Friday, September 9, 2011

ওয়ালমার্টের ভারত-স্বপ্ন!

ওয়ালমার্টের ভারত-স্বপ্ন!
 


বিজ্ঞাপন আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের জগতে। যেমন মাইক্রোসফ্‌টের বিজ্ঞাপন জানান দিচ্ছে ‘আজ তুমি কোথায় যেতে চাও?’ এধরণের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে আমাদের মনও ভেসে বেড়ায়। অথচ সংবাদপত্রের পাতায় বিজ্ঞাপন অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত খবরের কাগজ তেমন আকর্ষণীয় হয় না। তা সে ব্যাঙ্কে চুরির ঘটনাই হোক বা কোন সংস্থার নতুন পণ্যসামগ্রী বাজারে নিয়ে আসার বিষয়েই হোক, সবই নির্দিষ্ট থাকে ক্রেতাদের পছন্দের দিকে লক্ষ্য রেখে। আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায় এইসব ক্রেতাদের নির্দিষ্ট কিছু পছন্দের দিকে তাকিয়ে। অনেক সময় আমরা খেয়াল করি না ক্রেতাদের প্রলুদ্ধ করার বিষয়ে বিনোদন জগৎ, গণমাধ্যম ও খুচরো ব্যবসায়ীদের মধ্যে কী ধরণের বোঝাপড়া কাজ করে
নামী বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলি ক্রেতাদের পছন্দের ধরণ ঘন ঘন পরিবর্তনের জন্য তাদের মানসিক বিচ্ছিন্নতার কথা বলে। বাস্তবে বহুজাতিক সংস্থার কাজের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আন্তর্জাতিক বাজারে টিনএজের ছেলেমেয়েদের পোষাকের ধরণ প্রায় একই রকমের। এখানে বাজার চলতি ভাষায় বিশ্বায়নে বিচ্ছিন্নতার কোনও জায়গা নেই। বরং পুরো উল্টো। বহুজাতিকদের শত্রুই হোল প্রচলিত ধারা, স্থানীয় ব্র্যান্ড এবং স্থানীয় মানুষের রুচির ভিত্তিতে বাজার থেকে জিনিস কেনার অভ্যাস। সেকারণেই বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীদের দর্শনই হলো নিজস্ব ধারায় নিজস্ব ব্র্যাণ্ডের উপর ভিত্তি করে মানুষের রুচির পরিবর্তন করা
প্রশ্নটা আসলে ‘আজ তুমি কোথায় যেতে চাও’-এর থেকে বড় হয়ে ওঠে ‘আমরা তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছি’আমাদের পোষাক পরিচ্ছদে সুসজ্জিত হয়ে সেখানে তুমি পৌঁছে যাবে। সোজা কথায় আমার পছন্দই তোমার পছন্দ। আমরা সেই দিকেই তোমাকে ঠেলে নিয়ে যাব। বিজ্ঞাপনের ভাষার সঙ্গে কখন যে সহমত গড়ে ওঠে আমরা বুঝতে পারি না।
এসব ক্ষেত্রে মানুষের পছন্দের তালিকাও ক্রমশ কমিয়ে আনা হচ্ছে। এর জন্য গ্রহণ করা হয় নানা ধরণের পন্থা। যেমন— ১) বিভিন্ন সংস্থার সংযুক্তিকরণ, ২) ছোট ছোট সংস্থাকে বড় সংস্থা কিনে নিয়ে এক ছাতার তলায় ব্যবসা এবং ৩) স্থানীয় সংস্থাগুলিকে বাধ্য করা বড় সংস্থার কাছে নিজেদের বেচে দিতে।
বহুজাতিক সংস্থা সবসময় ক্রেতাদের পছন্দের দিকে সবিশেষ নজর দেয় এমন ভাবে যাতে মানুষের রুচি সংস্কৃতি আমূল পরিবর্তন হতে বাধ্য। সেই সঙ্গে মানুষের মেলামেশার প্রকাশ্য স্থানগুলি নষ্ট করে দেয়। বিগবক্‌সের শোরুম তথা বিপণন কেন্দ্রগুলি এত বিশাল যে সত্তর হাজার ধরণের পণ্য সামগ্রী সুন্দর করে থরে থরে সাজানো থাকে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের নজর সেদিকে চলে যাবে। সেখানে একসঙ্গে প্রচুর মানুষ কেনাকাটা করতে পারে। এতে করে সেই অঞ্চলের ভৌগলিক চেহারাটাও পাল্টে যায়। শহরের প্রধান প্রধান রাস্তায় জনপ্রিয় কাফে, হার্ডওয়্যারের দোকান, স্বতন্ত্র বইয়ের দোকান অথবা আর্ট ভিডিও হাউস যা ছিল সেখানে জায়গা করে নিয়েছে প্যাক-ম্যান চেনের : স্টারবাক্‌স, হোম ডিপো, দ্য গ্যাপ, চ্যাপ্টার্স, বর্ডার্স কিম্বা ব্লকবাস্টারের বিপণন কেন্দ্র। যেখানেই আপনি যান না কেন আর কিছু না কিছু জিনিস কিনুন না কেন জানবেন সবই যাবে কোন না কোন বহুজাতিক সংস্থার ঘরে।  প্রকাশ্য জায়গা বা পাবলিক প্লেস বলে পরিচিত জায়গায় গজিয়ে উঠছে বিরাট বিরাট মল। মুখে বলা হচ্ছে প্রকাশ্য জায়গাআর এখানে কেউ যদি কোনও প্রচারপত্র বা হ্যান্ডবিল বিলি করতে আসে তৎক্ষনাৎ তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয় এভাবেই শহরের পাবলিক প্লেসগুলি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে
এক শতাব্দী আগে মানুষের রুচি, সংস্কৃতি, নিত্যদিনের অভ্যাস বদলের সুপরিকল্পিত কোনও প্রয়াস ছিল না। ছিল না চেন পদ্ধতিতে বিক্রির উন্মাদনা। কপিরাইট, ট্রেডমার্ক আইন সহ ব্যক্তিগত শুভাকাঙ্খী সংস্কৃতি বলতে কিছুই ছিল কি? অথবা ব্যবসায়িক মহলে বাক স্বাধীনতার প্রশ্ন ছিল কি? কিন্তু আজকে ক্রেতাদের ব্যক্তিগত পচ্ছন্দ অপচ্ছন্দের কথা ভেবে বহুজাতিকরা ব্যবসা করবে একথা কল্পনা করা যাবে না। আমরা কী কিনবো, কেমন করে সাজবো, আমাদের বাড়ি কী করে নির্মাণ করবো সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রকাশ্য স্থানের মতন চলে যাচ্ছে বহুজাতিকদের কবজায়। আমাদের পছন্দ অপছন্দ সব কিছু ঠিক করে দিতে মরিয়া বহুজাতিক সংস্থার বিপণন পদ্ধতি।
গত শতাব্দীর আট ও নয়ের দশকে বহুজাতিক সংস্থার যে সব চেন বাজারে এলো, যেমন- আইকিয়া, ব্লকবাস্টার, দ্য গ্যাপ, কিনকো’স, দ্য বডি শপ, স্টারবাক্‌স। এই সব বিপণন কেন্দ্রগুলি ছয় ও সাতের দশকের ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট ও মলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পুরাতন ধ্যানধারণা ভেঙে ব্যবসার নতুন ধরণ উন্মোচিত হলো এদের হাত ধরে আট ও নয়ের দশকের মলগুলি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও নতুন যুগের কথা বলে। আগেকার সেই কার্টুন, প্ল্যাস্টিকের হলুদ খোল বা সোনালী আর্চের দোকানের কথা এখন আর কেউ ভাবে নাআধুনিক মলে প্রবেশ করলে দেখা যাবে কিনকো’স, ব্লকবাস্টারের কর্মচারীরা কাজ করছে সাদা ও খাকি রঙের পোষাক পড়ে যা ‘দ্য গ্যাপ’ থেকে কেনা। পোষাকে জ্বল জ্বল করছে ‘গ্যাপে আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ’কফি পরিবেশনের সময় স্টারবাক্‌সের কর্মচারীদের পোষাকে হয়ত জ্বল জ্বল করছে ‘কিনকো’-তে আপনাকে স্বাগত’। এই চেনের বিভিন্ন আউটলেটে কর্মরতদের চাকরির আবেদনপত্র পরীক্ষা করলে দেখা যাবে সবই কিনকো’স-এর কোন বন্ধুর কম্পিউটার মেসিনে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে ১২পয়েন্ট হেলভেটিকাতে মূদ্রিত নবাগত কর্মীরা সেখানে সি কে ওয়ান সুরভিতে আবৃত হয়ে কাজ করে। একমাত্র স্টারবাক্‌সের বিপনীতে কেউ কোন রকম সুরভি ব্যবহার করে না। তাহলে কফির গন্ধ ঢাকা পড়ে যাবে। এরা মুখ ধুয়ে আসে বডিশপের ব্লু কর্ণ মাক্স দিয়ে। আর যেখানে তারা বসবাস করে দেখা যাবে সেগুলি সাজানো আইকার আসবাবপত্রে।
অনেকগুলি বিপণন কেন্দ্র নিয়ে এক একটি চেন তৈরি করে প্রথমেই এরা নিকটবর্তী খুচরো ব্যবসায়ীর থেকে কম দামে বাজারে জিনিস বিক্রি করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অর্থনৈতিক দিক থেকে কাবু করে ফেলে। দ্বিতীয় ধারায় বিদ্যুতের ন্যায় ঝটিকা বেগে চেনগুলি তৈরি করে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের একঘরে করে ফেলে। তৃতীয় ধারায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা। যেখানে একজাতীয় ব্যবসা না করে বহুমুখী ব্যবসা চালু করা। অনেকটা সুপারস্টোরের ধারায় নতুন নতুন জিনিসের আমদানি বাড়িয়ে ত্রিমাত্রিক রূপদান করে সেই ব্র্যাণ্ডের বাজার দখল করা।
এতদিন ওয়ালমার্ট ও বিগবগসের বিরুদ্ধে প্রচুর বইপত্র লেখা হয়েছে। ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক বোওতের্গা লেখে ‘‘শ্যাম-উই-ট্রাস্ট’’। হোমডিপো (গৃহস্থালীর যাবতীয় জিনিস), অফিসডিপো ( স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালতের যাবতীয় সামগ্রী), বেড বাথ অ‌্যাণ্ড বিয়ণ্ডকে (বিছানাপত্র, বাথরুমের প্রয়োজনীয় জিনিস ও অন্যান্য) একত্র করে একটি সুবিশাল বিপণন কেন্দ্র খোলা হলো ‘‘পাওয়ার সেন্টার’’ নাম দিয়ে। খুচরো ব্যবসায়ীরা সকলে একে ‘ক্যাটাগরি কিলার’’ নামে অভিহিত করলো। কারণ এদের ক্রয় ক্ষমতা এত বেশি যে নিকটবর্তী সব ছোট ছোট প্রতিদ্বন্দ্বীকে শেষ করে ফেলতো।
খুচরো একচেটিয়া ব্যবসার জগতে শ্যাম ওয়ালটনের সাম্রাজ্য এত বিশাল যে তাকে ক্যাটাগরি কিলার বললে কম বলা হয় এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক অনেক দিকও ছিল। নানান পন্থায় বিগবক্সের এবং তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সহযোগী সংস্থার অমানবিক পর্যায়ের ধারা—ফুটপাত ব্যতীত রাস্তা, সরাসরি বিপণন কেন্দ্রের ভিতরে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করা যায় এমন ব্যবস্থা, বিপণন কেন্দ্রের এক একটা স্টোরের আয়তন যেন ছোটখাটো একটা গ্রামের মতন। আর এসব কিছুই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুন্দর ভাবে নকশা করা। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ডিসকাউন্ট স্টোরগুলি ক্রেতাদের পয়সা বাচানোর জায়গা। শহরের প্রান্তে কংক্রিটের সমুদ্রের মতন ডিসকাউন্ট স্টোরগুলির বাড়বাড়ন্ত ঘটতে লাগলো। শহরের ঐতিহ্যময় প্রাণকেন্দ্র টাউন স্কোয়ারে আগে মানুষজন নানান উপলক্ষ্যে মেলামেশা এবং সভা-সমিতিকে কেন্দ্র করে মিলিত হবার সুযোগ পেত। এখন সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে  বড় বড় বিপনন কেন্দ্র বা মলগুলি। সেখানেই এখন মানুষজন নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা ছাড়া যোগাযোগের কেন্দ্র হিসাবে মেনে নিয়েছে। অন্য দিকে স্টারবাক্‌স, ভার্জিন মেগাস্টোর ও মাইক টাউনের পত্তনের জন্য এরাই প্রাথমিক পর্বের যাবতীয় কাজ সেরে রাখেবিগবক্স তাদের আয়তনকে ব্যবহার করে অবিশ্বাস্যভাবে প্রচুর পরিমানে সামগ্রী মজুত করতে পারে। সেখানে নতুন নতুন খুচরো ব্যবসায়ীরা নিজেদের ভালো ভালো ব্র্যাণ্ডনেম ব্যবহার করে ওয়ালমার্টের ডিসকাউন্ট যেখানে কম তার পাশে যতটা উচুতে রাখা সম্ভব রাখবার চেষ্টা করে যাতে মানুষের নজরে পড়ে। বিগবক্সের প্রয়াস ছিল মানুষের মধ্যে কম দামে জিনিস কেনার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলা। আর নতুন খুচরো ব্যবসায়ীরা ব্র্যাণ্ডের চেনের পরিবর্তে নির্দিষ্ট দামে মানুষ যাবতীয় কেনার অভ্যাস রপ্ত করুক সেই প্রয়াস অব্যহত রাখল।
সংবাদপত্র ও সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে স্টারবাক্‌সের ঘোষণা ছিল এই হচ্ছে তৃতীয় পছন্দের জায়গা যেখানে নিশ্চিন্তে নিরিবিলিতে মিলিত হওয়া যায়। যা ম্যাকডোনাল্ড বা ওয়ালমার্টের মতন ঘিঞ্জি জায়গা নয়। স্টারবাক্‌স মানেই সম্ভ্রান্ত রুচিশীল মানুষের পছন্দ অনুযায়ী আধুনিক বিন্যাসে তৈরি। যেখানে এক পেয়ালা কফি নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিরিবিলিতে আড্ডা দেওয়া যায়। শহরের এঁদোগলির পাশে আগেকার পুরনো ছোটখাটো কফিশপের থেকে স্টারবাক্‌সের কফিশপগুলি সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ঝা চকচকে বিশালতা নিয়ে তৈরি। একথা অবশ্যই ঠিক এটা সভাসমিতির জায়গা নয় কিন্তু একসঙ্গে অনেক মানুষ এখানে নিরিবিলিতে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারবেন স্টারবাক্‌স শুধুমাত্র কফিশপ নয়, এখানে রয়েছে বিশাল বইয়ের ভাণ্ডার। যেখানে সাধারণ মানুষ থেকে রাজনৈতিক নেতা কর্মীরাও সময় কাটাতে পারবেন। কপির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে হাতের সামনে বইয়ের পাতায় চোখ রাখলে নীরব সমুদ্রের মতন বিশ্বকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
এটাই হচ্ছে ওদের দৃষ্টিভঙ্গী। বিগবক্‌সের মতন খোলামেলা প্রচুর জায়গা দেখে মানুষ প্রলুদ্ধ হবে এখানে আসতে। স্টারবাক্‌স বিগবক্‌সের থেকে আলাদা হলেও এদের ব্যবসার ধরণ কিন্তু একই। উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে প্রথম তেরো বছরে স্টারবাক্‌সের শ্রীবৃদ্ধি দেখলে মাথা ঘুরে যাবে কিন্তু সারা বিশ্বে ওয়ালমার্টের খুচরো ব্যবসা ধরনের সঙ্গে সায়ূয্য আছে। এবং এখানেই ব্যবসায়িক সাফল্য লুকিয়ে আছে।
কোক, ম্যাকডোনাল্ড এবং এ অ‌্যাণ্ড পি’র সঙ্গে তুলনাকে সর্বদাই স্বাগত জানায় কিন্তু স্টারবাক্‌স নিজের ব্র্যাণ্ডের সুখ্যাতির কারণেই এই তুলনাকে সমর্থন করে না  সর্বপরি গ্যাপ কাপড় এবং তার ব্র্যাণ্ড নাম নিয়ে পরিপূর্ণ জিনিষই বাজারজাত করে যা সহজেই গ্যাপ থেকে কেনা যায়। যেমন— খুব সহজেই এক ক্যান কোক বা দুধ কেনা যায়। অন্য দিকে স্টারবাক্‌স এক শ্রেণীর ব্যবসাতেই বেশি আগ্রহী যেমন এক কাপ কফি এবং পরিপূর্ণ ভাবে তাকেই জনপ্রিয় করে তোলে। স্টারবাক্‌সের কফি খেলেই মনে হবে কোনও আধ্যাত্বিক বা বিশিষ্ট কোনও পরিকল্পকের স্বাদ রুচির সঙ্গে আপনার সংযোগ ঘটছে। যে কারণে স্টারবাক্‌স ব্লকবাস্টার হিসাবে  পরিচিত হতে চায় না চায় একচেটিয়া বিপণনের অধিকারী হতে। আপনার হৃদয়ের সঙ্গে হার্দিক সম্পর্ক স্থাপনে নিজেকে অগ্রপথিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে।
চেন ব্যবসার প্রকৃত চিন্তা ভাবনা নিয়ে শহুরে ক্রেতাদের মাথাব্যথা নেই। বরং সামান্য পরিমাণে হলেও বিক্রেতার নিজের পণ্য সামগ্রী বিক্রির পিছনে কিছু যুক্তি ও ভাবাবেগ কাজ করে। প্রতিটি ব্র্যাণ্ড উপাদানের ক্ষেত্রে এটা ওঠানামা করে। টুকরা-টাকরা খণ্ড জুড়ে তৈরি কোন জিনিষ কতটা প্রগতিশীল বা ঘরে তৈরি কিনা এটা তাদের কাছে কোনও বিষয়ই নয়। ‘লেগো’র মত জুড়ে জুড়ে এক একটা চেন, এক একটা চেনের মধ্যে শতাধিক নিজস্ব খণ্ড খণ্ড অংশ জুড়ে তৈরি বিপনন কেন্দ্রচেনের যুক্তির মধ্যে যদি উক্ত খণ্ড খণ্ড অংশগুলি ম্যাকডোনাল্ডের কড়া করে মাছ ভাজা বা হামবার্গার অথবা ‘‘চারটি মৌল আইকন’’ হয় তবেই কিছু কথা থাকে। প্রতিটি স্টারবাক্‌সের বিপণন কেন্দ্রের নক্‌শার জন্য ভবন নির্মাণের সময়ই সর্বাধিক নজর দেওয়া হয়। যেন শান্তির প্রতীক।
এই প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক স্তরে চেন সম্প্রসারণের সময় দৃশ্যত নজরে আসে। যখন খুচরো ব্যবসায়ীরা নিজেদের দেশ ছেড়ে বাইরে পা রাখেন তখন স্টারবাক্‌সের এক ছাতার তলায় অনেক ব্যবসার সঙ্গে এক সঙ্গে প্রচুর জিনিস নিয়ে বিক্রির রণকৌশলের সঙ্গে ওয়ালমার্টের বিপণনের ধরণ মিলে মিশে যায় নতুন বাজারে জিনিষের দাম কম রাখতে ওয়ালমার্ট, হোমডিপো এবং ম্যাকডোনাল্ডের মতন চেনগুলি তুরুফের তাস হিসাবে একসঙ্গে অবিশ্বাস্য রকমের প্রচুর জিনিষ পাইকারদের কাছ থেকে কেনে এবং প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের থেকে কম দামে ক্রেতাদের কাছে মাল বিক্রি করে। যে কারণে অন্যরা নিজেদের দেশেই একটির বেশি বিপণন কেন্দ্র খুলতে পারে না বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে ওয়ালমার্ট ও অন্যান্যরা বিদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের সময় সেখানকার চালু চেনগুলি কিনে নিয়ে নাটকীয়ভাবে নিজেদের ব্যবসা শুরু করে। আসলে এসব কৌশলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বহুজাতিক খুচরো ব্যবসার সাফল্যের চাবিকাঠি।

ধরুন আমাদের দেশের কথা। ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি বা কাজের সুযোগ খুবই সীমিত। দেশের বেকার সমস্যা দিন দিন জটিল আকার নিচ্ছে। যাঁরা শিক্ষার সুযোগ সেভাবে পাননি, তাঁদের সামনে তো বটেই, শিক্ষিত ও পেশাদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যাঁরা, তাঁদের সামনেও কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। এই অবস্থায় অতি সাধারণভাবেই জীবনযাপন করার জন্য বেকার মানুষ খুচরো বাণিজ্যে উপার্জনের পথ খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারী তথ্য বলছে, কারখানায় পণ্য উৎপাদন (অ-কৃষি) ক্ষেত্রে ১৯৯০থেকে ১৯৯৮সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির হার ছিল ৫শতাংশের কম। স্পষ্টতই অন্যত্র কাজের সন্ধান করতে হয়েছে বিশাল শ্রমশক্তিকে। সেক্ষেত্রে রুটি-রুজির পথের হদিশ দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে খুচরো বাণিজ্য, যা প্রায় সবটাই অসংগঠিত। সেদিক থেকে বলা যায়, খুচরো বাণিজ্যের এই প্রসার আসলে দেশের ছদ্ম বেকারত্বেরই প্রতিফলন। যাঁরা বেকার, তাঁরা চাকরির সুযোগ না পেয়েই নিজের যৎসামান্য পুঁজি নিয়ে ও নিজের পরিশ্রম করার ক্ষমতার ওপর ভরসা রেখে কোনোরকমে একটা ছোট দোকান চালু করে খুচরো বাণিজ্যকে জীবিকা করতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থাৎ একজন খুচরো ব্যবসায়ি জন্ম নিচ্ছেন পরিস্থিতির শিকার হয়ে। তারপরেও উদয়াস্ত কী পরিশ্রম করে তাঁরা পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করেন, ভারতের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালে তা উপলব্ধি করা যেতে পারে। আজ যখন ইউ পি এ সরকার খুচরো বাণিজ্যের দরজা খুলে দিতে চাইছে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের স্বার্থে, তখন আসলে এই সামান্য পুঁজির স্বল্প রোজগেরে খুচরো ব্যবসায়ীদের জীবিকার লড়াইকে থামিয়ে দিতে চাওয়া হচ্ছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা হলো, খুচরো বাণিজ্যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে শুরুতে বিলাস দ্রব্য নিয়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলি প্রবেশ করে। মূলত, সমাজের উচ্চবিত্তদের কাছে তুলনামূলকভাবে সস্তায় সেগুলি তারা বিক্রি করে। ক্রমশ তারা হাত বাড়ায় অন্যান্য পণ্যের দিকে। অর্থাৎ বিলাস দ্রব্যের মাধ্যমে নিজেদের পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠা করে গোটা বাজার গিলতে উদ্যত হয় বহুজাতিকরা। এভাবেই তারা সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রির বাজারেও দখল কায়েম করে। মার্কিন কৃষি দপ্তরের তথ্য বলছে, খোদ আমেরিকাতেই ২০টি বৃহৎ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ২০০১সালে মুদি দ্রব্যের মোট বিক্রির ৫৮.৭শতাংশ অংশীদারি দখল করেছে, যা ১৯৮৭সালে ছিল ৩৬.৫শতাংশ। বস্তত, উন্নত দেশগুলির বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজারে ঢুকতে চাইছে বিপুল সংখ্যক ক্রেতাকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য। একটি হিসেব দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। এখন ভারতের জনসংখ্যা ১৩০কোটির মতো। এর ২০ শতাংশ মানে ২৬কোটি। নয়া অর্থনৈতিক নীতিতে দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫-২০শতাংশ রীতিমতো ফুলে ফেঁপে উঠেছে আর্থিক ক্ষমতার দিক থেকে। শতাংশের হিসেবে সংখ্যাটি ছোট হলেও জনসংখ্যার হিসেবে এর মানে ১৯.৫—২৬কোটি মানুষ। আমেরিকা, ইউরোপ মিলিয়ে অনেকগুলি দেশের জনসংখ্যা যোগ করলে তবে এই সংখ্যা পাওয়া যাবে। অতএব শুধু ভারতেই যদি বহুজাতিকরা খুচরো বাণিজ্যের মাধ্যমে এত বিপুল সংখ্যক ক্রেতা পাওয়ার সুযোগ হাসিল করতে পারে, তাহলে তাদের মুনাফার পরিমাণ বাড়ানোর মূল লক্ষ্য যে অনেক বেশি অনায়াসে পূরণ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো কোনো মহল থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, এরা ভারতে যে সাপ্লাই চেন গড়ে তুলবে, তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে। ঠিকই, তবে কর্মসংস্থানের সুযোগ যা সৃষ্টি হবে, তার তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় কর্মচ্যুতি ঘটবে দেশীয় খুচরো ব্যবসায়ীদের বাজার বহুজাতিকরা দখল করে নিলে। তারপরেও ইউ পি এ সরকার খুচরো বাণিজ্যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগকে অনুমতি দিতে ব্যগ্র। স্পষ্টতই দেশের এক বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবিকার ওপর আঘাত হানতে চাইছে সরকার, যার নেতৃত্বে কংগ্রেস এবং যার অন্যতম শরিক তৃণমূল কংগ্রেস। সুতরাং এই প্রচেষ্টা আর যা-ই হোক, দেশের গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের স্বার্থে নয়।

প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, ভারতে যদি খুচরো বাণিজ্যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগকে অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে ভারতীয় ক্রেতারা বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনতে পারবেন। আরো বলা হয়ে থাকে যে, ভারতে যদি বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তাঁরা দক্ষ সাপ্লাই চেনগড়ে তুলবেন। তাতে শুধু ভারতীয় ক্রেতারাই উপকৃত হবেন না, আন্তর্জাতিক বাজারে ঢোকার রাস্তাও খুলে যাবে। পরিণতিতে আমাদের দেশে কৃষিক্ষেত্র ও কারখানায় পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্র উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করতে আরো বড় বাজার পাবে। কিন্তু সত্যিই যদি বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে সস্তার পণ্য নিয়ে এসে এদেশে বেচতে শুরু করে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দেশীয় উৎপাদকরা বাজার হারাবেন, সরাসরি তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ঐসব উৎপাদকদের উৎপাদিত সামগ্রী যাঁরা বিক্রি করেন, সেই দেশীয় খুচরো ব্যবসায়ীদের ওপর। এমনকি যদি বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীরা ভারতীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে সামগ্রী কিনে এখনকার তুলনায় সস্তায় বেচতে চায়, তাহলেও তাঁরা ভারতীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে সামগ্রী কিনতে চাইবে কম দামে। বলা যায়, বাজার হারানোর আশঙ্কায় বহুজাতিকদের কাছে ভারতীয় উৎপাদকরা তখন অলাভজনক বা কম দামে সামগ্রী বিক্রি করতেও বাধ্য হবেন। পরিণতিতে তাঁদের উপার্জন আসলে নির্ভর করবে বহুজাতিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।

No comments:

Post a Comment