Friday, July 22, 2011

গণতন্ত্রে নাশকতার বিপদ রয়েই গেছে!


১৯৯২-র অন্তত তিন বছর আগে থেকে ধর্মাশ্রয়ী ভাবাবেগের ভিত্তিতে অযোধ্যা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যাদের জানাবোঝা আছে, তাদের কারোর কাছেই হয়তো লিবেরহান কমিশনের রিপোর্ট খুব আকর্ষণীয় বা চাঞ্চল্যকর হবে না। এমন প্রায় কিছুই এই রিপোর্টে নেই, যা তথ্য হিসেবে অজানা ছিলো। কিন্তু ১৭বছর পরে অযোধ্যার আন্দোলনকে ঘিরে ঘটনাক্রমের মর্মবস্তু আবার সামনে এনে দিয়েছে এই কমিশন। 

অযোধ্যার আন্দোলনকে অবশ্য ‘আন্দোলন’ বলতেই রাজি হয়নি কমিশন। জনগণের সমাবেশের ভিত্তিতে এই আন্দোলন হয়নি, বরং তীব্র ভাবাবেগ ও বিকৃত প্রচারের সামনে জনগণকে স্থানু করে রেখে সাম্প্রদায়িক শক্তি কাজ হাসিল করে নিয়েছে বলে কমিশনের বিশ্লেষণ। এই পর্যালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় সঙ্ঘ পরিবার ও তার সহযোগীরা, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনেকেও রামজনমভূমি আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত ও নজিরবিহীন বলে চিহ্নিত করেছেন। সাধারণভাবে ধর্মমুখী ভারতীয় সমাজের নিজস্ব সকল বৈশিষ্ট্য এই আন্দোলনে ফুটে উঠেছে বলে সমাজতাত্ত্বিকদের অনেকেই পাতাভর্তি প্রবন্ধ লিখেছেন। এই অতিকথনটিকে ভবিষ্যতেও ব্যবহার করা হবে। হিন্দুত্বের শক্তির সবচেয়ে সফল ‘মিথ’ হিসেবে মাঝেমধ্যেই এই ধারণাকে সামনে আনার প্রবণতা থাকবেই।

কমিশন রামজনমভূমি নিয়ে প্রচার থেকে শুরু করে বাবরি ধ্বংস পর্যন্ত ঘটনাক্রমকে বারবারই ‘যৌথ অভিন্ন উদ্যোগ’ বলে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তাদের সহযোগী সংগঠন যেমন ছিলো তেমনই রাষ্ট্রের অংশও ছিলো। এটি ছিলো একটি ‘ক্ষমতাদখলের অভিযান’। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ক্ষমতাদখল নয়, গণতন্ত্রের নিয়মকানুনকে অন্তর্ঘাত করেই অথচ গণতন্ত্রের সুযোগকে ব্যবহার করে এই অস্বাভাবিক অভিযান ঘটেছিল। কমিশন লিখেছে, ‘মন্দির নির্মাণের সমগ্র তৎপরতা ও প্রচার ছিলো রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতা দখলের নির্লজ্জ প্রয়াস। লক্ষ্য ছিলো অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলির হাত থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসন কেড়ে নেওয়া।... আর এস এস সমগ্র কর্মকাণ্ডের রূপকার ছিলো, গোটা অভিযান ও প্রচারের মস্তিস্ক ছিলো তারাই। বিশেষ বিশেষ শাখা সংগঠন গড়ে তোলা থেকে শুরু করে প্রতিদিনের কাজের নির্দেশ সবই করেছে তারা। এ তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে যে করসেবা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মসূচীর সমগ্র পরিকল্পনা সঙ্ঘের দিল্লির সদর দপ্তর থেকে হয়েছে। ঘটনাস্থলে থাকা নেতৃত্ব তা বাস্তবায়িত করেছে। সকলেই জানে রাজনীতির স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে।’ (পরিচ্ছেদ:১৩৩.১৪)

কমিশনের রিপোর্টে অভিযোগের তীর একেবারেই আর এস এস-র দিকে। সঙ্ঘ যে একটি অত্যন্ত সুসংবদ্ধ ও শক্তিশালী সংগঠন তা স্মরণ করিয়ে তাদের মতাদর্শ ও কাজকে বৃহত্তম বিপদ হিসেবে সামনে এনেছে কমিশন। ‘ক্ষমতাদখলের অভিযানের’ কেন্দ্রবিন্দুতে তারাই, তারাই বাকি সমস্ত অংশকে সমবেত করেছে, তারাই প্রচার থেকে প্রতারণার দায়িত্ব পালন করেছে। 

রাজনৈতিক দল ছাড়া এ কাজ অসম্ভব ছিলো। বি জে পি-কে এই ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। বি জে পি এবং সঙ্ঘের মধ্যে পার্থক্যের অনেক ভাষ্য তখনও প্রচলিত ছিলো, আজও আছে। প্রায়ই তা সংবাদমাধ্যমের শিরোনামেও আসে। কমিশন কিন্তু বি জে পি-কে স্বাধীন এমনকি আধা-স্বাধীন কোনো সংগঠন বলে স্বীকৃতিই দেয়নি। কমিশনের ব্যখ্যা: ‘ বি জে পি আর এস এস-র লেজুড় ছিলো এবং আজও আছে। কম জনপ্রিয় সিদ্ধান্তগুলিকে একটি গ্রহণযোগ্য ছদ্মবেশ দেওয়া এবং সঙ্ঘ পরিবারের দুর্বিনীত সদস্যদের মুখোশ হিসেবে কাজ করাই শুধুমাত্র বি জে পি’র ভূমিকা। গোবিন্দাচার্যের কথা বলে বহু পরিচিত ও বহুবার অস্বীকৃত সেই মন্তব্য যে বাজপেয়ী হলেন মুখোটা বা মুখোশ, বি জে পি’র সব শীর্ষ নেতা সম্পর্কেই সত্যি।’ (পরিচ্ছেদ: ১৬৬.৮) বি জে পি’র নেতারা তা—ই করেছেন যা তাঁদের করতে বলা হয়েছে। গণতন্ত্রের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সর্বোচ্চ সুবিধা নেবার জন্য রাজনৈতিক দলকে সামনে রাখার প্রয়োজনীয়তাটুকু সঙ্ঘ উপলব্ধি করেছে বলেই বি জে পি’র অস্তিত্ব। খুবই উল্লেখযোগ্য ভাবে বি জে পি’র ঘোষিত কর্মসূচীর অন্যান্য উপাদান যে মুখ্য মর্মবস্তু অর্থাৎ সঙ্ঘের হিন্দুত্বের দর্শনের অধীন, কমিশন তা জোরের সঙ্গেই বলেছে।  

বি জে পি সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় আরেকটি কথা হরদম দেখা যায়বি জে পি’র মধ্যে ‘কট্টর’ ও ‘উদারপন্থী’ দু’ধরনের নেতা আছেন। সঙ্ঘের বেশি ঘনিষ্ঠ ও প্রকাশ্যে হিন্দুত্বের পক্ষে সোচ্চার ‘কট্টর’ নেতাদের মধ্যে আদবানি, মুরলীমনোহর যোশীরা থাকলে ‘উদার’ বাজপেয়ীও আছেন। কমিশনের বিচারে এমন কোনো বিভাজনই নেই। অন্তত রামজনমভূমি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এমন বিভাজনের কোনো বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ পায়নি কমিশন। বস্তুত, আদবানিও কমিশনকে বলেছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন ৬ই ডিসেম্বর। তিনি নাকি বিতর্কিত সৌধ ভাঙায় ব্যথিত হয়েছিলেন। বাজপেয়ী ঘটনার দিন অযোধ্যায় ছিলেন না, তিনি তারও আগে আদবানির রথযাত্রায় লাগাতার সাথীও হননি। কখনও চড়া সুরে হিন্দুত্ব, কখনও প্রচ্ছন্ন হিন্দুত্ব আবার কখনও হিন্দুত্ব-বহির্ভুত বিষয় নিয়ে বাজপেয়ীর ক্রমাগত অবস্থান পরিবর্তন তাঁকে তুলনায় গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল সঙ্ঘ-বহির্ভূত রাজনৈতিক শক্তির কাছেও। এই ধাঁধা থেকে সটান বেরিয়ে এসে কমিশন দলের এই ধরনের সব নেতাদেরই চিত্রায়িত করেছে একটি বিশেষণে: ‘মেকী উদারপন্থী’। কমিশন বলেছে, ‘আর এস এস-র অন্যান্য সমস্ত সংগঠন বা শিখণ্ডীর মতো বি জে পি’র মেকী উদারবাদী নেতারা সঙ্ঘের হাতে হাতিয়ার। আর এস এস-র তৈরি করা রাজনৈতিক সাফল্যের উত্তরাধিকার ভোগ করেছেন তাঁরাই।’ (পরিচ্ছেদ: ১৬৬.৭)

এই উত্তরাধিকার রাজ্যে রাজ্যে প্রসারিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সেক্ষেত্রে ‘মেকী উদারবাদের’ একটা বড় ভূমিকা ছিলো। বি জে পি অন্য রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে মিত্র যোগাড় করতে পেরেছিল প্রধাণত এই ‘উদারবাদীদের’ সামনে রেখে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির মধ্যে থেকে মিত্র সংগ্রহ করে এন ডি এ গঠন ছাড়া বি জে পি দিল্লির ক্ষমতায় বসতে পারতো না। তাদের রণকৌশল কাজ দিয়েছে, সেইসঙ্গে এই রণকৌশলের শিকার রাজনৈতিক দলগুলির উপলব্ধির অভাবকে প্রকট করেছে। ভারতীয় রাজনীতির দক্ষিণমুখী অভিযানে এই শক্তিগুলির অবদান ইচ্ছে করলেই ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া সম্ভব না।

রাষ্ট্র বা সরকারের ভূমিকা সম্পর্কেও কমিশনের রিপোর্ট অনেক ক্ষেত্রে দলিল হয়ে থাকবে। বিচারপতি লিবেরহান তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার সম্পর্কে নরম মনোভাব নিয়েছেন। এ কারণে কমিশনের রিপোর্ট কড়া সমালোচনার মুখে পড়বে বলেই মনে হয়। কিন্তু বি জে পি’র নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশ সরকারকে কমিশন ‘যৌথ অভিন্ন উদ্যোগের’ অংশ বলেই চিহ্নিত করেছে। সঙ্ঘের অপারেশনকে সফল করতে রাজ্য সরকার ‘দ্বিধাহীন সমর্থন’ যুগিয়েছে এবং পুলিস, প্রশাসন সঙ্ঘের কর্মসূচী রূপায়ণ করতে যা যা করা দরকার তা অনায়াসে করেছে। কমিশন দেখিয়েছে, কল্যাণ সিং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে লক্ষ্ণৌয়ের সচিবালয় থেকে নিম্নতম স্তর পর্যন্ত সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষের লোককে নিয়োগ করেছিলেন। বাদ যায়নি পুলিসও। এমন একজনকেও সহ্য করা হয়নি যিনি কোনো প্রশ্ন তুলবেন। সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা জানতো তাদের কেউ প্রশ্ন করার নেই। করসেবকরাও জানতো বাবরি ভাঙার কাজে কেউ তাদের বাধা দেবে না, বরং প্রশাসন সাহায্য করবে। রাজ্যের শীর্ষতম অফিসার থেকে ফৈজাবাদের জেলাশাসক-পুলিস সুপার স্বয়ংসেবকদের মতোই কাজ করেছেন। কমিশন বলেছে, ‘একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে অযোধ্যা অভিযানের সময়ে সরকার লোপ পেয়েছিল এবং তা বাস্তবে সঙ্ঘ পরিবারের শিখণ্ডীতে পরিণত হয়েছিল।’ (পরিচ্ছেদ: ১৩২.৮) উত্তর প্রদেশ সরকারকে ‘উন্মত্ত হিন্দুত্বের পুনর্জন্মের সহ-ষড়যন্ত্রী’ বলে অভিহিত করেছে কমিশন (পরিচ্ছেদ: ১৬১.১৫)।

১৯৯২-র দশ বছর পরে ২০০২-এ গুজরাট গণহত্যা। একই ঘটনা, একই প্রক্রিয়া, সরকারকে গিলে ফেলার একই পদ্ধতিতে সে-রাজ্যেও সাম্প্রদায়িক বর্বরতা সংগঠিত করে বি জে পি এবং সঙ্ঘ পরিবার। একই ভাবে দেখা যায়, পুলিস দাঙ্গাকারীর মদতদাতা। একই ভাবে দেখা যায়, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী গণহত্যায় উৎসাহ দিচ্ছেন। একই ভাবে দেখা যায়, এই অভিযান প্রতিহত করার কোনো ক্ষমতা রাষ্ট্রের অন্যান্য অংশের নেইবরং এই শক্তি চিন্তার জগতকে প্রভাবিত করতে পেরেছে এবং নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। বাবরি ভাঙার পরেও ক্ষমতাসীন বাজপেয়ী-আদবানি সম্পর্কে উছ্বসিত মোহ এবং একই ভাবে গুজরাটের গণহত্যা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে সর্বোচ্চ প্রশংসা চিন্তার জগতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা তৈরি করেনি। লিবেরহান কমিশনের প্রাসঙ্গিকতা এই যে গণতন্ত্রের মধ্য নাশকতার আশঙ্কাকে আবার বুঝে নেবার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

সাম্প্রদায়িক চরিত্রের এই ‘ক্ষমতাদখলের অভিযানে’ বিচারবিভাগের ভূমিকা কী হতে পারতো? গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক মর্মবস্তু ও বিধিগুলির সপক্ষে জোরদার ভূমিকা পালনের পরিবর্তে আদালত বিপজ্জনক অবস্থান নিয়েছিল বলে কমিশনের আক্ষেপ। লিবেরহান কমিশনের বিচার্য বিষয়ের পরিধির মধ্যে এ নিয়ে বিশদে আলোচনার অবকাশ কম বলে কমিশন নিজেই বলেছে ভবিষ্যতের স্বার্থে ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, আইন-বিশেষজ্ঞদের তা খতিয়ে দেখা উচিত। উত্তরপ্রদেশ হাইকোর্ট ‘গোঁয়ার্তুমি’ করেছে বলে কমিশন থেমে যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের ‘দূরদর্শিতার অভাব’-কেও দায়ী করেছে কমিশন। আদালতের সামনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সঙ্ঘ পরিবার এবং রাজ্য সরকার পালন করছে কিনা, তা দেখার জন্য সুপ্রিম কোর্ট পরিদর্শক নিয়োগ করেছিল। কমিশন দেখেছে তিনি চোখের সামনে মিথ্যাচারিতা দেখেও কোনো রিপোর্ট করেননি। শান্তিতে ভজন করার বদলে সেখানে সৌধ ভাঙার পুরোদমে প্রস্তুতি চলছে দেখেও তিনি আদালতকে সতর্ক করেননি। ‘ব্যাখ্যার অতীত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ বলে অভিহিত করলেও কমিশন নিজেই এই পরিদর্শকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেএই ‘পরিদর্শক’ জানতেন কী হতে চলেছে। এতোটাই জানতেন যে এই ‘মহাদৃশ্য’ দেখাতে তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও নিয়ে এসেছিলেন। সেই সদস্যরা গুছিয়ে-গাছিয়ে বেরোতে দেরি করেছিলেন বলে সৌধের গম্বুজ যখন ভাঙছে, তখনও পরিদর্শক ঘটনাস্থলে হাজিরই হতে পারেননি। (পরিচ্ছেদ: ১৬১.১৪)

অবশেষে মিডিয়া। গণতন্ত্রের বাকি সৌধগুলি যখন এভাবে তাদের নিজের কর্তব্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছে, তখন তথাকথিত ‘চতুর্থ সৌধ’ এই স্রোতে শুধু গা ভাসায়নি, অযোধ্যা অভিযানকে বৈধতা দিয়েছে দিনের পর দিন। অনেক সংবাদপত্র নিজের রঙ গেরুয়া করে তুলেছিল। ১৯৯১-এর অক্টোবরে অযোধ্যায় মসজিদ ভাঙার প্রথম চেষ্টায় যখন মুলায়াম সিং যাদবের সরকার গুলি চালায় তখন ৫০০করসেবক মারা গেছে বলে সবচেয়ে বেশি বিক্রির পত্রিকাগুলিতে খবর বেরোয়। প্রকৃত সংখ্যা মেরেকেটে ছিলো ৮। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচার প্রায় প্রতিদিন এই সংবাদমাধ্যমের উপাদান হয়ে উঠেছিল। পরে কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলের তরফে ভর্ৎসনাও করা হয়। কমিশনের বিশ্লেষণের অন্য একটি দিক লক্ষ্যণীয়। ১৯৯৯০-র দশকের গোড়া থেকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জগতের কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে গেরুয়া সাংবাদিকতার সম্পর্ক কী ছিলো, তা দেখিয়েছে কমিশন। ‘ মিডিয়ার একটি অংশ স্বেচ্ছায় অযোধ্যা অভিযানের পুরো সময়কালে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছে। বেশি সোচ্চার ব্যক্তিদের প্ররোচনামূলক বক্তৃতা সানন্দে রিপোর্ট করা হয়েছে, চাঞ্চল্য তৈরি করা হয়েছে। উদারনীতির ফলে সৃষ্ট এবং বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেল-সহ নতুন তৈরি হওয়া সেই সময়কার গণ মাধ্যম গর্ত থেকেও প্রতিবেদনযোগ্য খবরের উপাদান খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এর ফলে খবরের চাহিদা বেড়ে গেল। মিডিয়া-দক্ষ সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষে সর্বোচ্চ সম্ভব মিডিয়া প্রচার পাবার ও নিজেদের অ্যাজেণ্ডা, অন্তত সেই অ্যাজেণ্ডার বি জে পি-ধৌত ভাষ্য গোটা দেশে ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে তা ছিলো আদর্শ পরিবেশ। সাংবাদিকরাও সম পরিমাণে খুশি হলেন। কেননা রসকষহীন সরকারী টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বা পুরনো ধাঁচের মুদ্রণ মাধ্যম থেকে জনতাকে টেনে নেবার রসদ মিলতে থাকলো।’ (পরিচ্ছেদ: ১৭০.৪) 

বিচারপতি লিবেরহান যা বলেছেন তার অর্থ দাঁড়ায় বাণিজ্যই শাসন করেছে মিডিয়ার মূল্যবোধকে। কোনো ক্ষেত্রে তা হয়তো সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই সাহায্য করেছে, অন্য বহু ক্ষেত্রে এই একই মুনাফা-সূত্র কাজ করছে আজও। ‘অর্থের বিনিময়ে সংবাদ’ বা পেইড নিউজ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিদিনের অভিধানে ঢুকে পড়েছে। 

মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে জগঝম্প বৃন্দবাদনের মধ্যে বিচারপতি লিবেরহান অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন তুলেছেন। মিডিয়ার বিচার কে করবে? কমিশন বলছে: ‘ চিকিৎসক বা ‌আইনজীবীদের মতো ভারতে মিডিয়ার পেশাগত মান বিচারের কোনো সংস্থা নেই। এমন কোনো সংস্থা নেই যারা কার্যকরভাবে হলুদ সাংবাদিকতাকে বিচার করতে পারে। এখন ভারতের প্রেস কাউন্সিল যে অবস্থায় আছে তাতে সন্দেহজনক প্রতিবেদনের ফলে ক্ষুব্ধ ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। মেডিক্যাল কাউন্সিল বা বার কাউন্সিলের মতো মিডিয়ার জন্য একটি সংস্থার খুবই দরকার, যাদের স্থায়ী ট্রাইব্যুনাল থাকবে। সেখানে একজন সাংবাদিক বা সংবাদপত্র, টি ভি, রেডিও চ্যানেল বা মিডিয়া সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগের মীমাংসা হবে।’ (পরিচ্ছেদ: ১৭৭.৩;১৭৭.৪)

যে মতাদর্শ অযোধ্যার সৌধ ভাঙার অভিযানকে জ্বালানি যুগিয়েছে, যে সংগঠন সেই আগুন-জ্বালানো অভিযান পরিচালনা করেছে, যে রাজনৈতিক দল সামনের সারির সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছে, যে আদালত-প্রশাসন গণতন্ত্রকে ভেতর থেকে অন্তর্ঘাত করেছে, যে মিডিয়াকুল সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগকে উসকে দিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির সহায়ক আততায়ী হিসেবে কাজ করেছে—তারা সকলেই রয়ে গেছে। সুতরাং বিপদও রয়ে গেছে। এক হাজার পাতার লিবেরহান রিপোর্ট কষ্ট করে পড়লে বোঝা যাচ্ছে বিপদ কত গভীরে প্রোথিত হয়ে রয়ে গেছে।

Friday, July 8, 2011

সহজপাঠ : বিভ্রান্তি নিরসন

গত ১৭ই জুন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিধানসভার অধিবেশনে বলেছিলেন — ‘‘...রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সহজপাঠ একদিন বাতিল হয়েছিলো, সেই সহজপাঠকে আবার ইনক্লুড করবো সিলেবাসে।’’ অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী ‘‘সহজপাঠ’’কে আবার ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। তার আগে রবীন্দ্র সার্ধশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রাথমিক ‘‘সহজপাঠকে আবশ্যিক করার প্রস্তাব দেন শাঁওলি মিত্র। গণশক্তির পাতায় ইতোমধ্যেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে — ‘‘যা ইতিমধ্যেই আছে তাকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়?’’ এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য আমি সংযোজন করতে চাই।

১। ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষক আন্দোলনের নেতা সত্যপ্রিয় রায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম ও ২য় শ্রেণীতে সহজপাঠ ১ম ও ২য় ভাগকে একমাত্র পাঠ্যপুস্তক রূপে প্রবর্তন করেন এবং বিনামূল্যে তা শিশুদের হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা করেন।

২। ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ রায়ের শাসনকালে রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় ১ম ও ২য় ভাগকে সহজপাঠের সঙ্গে অবশ্য পাঠ্যরূপে নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য যে, রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষকেরা শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে যথেষ্ট বলে মনে করছিলেন না।

৩। সিদ্ধার্থ শাসনকালে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম পুনর্গঠনের জন্য একটি সিলেবাস কমিটি গঠিত হলেও তা কখনও বসেনি, কোনও কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি।

৪। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর দলমত নির্বিশেষে সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি রাজ্যের টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সমূহের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে ঐ সিলেবাস কমিটিকে সম্প্রসারিত করা হয়। কমিটির সভাপতি থাকেন বিশ্বভারতীর শিক্ষা-শিক্ষণ বিভাগের প্রধান হিমাংশু বিমল মজুমদার। এই কমিটি অনেক আলোচনা, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে রাজ্যে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষার একটি আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম প্রণয়ন করেন। এই পাঠক্রম অনুযায়ী এক একটি বিশেষজ্ঞ লেখকগোষ্ঠী এক একটি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন এবং সিলেবাস কমিটি অনুমোদন করলে তা প্রকাশিত হয়।

৫। বাংলা সম্পর্কে সিলেবাস কমিটি এই সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেন যে ১ম ও ২য় শ্রেণীর জন্য দুখানি প্রাথমিক ভাষা শিক্ষার বই বা প্রাইমার রচনা করা হবে। রচনার কাজ যখন চলছে তখন ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ কোনও কোনও সংবাদপত্রে গুজব রটনা শুরু হয় যে সহজপাঠবাতিল করা হচ্ছে। পণ্ডিত বিদ্বান সাহিত্যিকদের দিয়ে দি‍নের পর দিন লেখানো হতে থাকে সহজপাঠেরগুণাগুণ আর বামফ্রন্ট সরকারকে গালমন্দ।

৬। এই ধূমজালে আকাশ যখন আচ্ছন্ন তখন সিলেবাস কমিটির বাংলা উপ-সমিতির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শ্রীমতী অনিলা দেবীর এই সম্পর্কিত বক্তব্য যুগান্তরপত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালের ১লা নভেম্বর।

৭। কেন বর্ণপরিচয়ের পরিবর্তে প্রাইমার রচনার সিদ্ধান্ত সিলেবাস কমিটি নিয়েছেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লেখেন — ‘‘শিশুর ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে পিতা পিতামহ বলে যাঁকে নামাঙ্কিত করতে হয় তিনি হচ্ছেন বাঙালীর কাছে চিরস্মরণীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি কেবল বাংলা গদ্যরই জনক নন, বাংলা ভাষা শিক্ষারও জনক। তাঁর রচিত বর্ণপরিচয় বাঙালীর মাতৃদুগ্ধগত ১২০ বছর ধরে ছোট্ট আকারের বর্ণপরিচয় ১ম ও ২য় ভাগ পুস্তক দুখানি ভাষা প্রবেশের সিংহদ্বারের ভূমিকা পালন করে এসেছে।’’

‘‘কিন্তু এই বইতে বিদ্যাসাগর তৎকালে প্রচলিত যুক্তিমূলক পদ্ধতি (Logical Method) অনুসরণ করে বর্ণ ও শব্দ শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। বর্ণের পর বর্ণ যোগ করে শব্দ রচনা এবং শব্দের পর শব্দ যোগ করে বাক্য রচনা পদ্ধতিই অনুসৃত হয়েছে বর্ণপরিচয়ে। বর্ণ থেকে বাক্যে আসার এই রীতি আধুনিক মনস্তত্ত্বমূলক পদ্ধতিতে (Psychological Method) পরিত্যাজ্য। কারণ এই পদ্ধ‍‌তিতে শিশুর আনন্দ, আগ্রহ ও আকর্ষণ উদ্দীপিত হয় না। ফলে শিক্ষণ হয় ব্যাহতশিশুমনের আনন্দময় অভিজ্ঞতা ও আকর্ষণকেই শিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বিবেচনা করা হয় আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতিতে। শিশুমনের ভাবোদ্দীপক চিত্র থেকে বাক্যে এবং সেই বাক্য থেকে শব্দে এবং সেই শব্দ থেকে বর্ণে অবরোহণই মাতৃভাষা শিক্ষার আধুনিক মনস্তত্ত্বসম্মত পদ্ধতি।

রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সহজপাঠের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বাক্য ক্রমিক পদ্ধতি গ্রহণ করেন। কোথাও নিরসতার সামনে শিশুদের হাজির করেননি। সহজপাঠের ১ম ভাগের পাঠে তিনি আজ, ঈশ,’ ইত্যাদির মতো দুর্বোধ্য শব্দ না এনে এনেছেন বনে থাকে বাঘ,’ ‘গাছে থাকে পাখিইত্যাদির মতো শিশুর কল্পনা ও ভাবোদ্দীপক বাক্য সমুদয়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের আধুনিকতা, এখানেই শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথের মনীষা

৮। এই কারণের জন্য সিলেবাস কমিটি বর্ণপরিচয়ের পরিবর্তে দুখানি প্রাইমার রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তাই কিশলয়১ম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ রচিত ও প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালের শিক্ষাবর্ষে। তবে আগে সমস্ত বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার দূর করতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯৮০ সালের ১লা নভেম্বর ঘোষণা করেছিলেন সহজপাঠযেমন পাঠ্য আছে তেমনই থাকবে। সেই সময় থেকে আজ প্রায় ৩০ বছর যাবৎ দুটি বইই প্রাথমিকে পাঠ্য রয়েছে। প্রতি বছর তার লক্ষ লক্ষ কপি ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সমালোচনা আলোচনার ভিত্তিতে কিশলয়কে ক্রমাগত পরিমার্জিত ও উন্নততর করার কাজ অব্যাহত থেকেছে।

৯। সহজপাঠকে কেন একমাত্র পাঠ্য রাখা গেলো না তাও অনিলা দেবী উক্ত প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছিলেন ‘‘সত্যপ্রিয় রায়ের এই মহৎ প্রয়াস সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই একমাত্র পাঠ্যপুস্তক হিসাবে সহজপাঠগৃহীত হয়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথম মনে হয়, সহজপাঠের মধ্যে প্রথম ভাগে শিক্ষার অপরিহার্য কয়েকটি স্তর অনুক্ত রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। সহজপাঠ কবি রচনা করেছিলেন মূলত শান্তিনিকেতনের পাঠের অবলম্বন রূপে।’’ শিশুদের পড়াতে গিয়ে ওখানকার বিদগ্ধ শিক্ষকরাই পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে শিখন পরিস্থিতি সৃজন করে এই অনুক্ত ফাঁকগুলি ভরিয়ে তুলতেন। বর্ণপরিচয়ের সাহায্যও তাঁদের নিতে হতো। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় পশ্চিমবঙ্গের লক্ষাধিক শিক্ষকের পক্ষে শান্তিনিকেতনের বিচক্ষণ শিক্ষকদের কর্তব্য পালন করা সম্ভব নয়। তাই এই প্রাইমার রচনার সিদ্ধান্ত দলমত নির্বিশেষে সকলে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছিলেন।

‘‘সহজপাঠ প্রথম ভাগে বর্ণপরিচিতির পর স্বরচিহ্নগুলির যেমন আ-কার, ই-কার ইত্যাদির সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করান হয়নি। অথচ এই কাজটি উনিশ কুড়িটি অনিবার্য পাঠের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্ব। এগুলির ধ্বনিরূপ ও লিপিরূপ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে তাদের অবস্থান শেখানোর দায়িত্ব প্রধানত শিক্ষকদের উপরে কবি ছেড়ে দিয়েছেন। তাই তিনি বর্ণ‍‌ শিক্ষার পরে প্রথম পাঠ শুরু করেছেন — ‘বনে থাকে বাঘ। গাছে থাকে পাখি। ওরা সব মৌমাছি। তাতে আছে মধুভরা কিংবা বাঁশগাছ করে নাচইত্যাদি বাক্য দিয়ে। এই পাঠের মধ্যে রয়েছে এ-কার, আ-কার, ই-কার, ও-কার, ঔ-কার, চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদির ব্যবহার। পর পর পর্যায় ক্রমিক দীর্ঘ শিক্ষণ ব্যতীত বর্ণপরিচয়ের পরেই শিশুর পক্ষে বিশেষ করে শিক্ষা সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিশুদের পক্ষে এই পাঠগ্রহণ করা সহজসাধ্য নয়।’’ তাছাড়া সহজপাঠের বর্ণপরিচয়ে ড়,ঢ় ইত্যাদি কয়েকটি বর্ণ শেখানো হয়নি। এই সব কথা বিবেচনা করে সহজপাঠের পাশাপাশি দুটি প্রাইমার রচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিলেবাস কমিটি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রজীবনী রচনাকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের উক্তিটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন — ‘‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় শিশুদের ভাষার জগতে প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছে, আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজপাঠ শিশুদের ভাব ও ছন্দের জগতে প্রবেশের অধিকার দিয়েছে।
এই কথা বলতে হলো এই কারণে যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সস্তায় বাজিমাত করতে চাইছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বিবৃতি দিয়ে বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। কিছু ভাড়া করা নেত্রীর অনুগামী বুদ্ধিজীবী সহজপাঠ ফিরিয়ে আনার অদ্ভুত কথা বলে লোককে বোঝাতে চাইছেন তাঁরা ভীষণ রবীন্দ্রভক্ত আর বামফ্রন্ট সরকার যারা তিন দশক ধরে রবীন্দ্র সংস্কৃতি প্রসারে অনলস ভূমিকা পালন করে গেছেন তাঁরা কত রবীন্দ্র-বিরোধী!