প্রতিবাদের চিত্রভাষা...
মৃণালকান্তি দাস
গ্রামের বাড়ির লম্বা মাটির দাওয়া। ইতস্তত পড়ে থাকা শূণ্য মাটির হাঁড়ি-কলসি-পাত্র। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছের পাতা। কোথাও গাছের ছায়া। এ সবই আঁকা কালো কালিতে। স্কেচ। ছবিটির নাম পড়ে বোঝা যায় বাংলার কোনো এক তাঁতিপাড়ার ছবি। কোন একসময়ে এই তাঁতিপাড়ায় জীবন ছিল, আজ শূন্য ঐ পাড়া। কোথায় গেল সব? ক্ষুধার জ্বালায় হয়তো বা লঙ্গরখানায়, কিংবা রিলিফ কমিটির অফিসে, অথবা হাসপাতালে। অথবা হয়ত ফ্যানের খোঁজে সুদুঢ় কোনো শহরে।
হাড়-পাঁজর বার করা মানুষ, হাসপাতাল আর লঙ্গরখানায় ছড়িয়ে থাকা মানুষ, সরু সরু পা, সামনে খাবারের শূণ্য বাটি নিয়ে বসে থাকা মানুষ। উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ। ছোট ছেলেদের ছবি, পরণে একরত্তি কাপড়, কী যন্ত্রণায় তাকিয়ে। একের পর এক ছবিতে সেই মুহূর্তগুলির রচনা। যেখানে অবিশ্রান্ত মৃত্যুর মিছিলের মাঝেও, এই মানুষগুলি, তাদের দীঘল আয়ত চোখ তুলে, শুধু একটি মুহূর্তের প্রাণ প্রার্থনা করে...।
দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা।
যে চিত্রমালা জুড়ে থাকে কংকালসার মানুষের মিছিল। এরা সেইসব মানুষ, মানুষের স্রোত, যাদের ঘর গিয়েছে, স্বজন গিয়েছে, চলে গিয়েছে দেশ কাল। এখন তাদের নিত্যসঙ্গী শুধুই ব্যাধি, ক্ষুধা আর মৃত্যু।
খিদের ওই চিত্রমালা আমার আর কতটুকু জানা। ওই থুতু, ওই কষ, ওই দাঁতের দাগের গন্ধ প্রাণপনে শুঁকতে চাইছি। খিদের ওই গন্ধ আমরা ক-জন জানি! জানতেন আপনি। নিজের গড়ে নেওয়া জীবন দিয়েই জেনে নিয়েছিলেন। লোকাল ট্রেনে যাতায়াতের পথে কিংবা নিজের শৈশব থেকে যেমন জেনে নিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। খিদের স্বাদ, গন্ধ, ঝিমুনি, শ্বাস নিপাট জানতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯২৬থেকে সাজাদপুরে–শিলাইদহে বসবাস করার সময় ওই গন্ধটা চিনে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৩০০সালেই যে গল্প লিখেছিলেন, সেখানেই খিদের অক্ষর। রাধার যে বাক্যের জন্য দুখীরাম তাকে খুন করেছিলো— ‘ভাত কোথায় যে ভাত দিব। তুই কি চাল দিয়া গিয়াছিলি। আমি কি নিজে রোজকার করিয়া আনিব!’ —সে বাক্যটা সাধু ক্রিয়াপদে। তার ঠিক আগেই দুখীর সেই অমোঘ বাক্য—‘ভাত দে।’ যা বাক্যের ব্যাকরণ-গড়ন ফালাফালা করে ভেঙে ফেলে!
খিদের ওই নাড়ী-পোড়ানো গন্ধটা (তাঁর শব্দ ‘ক্ষুধানল’) মনে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ ছেড়ে আসার পরও। কতকাল পরে হেমন্তবালা দেবীকে যে সব চিঠি লিখেছিলেন তিনি, সেখানে মন্দিরের ধনী দেবতার বিরুদ্ধে ক্ষুধার্ত দেবতা। মন্দিরের বাইরে ‘সত্যকার দেবতা সত্যকার মানুষের কঙ্কালশীর্ণ হাতের মুষ্ঠি প্রসারিত করে’...
১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ।
আপনার সঙ্গী ফটোগ্রাফার সুনীল জানা। দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকাগুলিতে চষে বেরিয়েছেন। ঘুরে ঘুরে আশ্রয়হীন, মুমূর্ষু মানুষের খবর সংগ্রহ করে পার্টির কাগজে প্রকাশ করাই ছিল আপনাদের দু’জনের কাজ। সাদা কাগজে কালো কালি, পেন, ব্রাশে আঁকিবুকিতে মানুষের দু:খ, দারিদ্র আর তার বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামের কাহিনী চিত্রিত করতেন। ‘জনযুদ্ধ’ কাগজের বিশেষ সংখ্যায় সেই ছবি কখনো কখনো কালোর বদলে লাল রঙের ব্যবহার। ফুটে উঠেছে চল্লিশের দশকের বামপন্থী রাজনীতি ও সংস্কৃতির অনিবার্য ঐতিহাসিক প্রসঙ্গগুলি।
কিছু ছবি চারকোলে আঁকা। সব কিছুই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, স্টার্ক। আপনার পেনের স্ট্রোকে, ছবির লাইনগুলোতে মৃত্যুপথ যাত্রী মানুষগুলি যেন, ‘আমরা যাইনি মরে আজও’। ঠিকই, আজ আপনাকে কেউ বলছেন ‘অসাধারণ এক শিল্পী’, আবার কেউ সখেদে জানাচ্ছেন ‘বিস্মৃতপ্রায় চিত্তপ্রসাদ’। আপনাকে চেনার পথে কতো জল্পনা। রাজনীতি, সমাজ ও মানুষের অঙ্গাঙ্গিতা আজ আপনার ছবিকে শৈল্পিক আয়তন দিয়েছে। অথচ, একসময় আপনার ‘অতি সরল’ চিত্র ভাষায় বিষয়-নির্দিষ্ট ছবি আঁকার জন্য শিল্প মহলে আপনার কদর ছিলো নেহাতই আপনার পরিচয়। আপনি চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।
জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটিতে, ১৯১৫-র ২১শে জুন। চট্টগ্রাম গভর্ণমেন্ট কলেজে পড়াশোনা শেষে কলকাতায় এসেই আলোড়ন তুলেছিলেন, আপনি তখন তরুণ। একসময় ভেবেছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসুর কাছে ছবি আঁকার তামিল নেবেন। হয়ে ওঠে নি আর। ৪০-এর দশকের প্রথমে যুক্ত হন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। হোলটাইমার হন। ৪৩-এর মন্বন্তরের সময়ে পার্টির নির্দেশে যান মেদিনীপুর। কালি, কলম আর খাতা নিয়ে। সঙ্গে সুনীল জানা, ফটোগ্রাফার। সুনীল জানার তোলা ফটোগ্রাফ, আপনার আঁকা ছবি ও রিপোর্টাজ ছাপা হত পার্টির মুখপত্র জনযুদ্ধ-এ, মন্বন্তরের বিবরণী। কিছুদিনের মধ্যে ঐ সব রিপোর্টাজ ও স্কেচ নিয়ে বম্বে থেকে প্রকাশিত হয় Hungry Bengal - A Tour Through Midnapur District, By Chittaprosad, In November 1943 নামে বইটি। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সমস্ত কপিই বাজেয়াপ্ত ও নষ্ট করা হয়।
চল্লিশের দশকে যখন একদিকে তেতাল্লিশের মন্বন্তর, আরেক দিকে রাজনৈতিক বিক্ষোভ সারা বাংলাকে উদ্বেলিত করছিল, তখনই আপনি পালন করছেন শিল্পী হিসেবে অনন্য ভূমিকা। শহর ও গ্রামের সুখ-দুঃখে জড়ানো মানুষ ও তার পরিবেশ ফুটে উঠেছিলো আপনার একান্ত নিজস্ব শৈলীতে কালিকলম ও তুলি কিংবা ছাপাই ছবির প্রকরণে। অচিরে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায় আপনাকে পাড়ি দিতে হয়েছিলো মুম্বইয়ে। সেখানেও নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন শিল্পভাষার প্রসারে। ব্যক্তিগত ও শিল্পগত দুই পরিচয়েই তিনি অনন্য। তাঁকে ওই সমগ্রতায় চিনুক সবাই— চাইতেন তাঁর বন্ধুরা, তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পানুরাগীরা।
স্কেচ-পোস্টার-কার্টুন ও আরও নানা চেনা মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ ও জনজীবন রূপ পেয়েছে আপনার হাংরি বেঙ্গল রচনাটিতেও। অসহযোগ আন্দোলন, তেলেঙ্গানার কৃষক-বিদ্রোহ, বাংলার তেভাগা আন্দোলন, ভারতের নৌ-বিদ্রোহ ইত্যাদি একের পর এক বিষয় আসা-যাওয়া করে আপনার ছবিতে। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’ ও ‘পিপলস ওয়ার’-এ ছাপা সে-সব ছবি আজও চোখে ভাসে এ কালের সংস্কৃতিকর্মীদের। মন্বন্তরের ছবির সঙ্গেই কৃষক-জীবন ও তার চরম দারিদ্র কিংবা কৃষক-সমাবেশ ও প্রতিবাদ। পরে মুম্বইয়ের সুতাকল শ্রমিকদের ধর্মঘট বা রেল-ধর্মঘট। জাতীয় রাজনীতির মুখোমুখি আপনার নি:স্বার্থ প্রতিবাদ। ১৯৫৮-তে ৭ফুট বাই ১২ফুটের ম্যুরাল আঁকেন বিখ্যাত গায়ক পল রবসনের জন্ম উপলক্ষে।
এর পাশেই অবশ্য আপনার ছবির অন্য এক ঘর আছে। যেখানে বার-বার ফিরে আসে ‘বিশ্বশান্তি’ এই শিরোনাম, লোকজীবন লোকশিল্প বা লোকনৃত্যের অনুষঙ্গ, মা ও শিশুর অন্তরঙ্গতা, পুতুলনাচের পুতুল (শেষজীবনে যে-সৃজনকর্মে তাঁর মন গিয়েছিল)। মা তো বটেই, শিশুও তাঁর ছবিতে ভিড় করে আসে। সে যেমন হতভাগ্য শিশুশ্রমিক হতে পারে ‘রূপকথাহীন দেবদূত’ তেমনই কল্পনায় ভর করে মুক্তিপ্রয়াসী। ‘যে-রূপকথাকে হারিয়ে ফেলেছে শিশু, সেই বর্ণময় রূপকথারই যেন পুনরাবিষ্কার।’ এ সব ছবিও কখনও কালি-কলমে বা প্যাস্টেলে বা কদাচিৎ চারকোলে এবং অবশ্যই উডকাটে তবে সিংহভাগই লিনোকাটে।
বাংলা লোকশিল্পের ধারা কখনও সহায় হয়েছিলো আপনার শিল্পে। ভারতীয় ধ্রুপদী অভিজাত শিল্প অতি পরিশীলিত ও সুষমামণ্ডিত হওয়ার কারণে তার ব্যবহারের গন্ডি ভেঙে তছনছ হয়েছে। লোক-শিল্প আঙ্গিক তার বলিষ্ঠতার গুণে আপনার শিল্পে তার উপযুক্ত আধার হিসেবে কাজ করেছে। ‘প্রথম শহুরে লোকশিল্পী’ যামিনী রায়ের শিল্পকে চিরাচরিত আঙ্গিকে নতুন গতি দিয়েছিলেন। একসময় যে লোক-শিল্প আঙ্গিক শুধুমাত্র লোকাচারগত অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো তা রূপ নিলো জীবন সংগ্রামের এক অনবদ্য প্রেক্ষাপটে।
শেষ জীবনে আপনি তখন মুম্বাইয়ে। গড়ে তুলেছিলেন পাপেট থিয়েটার ‘খেলাঘর’। লেখা, কস্টিউম ডিজাইন, পরিচালনা আপনার নিজেরই। শকুন্তলা, পৃথ্বীবারজ এবং সংযুক্তা নামে পাপেট শো এবং ছোটদের জন্য মজার লোককথার গল্প থেকে নেওয়া বিভিন্ন বিষয়। ডেনমার্কের ইউনিসেফ কমিটিকে দান করে গিয়েছিলেন শিশুদের জন্য সৃষ্টি সন্ধান ‘অ্যাঞ্জেলস উইদআউট ফেয়ারি টেলস’ এবং ‘নেগলেকটেড চাইল্ডহুড সিরিজ’-এর শিল্পকর্ম। ১৯৭২-এ আপনাকে নিয়েই তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন চেকোশ্লোভাকিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক প্যাভেল হবি।
আপনার শিল্পে ফুটে উঠেছে মানুষের শরীর ও মুখ যা রাজনীতির মানুষ হতে পারে, আবার দৈনন্দিনেরও। কিন্তু, সব কিছুতেই পুনরাবৃত্ত আপনার আসল জায়গা ছিলো শুধুই ছাপাই মাধ্যম। তাই আপনাকে বলতে পারি ‘প্রিন্টার্স পার্সোনালিটি’, আপনার শিল্পের বিবর্তন ও বৈচিত্রও। আগে যা ছিল, তার পাশাপাশি নরনারীর যৌনজীবন, সুখী দাম্পত্য, ফুল বা জীবজন্তু কিছুই বাদ যায় না। এ কি শিল্পীর জীবনের ব্যর্থতাবোধেরই পরিপূরণ?
চারের দশকের বা যে কোনো সঙ্কটের সময়ে মানুষ যখন সঙ্কট থেকে উত্তরণ খোঁজে, তখন মানুষ সেই শিল্প উপভোগ করে যাতে সঙ্কটের কথা আছে। আছে তার থেকে মুক্তির ইঙ্গিত। শিল্পী সোমনাথ হোড়ের কথায়, মানুষের দু:খ দারিদ্র ছাড়াও জীবনের আর যা কিছু আছে তার রূপ দেওয়া শিল্পে দরকার। মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা, আনন্দ, প্রেম-প্রীতি স্নেহ সবই তার জীবন সংগ্রামের অঙ্গ। আর তাই সৎ শিল্পের উপজীব্য। কোন্ ভাষায় তা প্রকাশিত হবে সে বিবেচনার ভার শিল্পীর ওপর ছেড়ে রাখাই ভালো।
চট্টগ্রাম থেকে কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত শিল্পী চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও সোমনাথ হোর’কে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন সে সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশী। তাঁরা অবশ্য আগেই চট্টগ্রামে, এমনকী মাঝে মাঝে কলকাতায় যাতায়াতে, পার্টির সাংস্কৃতিক কর্মে জড়িয়ে ছিলেন। যোশীর প্রেরণায় এসে পড়লেন বৃহত্তর জগতে। ততোদিনে চিত্তপ্রসাদ কালি-কলম-তুলির রেখায় এবং পরে কাঠখোদাই আর লিনোখোদাই মাধ্যমে নিজের ছবির একটা ভুবন তৈরি করে ফেলেছেন। তিনি তাঁর ছবি আঁকা শুরুই করেছিলেন ’৪৩-এর মন্বন্তর, কৃষক-আন্দোলন, গ্রাম ও শহরের মানুষের দুঃখকষ্ট নিয়ে। প্রগতি ভাবনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে তাঁর শিল্প। তাঁর আসল জায়গাটা তখনও ছাপাই ছবিতেই। এই সব ছবির কথা অন্তরঙ্গ মহলের বাইরে অল্প লোকেই জানত। আরেকটা কারণ ছিল তাঁর আপসহীন মেজাজ। ছবিকে তিনি পণ্য করতে চাননি কখনও। অথচ তিনি যে কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, তার স্বীকৃতি আছে নন্দলাল থেকে শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরই মুখে। পরে বিদেশি বন্ধু ও ভক্তদের তারিফও পেয়েছেন। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। মুম্বইয়ের আন্ধেরিতে একটি ঘরে বসে দৈন্যদশাতেও নিঃসঙ্গ এই শিল্পী নিজের কাজ করে গিয়েছেন। কলকাতার জন্য একটা টান ছিল সব সময়ই। ১৯৭৮-এ জীবনের একেবারে শেষ পর্বে ফিরেও এসেছিলেন, কিন্তু তখন তো তিনি মৃত্যুর সীমান্তে।
এ দেশে তাঁর চিত্রপ্রদর্শনীর সংখ্যা বেশ সীমিত। ’৪৩-এর সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে প্রথম একক, তার পর যৌথ ভাবে কয়েকটি। মুম্বই-পর্বে চিত্তপ্রসাদের ছবির প্রগাঢ় অনুরাগীদের পাওয়া গেল বিদেশে। ১৯৫৫-তে নিউ ইয়র্কের ইন্ডিয়া হাউসে চিত্তপ্রসাদের করা ৪০-টি সাদা-কালো প্রিন্টের প্রদর্শনী হয়, ঐ বছরেই ওনার লিনোকাট নিয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে Contemporary Woodcuts নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ১৯৫৬সালে প্রাগ শহরে এবং ইউরোপের আরও কিছু জায়গাতেও (ডেনমার্ক, হল্যান্ড,জার্মানী) চিত্তপ্রসাদের কাজের প্রদর্শনী হয়। ১৯৬৪-তে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ চিত্তপ্রসাদের গ্রাফিক্সের শেষ একক প্রদর্শনী, ১৯৭৮-এ মৃত্যুর পর ১৯৯৪-এ শান্তিনিকেতন কলাভবনে। ১৯৬৫-তে মা-কে একটি চিঠিতে লেখেন – ‘কলকাতায় প্রদর্শনীর পরে কাগজে আমার কাজ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু আমার ছবি কেনার জন্য কেউই এক পয়সাও খরচ করে না। বিদেশীরা কিছু ছবি কেনাতেই আমি এখনও বেঁচে আছি। নিজের দেশের লোকের ওপর ভরসা করতে হলে, এতদিনে মরে ভূত হয়ে যেতাম।’
৫০-এর দশকের পর থেকে ভারতীয় চিত্রকলায় যে প্রবল বাঁক ও বদল, সে সবের থেকে চিত্রপ্রসাদের কাজ একটু দূরে ছিল। হয়ত বা ওনার জীবনাচরণ। ৫০-এর দশকের শুরু থেকে বম্বে শহরে এক কামরার একটা ঘরে কিছু বইপত্র, একটা কুকুর, একটা বেড়াল আর নিজের কাজকর্ম নিয়ে মূলতঃ একা জীবন কাটিয়েছেন। সেই সময়ে চেক দূতাবাসের এক কর্মী Ing Frantisek Salaba -র সাথে পুতুল নাচের সূত্রে সখ্যতা গড়ে ওঠে। Salaba পরে লেখেন - But his pride did not allow him to show it or to even try to sell some of his art works to me. When I understood his situation, I tried to help by purchasing his drawings and linocuts. The difficulty was that he was never able to state his price and I was force to offer him a valye myself, or to think of ingenious ways of puting money in his pocket.
চিত্তপ্রসাদের ছবির প্রতিবাদী রূপ। হাংরী বেঙ্গল পর্বে এই প্রতিবাদী রূপ না থাকলেও, ৪৭ থেকে ৫০ সালের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে অসংখ্য পোস্টারে এই প্রতিবাদী ধারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নৌ-বিদ্রোহ, তেলেঙ্গানা আন্দোলন, কালোবাজারী, দুর্নীতি, কাশ্মীর সমস্যা, বিভিন্ন দেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে আঁকা প্রোপাগান্ডামূলক পোস্টার আজকেও চমকে দেয়, এবং এর মধ্যে অনেক পোস্টারই আজকেও, এতদিন পরেও প্রাসঙ্গিক! ফলে ৫০-এর দশকের শুরু থেকেই চিত্তপ্রসাদ হয়ত বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন ওনার ৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি ও প্রতিবাদী পোস্টারের সাথে।
আমরা যারা মধ্যবিত্ত কুরশিতে বসে লেখাজোখা করি, থলে হাতে বাজার যাই বটে, টের পাই দাম-বাড়ার দাপট, কিন্তু পাকস্থলী পূরণের অনিরাপত্তায় ততখানি কেঁপে উঠি না। ভাবি না দেশজোড়া মানুষের পেটের বিরুদ্ধে কাদের ষড়যন্ত্রে নিত্য লেজ আছড়াচ্ছে। শুধু তাকিয়ে দেখি, খাদ্যের বলয় থেকে প্রতিদিন ঠেলে বার করে দেওয়া হচ্ছে অগণন মানুষকে, তবু সাদা-নীল মলাটের ইকনোমিক সার্ভে-র রিপোর্ট হাতে অর্থমন্ত্রীর প্রশান্ত মুখ।
এ দেশের কোটি কোটি মানুষের ছিনার হাড়ের ভাঁজে ভাঁজে যে গর্ত, সে গর্তের গভীরতা বাড়ে, সেখানে শুধুই রাষ্ট্রের পরিসংখ্যান। শুখা উনুন—ফ্যান-ফোড়ন-ন্যাতায় না-ভিজে উনুন, গালের কষ, দিন-দিন সাদা হয়ে যাওয়া চোখ, সাদা চিটেল থুতুতে ওই পরিসংখ্যানের শব্দ, সংখ্যা গণিত...।
তারই মধ্যে আবিষ্কার করি কমরেড আপনাকে।
আপনার শিল্পের প্রতিটি অণু ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি জেহাদ। এখন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা পালটেছে। সরাসরি দেশ দখলের চেয়েও অনুগত সরকারের মাধ্যমে সে দেশে পুঁজি লগ্নিতে তাদের আগ্রহ বেশি। এভাবেই কয়েক বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে ব্যাঙ্কে মানুষের গচ্ছিত আমানত রাতারাতি গায়েব হয়ে গেছে। এ দেশেও তেমনটা ঘটতে চলেছে। গরিব মেহনতী মধ্যবিত্তের সমষ্টিগত প্রতিরোধের এ মুহূর্তে বড় প্রয়োজন।
আর ততটাই প্রয়োজন ওদেরও এই প্রতিরোধ ভাঙার। ওরা অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও তার প্রতিনিধিদল, আমরা অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষ।
আপনাকে এ সময়ে লেখা কারণ এতোদিন পরেও আপনার শিল্পে অপরিবর্তিতভাবে রয়ে গেছে মেহনতী মানুষের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আপনার বিশ্বাসের কথা। চারপাশের নিজেকে ঘিরে থাকা লোভীদের মাঝে আপনার মতো রোমান্টিক যোদ্ধারা আমাদের সহায়। তাই অসময় নয়, বরং এটাই সময় আপনাকে লেখার।