মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্ট্র্যাটেজিক মৈত্রীর খুচরো কারবার
প্রায় এক বছর আগে ৮ই নভেম্বর, ২০১০ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারত সফরে এসেছিলেন। বুশ রাজত্বের নীতিই অনুসরণকারী ওবামা প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল আমেরিকান অর্থ প্রতিষ্ঠান ও বৃহৎ কোম্পানির স্বার্থের প্রতি খোলাখুলি সমর্থন। সেই সফরের বার্ষিকী পূরণের লক্ষ্যেই হয়তো ২০১১-র ২৪শে নভেম্বর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্যাবিনেট মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত হলো ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় খুচরো বাজার টেসকো, ওয়াল মার্ট,ক্যারিফোর প্রভৃতির জন্য ৫১ শতাংশের বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া এবং সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেলে ১০০ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ। দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার হিসাবে ক্যাবিনেটে এই সিদ্ধান্ত যখন নিল তখন ভারতের সংসদের শীতকালীন অধিবেশন চলছে, এবং দেশের ৪ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যাপারে দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোন মতামত নেবারও প্রয়োজন মনে করলো না। গণতন্ত্রের অবজ্ঞার এও এক নিদর্শন।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম — ওবামার ভারত সফর, সেই সময় সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রকাশিত নভেম্বর, ২০১০-এ ওবামার ভারত সফর উপলক্ষে ‘মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’ পুস্তকে স্পর্শকাতর ক্ষেত্রগুলি খুলে দেবার জন্য চাপ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, ‘‘বিদেশী বিনিয়োগের জন্য ভারতের খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্র খুলে দিতে ওয়াল মার্ট কোম্পানি প্রধান প্রকাশ্যে দরবার করছে। ভারতের চার কোটি মানুষের কর্মসংস্থান খুচরো ব্যবসার উপর নির্ভরশীল। প্রধানত এরা ক্ষুদ্র অসংগঠিত খুচরো ব্যবসায়ী। বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে খুচরো বাজার দখল করতে দিলে এই চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ‘মনসান্টো’র মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ভারতীয় কৃষিকে নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী। এই ওয়াল মার্ট ও মনসান্টো ‘‘ভারত-মার্কিন কৃষি জ্ঞান প্রবর্তক’-র অংশ।’’ এ তো গেল ওবামার ভারত সফরের প্রাক্কালে সি পি আই (এম)-র আশঙ্কা প্রকাশ। যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগের দরজা উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত আজ নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে সেপ্টেম্বর ২০০৭-এ প্রকাশ কারাত লিখিত পুস্তক ‘সাবঅরডিনেট অ্যালাই’ পুস্তকে যেখানে ব্লু প্রিন্ট ফর ইউ এস ক্যাপিটাল অধ্যায়ে বলা আছে ‘Liberalisation of FDI norms in Retail Trade’ (বিদেশী বিনিয়োগের দরজা খুচরো ব্যবসায়ে খুলে দেওয়া)। আজকে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু রাজ্যে কিছু কিছু আঞ্চলিক দল এই বিদেশী বিনিয়োগের বিরুদ্ধে দু’চার কথা বলছে। সেই প্রতিবাদ অবশ্যই স্বাগত, কিন্তু ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণ, বীমাক্ষেত্র বেসরকারীকরণ, পেনশন ব্যবস্থাকে শেয়ার বাজারের উপর নির্ভরশীল করা, তৈলক্ষেত্র বেসরকারীকরণ ও তেলের দামের বিনিয়ন্ত্রণ, টেলিকম ক্ষেত্র, কয়লা শিল্প, ডিফেন্সের সরঞ্জাম তৈরি — উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করা, খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগ প্রভৃতি ২০০৬ সালে বুশ-মনমোহন ঘোষিত ‘‘ইউ এস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের অংশ। তাই ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সের অংশ হলো খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগ। ২০০৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা কাঠামোগত চুক্তি, ২০০৬-এ ইন্দো-ইউ এস স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স, ২০০৮-এ ভারত-মার্কিন পরমাণু বিদ্যুৎ চুক্তি, ২০১১-এ খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগ সবটাই হচ্ছে ভারত-মার্কিন সমঝোতা কার্যকর করার পদক্ষেপ। তাই সমগ্র ভারত-মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সের বিরোধিতা থেকে সরে এসে, বিশ্ব প্রভুত্বের ছকের অংশ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নশীল বিশ্বের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জনস্বার্থের প্রতি শত্রুতামূলক নীতিসমূহকে পরাস্ত করা যাবে না। এই বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাবার দরকার আছে যে অবাধ অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক মৈত্রী আরও বিস্তৃত করাই এই বিদেশী বিনিয়োগের দরজা খোলা। ২০০৫ সালে ভারত সরকারের কনজিউমার্স অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস (ICRIER) ‘‘এফ ডি আই এন রিটেল সেক্টর ইন্ডিয়া ইন জুন ২০০৫’’-এ বলেছিল প্রথমে ৪৯ শতাংশ অনুমোদন দিতে হবে, তারপর তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ১০০ শতাংশই দিতে হবে। কিন্তু ২০১১-তে সিদ্ধান্ত ৪৯ নয় একেবারে ৫১ শতাংশ আর সিঙ্গল ব্র্যান্ডে ১০০ শতাংশ। কি প্রচণ্ড মার্কিন ও বহুজাতিক প্রেম। ২০০৭ সালের এক হিসাবে এই রিটেল ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘অ্যাহোল্ড-নেদারল্যান্ডের’ ৭৪%, ফ্রান্সের ক্যারিফোরের ৫২%, জার্মানির মেট্রোর ৫৩%, ইউ কে-র টেসকোর ২২%, ওয়াল মার্টের ২০% (ইউ এস এ) রেভিনিউ বেড়েছে। ওয়াল মার্টের ২০০৭ সালের আয় হচ্ছে ৩৭৯ বিলিয়ন ডলার, দ্বিতীয় ক্যারিফোরের আয় ১২৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতে আমাদের এই মুহূর্তের কাজ হলো আমেরিকার বর্তমান অচল অর্থনীতির ওয়াগনের পেছনে আমাদের দেশকে জুড়ে দেবার চেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
No comments:
Post a Comment