১। ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষক আন্দোলনের নেতা সত্যপ্রিয় রায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম ও ২য় শ্রেণীতে সহজপাঠ ১ম ও ২য় ভাগকে একমাত্র পাঠ্যপুস্তক রূপে প্রবর্তন করেন এবং বিনামূল্যে তা শিশুদের হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা করেন।
২। ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ রায়ের শাসনকালে রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় ১ম ও ২য় ভাগকে সহজপাঠের সঙ্গে অবশ্য পাঠ্যরূপে নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য যে, রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকেরা শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে যথেষ্ট বলে মনে করছিলেন না।
৩। সিদ্ধার্থ শাসনকালে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম পুনর্গঠনের জন্য একটি সিলেবাস কমিটি গঠিত হলেও তা কখনও বসেনি, কোনও কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি।
৪। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর দলমত নির্বিশেষে সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি রাজ্যের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সমূহের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে ঐ সিলেবাস কমিটিকে সম্প্রসারিত করা হয়। কমিটির সভাপতি থাকেন বিশ্বভারতীর শিক্ষা-শিক্ষণ বিভাগের প্রধান হিমাংশু বিমল মজুমদার। এই কমিটি অনেক আলোচনা, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে রাজ্যে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষার একটি আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম প্রণয়ন করেন। এই পাঠক্রম অনুযায়ী এক একটি বিশেষজ্ঞ লেখকগোষ্ঠী এক একটি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন এবং সিলেবাস কমিটি অনুমোদন করলে তা প্রকাশিত হয়।
৫। বাংলা সম্পর্কে সিলেবাস কমিটি এই সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেন যে ১ম ও ২য় শ্রেণীর জন্য দুখানি প্রাথমিক ভাষা শিক্ষার বই বা প্রাইমার রচনা করা হবে। রচনার কাজ যখন চলছে তখন ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ কোনও কোনও সংবাদপত্রে গুজব রটনা শুরু হয় যে ‘সহজপাঠ’ বাতিল করা হচ্ছে। পণ্ডিত বিদ্বান সাহিত্যিকদের দিয়ে দিনের পর দিন লেখানো হতে থাকে ‘সহজপাঠের’ গুণাগুণ আর বামফ্রন্ট সরকারকে গালমন্দ।
৬। এই ধূমজালে আকাশ যখন আচ্ছন্ন তখন সিলেবাস কমিটির বাংলা উপ-সমিতির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শ্রীমতী অনিলা দেবীর এই সম্পর্কিত বক্তব্য ‘যুগান্তর’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালের ১লা নভেম্বর।
৭। কেন বর্ণপরিচয়ের পরিবর্তে প্রাইমার রচনার সিদ্ধান্ত সিলেবাস কমিটি নিয়েছেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লেখেন — ‘‘শিশুর ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিতা পিতামহ বলে যাঁকে নামাঙ্কিত করতে হয় তিনি হচ্ছেন বাঙালীর কাছে চিরস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি কেবল বাংলা গদ্যরই জনক নন, বাংলা ভাষা শিক্ষারও জনক। তাঁর রচিত বর্ণপরিচয় বাঙালীর মাতৃদুগ্ধ। গত ১২০ বছর ধরে ছোট্ট আকারের বর্ণপরিচয় — ১ম ও ২য় ভাগ পুস্তক দুখানি ভাষা প্রবেশের সিংহদ্বারের ভূমিকা পালন করে এসেছে।’’
‘‘কিন্তু এই বইতে বিদ্যাসাগর তৎকালে প্রচলিত যুক্তিমূলক পদ্ধতি (Logical Method) অনুসরণ করে বর্ণ ও শব্দ শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। বর্ণের পর বর্ণ যোগ করে শব্দ রচনা এবং শব্দের পর শব্দ যোগ করে বাক্য রচনা পদ্ধতিই অনুসৃত হয়েছে বর্ণপরিচয়ে। বর্ণ থেকে বাক্যে আসার এই রীতি আধুনিক মনস্তত্ত্বমূলক পদ্ধতিতে (Psychological Method) পরিত্যাজ্য। কারণ এই পদ্ধতিতে শিশুর আনন্দ, আগ্রহ ও আকর্ষণ উদ্দীপিত হয় না। ফলে শিক্ষণ হয় ব্যাহত। শিশুমনের আনন্দময় অভিজ্ঞতা ও আকর্ষণকেই শিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বিবেচনা করা হয় আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতিতে। শিশুমনের ভাবোদ্দীপক চিত্র থেকে বাক্যে এবং সেই বাক্য থেকে শব্দে এবং সেই শব্দ থেকে বর্ণে অবরোহণই মাতৃভাষা শিক্ষার আধুনিক মনস্তত্ত্বসম্মত পদ্ধতি।
রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সহজপাঠের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বাক্য ক্রমিক পদ্ধতি গ্রহণ করেন। কোথাও নিরসতার সামনে শিশুদের হাজির করেননি। সহজপাঠের ১ম ভাগের পাঠে তিনি ‘আজ, ঈশ,’ ইত্যাদির মতো দুর্বোধ্য শব্দ না এনে এনেছেন ‘বনে থাকে বাঘ,’ ‘গাছে থাকে পাখি’ ইত্যাদির মতো শিশুর কল্পনা ও ভাবোদ্দীপক বাক্য সমুদয়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের আধুনিকতা, এখানেই শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথের মনীষা।
৮। এই কারণের জন্য সিলেবাস কমিটি ‘বর্ণপরিচয়ের পরিবর্তে দুখানি প্রাইমার রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তাই ‘কিশলয়’ ১ম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ রচিত ও প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালের শিক্ষাবর্ষে। তবে আগে সমস্ত বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার দূর করতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯৮০ সালের ১লা নভেম্বর ঘোষণা করেছিলেন ‘সহজপাঠ’ যেমন পাঠ্য আছে তেমনই থাকবে। সেই সময় থেকে আজ প্রায় ৩০ বছর যাবৎ দুটি বইই প্রাথমিকে পাঠ্য রয়েছে। প্রতি বছর তার লক্ষ লক্ষ কপি ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সমালোচনা আলোচনার ভিত্তিতে ‘কিশলয়’কে ক্রমাগত পরিমার্জিত ও উন্নততর করার কাজ অব্যাহত থেকেছে।
৯। ‘সহজপাঠ’কে কেন একমাত্র পাঠ্য রাখা গেলো না তাও অনিলা দেবী উক্ত প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছিলেন ‘‘সত্যপ্রিয় রায়ের এই মহৎ প্রয়াস সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই একমাত্র পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ‘সহজপাঠ’ গৃহীত হয়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথম মনে হয়, সহজপাঠের মধ্যে প্রথম ভাগে শিক্ষার অপরিহার্য কয়েকটি স্তর অনুক্ত রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। সহজপাঠ কবি রচনা করেছিলেন মূলত শান্তিনিকেতনের পাঠের অবলম্বন রূপে।’’ শিশুদের পড়াতে গিয়ে ওখানকার বিদগ্ধ শিক্ষকরাই পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শিখন পরিস্থিতি সৃজন করে এই অনুক্ত ফাঁকগুলি ভরিয়ে তুলতেন। বর্ণপরিচয়ের সাহায্যও তাঁদের নিতে হতো। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় পশ্চিমবঙ্গের লক্ষাধিক শিক্ষকের পক্ষে শান্তিনিকেতনের বিচক্ষণ শিক্ষকদের কর্তব্য পালন করা সম্ভব নয়। তাই এই প্রাইমার রচনার সিদ্ধান্ত দলমত নির্বিশেষে সকলে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছিলেন।
‘‘সহজপাঠ প্রথম ভাগে বর্ণপরিচিতির পর স্বরচিহ্নগুলির যেমন — আ-কার, ই-কার ইত্যাদির সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করান হয়নি। অথচ এই কাজটি উনিশ কুড়িটি অনিবার্য পাঠের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্ব। এগুলির ধ্বনিরূপ ও লিপিরূপ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে তাদের অবস্থান শেখানোর দায়িত্ব প্রধানত শিক্ষকদের উপরে কবি ছেড়ে দিয়েছেন। তাই তিনি বর্ণ শিক্ষার পরে প্রথম পাঠ শুরু করেছেন — ‘বনে থাকে বাঘ। গাছে থাকে পাখি। ওরা সব মৌমাছি। তাতে আছে মধুভরা কিংবা বাঁশগাছ করে নাচ’ ইত্যাদি বাক্য দিয়ে। এই পাঠের মধ্যে রয়েছে এ-কার, আ-কার, ই-কার, ও-কার, ঔ-কার, চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদির ব্যবহার। পর পর পর্যায় ক্রমিক দীর্ঘ শিক্ষণ ব্যতীত বর্ণপরিচয়ের পরেই শিশুর পক্ষে বিশেষ করে শিক্ষা সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুদের পক্ষে এই পাঠগ্রহণ করা সহজসাধ্য নয়।’’ তাছাড়া সহজপাঠের বর্ণপরিচয়ে ড়,ঢ় ইত্যাদি কয়েকটি বর্ণ শেখানো হয়নি। এই সব কথা বিবেচনা করে সহজপাঠের পাশাপাশি দুটি প্রাইমার রচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিলেবাস কমিটি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রজীবনী রচনাকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের উক্তিটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন — ‘‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় শিশুদের ভাষার জগতে প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছে, আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজপাঠ শিশুদের ভাব ও ছন্দের জগতে প্রবেশের অধিকার দিয়েছে।
এই কথা বলতে হলো এই কারণে যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সস্তায় বাজিমাত করতে চাইছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বিবৃতি দিয়ে — বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। কিছু ভাড়া করা নেত্রীর অনুগামী বুদ্ধিজীবী সহজপাঠ ফিরিয়ে আনার অদ্ভুত কথা বলে লোককে বোঝাতে চাইছেন তাঁরা ভীষণ রবীন্দ্রভক্ত আর বামফ্রন্ট সরকার যারা তিন দশক ধরে রবীন্দ্র সংস্কৃতি প্রসারে অনলস ভূমিকা পালন করে গেছেন তাঁরা কত রবীন্দ্র-বিরোধী!
No comments:
Post a Comment