ভারতের গ্রামাঞ্চলের জন্য বি পি এল সেন্সাস ২০১১ শুরু হচ্ছে বাছাই করা কয়েকটি রাজ্যে। প্রথম শুরু জুনে, ত্রিপুরায়। প্রতি রাজ্যে গরিবদের সংখ্যা যোজনা কমিশন ইতোমধ্যে নিরূপণ করেছে। যেমন ত্রিপুরায় বি পি এল সেন্সাসের পর গরিবের সংখ্যা যাই দাঁড়াক না কেন, মাত্র ৪৯ শতাংশেই বি পি এল কার্ড দেওয়া হবে। সুতরাং অন্তর্নিহিত গলদ থেকেই যাচ্ছে। যোজনা কমিশন প্রতিটি রাজ্যে গরিবের সংখ্যা (পভার্টি কোটা) ঠিক করছে গলদেভরা হিসাবের উপর নির্ভর করে। পাশাপাশি কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক এবং রাজ্যগুলির গ্রামোন্নয়ন দপ্তরগুলি এ ব্যাপারে তাদের নিজেদের হিসাব তৈরি করেছে। ভারতের মতো যেসব দেশে বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষ বাস করেন, সেখানে গরিব মানুষের সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়টি অনেকসময় গরিবের সংখ্যা কম দেখানো এবং গরিবদের মধ্যে বিভাজন তৈরির অজুহাত হিসাবে খাড়া করা হয়। কারণ নজর থাকে সর্বজনীন অধিকারের বদলে গরিব মানুষকে বিভক্ত করার মতো অমানবিক নীতি রূপায়ণের দিকে। যেহেতু এই বিষয়টি হলো বর্তমান অর্থনৈতিক নীতিগত কাঠামোর অচ্ছেদ্য অঙ্গ তাই এই বি পি এল সেন্সাসের প্রকৃত চেহারা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বি পি এল প্রশ্নমালা
গ্রামাঞ্চলের জন্য বি পি এল সেন্সাসের প্রশ্নমালা এখন পাওয়া যাচ্ছে। তবে শহরাঞ্চলের জন্য বি পি এল প্রশ্নমালা এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। গরিবদের চিহ্নিত করার জন্য গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক এর আগে যে প্রশ্নমালা ব্যবহার করেছিলো সে সম্পর্কে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হওয়ায় ঐ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার সংসদে আশ্বাস দিয়েছিলো।
নতুন প্রশ্নমালার সাহায্যে পাইলট স্ট্যাডিসহ ২৬০টিরও বেশি গ্রামে বিশদ সমীক্ষা চালানো হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল আদৌ সন্তোষজনক নয়। ২০০২ সালের প্রশ্নমালার কয়েকটি অত্যন্ত আপত্তিকর প্রশ্ন বাদ দেওয়া ছাড়া গরিবদের চিহ্নিত করার পদ্ধতি বা ছকটি এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট আপত্তিকর অবস্থাতেই আছে। আগের প্রশ্নমালায় জানতে চাওয়া হতো — দিনে ক’বার খাওয়া হয় বা ক’টি শাড়ি আছে। একবার খাওয়া জুটলে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে একটিমাত্র শাড়ি থাকলে তবেই বি পি এল পর্যায়ভুক্ত হওয়া যেত।
বি পি এল সেন্সাসের ক্ষেত্রে সহজে যাচাই করে বাদ দেওয়ার মতো স্তর নিরূপণ করা বেশ শক্ত। কারণ ভারতের গ্রামাঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য যথেষ্ট প্রকট। সেখানে রয়েছে ধনী, বড় জোতদার-জমিদার ও কৃষক, বড় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। কিন্তু বর্তমান যে মাপকাঠি তার উদ্দেশ্য হলো প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় আরো বেশি মানুষকে বি পি এল তালিকার বাইরে রাখা। শোনা যাচ্ছে, গ্রামীণ জনসংখ্যার মোটামুটি ৩০ শতাংশকে বি পি এল তালিকার বাইরে রাখার ‘লক্ষ্য’ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। পাইলট স্টাডিতেও একই ধরনের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়েছে। বি পি এল তালিকার বাইরে সরকারী কর্মচারী, আয়করদাতা, ট্র্যাকটর মালিক, কিষান ক্রেডিট কার্ডের মালিক (৫০ হাজার টাকার ক্রেডিট)-দের রাখলে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু যাঁর দ্বিচক্র-যান আছে তাঁকে কেন ট্র্যাকটর মালিকদের পর্যায়ভুক্ত করা হবে এবং বি পি এল তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে? যাঁদের ল্যান্ডলাইন টেলিফোন আছে তাঁদের কেন বি পি এল তালিকায় রাখা হবে না? অনেক তফসিলী জাতি/তফসিলী আদিবাসী পরিবার বা দুর্বল সামাজিক পর্যায়ে পড়া প্রতিবন্ধী মানুষজনের টেলিফোন বুথ থাকতে পারে। এদিকে মোবাইল ফোনের প্রচলন বাড়ায় গ্রামাঞ্চলের ঐ বুথগুলি লোকসানে চলছে। আরো শোচনীয় দিক হলো, যে কৃষকের ২.৫ একর সেচসেবিত জমি আছে এবং যাঁর একটি নলকূপ আছে তাঁকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে। যেখানে কৃষকদের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট তারতম্য রয়েছে, যেখানে গরিব কৃষক পরিবারগুলির উপরে বিপুল ঋণের বোঝা, যেখানে প্রকৃতির খামখেয়াল, যেখানে খরা ও বন্যা প্রচণ্ড প্রকোপ সেখানে এইভাবে সরাসরি বি পি এল তালিকার বাইরে রাখার যে প্রক্রিয়া তাতে ভারতের গ্রামাঞ্চলের বিরাট অংশের প্রতি দারুণ অবিচার করা হচ্ছে।
বি পি এল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করার আরেকটি আপত্তিজনক উদাহরণ হাজির করা যেতে পারে। যেমন যদি কোনো পরিবারের সরকারী নিবন্ধীভুক্ত অ-কৃষি ব্যবসা থাকে তা হলে তারা বি পি এল — পর্যায়ভুক্ত হবে না। যেমন আজকাল মহিলাদের পরিচালিত স্বনির্ভরগোষ্ঠীগুলিও সরকারের রেজিস্ট্রিকৃত। তাই অন্যদের মতো এরাও সরাসরি বি পি এল পর্যায়ভুক্ত হবে না।
সরাসরি বাদ পড়ার যে তালিকা তা অযৌক্তিক। তা অবশ্যই সংশোধন করা উচিত। যাই হোক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে ভারতে (যেমন তামিলনাডু) এবং অন্যান্য অনেক দেশে লক্ষ্য করা গেছে যাদের ভরতুকির সুবিধা পাওয়ার দরকার নেই। তাদের সরাসরি বাদ দিলে বি পি এল তালিকা আরো নিখুঁত ও ন্যায্য ধরনের হয়। অধিকন্তু সরাসরি বাদ দেওয়ার মাপকাঠি তখনই অর্থবহ হয়ে উঠবে যখন জনসংখ্যার বাকি অংশ সরাসরি সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চয়তা প্রকল্পের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু বর্তমান বি পি এল সেন্সাসে তা হচ্ছে না।
অন্তর্ভুক্তিকরণ
এবারের বি পি এল সেন্সাসে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হবার ক্ষেত্রে যে ৫টি পয়ন্ট ঠিক করা হয়েছে তা অবিশ্বাস্যমাত্রায় সঙ্কীর্ণ ধরণের। ঐ মাপকাঠি অনুসারে ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার ৫ শতাংশও বি পি এল পর্যায়ভুক্ত হবে না। এই মাপকাঠি অনুযায়ী নিঃস্ব বলে গণ্য হবেন তাঁরা যাঁরা ভিক্ষাজীবী। তাঁরা আপনাআপনি বি পি এল তালিকাভুক্ত হবেন। অপরদিকে যে পরিবারে দু’জন প্রবীণ ব্যক্তি আছেন এবং যাঁরা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মাসে ৪ অথবা ৫দিন কাজ করতে বাধ্য হন সেই পরিবার ‘নিঃস্ব’ বলে গণ্য হবে না। কারণ তাঁরা ভিক্ষা করেন না। আরেকটি সরাসরি অন্তর্ভুক্তিকরণের স্তর হলো ‘আইনগত দিক থেকে মুক্ত হওয়া বেগার শ্রমিকেরা।’ এই শ্রমিকেরা যদি বেগার শ্রমের যাঁতাকল থেকে পালিয়ে যান তাহলে তাঁরা ‘আইনগত দিক থেকে মুক্ত’ বলে গণ্য হবেন না এবং তাঁদের স্বাভাবিক পর্যায়ে বি পি এল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার থাকবে না। সরাসরিভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার (automatic inclusion) আরেকটি স্তর হলো যেসব পরিবার নিরাশ্রয় অথবা যেসব সাফাইকর্মী হাতেনাতে কাজ করেন (manual scavengers) বা আদিম আদিবাসী গোষ্ঠী।
এই পাঁচ পয়েন্টের ভিত্তিতে স্বাভাবিক অন্তর্ভুক্তিকরণ (automatic inclusion category) স্তর ব্যবস্থা আসলে আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই পর্যায়ে আরো কিছু সামাজিক ক্যাটিগরির উল্লেখ করা হয়নি। যেমন, তফসিলী জাতি/তফসিলী আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, বিধবা, ক্যাজুয়াল ম্যানুয়াল শ্রমিক। এঁদের ঐ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
র্যাঙ্কিং
বি পি এল প্রশ্নাবলীতে সবচেয়ে সমস্যার বিষয় হলো এখানে আগের সাতদফা প্রশ্নের জবাবে র্যাঙ্কিং প্রথা জিইয়ে রাখার চেষ্টা। এই সঙ্কীর্ণ ধরনের মাপকাঠির ভিত্তিতে সরাসরি অন্তর্ভুক্তি ঠিক হয় একটি র্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই পদ্ধতিতে গ্রামীণ গরিব মানুষের বিপুল অংশ ‘গরিব’ অথবা ‘গরিব নয়’ এই দুইভাগে চিহ্নিত হবেন। প্রশ্নগুলি বেয়াড়া ধরনের। এগুলির সঙ্গে জনগণের প্রকৃত অবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন ধরুন পাঁচজনের একটি আদিবাসী পরিবারের একজন ষাটোর্ধ্ব মহিলা আছেন যাঁর নাম ধরা যাক মীনা উসেন্ডি। ১৭ বছরের একটি ছেলে আছে। দুই কন্যা পোলিওয় আক্রান্ত। এই সংসারের মালিকানায় আছে আধবিঘা জমি, ঐ জমিতে পরিশ্রম করে ঐ পরিবারকে বেঁচে থাকতে হয়। এই পরিবারকে যদি সাতদফা প্রশ্নোত্তরের গণ্ডি পেরিয়ে বি পি এল কার্ডের জন্য ‘যোগ্য’ অথবা ‘অযোগ্য’ বলে চিহ্নিত হতে হয় তার চেয়ে খেদের বিষয় আর কি হতে পারে?
১ নম্বর প্রশ্ন—‘কাঁচা দেওয়াল ও ছাদের একটি ঘরের বাড়ি।’ আপনার ছোট একটি জমির প্লটের মধ্যে আপনি কাঁচা ছাদের দু’টি ছোটঘর (একটি নয়) নিয়ে যদি একটি বাড়ি বানান তা হলে আপনি পাবেন ‘০’ (শূন্য)।
২ নম্বর প্রশ্ন—যে পরিবারে ১৬ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে কোনো পূর্ণবয়স্ক সদস্য নেই।’ এদিকে আপনার বয়স ৩৫ এবং পূর্ণবয়স্ক। সুতরাং আপনি পাবেন ‘০’।
৩ নম্বর প্রশ্ন—‘পরিবারের কর্তা একজন মহিলা। সেখানে ১৬ থেকে ৫৯ বছর বয়সের কোনো পূর্ণবয়স্ক পুরুষ সদস্য নেই।’’ এদিকে আপনি যদি এখন মহিলা হন এবং একটি পরিবার চালান, যেখানে আপনার বড় ছেলের বয়স ১৭ বছর, তাহলে আপনি এই প্রশ্নের উত্তরে পাবেন ‘০’।
৪ নম্বর প্রশ্ন—‘পরিবারের প্রতিবন্ধী সদস্য আছেন কিন্তু কোনো সক্ষম সদস্য নেই।’ এখন আপনার যদি পোলিওয় প্রতিবন্ধী হওয়া দু’টি শিশু থাকে এবং আপনি যদি সক্ষম পূর্ণবয়স্ক হন, তাহলে আপনি ঐ প্রশ্নের উত্তরে ‘০’ পাবেন।
৫ নম্বর প্রশ্ন—‘তফসিলি জাতি/তফসিলী আদিবাসী পরিবার’। আপনি যদি একজন আদিবাসী হন, তাহলে আপনি ঐ প্রশ্নের উত্তরে পাবেন ‘১’ নম্বর।
৬ নম্বর প্রশ্ন—‘যে পরিবারের ২৫ বছরের বেশি বয়স এমন কোনো পূর্ণবয়স্ক সাক্ষর নেই।’ এখন আপনার বয়স যদি ৩৫ বছর হয় এবং আপনি যদি চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে থাকেন তাহলে আপনি সাক্ষর এবং তাই আপনি ঐ প্রশ্নের উত্তরে পাবেন ‘০’।
৭ নম্বর প্রশ্ন—‘ভূমিহীন পরিবার যাদের আয়ের বেশিরভাগ আসে অস্থায়ী ধরনের কায়িক পরিশ্রমের কাজ থেকে।’ কিন্তু যেহেতু আপনার আধবিঘা শুখা ও অনুৎপাদনশীল জমি আছে, যেখানে আপনি একজন ক্যাজুয়াল মজুর হিসাবে উদয়াস্ত কাজ করলেও আপনি ঐ প্রশ্নের উত্তরে পাবেন ‘০’ (শূন্য)।
সুতরাং এই সাতদফা প্রশ্নাবলীর জবাবে মহিলা পরিচালনাধীন আদিবাসী পরিবার (যে পরিবারকে নির্ভর করতে হয় কায়িক পরিশ্রমের উপরে) পাবে ১।
এইসব তথ্য পঞ্চায়েত অফিসে টাঙানো হবে। গ্রামসভায়ও প্রকাশ্যে জানানো হবে যাতে দাবি বা আপত্তি পেশ করা সম্ভব হয়। যেহেতু মীনা উসেন্ডি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেশ করা হয়েছে তাই তিনি কোনো আপত্তি জানাবেন না।
তাহলে মীনা উসেন্ডি প্রশ্নাবলীর উত্তরে ১ নম্বর পেয়ে কিভাবে বি পি এল কার্ড পাবেন?
আসলে ঐ প্রশ্নমালার ছক এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে গরিবদের মাত্র একটি ক্ষুদ্রাংশ সর্বোচ্চ বা সর্বোচ্চ নম্বরের ধারেকাছে স্কোর করতে পারেন। নয়া উদারনৈতিক নীতিসমূহের প্রবক্তারা রাজনৈতিকভাবে এই ধরনের পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে পারেন। তাঁরা প্রচার করতে পারেন, দেখা যাচ্ছে দেশে প্রকৃত গরিবের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই ধরনের নম্বর দেওয়ার বা র্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মূল সমস্যা হলো এখানে দারিদ্র্যের ধারণা সম্পর্কে এই পদ্ধতিতে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয় এবং অনেক ভাগ গড়ে তোলা হয় গরিব মানুষজনের মধ্যে। অর্থাৎ ‘গরিব’, ‘খুব গরিব’, ‘ভীষণ ভীষণ গরিব’, ‘হতদরিদ্র’ ইত্যাদি নানা বিভাজন তৈরি করে পার্থক্য টানার চেষ্টা। মূল উদ্দেশ্য হলো, জনসংখ্যা একটি ক্ষুদ্র অংশকে ‘হতদরিদ্র’ (extremely poor) বলে চিহ্নিত করে ‘গরিবদের’ বাকি অংশকে ‘তেমন গরিব নয়’ (not so poor) বলে আখ্যা দেওয়া। এইরকম ক্ল্যাসিক পদ্ধতিতে নয়া উদারনীতির প্রবক্তারা ‘দারিদ্র্য’ উধাওয়ের ব্যবস্থা করেন। আপনি এখন আর গরিব নন। কারণ আপনি হতদরিদ্রের (poorest of the poor) মতো গরিব নন।
‘গরিবী রেখা’-র সন্ত্রাস
৭ দফা প্রশ্নের ভিত্তিতে কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়নমন্ত্রক এবং রাজ্যগুলির সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলি কে বা কারা গরিব তা চিহ্নিতকরণের কাজটি করে থাকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কত মানুষ গরিব বলে গণ্য হবেন তা ঠিক হয় যোজনা কমিশনের সন্দেহজনক পদ্ধতি দ্বারা স্থিরীকৃত গরিবের সংখ্যার ভিত্তিতে।
যেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের ঊর্ধ্বসীমা হলো ৪২ শতাংশ। সেই অনুযায়ী ‘কাট-অব স্কোর’ হতে পারে ৪ নম্বর। যারা ৪-এর নিচে নম্বর পাবেন তারা বি পি এল কার্ড পাবেন না। এক একটি রাজ্যের ‘কাট-অব স্কোর’ এক একরকম। যেমন মধ্য প্রদেশে কেউ ৪ নম্বর পেলেও বি পি এল কার্ড পাবেন না। কারণ সেখানে যোজনা কমিশনের ‘ঊর্ধ্বসীমা’ অনুযায়ী ‘কাট-অব স্কোর’ ৫ হতে পারে। সেখানে ৫ থেকে ৭ পর্যন্ত নম্বর তোলা পরিবারের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি। এইভাবে ‘গরিবী রেখা’র সন্ত্রাস নিহিত রয়েছে।
এই পটভূমিকায় আদিবাসী মহিলা মীনা উসেন্ডি মাত্র ১নম্বর পাওয়ায় তাঁর বি পি এল কার্ড পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
‘সঙ্গতিপূর্ণ’ স্ট্র্যাটেজি
খাদ্য নিরাপত্তা বিলের যে চলতি খসড়া জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ (এন এ সি) তৈরি করেছে তার সঙ্গে এই বি পি এল প্রশ্নমালা চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে যায়। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সর্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো একমাত্র ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতির বদলে এন এ সি ৪৬ শতাংশের ‘অগ্রাধিকারমূলক’ কয়েকটি অংশ ভাগ করেছে। যোজনা কমিশনও এই ৪৬ শতাংশ মেনে নিয়েছে। তাছাড়া ভৌগোলিক দিক থেকে বিভাজনেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এন এ সি-র আরেকটি সুপারিশ হলো — ‘সামাজিক দিক থেকে অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে নির্দিষ্টভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল পর্যায়ভুক্ত মানুষদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।’ এর ফলে বি পি এল সেন্সাসের প্রতারণামূলক ‘অটোমেটিক ইনক্লুসন’-র পথ প্রশস্ত হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও এই ধরনের বিভাজনের সুপারিশ আছে। এখানেই শেষ নয়। বিশ্বব্যাঙ্ক সম্প্রতি যে রিপোর্ট (‘সোস্যাল প্রোটেকশন ফর এ চেঞ্জিং ইন্ডিয়া’) পেশ করেছে সেখানেও সর্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থার বিপক্ষেই মত প্রকাশ করা হয়েছে।
বর্তমান বি পি এল সেন্সাসের প্রশ্নমালা তৈরি হয়েছে গরিবদের চিহ্নিত করার মাপকাঠিকে আরো সঙ্কীর্ণ করে তোলার জন্য। যাতে যোজনা কমিশনের দেওয়া পুরোপুরি একতরফা ও চূড়ান্তভাবে অযৌক্তিক গরিবের সংখ্যার সঙ্গে এই সেন্সাসকে খাপ খাওয়ানো যায়। নতুন ছকও গলদে ভর্তি এবং অন্তর্ভুক্তি ও বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আগের লক্ষ্যই বহাল আছে। নম্বর দেওয়া বা র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভারতের গরিবদের কাছে আরো অপমানজনক বলে গণ্য হবে। যেমন আদিবাসী গরিব মহিলা মীনা উসেন্ডি বি পি এল কার্ড থেকে বঞ্চিত হবেন। খুব নিশ্চিতভাবেই বলা যায় গোটা বি পি এল সেন্সাস ব্যবস্থায় গরিবদের কোনো উপকার হবে না। উলটে তাঁরা জাতীয় সম্পদের ন্যায্য ভাগ থেকে আরো বঞ্চিত হবেন।- বৃন্দা কারাত
No comments:
Post a Comment