Friday, August 30, 2013

syria vs us


সিরিয়া সংকট
চ্যালেঞ্জের নাম রাসায়নিক অস্ত্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায়, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রেড লাইনবা চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছেন। কাজেই এখন তাঁকে শাস্তি পেতে হবে। পাশ্চাত্যের নেতারা একসুরে বলছেন, নিরীহ জনগণের ওপর এত বড় নির্মমতা আন্তর্জাতিক বিশ্ব চুপ করে মানবে না। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল ও শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা এরই মধ্যে বলেছেন, সমরাস্ত্র নিয়ে পুরোপুরি তৈরি মার্কিন সেনারা। এখন শুধু ওবামার হুকুমের অপেক্ষা। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সমরযন্ত্রের নিয়ন্ত্রকদের এ ঘোষণার পর থেকে দৃশ্যত সিরিয়া অভিযান সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশেষ করে রাশিয়ার সামরিক সহায়তাপুষ্ট সিরিয়া শক্তির বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যের মোটামুটি সমীহ জাগানো দেশ। হামলার ভয়ে তারা কুঁকড়ে যায়নি; বরং দম্ভ প্রকাশ করেছে। দেশটির বিদেশমন্ত্রী ওয়ালিদ মোয়াল্লাম বেশ তেজের সঙ্গেই বলেছেন, সিরিয়ার কাছে এমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে, যা গোটা বিশ্বকে চমকে দেবে। তবে পাশ্চাত্যের অভিযানের মুখে শক্তিশালী ইরাকের পরিণতির কথা মাথায় রাখলে বিদেশমন্ত্রীর এ কথায় সিরীয়দের ভরসা পাওয়ার বিশেষ কারণ নেই। প্রশ্ন উঠেছে, সিরিয়ায় হামলা চালালে আমেরিকা ও তার মিত্ররা লিবিয়ার ঘটনার মতো সহজেই জয়ী হতে পারবে কি না; নাকি জড়িয়ে পড়বে আরেক ইরাকজাতীয় ফাঁদে। এ উদ্বেগ থেকেই আমেরিকা সিরিয়া অভিযানে নামতে এত দিন গড়িমসি করছিল। সপ্তাহ খানেক আগে দেওয়া ভাষণেও ওবামা বলেছিলেন, আমেরিকা বাশার বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করার অভিযোগটি খতিয়ে দেখছে। তিনি হুট করেই আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে চান না।লিবিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা শক্তির বেশ তফাত রয়েছে। বাশার নীরবে সমরাস্ত্রের বিশাল এক মজুত গড়ে তুলেছেন। এর উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাপক বিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র। আগেও বিভিন্ন সময় সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে ও নিজ জনগণের বিরুদ্ধে তা প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাশারবিরোধী বিদ্রোহীরাও কখনো কখনো এ কাজ করেছে বলে অভিযোগ আছে। সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানো হলে সংগত কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হবে বাশারের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত ধ্বংস করা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব সতর্ক না হলে হামলার পরিণতি হবে মারাত্মক। জাহাজ বা বিমান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ভুল জায়গায় পড়লে রাসায়নিক অস্ত্র বিস্ফোরিত হয়ে যে গ্যাস ও ক্ষতিকর পদার্থ ছড়াবে, তাতে বেঘোরে মারা পড়বে হাজারো নিরীহ মানুষ। এ জন্য পেন্টাগন কর্মকর্তারা খুব সতর্কভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করে সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা ও ঘাঁটিতে হামলা চালানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু মুখে বললেই সুনির্দিষ্টভাবে বাশারের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুতে আঘাত হানা সহজ হবে না। আমেরিকা ও তার মিত্ররা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না, বিপজ্জনক সারিন ও মাস্টার্ড গ্যাসে ভরা রাসায়নিক অস্ত্রগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন বাশার। আর বিভিন্ন স্থানে রাখা এই মারণাস্ত্রের মজুত এতটাই বিশাল যে যতই ধ্বংস করা হোক না কেন, কিছুটা থেকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশ জোরালো। তা পড়তে পারে জঙ্গিদের মতো আরও বিপজ্জনক পক্ষের হাতেও। সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক দুঃস্বপ্ন। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পশ্চিমি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা ছিল, সিরিয়ার ভেতর ১৫টি বা তার বেশি গোপন স্থানে রাসায়নিক অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সেই যুদ্ধের বয়স এখন দুই বছর পার হয়েছে। এত দিনে পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়ে থাকতে পারে।ওয়াশিংটনের হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের শিক্ষক ও সাবেক পেন্টাগন কর্মকর্তা এলিয়ট কোহেন বলেন, এত দিনে এসব রাসায়নিক অস্ত্র আরও কয়েকটি গোপন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছে বাশারের অনুগত সেনারা। নতুন স্থানগুলোর হদিস করা এবং খুঁজে খুঁজে সেখানে হামলা চালানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাঁর মতে, রাসায়নিক অস্ত্রের মজুতে আঘাত হানলে সবচেয়ে বিপজ্জনক যে ঘটনাটি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, তা হচ্ছে আশপাশের লোকজন এর সংস্পর্শে আসা। এলিয়ট কোহেনের মতে, বরং স্থলপথে সেনা অভিযান চালিয়ে স্থাপনা অবরোধ করে অস্ত্রগুলো যদি উদ্ধার করা যায়, তাহলে জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্থল অভিযান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। খরচের বোঝা বাড়া ও বিপদের ঝুঁকি ছাড়াও এর মধ্যে তাদের নিজস্ব আইনি জটিলতার ব্যাপার আছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রক পেন্টাগন হিসাব করে দেখেছে, এ ধরনের অভিয়ানে ৭৫ হাজার সেনার প্রয়োজন হতে পারে।
গত মাসে সিরিয়ায় সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান (জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ চেয়ারম্যান) জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি। কংগ্রেসের সশস্ত্র বাহিনীসংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান মিশিগানের ডেমোক্র্যাট সিনেটর কার্ল লেভিনের কাছে এ বিবরণ দেন তিনি। মার্টিন ডেম্পসি বলেন, রাসায়নিক অস্ত্রের স্থানান্তর ও সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এই মজুতের অংশবিশেষ ধ্বংস করে দেওয়া যায়। একই সঙ্গে এসব অস্ত্র ব্যবহারের সরঞ্জামও বাজেয়াপ্ত করা যায়। কিন্তু তা করতে গেলে অন্তত উড্ডয়ননিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ভারী অস্ত্র লাগবে। লাগবে আরও বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র। এসব ব্যবহারে লাগবে আবার কয়েক’শ যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ, ডুবোজাহাজ এবং এ ধরনের যান ও সরঞ্জাম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে অভিযান চালাতে লাগবে বিশেষ ও পদাতিক বাহিনীর হাজার হাজার সেনা। কিন্তু ওবামা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ কেউই চান না সিরিয়ার মাটিতে মার্কিন সেনারা যাক। এ জন্য ওবামা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা আকাশযুদ্ধের কথাই ভেবেছেন।
বিমান হামলাও শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত হবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার মতো যথেষ্ট শক্তি আছে বাশারের বিমানবাহিনীর। এ জন্য রাশিয়া পর্যাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে সিরিয়াকে। যদিও সিরিয়ার বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রসরঞ্জামের কতগুলো কর্মক্ষম আর যথেষ্ট হালনাগাদ, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
কিছু মার্কিন কর্মকর্তা আবার দূরপাল্লার টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে স্থলে আঘাত হানার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এসব ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার পাউন্ডের বেশি যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম নয়। এই যুদ্ধাস্ত্র মাটির এতটা গভীরে গিয়ে আঘাত হানতে সক্ষম হবে না, যেখানে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত রয়েছে।
এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের রাসায়নিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অ্যামি স্মিথসন বলেন, রেটামাহক দিয়ে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করার চেষ্টা একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এই ক্ষেপণাস্ত্র যদি অর্ধেক রাসায়নিক অস্ত্রও ধ্বংস করে, এর বিপরীতে প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যাবে বহুগুণ। ধ্বংস হওয়া রাসায়নিক অস্ত্র থেকে যে প্রাণঘাতী গ্যাস বেরোবে, তা নিকটবর্তী এলাকার মানুষের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
অ্যামি স্মিথসনের মতে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর আগে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুত আছেএমন এলাকার লোকজনকে আগেভাগে সতর্ক করে দিতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে তাদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা। এ জন্য তাদের গ্যাসরোধী মুখোশ দিতে হবে। এ পরামর্শ যে যুদ্ধের বাস্তব কারণেই সম্ভব নয়, এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। তার মানে, সিরিয়ায় হামলা চালালে নিরীহ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। অথচ কিনা সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্যই এ অভিযানের আয়োজন বলে দাবি করছে পাশ্চাত্য। তারা এ উদ্বেগের সমাধান কীভাবে করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।


সিরিয়ায় যুদ্ধের ভেতর যুদ্ধ
সিরিয়ার সরকারবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ফ্রি সিরিয়ান আর্মির (এফএসএ) অন্যতম শীর্ষ নেতা কামাল হামামিকে সম্প্রতি হত্যা করেছে জঙ্গিরা। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে বিদ্রোহীদের অভ্যন্তরে উদারপন্থী ও আল-কায়েদাসংশ্লিষ্ট ইসলামপন্থীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব।
এফএসএর একজন নেতার ভাইকে অপহরণ করেছে সিরিয়ার সবচেয়ে বড় জঙ্গি সংগঠন নুসরা ফ্রন্ট। সেই নেতা এখন নুসরা ফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। তিনি এখন সিরিয়ার সীমান্তের ওপারেই তুরস্কের কোথাও অবস্থান করছেন। ভাইয়ের মুক্তিপণ হিসেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ৫০ হাজার মার্কিন ডলার গুনতে হয়েছে তাঁকে। এফএসএর এ নেতা জানেন, নুসরা ফ্রন্ট ওই টাকা দিয়ে কেবল অস্ত্র কিনবে। আর সেই অস্ত্র ব্যবহূত হবে এফএসএর বিরুদ্ধে।
এফএসএর ওই নেতা বলেন, তাঁর বাহিনীকে দুর্বল করে দিতে একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীকে পাঠানো হয়েছিল। ওই হামলায় ১২ জন নিহত হয়। তখন এফএসএর অধিকাংশ যোদ্ধা কোসায়েরের লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকায় হামলাকারীরা সুযোগ নিয়েছিল।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র বিরোধ চলে আসছে। উদারপন্থী ও চরমপন্থীদের এই বিরোধ প্রায়ই রক্তাক্ত রূপ নেয়। সরকারি বাহিনীর আক্রমণে বিদ্রোহীরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লেও তাদের অভ্যন্তরীণ লড়াই থামেনি। এই লড়াইকে গৃহযুদ্ধের অভ্যন্তরে আরেকটি গৃহযুদ্ধ বলা যেতে পারে। এফএসএর শীর্ষ নেতা কামাল হামামিকে হারানোর পর তা আরও জোরালো হয়েছে। তিনি লাতাকিয়া প্রদেশে এফএসএর একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিগেড পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। বিদ্রোহীদের দাবি, হামামি এফএসএর সর্বোচ্চ সামরিক পরিষদের সদস্য ছিলেন বলেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এফএসএর আরও কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। বিদ্রোহীদের এই অন্তর্কলহের কারণ কিছুটা স্বার্থগত ও কিছুটা আদর্শিক। এফএসএর কয়েকটি ব্রিগেডের যোদ্ধাদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে উভয়পক্ষই ধার্মিক। তাদের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য হলো এফএসএর ধর্মনিরপেক্ষ অংশটি ভবিষ্যতে সিরিয়াকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু জঙ্গিরা দেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।
সরকারবিরোধী এক মহিলা মন্তব্য করেন, জঙ্গিদের এই আধিপত্য গোটা বিপ্লবের জন্য বিপর্যয়কর। তিনি জানান, বন্দুকধারী কট্টর ইসলামপন্থী যোদ্ধারা মহিলাদের কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া সাংগঠনিক সভা ও কর্মকাণ্ডে মহিলার অংশগ্রহণে বাধা দিচ্ছে তারা। ওই মহিলা বলেন, তাঁরা এমন যোদ্ধাদের চান না।
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে অনেক বিদেশি যোদ্ধা। মূলত এরাই জঙ্গি। বলা হচ্ছে, এফএসএর অভ্যন্তরে যে দুর্নীতি ও অন্তর্কলহ রয়েছে তারই সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা। এফএসএর লুটপাটের প্রতিবাদ করেছিলেন একজন বিদ্রোহী। এ জন্য তাঁকে দেশ থেকেই পালাতে হয়েছে।
মোট কথা, সিরিয়ায় বাশারবিরোধী গণবিক্ষোভের প্রথম দিকে যে আদর্শিক চেতনা কাজ করেছে, তা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। সিরীয় জনগণের অনেকে এখন মনে করছে, শুরুর সেই গণবিপ্লব কলুষিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে নতুন এক ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে। অপহরণ ও ডাকাতির মতো অপরাধের ঘটনাও সেখানে ঘটছে।
প্রেসিডেন্ট বাশারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে সুন্নি মুসলমানদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই বিদ্রোহীদের পক্ষ ছেড়ে যাচ্ছে। কারণ, সব দিক বিবেচনা করে তারা সরকারপক্ষকেই মন্দের ভালোমনে করছে।

শেষ পর্যন্ত বাশারই জিতবেন?
টানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে দেশটির অনেক এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ১৬ লাখ সাধারণ মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়ে কাটাচ্ছে মানবেতর জীবন। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৮০ হাজার লোক নিহত হয়েছে এ যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। একবার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত সেনারা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহীদের হটিয়ে দেয় তো আরেকবার বিদ্রোহী বাহিনী কোণঠাসা করে তোলে সরকারি সেনাদের।
তাহলে সিরিয়াযুদ্ধের পরিণতি কী?
এ প্রশ্ন এখন সবার মনে। কিন্তু এর সহজ কোনো উত্তর নেই। তবে বিদেশি হস্তক্ষেপের হিসাব বাইরে রাখলে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অবস্থান এখনো বিদ্রোহীদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি মজবুত। প্রতিবেশী লেবাননের কট্টরপন্থী ইসলামি শিয়াগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সম্প্রতি প্রকাশ্যে বাশারের পক্ষে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে। মিত্র রাশিয়া ও ইরান সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। বাশারের অনুগত সেনাদের সবল রাখতে রাশিয়া জাহাজ ভরে অস্ত্র আর গোলাবারুদ দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের কয়েকটি পর্যায়ে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কে ঢুকে পড়ল বলে মনে হলেও বাস্তবে তা থেকে তারা অনেক দূরে। সিরিয়ায় বাশারের সরকারকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে সক্রিয়ভাবে সরাসরি সহযোগিতা করছে হিজবুল্লাহ ও রাশিয়া। ইরানের ভূমিকাটা অন্য রকম। তারা মূলত সমর্থন দিচ্ছে পার্শ্বরেখা থেকে। শিয়া প্রাধান্যপুষ্ট দেশ ইরান চায় সিরিয়ায়ও বাশারের শিয়া সরকার টিকে থাকুক। বাশারকে তারা প্রয়োজনে অর্থসহ যেকোনো সহায়তা দিতে প্রস্তুত। আবার কট্টর শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহর বড় পৃষ্ঠপোষক এই ইরান। সংগঠনটি চায় বাশার ক্ষমতায় থাকুন। বাশার ও হিজবুল্লাহর অভিন্ন শত্রু ইজরায়েল।
হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সহায়তায়ই সিরীয় সেনারা সমপ্রতি বিদ্রোহীদের দখল থেকে কুশায়ের শহর পুনরুদ্ধার করেছে। লেবানন সীমান্তের কাছের গুরুত্বপূর্ণ শহরটি সরকারি সেনাদের পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় যুদ্ধে বাশারের কৌশলগত অবস্থান মজবুত হয়েছে।
হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের উপস্থিতি যে বাশারের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, এ কথা বিদ্রোহীরাই এখন স্বীকার করছে। আহমেদ নামের বাশারবিরোধী এক সাবেক যোদ্ধার ভাষ্য, ‘হিজবুল্লাহর উপস্থিতি যুদ্ধে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি করেছে। কারণ, এই যোদ্ধারা সত্যিকারের সৈনিক। তারা আমৃত্যু লড়ে।
বাশারের সেনাদের জন্য প্রধান ভরসা রাশিয়ার সমর্থন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কার্যত একমাত্র সিরিয়াই আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবমুক্ত রয়েছে। রাশিয়া চায় না, বাশার পরাজিত হয়ে এ দেশটিও পশ্চিমাদের করতলগত হোক। এতে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে রাশিয়ার যেমন দূরত্ব সৃষ্টি হবে, তেমনি দেশটিতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার নামে ধর্মীয় উগ্রপন্থার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। পরবর্তী সময়ে তা রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটি সিরিয়ার উপকূলেই।
কাজেই রাশিয়া নিজের স্বার্থেই বাশারের সমর্থনে কাজ করছে। পরিস্থিতি বিচার করলে বাশারের পক্ষে থাকলে রাশিয়ার অনেক লাভ। এক দিকে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ আসছে, একই সঙ্গে সিরিয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে উপস্থিতি বজায় রাখা যাচ্ছে। সর্বোপরি প্রতিদ্বন্দ্বী পশ্চিমা দেশগুলোকেও একটা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
বাহরিনে আরব বসন্তের ঝড় ওঠার সময় সৌদি আরবের সহযোগিতায় দেশটির কর্তৃপক্ষ কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করে। তখন আমেরিকা বাহরিনের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। রাশিয়ার প্রতিরক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষক রুজলান পুকভ এ প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমেরিকা তখন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন?’
বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাস বলেন, ‘সি আই এ, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি তুরস্কের মাধ্যমে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের কাছে সমরাস্ত্র পাঠাতে পারে, সেখানে সিরিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রিতে রাশিয়ার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, সিরিয়ায় এখন রাশিয়ার তৈরি প্রায় পাঁচ হাজার ট্যাংক রয়েছে। পদাতিক সেনাদের লড়াই করার মতো ভারী সাঁজোয়া যান রয়েছে আড়াই হাজারের মতো। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।
দৃশ্যত পরিস্থিতি এখন বাশারের অনুকূলে। গত ডিসেম্বরে জার্মানি মন্তব্য করেছিল, বাশার এখন পতনের শেষ ধাপে রয়েছেন। এখন তারাই বলছে, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।
সামপ্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ গৃহযুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। স্যান ডিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বারবারা ওয়াল্টারের তথ্যমতে, ১৯৪৫ সাল থেকে যেসব গৃহযুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো গড়ে ১০ বছর করে টিকেছে।
কিছু বিশ্লেষক সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে প্রতিবেশী লেবাননের গৃহযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। ওই গৃহযুদ্ধ ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলেছে। ওয়াল্টারের মতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধও আরও বহু বছর চলবে। আর পরিণতিতে বাশারের বিজয় আসবে না।

এর বিপরীত মন্তব্যও আছে। কিছু পর্যবেক্ষকের ভাষ্য, ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ১৮টি প্রদেশের মধ্যে ১৫টিরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। এরপরও দাপটের সঙ্গে আবার এসব প্রদেশে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনেন। দেশ শাসন করে যান আরও ১২টি বছর। সে তুলনায় বাশারের অবস্থান অনেক ভালো। ১৪টি প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে একমাত্র রাক্কা এখন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। প্রভাবশালী রাশিয়া ও চীন সিরিয়ার পাশে থাকায় জাতিসংঘেও ইচ্ছামতো উদ্যোগ নিতে পারছে না মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য। অন্যদিকে বিদ্রোহীদের গতিবিধি বুঝে দফায় দফায় যুদ্ধের কৌশল পাল্টাচ্ছেন বাশার। বিদ্রোহীদের পর্যুদস্ত করতে মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদও ভালোই। সবমিলিয়ে সাদ্দামের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে বাশার। এসব কারণে বিশেষজ্ঞদের অন্তত একটি অংশ মনে করে, দেরিতে হলেও গৃহযুদ্ধে হয়তো শেষ পর্যন্ত বাশারই জিতবেন।

Thursday, August 29, 2013

syria war


সিরিয়ায় যুদ্ধের দামামা

সিরিয়ায় বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা সিরিয়ায় সামরিক হামলার ছক কষে ফেলেছে। আজ বৃহস্পতিবারই সিরিয়ায় হামলা চালানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন এক মার্কিন কর্মকর্তা। তবে পশ্চিমাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে রাশিয়া বলেছে, সিরিয়ায় হামলা হলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সতর্ক করে ইরান বলেছে, সিরিয়া আক্রান্ত হলে ইসরায়েলও অক্ষত থাকবে না। আগুন জ্বলবে ইসরায়েলেও। এ হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও সিরিয়ায় হামলার অনুমতি চেয়ে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে যুক্তরাজ্য। গতকালই 
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের অনুমতি চেয়ে একটি প্রস্তাব তুলেছে যুক্তরাজ্য। সর্বশেষ খবর পর্যন্ত প্রস্তাবটি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা চলছিল। ওদিকে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েলও। সীমান্তের বাসিন্দাদের জরুরি গ্যাস-মাস্ক সরবরাহ শুরু করেছে তারা। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা হামলার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ওয়ায়েল আল হালকি গতকাল বলেছেন, সামরিক হস্তক্ষেপে আগ্রাসী শক্তির কবর রচনা হবে। এদিকে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শক দল বলছে, সিরিয়ার সরকারি বাহিনী যে দামেস্কের উপকণ্ঠে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে তারা তার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আরেকবার তদন্ত চালানো হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, তদন্তকাজ শেষ করতে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শকদের আরও চারদিন সময় লাগবে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত লাখদার ব্রাহিমি বলেছেন, সিরিয়ায় হামলা চালাতে হলে অবশ্যই জাতিসংঘের অনুমতি নিতে হবে। রাশিয়া বলেছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই সিরিয়ায় হামলার অনুমতি দেওয়ার আগে অস্ত্র পরিদর্শকদের তদন্তকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সিরিয়ায় সামরিক হামলা চালাতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। আজই হামলা চালানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন ওবামা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। গতকাল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসি নিউজকে ওই কর্মকর্তা বলেন, সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে সম্ভাব্য হামলা বৃহস্পতিবারই শুরু হতে পারে। এ অভিযান হতে পারে সীমিত আকারে। স্থায়ী হবে এক বা দু'দিন। হামলার টার্গেট হবে প্রধানত সিরিয়ার সামরিক বাহিনী ও সামরিক স্থাপনাগুলো। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে হামলা চালাবে না। মিত্রদের সঙ্গে নিয়েই এগোবে। এর আগে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল ঘোষণা দিয়েছেন, যে কোনো সময়ে সিরিয়ায় সামরিক হামলা চালাতে প্রস্তুত মার্কিন বাহিনী। অপেক্ষা শুধু প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্দেশের। 

যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা নিশ্চিত দামেস্কের কাছে বিদ্রোহীদের ওপর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীই রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, জঘন্য রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের জন্য বাশার আল আসাদের সরকারই দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো বলেছে, সিরিয়া সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টিকে বিনা জবাবে ছেড়ে দেওয়া হবে না।
এদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের অন্যতম রাশিয়া পশ্চিমাদের সিরিয়া আক্রমণ প্রস্তুতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তাতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনী দামেস্কের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র হামলার জন্য দায়ী বলে মনে করে না রাশিয়া। রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদিমির টিটোভ বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে সিরিয়া ইস্যুতে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্যই অস্ত্র পরিদর্শক দলের বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে যে কোনো পরিস্থিতির আশঙ্কায় সিরিয়া থেকে তার জনগণ ও কর্মকর্তাদের বিশেষ বিমান পাঠিয়ে ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে রাশিয়া। অন্যদিকে সিরিয়ার মিত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ইরান হুমকি দিয়ে বলেছে, সিরিয়া আক্রান্ত হলে পশ্চিমাদের মিত্র ইসরায়েলেও হামলা চালানো হবে। ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আব্বাস আরকি এ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সিরিয়ায় হামলা হলে তা সীমান্তে আটকে থাকবে না। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবেতারা চান মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংস বয়ে আনবে। 

এদিকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেশ কিউবা হুঁশিয়ার করে বলেছে, সিরিয়ায় হামলা ইতিমধ্যে অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে। তাছাড়া এটা হবে জাতিসংঘ সনদের পরিষ্কার লঙ্ঘন।

পশ্চিমীদের যুদ্ধের প্রস্তুতি
ক্রজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় চারটি যুদ্ধজাহাজ ও একটি সাবমেরিন সিরিয়ার দিকে তাক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া তুরস্ক ও জর্ডানে থাকা দুটি বিমানঘাঁটি থেকে বিমান হামলা চালাতে পারে দেশটি। এ ছাড়া এ অঞ্চলে থাকা দুটি বিমানবাহী রণতরী ব্যবহার করবে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোকে এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য জিব্রাল্টার প্রণালিতে থাকা তাদের একটি সাবমেরিন থেকে ত্রুক্রজ হামলা চালাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাইপ্রাসে থাকা ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বিমানঘাঁটি থেকে হামলা চালানো হতে পারে। এই মুহূর্তে পশ্চিম ভূ-মধ্যসাগরে রয়েছে ফ্রান্সের বিমানবাহী রণতরী চার্লস দ্য গল। সিরিয়ায় যুদ্ধে এটি ব্যবহার করা হবে। অন্যদিকে আকাশপথে হামলায় অংশ নিতে পারে রাফায়েল অ্যান্ড মিরেজ যুদ্ধবিমান। ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে আরব আমিরাত। হামলা চালানো হবে শুধু প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ নিয়ন্ত্রিত সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোতে। যেসব ঘাঁটি থেকে সরকারি সেনারা হামলা করে থাকে সেসব স্থানে এবং অস্ত্র ঘাঁটিগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হবে। তবে রাসায়নিক অস্ত্র আছে সন্দেহভাজন এমন স্থানে হামলা চালানো হবে না। বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ আরও বাড়ানো হবে। এ ছাড়া সিরিয়া সরকার যাতে তার বিমানবাহিনীকে ব্যবহার না করতে পারে এ জন্য নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা করা হবে। বাশার সরকারের কাছে রাশিয়ার নির্মিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এসব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা করা হতে পারে। বছরখানেক ধরে নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনা করে আসছে পশ্চিমারা। এ ছাড়া বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে। খবর বিবিসির।
সিরিয়া যুদ্ধ কি বৈধ হবে?
সিরিয়ায় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে সিরিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপ বৈধ হবে কি-না। অর্থাৎ এটি আন্তর্জাতিক আইন মেনে করা হবে কি-না। একটি যুদ্ধ তখনই পুরোপুরি বৈধ হবে যখন সব রাষ্ট্র বিশেষত জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোর সম্মতিক্রমে অভিযান চালানো হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এটি প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
জাতিসংঘের রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট (আর২পি) সনদ অনুযায়ী, কোনো দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে যেসব মানদণ্ড মেনে চলতে হবে সেগুলো হচ্ছে_
প্রথমত, কোনো রাষ্ট্রকে তার জনগণকে গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্র যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তবে ওই রাষ্ট্রে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কোনো ক্ষেত্রে যদি এমন অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় যা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিবেচনায় আনা যাবে।
তৃতীয়ত, যদি উপরোক্ত সবগুলো প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয় তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে। সামরিক এই হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে অবশ্যই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে দেশটির পাশে রাশিয়া ও চীন থাকায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নেওয়া সম্ভব হবে না, তা একরকম নিশ্চিত প্রায়। তা হলে সিরিয়ায় হামলা কীভাবে বৈধ হবে?
আর২পি সনদে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থাও রয়েছে। তা হচ্ছে আঞ্চলিক জোট। একটি কোয়ালিশন তৈরি করে সামরিক হস্তক্ষেপ পরিচালনা করা যেতে পারে। তা করার জন্যও তিনটি শর্ত রয়েছে। এগুলো হলো_ সংশ্লিষ্ট দেশে মারাত্মক হত্যাযজ্ঞের শক্তিশালী প্রমাণ থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনীতিক আলোচনা ও নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করতে হবে। তাতে কাজ না হলে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে। তবে প্রত্যেকটি হামলা করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নৃশংতা থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষা করার লক্ষ্যে। সিরিয়ায় হামলার ক্ষেত্রে এই দিকটি সামনে রেখেই এগোতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।

রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার কী ইঙ্গিত দিচ্ছে
সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহীরা দাবি করছে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে। সম্প্রতি সারি করে শুইয়ে রাখা মৃত শিশুদের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, সিরীয় বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগে ওইদিন শিশুসহ অন্তত এক হাজার ৩০০ জন নিহত হয়েছে। এ অভিযোগে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আবার ঘটনা ও পারিপাশর্ি্বক অবস্থা তলিয়ে দেখলে কিছু প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয়।
প্রশ্নটি হতে পারে_ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী, এটি কিসেরই বা প্রতিধ্বনি করছে? যদি এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ সত্য হয়, তবে তা দেশটির সরকার ও বিরোধীদের সংঘাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড় হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কেনই বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হুঁশিয়ারির পরও এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেবেন? তাছাড়া রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের অতীতের একটি অভিযোগ তদন্তে সিরিয়ায় যখন জাতিসংঘের একটি দল অবস্থান করছে, তখনই কেন তিনি এত বড় মাত্রায় এ ধরনের হামলা করতে যাবেন? ওই হামলা ও হতাহতের জন্য সরকার ও বিদ্রোহী উভয়েই পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
বিগত কয়েক সপ্তাহের সিরীয় পরিস্থিতি বিচার করলে এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক, এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট বাশারের সেনাবাহিনীর এ ধরনের হামলার কোনো আবশ্যকতা নেই। যখন এমনিতেই বিদ্রোহীদের ওপর ভারি অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে যথেষ্ট চাপের মুখে আছেন প্রেসিডেন্ট বাশার। অন্যদিকে, এ ধরনের হামলা সিরীয় বাহিনীর রণকৌশলেরই একটি অংশ হতে পারে। রাসায়নিক বা অন্য কোনো হামলা_ যার মাধ্যমে ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে নেওয়া যেতে পারে। রাসায়নিক অস্ত্রের সামরিক ও মনস্তাত্তি্বক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এর মাধ্যমে হত্যা করা যায়। আবার জনতাকে ভীত করেও তোলা যায়।
রাসায়নিক অস্ত্র কেবল বেপরোয়া মনোভাব থেকেই ব্যবহার করা হয় না। বেশ আড়ম্বর দেখাতেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমনটি করেছিলেন ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। ১৯৮৮ সালে উত্তর ইরাকের হালাবজা গ্রামে কুর্দিদের ওপর শেষোক্ত কারণে এটি ব্যবহার করেছিলেন। সিরীয় প্রেসিডেন্ট নিজেকে লৌহমানব হিসেবে দেখাতে চান। আর জয়ী হতে গিয়ে যদি বদনাম কুড়াতে হয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। এজন্য হয়তো 'খুচরো' হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে পাইকারি হত্যা চালিয়ে বিরোধীদের অবশ করে দিতে চাইছে সরকারি বাহিনী। যুক্তির খাতিরে এটাও ধরে নেওয়া যায়, সিরিয়া হয়তো ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের দেখাতে চায়, প্রত্যুত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। ওই হামলা পশ্চিমাদের বিব্রত করেছে। বিরোধীদের শক্তিহীন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
আরেকটি প্রশ্ন হতে পারে_ সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পশ্চিমা বিশ্বের অপরাগতার ব্যাখ্যা কী? গত অর্ধ শতাব্দী ধরে এ ধরনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলের পদক্ষেপ নির্ভর করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ও ক্ষমতার ওপর। সিরিয়া ইস্যুতে অনেক আগেই ওবামা প্রশাসন পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, তারা সামরিক হস্তক্ষেপ করতে চায় না। হোয়াইট হাউস এখন নিজেদের ঘরোয়া এজেন্ডা বাস্তবায়নেই হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া আফগানিস্তান ও ইরাকে দুটি অজনপ্রিয় যুদ্ধের কলঙ্ক তো রয়েছেই। তাছাড়া সিরীয় ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্বার্থই হুমকির মুখে পড়ছে না। বিপরীতে এটাও বলা যায়, স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে বলেই এখন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল ও মার্কিন শত্রু সিরিয়া যদি অভ্যন্তরীণ সংঘাতে দুর্বলতর হয়ে যায়, ইরান ও হিজবুল্লাহ প্রেসিডেন্ট বাশারের পক্ষ নিয়ে অপদস্থ ও আরব বিশ্বে সমর্থন হারায় তাতে ক্ষতি কি? এ অবস্থায় সাইড লাইনে বসে সিরীয় পরিস্থিতি দেখার মধ্যে কোনো ক্ষতি নেই। তাছাড়া হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক হলে বা বিদ্রোহীদের সহায়তা করলে_ উভয় ক্ষেত্রেই 'উগ্র জিহাদিদের' লাভবান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিপরীতে আজকের অবস্থানে ওয়াশিংটনের মুখরক্ষার সব কৌশলই কার্যকর থাকছে।
শেষ প্রশ্নটি হতে পারে_ চূড়ান্ত সীমা অতিক্রান্ত হলে ওয়াশিংটন কি করবে? যদি প্রমাণিত হয় সিরীয় সরকারি বাহিনী রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে তাহলে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে তা ব্যাপক চ্যালেঞ্জ জুড়ে দেবে। চান বা না চান তাকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। কেননা তিনি আগেই এ ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন।
সূত্র : আলজাজিরা অনলাইন।

শিশুরা যুদ্ধের বলি
লেবাননের বালবেকের শরণার্থী শিবির। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মারসি করপোরেশনের সদস্যদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে কয়েকজন শিশু। তাদের সবাই সিরীয় শরণার্থী। হঠাৎ চোখ যায় একটু দূরে একটি ছেলের দিকে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছোট সেই ছেলেটিকে দেখলে মনে হবে হঠাৎ করেই অনেক বুড়িয়ে গেছে সে। চুলে পাক ধরেছে, চোখ ভাষাহীন।
১২ বছরের এই শিশুটির নাম মোস্তফা। বাড়ি সিরিয়ার আলেপ্পোয়। সেখানে ৬ ভাইবোন নিয়ে একটি বড় বাড়িতে থাকত সে। স্কুলে যাওয়ার পাশাপাশি ভেড়া চরিয়েই তার দিন কাটত। আসাদ সরকার নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র তৈরির কারখানার পাশে বাড়ি হলেও সহিংসতা শুরুর দেড়-দুই বছরের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব টের পায়নি মোস্তফার পরিবার। কাজেই দেশ ছাড়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাদের। কিন্তু ৬ মাস আগে অস্ত্র তৈরির কারখানা দখলে নিতে আলেপ্পোয় হামলা চালায় বিদ্রোহীদের জোট ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই রাজনৈতিক এই পট পরিবর্তনের যুদ্ধের মাঝে পড়ে যায় মোস্তফার পরিবার। মোস্তফার বোন ফাতেমা জানান, বাবা-মা ও ভাইবোনের সঙ্গে দেশ ছাড়ার সময় বারবারই নিজের ভেড়াগুলোর কাছে ছুটে যেতে চেয়েছে মোস্তফা।
সহিংসতায় বিধ্বস্ত গ্রাম পেছনে ফেলে লেবাননের শরণার্থী শিবিরে পেঁৗছতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মোস্তফা ও তার পরিবারকে। গোটা রাস্তাতেই গাদাগাদি করে ঠাসা বাসটি বারবার পড়েছে চেক পোস্টের মুখে। এর মধ্যে অনেকই সরকারি বাহিনীর, কিছু আবার বিদ্রোহীদের। একেকটি চেক পোস্টে কিছু কিছু যাত্রী রেখে এগিয়েছে বাসটি। এরপর লেবাননের বালবেকে পেঁৗছে আত্মীয়-পরিজন ছাড়া অপরিচিত জায়গায় রীতিমতো আরেক মানবেতর পরিস্থিতি।
যুদ্ধ মানেই সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে সে দেশের নারী ও শিশুরা। আড়াই বছরের যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। একের পর এক শহর নিজেদের দখলে নিতে হামলা-পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে আসাদ বাহিনী ও বিরোধীরা। চলমান যুদ্ধপরিস্থিতিতে স্বাভাবিক শৈশব হারিয়ে ফেলছে সিরীয় শিশুরা। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের রেশ বেশ ভালোই টের পাচ্ছে দেশটির লাখ লাখ মানুষ। লেবাননের মতো লাখ লাখ সিরীয় আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ জর্ডান, তুরস্ক, ইরাক ও মিসরের শরণার্থী শিবিরে। সিরিয়ার আড়াই বছরের সহিংসতায় শরণার্থীদের তালিকায় শুধু শিশুদের সংখ্যাই ১০ লাখে পেঁৗছেছে। এই ঘটনাকে দুঃখজনক মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটির দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, লেবানন, জর্ডান, তুরস্ক, ইরাক এবং মিসরের মোট সিরীয় শরণার্থীর অর্ধেকই শিশু। এদের সাড়ে ৭ লাখ শিশুর বয়সই ১১ বছরের নিচে। ৪ বছরের কম বয়স এমন শিশুর সংখ্যাই এক লাখ। সিরিয়া পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার কারণ হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
দেশের রাজনীতি বোঝার ক্ষমতা না থাকলেও সেই রাজনীতির বলি হচ্ছে তারা। মোস্তফার মতো অনেকেই আছে, যারা বেঁচে আছে, কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া। সিরিয়ার বিভিন্ন শহরের প্রতিটি অলি-গলিতে আর্টিলারির ক্ষতচিহ্ন প্রত্যক্ষ হলেও শিশুদের মনের ক্ষতের প্রভাব সুদূরপ্রসারি। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালালেও পিছু ছাড়েনি যুদ্ধের ভয়াবহতা। চোখের সামনে প্রিয়জনকে হত্যার দৃশ্য বা সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। এমন পরিস্থিতিতে তথাকথিত এই গণতন্ত্র অর্জনের চেষ্টার লড়াইয়ে যে পক্ষেরই জয় হোক না কেন, দীর্ঘ এই গৃহযুদ্ধে ক্ষতির পরিমাণ অপরিমাপযোগ্য। যুদ্ধ শেষে নিজ দেশে ফিরলেও ফিরবে না শিশুদের সেই সারল্য। সিরিয়ার ভবিষ্যৎ গিয়ে পড়বে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক প্রজন্মের হাতে।