থার মাথাচাড়া
দিয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে তা রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য
হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটি সিরিয়ার
উপকূলেই।
কাজেই রাশিয়া নিজের স্বার্থেই বাশারের সমর্থনে কাজ করছে।
পরিস্থিতি বিচার করলে বাশারের পক্ষে থাকলে রাশিয়ার অনেক লাভ। এক দিকে অস্ত্র
বিক্রির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আসছে, একই সঙ্গে সিরিয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে
উপস্থিতি বজায় রাখা যাচ্ছে। সর্বোপরি প্রতিদ্বন্দ্বী পশ্চিমা দেশগুলোকেও একটা
শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
বাহরিনে আরব বসন্তের ঝড় ওঠার সময় সৌদি আরবের সহযোগিতায়
দেশটির কর্তৃপক্ষ কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করে। তখন আমেরিকা বাহরিনের কাছে অস্ত্র
বিক্রি করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। রাশিয়ার প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষক রুজলান পুকভ
এ প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমেরিকা তখন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন?’
বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাস বলেন, ‘সি আই এ,
ফ্রান্স ও ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি তুরস্কের মাধ্যমে
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের কাছে সমরাস্ত্র পাঠাতে পারে, সেখানে
সিরিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রিতে রাশিয়ার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, সিরিয়ায় এখন রাশিয়ার তৈরি প্রায় পাঁচ
হাজার ট্যাংক রয়েছে। পদাতিক সেনাদের লড়াই করার মতো ভারী সাঁজোয়া যান রয়েছে
আড়াই হাজারের মতো। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান দিয়ে
যাচ্ছে রাশিয়া।
দৃশ্যত পরিস্থিতি এখন বাশারের অনুকূলে। গত ডিসেম্বরে
জার্মানি মন্তব্য করেছিল,
বাশার এখন পতনের শেষ ধাপে রয়েছেন। এখন তারাই বলছে, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।
সামপ্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ
গৃহযুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। স্যান ডিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক বারবারা ওয়াল্টারের তথ্যমতে, ১৯৪৫ সাল থেকে যেসব
গৃহযুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো গড়ে ১০ বছর করে টিকেছে।
কিছু বিশ্লেষক সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে প্রতিবেশী লেবাননের
গৃহযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। ওই গৃহযুদ্ধ ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলেছে।
ওয়াল্টারের মতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধও আরও বহু বছর চলবে। আর পরিণতিতে বাশারের বিজয় আসবে না।
এর বিপরীত মন্তব্যও আছে। কিছু পর্যবেক্ষকের ভাষ্য, ১৯৯১ সালের
উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ১৮টি প্রদেশের
মধ্যে ১৫টিরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। এরপরও দাপটের সঙ্গে আবার এসব প্রদেশে
নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনেন। দেশ শাসন করে যান আরও ১২টি বছর। সে তুলনায় বাশারের
অবস্থান অনেক ভালো। ১৪টি প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে একমাত্র রাক্কা এখন বিদ্রোহীদের
নিয়ন্ত্রণে। প্রভাবশালী রাশিয়া ও চীন সিরিয়ার পাশে থাকায় জাতিসংঘেও ইচ্ছামতো
উদ্যোগ নিতে পারছে না মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য। অন্যদিকে বিদ্রোহীদের
গতিবিধি বুঝে দফায় দফায় যুদ্ধের কৌশল পাল্টাচ্ছেন বাশার। বিদ্রোহীদের পর্যুদস্ত
করতে মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। সিরিয়ার
রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদও ভালোই। সবমিলিয়ে সাদ্দামের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক
অবস্থানে বাশার। এসব কারণে বিশেষজ্ঞদের অন্তত একটি অংশ মনে করে, দেরিতে হলেও গৃহযুদ্ধে হয়তো শেষ পর্যন্ত বাশারই জিতবেন।